তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৮

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৮
নীল মণি

_” কি শুরু করেছিস তোরা? শুধুমাত্র একটা মিথ্যের জন্য মানুষদের এভাবে হেনস্থা করবি?
জায়নের কণ্ঠে বজ্রের মতো গর্জন,তার চোখে যেন তপ্ত আগুনের লেলিহান শিখা সেই চোখ দেখে তিয়াশা ভয়ে কেঁপে উঠলেও নিজের মনকে শক্ত করে তোলে। এই চিৎকার সে মেনে নেবে কেন? বুকের ভেতর জমানো ক্ষোভ নিয়ে সেও পাল্টা জবাব ছুঁড়ে দিল,
__” ভালো করেছি , মিথ্যে বলার সময় মনে ছিল না?
কেন গেছিলে মিথ্যে বলে, আমার তো এখন মনে হচ্ছে
তুমিই সবাইকে নিয়ে গেছো ?”
তিয়াশার সাহসী স্বর যেন জায়নের গম্ভীরতায় কাঁটা বিঁধিয়ে দিল, তার চোখে রাগের তীব্রতা আরও গাঢ় হলো, বউ দিন দিন বেড়েই চলেছে , এখন আবার মুখে মুখে তর্ক করছে , তাই সে ও নিজেকে না দমিয়ে বলে ঠোঁট চেপে একেবারে শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,

__” মুখে মুখে তর্ক করিস না জান, আমার একদম পছন্দ না , আর হ্যা আমি নিয়ে গেছি ওদের আবারো
নিয়ে যাব দরকার পড়লে ।”
তিয়াশার চোখে ঝলসে উঠল বিদ্রোহের আগুন। গলার স্বর এখন আর স্রেফ রাগ নয়, তাতে আছে অবহেলার ধারালো ব্যঙ্গ ,তাই তিয়াশা নাক মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলো,
__” ঠিক আছে যাও , আল্লায় তো শুধু তোমায় হাত পা দেয় নি আমকেও দিয়েছে , আমিও যেতে পারি। ”
এবার যেন জায়নের মাথায় আগুন ছড়িয়ে গেল। তার শ্বাস ভারী, চোখের শিরা ,বুক ওঠা নামা করছে রাগের তীব্রতায় স, রাগে তিয়াশার মুখ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো,
__” আমি ছাড়া এক পা বাসা থেকে বের করে দেখাস ,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পা কেটে ঝুলিয়ে রাখবো।”
তিয়াশার বুকের ভেতর রাগ ফেটে পড়ল, চোখ লাল হয়ে উঠল। সে নিজের মুখ থেকে জায়নের হাত সরিয়ে দিল এক ঝটকায়। ঠোঁট কাঁপলেও স্বরে কাঁপন নেই,
__” হ্যা শুধু কথায় কথায় হাত তুলতে পারো। নিজে যেতে পারবে, আমি কেন পারবো না ?
জায়ন এর মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে তার বউ পায়ে তাল দিয়ে ঝগড়া করেই যাচ্ছে। জায়ন এর তিয়াশা এত চিৎকার করছে যে এদিকে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা সবাই জায়ন এক দ্বন্দ্বের একদম হালকা আভাস শুনতে পাচ্ছে তাদের রুম থেকে , কিছু স্পস্ট শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু বুঝতে পারছে কিছু নিয়ে দুজনেই চিৎকার চেচা মেচি হচ্ছে ।এই শুনে রুহেনা বেগম চিন্তিত স্বরে বলে উঠলেন মেহজাবিন বেগম কে ,

__” আপা একবার যাবে ,মনে তো হচ্ছে দুজনের
মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে ।”
মেহজাবীন বেগম রাতের খাবার বাড়তে বাড়তে শান্ত কন্ঠে হালকা হেসে জবাব দিল,
__” তোর ছোট জামাই পাগল , তোর মনে হয় ঝগড়া হলেও বেশিক্ষন টিকবে? যতক্ষন বড় কোন ঝামেলা না হয় আমাদের দূরে থাকাই উচিত ওদের স্বামী স্ত্রীর ব্যাপারে। ”
মেহজাবীন বেগম এর কথায় রুহেনা বেগম ও একটু স্বস্তি পেল, পুনরায় তারা ব্যাস্ত হয়ে গেলো তাদের কাজে।
__” তুই আমার বউ তাই পারবিনা , যেখানে যাবি তোর এই হাজবেন্ড তোকে সঙ্গে নিয়ে যাবে ।”

জায়ন এর কথায় তিয়াশা রেগে মনে মনে ভাবলো এই
লোকটার সঙ্গে এখন কথা বাড়ালে ঝামেলা সৃষ্টি হবে
তাই তিয়াশা জায়ন এর দিকে এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে কিছু না বলে বাইরের চলে যেতে চাইলো কিন্তু জায়ন এর চোখের ভেতর রাগের ঝড় ঘুরছে এর তিয়াশার এই উপেক্ষা পছন্দ হলো না তাই তিয়াশার হাত টেনে কাছে নিয়ে এসে তিয়াশার দিকে র”’ক্ত গলা দৃষ্টি দিয়ে বলে উঠল,

__”আমার কথা এখনো শেষ হয়নি আর কোথায় যাচ্ছিস এই পড়ে? ”
জায়ন এর কথায় তিয়াশা নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে এখনো সেই নাইট ড্রেস পরে আছে ,
তাই এক গভির নিশ্বাস ছেড়ে জায়ন এর দিকে তাকিয়ে গলায় অনিচ্ছার ভার রেখে বলল ,
__” আমি খেয়াল করিনি , আর ছাড়ো আমায়
একদম ছোঁবে না।”
জায়নের ঠোঁটে এক তীব্র তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল তিয়াশার কথা শুনে , তিয়াশাকে নিজের আরো কাছে টেনে এনে তার গলায় মুখ গুজে জবাব দিল,
__” নিজের বউ কে ছুঁতে তোর মনে হয় আমার কারো পারমিশন এর প্রয়োজন ? কি চায়ছিস তোরা ? ইউভি কোমোর ব্যথা নিয়ে উপরে ছাদে মসার কামড় খাচ্ছে, কিন্ত এতবার বলার পরেও সে নিচে নামছে না , নিচে নামলে অনু বাসায় বলবে সে ইউভি কে পছন্দ করে না তোর ওই ভীতু ভাই ভয়ে বসে আছে উপরে।”
জায়ন এত কিছু বলে মাথা নিচু করে এক গভির শ্বাস
ফেলে আবার বলে উঠলো,

__” নাজিম এর অবস্থা দেখে আয় বৃষ্টি কি করেছে ।
আর তোর বান্ধবী কে জিজ্ঞেস কর আকাশ কোথায় ?
আকাশ ফোন ধরছে না ফুফি চিন্তা করছে ।”
তিয়াশা মুখ ঘুরিয়ে ছিল কিন্তু ফুপির কথা বলতেই
তিয়াশার চোখ একটু নরম হলেও গলায় কণ্ঠস্বর ঠান্ডা, তাই তিয়াশা গম্ভির স্বরে বলে উঠল,
__” ফোন করতে হবে না, ভাইয়া লেক পার্কে আছে ।”
জায়ন অবাক হয়ে তিয়াশার গলা থেকে মুখ সরিয়ে তিয়াশার ওই ডাগর ডাগর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, তার মানে তার বউ আর বাকি সবাই ও যানে কে কি কার সঙ্গে করবে ?এইসব বুলশিট ফাকিং মাইন্ড আসে কোথা দিয়ে ? ,
কিন্তু জায়ন এর আপাতত কাজ হলো আকাশ কে খুজতে যাওয়া, জায়নের বুকের ভেতর হিম আর আগুন দুটোই বইয়ে দিল, চোখ সরু করে বলে উঠল ,

__”আমি খুজতে যাচ্ছি আকাশ কে , কিন্তু তার আগে
একটা কথা ক্লিয়ারলি বলে দিয়ে যাচ্ছি , এই ড্রেস চেঞ্জ করে যেন ডিনার করে আসা হয় আর আমি যেন বাসায় ফিরে দেখি ভদ্র ভাবে এই ঘরেই বসে আছিস , তারপর দেখাবো এই সব ফাকিং প্লানিং
এর জন্য আমি কতটা হার্ড হতে পারি ।”
তিয়াশা যেন কেঁপে উঠল যা তার চোখে স্পষ্ট, সে বুঝতে পারছে জায়ন এর কথার মানে । এদিকে জায়ন
তিয়াশাকে ছেড়ে বেড সাইড টেবিল থেকে বাইকের চাবিটা উঠিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
__” নিজের লোভ দেখিয়ে ডেকে এনে আমাকে ঝাল খাওয়ানোর আসল ঝাল আজ ফেস করবি , আগের দিন তো কিছুই ছিল না আজকে দেখাবো।”

এই বলে জায়ন বেড়িয়ে গেল কিন্তু তিয়াশার ডাগর ডাগর চোখ আর বড় বড় হয়ে উঠলো কাপতে কাপতে নিঃশব্দে বিছানায় বসেই পড়ল । তিয়াশার হাত-পা হালকা কাঁপতে লাগল, বুকের ভেতর অদৃশ্য শীতলতা ছড়িয়ে পড়ল। জায়নের ছায়া যেন ঘরের আলো ঢেকে দিল।
এদিকে বাসার কর্তারা তখন রাতের খাবার খাচ্ছেন ডাইনিং টেবিলে বসে , গিন্নির তাদের খাবার পরিবেশন করছেন, এদিকে তাদের সবার নজর গেল নিচে
নামতে থাকা জায়ন এর ভয়ংকর চোখের দিকে ।
জায়ন ও জানে প্রশ্নের স্বীকার হবে তাই আগেই তার ফুপির উদ্যেশ্যে বলে উঠল,

__” আকাশের বাইক খারাপ হয়ে গেছে ফুপি , তাই
আমি নিতে যাচ্ছি।”
জায়ন সদর দরজার কাছে যেতেই ড্রয়িং রুমের সবার কানে ভেসে আসলো খুব গম্ভীর কন্ঠস্বর,
__” বৃষ্টি আর একটু শুনে যা তো।”
এই কন্ঠ শুনতেই বৃষ্টি আর অনুর গলায় কাঁটা গেঁথে গেল, বুকের ভেতর অকারণ শ্বাসরুদ্ধ অনুভূতি, পা যেন ভারী হয়ে গেল , এরমধ্যেই সুরাইয়া বেগম বলে
উঠলেন,

__” কি রে শুনিস না তোরা জায়ন ডাকছে তোদের ।”
সুরাইয়া বেগম এর কথা শুনে বৃষ্টি আর অনু দুজনেই
পা বাড়ালো সদর দরজার দিকে, দুজনে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো জায়নের সামনে এসে তারা দুজনেই মাথা নিচু করে আছে, জায়ন নিজের রাগ একটু নিয়ন্ত্রণ করে বরফশীতল কণ্ঠে বলল
__” অনু এখন ই ইউভি কে উপর থেকে আসার অনুমতি না দিস আমি নিজেই বাসায় বলে দেব তোর
ইউভি কে পছন্দ না ,”
তারপর একটু থেমে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,

__” নিচে বসে না থেকে নিজের স্বামী কে যে অসুস্থ
করেছিস , সুস্থ ও তুই করবি নইলে খুব খারাপ হয়ে
যাবে । আই এম ক্লিয়ার ?”
অনু আর বৃষ্টি দুজনে নিঃশ্বাস আটকে মৃদু স্বরে মাথা নিচু করে বলল,
__” জী ভাইয়া ।”

এদিকে ড্রয়িং রুমে আর ডাইনিং টেবিল জুড়ে এক অদ্ভুত চাপা নীরবতা নেমে এসেছে। কেউ কিছু স্পষ্ট বুঝতে পারছে না, কিন্তু সবাই টের পাচ্ছে ঘরের ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি ঘুরপাক খাচ্ছে, যেন বাতাসও একটু ঘন হয়ে গেছে। জায়নের গম্ভীর চেহারা, চোখে সেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি, আর ঠোঁটে কোনো উত্তর না থাকার অদ্ভুত অভ্যাস সবাই জানে, এই মানুষকে বেশি প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যাবে না, বরং সেই প্রশ্নই বিপদ ডেকে আনবে।
তাই জায়ন বাইরে পা বাড়াতেই, প্রান্তিক সাহেব ভাতের প্লেটে হাত রেখেই ডাইনিং টেবিল থেকে চোখ সরু করে বৃষ্টি আর অনুর দিকে তাকিয়ে হালকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলেন,

__”তোদের কানে কি ফিসফিস করে গেলো রে তোদের বেপরোয়া বড় ভাই?”
কথাটা এতটা হালকা করে বলা হলেও ভেতরে লুকানো ছিল কৌতূহল আর সামান্য বিদ্রূপের মিশ্রণ। মুহূর্তের মধ্যে বৃষ্টি আর অনুর গলা শুকিয়ে এল, বুকের ভেতর ধকধক শব্দ যেন আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তারা একে অপরের দিকে তাকালো, চোখে ভয়ের ছায়া গাঢ় হয়ে উঠল, যেন ভুল একটা শব্দ বললেই আগুন জ্বলে উঠবে।
বৃষ্টি ঠোঁট ভিজিয়ে, গলায় অনিচ্ছার ভার নিয়ে একটু সাহস জোগাল। তবু কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে হালকা হাসি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,

__”আ আসলে বড় আব্বু ভাইয়া বলল আমাদের আগামীকাল রেডি থাকতে কোথায় নিয়ে যাবে তাই।”
তার গলায় ছিল একধরনের অস্বস্তি যেন নিজের কথাই বিশ্বাসযোগ্য শোনাতে পারছে না। চোখের মণি নিচের দিকে নামিয়ে রেখেছে, প্রান্তিক সাহেবের চোখে চোখ রাখার সাহস নেই। এদিকে তাহসান সাহেব খেতে খেতেই মুখ এমন করে রেখেছে যেন সে জানে এই দুটো তেই মিথ্যে বলছে।
প্রান্তিক সাহেব খাওয়ার মাঝেই থেমে এক মুহূর্ত ওদের দিকে তাকালেন, তারপর আবার হাত চালাতে চালাতে গম্ভীর গলায় বললেন,

__”আচ্ছা, যেও তবে। এখন যাও, ইউভি আর আমার বৌমাকে ডেকে আনো নিচে , মেয়ে টাকে পুরো ঘর বন্দী করে রেখেছে বেয়াদব ঘাড় ত্যাড়া ছেলে জন্ম দিয়েছি একটা, আর বড় জামাইয়ের জন্য যেই খাবার ভালো মনে হয় খাইয়ে দাও গিয়ে ।”
বৃষ্টির মাথা নিচু রেখেই সে আস্তে জবাব দিল, ঠোঁটের কোণে জোর করে একটুকরো শান্ত ভাব আনতে চেষ্টা করে,
__”জী বড় আব্বু এক্ষুনি যাচ্ছি।”
আর কিছু না বলে না তাকিয়ে দুজনেই পা বাড়িয়ে দিল সিঁড়ির দিকে ।

লেকের নরম আলোয় একপাশের সেডের নিচে বসে আকাশ যেন পাগলপ্রায় হয়ে আছে। ভেজা শরীরে যেন তার হাত থেমে থেমে নয় বরং অবিরাম চুলকাচ্ছে, যেন চামড়ার নিচ দিয়ে অজানা আগুন ছুটে যাচ্ছে। লেকের ঠান্ডা পানিতে নামাটা যেন পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে দিল জ্বালা আর চুলকানির তীব্রতা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
মনে মনে নিজেকেই তীব্র গালাগালি দিচ্ছে,
“কেন রে আকাশ, তুই ওই জলপরীর জালে পা দিলি? কী দরকার ছিল এত বোকামির, শা* সুন্দর তো মজা নিচ্ছিলিস রিসর্ট এ?”
প্রতিটা চুলকানির ধাক্কায় যেন নিজের উপর রাগ আরও বাড়ছে, কিন্তু শরীরের অবস্থা এমন যে সেই রাগ ঝাড়ার মতো শক্তি নেই।
পকেটের ভেতর ফোন আছে, কিন্তু হাত কাঁপছে এতটাই যে ফোন বের করার ক্ষমতাই নেই। ত্বক লালচে হয়ে জ্বলে উঠেছে, ঘাম আর পানির মিশ্রণে ত্বক যেন এক অদ্ভুত জ্বালা তৈরি করছে।
হঠাৎ সামনে চোখ গেল দেখতেই দেখল জায়ন আর জেমস এগিয়ে আসছে। এই দৃশ্য দেখে বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক স্বস্তি ঢেউ খেলল, চোখে পানি চলে এল। আর দেরি না করে গলা ছেড়ে চিৎকার করে উঠল,

__”বড় ভাই, বাঁচাও আমায়”
জায়ন কাছে আসতেই এক ঝলকেই পরিস্থিতি বুঝে নিল। আকাশের ভেজা অবস্থা, পাগলের মতো চুলকানি সব মিলিয়ে তার ঠোঁটের কোণে একটুখানি বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। মনের ভেতরে ভাবল,
জায়ন সামনে আসতেই আকাশ দেখে মনে মনে একটু হেসেই ফেলল , মনে মনে ভাবছে কি অবস্থা করেছে ছেলে টার, সারা শরীর ভেজা আকাশের আর তাকে এরকম ভাবে চুলকাতে দেখে একটু বুঝতে পেরে
মুখে কেবল মৃদু কৌতুকের সুরে বলল,
__”তো তোর উপর কোন ফর্মুলা প্রয়োগ করেছে?”

আকাশের মাথা তখন ঘুরছে, ব্যথা আর চুলকানির মাঝে মস্তিষ্কে যেন কিছুই ঠিকমতো ঢুকছে না। তাই হাপাতে হাপাতে বলল,
__”ভাই, আমার মাথায় কিছুই যাচ্ছে না তুমি প্লিজ এখান থেকে নিয়ে আমায় কোনো মেডিসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করো।”
জায়ন আর কথা না বাড়িয়ে এক হাত দিয়ে আকাশকে ধরে নিজের বাইকে বসিয়ে নিল। জেমস আকাশের বাইকে চেপে পেছন পেছন রওনা দিল। রাস্তায় যেতে যেতে একটা ফার্মেসি দেখে জায়ন বাইক থামিয়ে ভিতরে ঢুকল, হাতের তাড়াহুড়োয় মেডিসিন কিনে এনে সঙ্গে সঙ্গেই আকাশকে খাইয়ে দিল, যেন অন্তত সামান্য স্বস্তি পায় সে।
এরপর হঠাৎ চোখে পড়তেই পাশের একটি গ্যাজেট শপে ঢুকে গেল জায়ন। আকাশ আর জেমস দুজনেই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। প্রায় ১৫, ২০মিনিট পর সে বেরিয়ে এল কিছু জিনিস নিয়ে, যেগুলো শপ কিপার লাজুক এক হাসি দিয়ে প্যাকেট করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে।
জেমস এগিয়ে গিয়ে প্যাকেটটা নিতে চাইলো, কিন্তু জায়ন হাত সরিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে বলল,

__”ইটস পার্সোনাল।”
তার ঠোঁটে তখনও সেই রহস্যময় হাসি, যেন সে একাই জানে এই জিনিসগুলোর আসল উদ্দেশ্য…
ঢাকা শহরের সকালটা যেন এক অনবরত চলমান ক্যানভাস যেখানে আলো, শব্দ আর গন্ধ মিলেমিশে এক বিশেষ দৃশ্য আঁকে।ভোরের কুয়াশা এখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি, তাই দূরের বিল্ডিংগুলো আধো আধো দেখা যায়।দূরের আজানের সুর আর পাখির ডাক একসঙ্গে মিশে শহরের নিজস্ব সঙ্গীত তৈরি করছে।
সূর্যের নরম, সোনালি আলো থাই গ্লাস ভেদ করে এসে যেন আলতো করে তিয়াশার ত্বক ছুঁয়ে গেল। ঘুম ভাঙার সেই কোমল মুহূর্তে তার চোখ ধীরে ধীরে মেলে উঠল। অলস ভঙ্গিতে কনফোর্টর সরিয়ে বসে
পড়ল, এক লম্বা হাই ছেড়ে তাকিয়ে দেখতে পেল নিজের পরিচিত ঘরের নীরবতা আর সকালের শান্ত আবহ।
কিন্তু পরক্ষণেই গত রাতের দৃশ্যগুলো যেন হঠাৎ করেই মাথায় ঝড় তুলল। মুহূর্তেই শরীরের ভেতর এক শীতল স্রোত বয়ে গেল, আঙুলের ডগা পর্যন্ত ঠাণ্ডা হয়ে উঠল। গত রাতে, জায়নের ভয়ংকর মেজাজ টের পেয়েই, সে ঠিক করেছিল সামনে না গিয়ে নিজ রুমেই নিজেকে আটকে রাখবে , তাই জায়ন আসার আগেই দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিল, যদি এভাবে ঝড়কে এড়িয়ে যাওয়া যায়।
কিন্তু ঝড় থেমে থাকেনি। জায়ন বহুবার দরজা ধাক্কিয়ে, চিৎকার করে, ধমকি দিয়ে গিয়েছিল,

__”রোদ, দরজা খোল নইলে সামনে একবার পেলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।”
প্রতিটি শব্দে ছিল দমদার রাগ আর হুমকি, কিন্তু তিয়াশা এক বিন্দুও নড়েনি। সে জানত, যদি মুখোমুখি হয়, তবে কাল রাতেই সেই রাগ ঝড়ের মতো নেমে আসত তার উপর।বদমাইস লোক হাত বাঁধা অবস্থায় প্রমিজ করেছিল কিছু করবে না আর হাত খোলামাত্রই শুরু হয়ে গিয়েছিল বকা, ঝাঁঝালো কথা আর অনবরত ধমকি। তিয়াশা বুঝেছিল তার রাগ শান্ত
করা ওই মুহূর্তে অসম্ভব হয়ে যেত , আজ যে করেই হোক জামাই এর রাগ ভাঙাতে হবে নইলে কপালে ভীষন দুঃখ আছে।

তিয়াশা বেডসাইড টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে তুলে স্ক্রিন অন করতেই চোখ বড় হয়ে গেল ৩২টা মিস কল, ৪০টা মেসেজ, আর সবকটিই হুমকির সুরে লেখা। গত রাতে জায়নের এই নিরন্তর কল আর মেসেজের তাড়নায় সে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল, যেন নিজের ভেতরের অস্থিরতায় আরও আগুন না লাগে।
এই মুহূর্তে তিয়াশার মনে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি
ভয়, রাগ, আর কিছুটা বরের অভিমান ও সব একসাথে জমে আছে, কিন্তু সাথে আছে পরিকল্পনার সূক্ষ্ম নীরবতা, কিভাবে আজ সেই ঘাড় ত্যাড়া স্বামীকে সামলাবে।
আজ চৌধুরী পরিবারে সকালটা যেন অন্য রকম উজ্জ্বল। চারপাশে ব্যস্ততা, মুখে মুখে হাসির ঝিলিক, আর সবার মধ্যে এক ধরনের আনন্দের হালকা কম্পনকারণ আজ আকাশ আর আরোহীর নতুন পথচলার পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিন।

কিন্তু আকাশ সে তো এই বাসাতেই নেই থাকবেই বা কীভাবে? আগের রাতেই জায়ন তাকে তার নিজের বাসায় পৌঁছে দিয়ে এসেছে, সঙ্গে রেখে এসেছে জেমস কেও।
তাদের বাসায় ছাড়ার আগে জায়ন এক ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে তাদের হাতে রাতের খাবার ও ধরিয়ে দিয়েছিল , আকাশ কে রাতে বাসায় নিয়ে আসলে হয়তো অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো তাই শুধু জায়ন একাই বাসায় এসেছিল।
তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী জায়ন একাই ফিরেছিল বাড়িতে। এসে অবশ্য ফুপি মা ও চাচীকে আশ্বস্ত করে বলেছিল,
__”আকাশ সকালে চলে আসবে, ওর জরুরি দরকারে বাসায় যেতে হয়েছে।”
কথাটা এমনভাবে বলেছিল যে কারো সন্দেহ হয়নি, যেন সবটাই স্বাভাবিক।

রুহেনা বেগমের মুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট চোখে মুখে মাতৃত্বের সেই চিরচেনা দুশ্চিন্তা, আর গলায় এমন স্নেহমাখা উদ্বেগ, যা শুনলেই বোঝা যায় তিনি রাতভর মন খারাপ করে কাটিয়েছেন।
__” জামাই এখন কেমন আছে রে বৃষ্টি? কি যে হলো কাল সন্ধ্যার পর থেকে , ওদিকে ওই দুইজনের রুম থেকে সারা রাত চেঁচামেচি আবার তোর ভাইয়া বাথরুমে পরে গিয়ে কোমরে চোট পেল, কি যে হচ্ছে আল্লাহ তা’আলা জানে।”
বলতে বলতেই যেন নিজের ভেতরকার অস্থিরতার ওজনটা আরও বাড়িয়ে ফেললেন। ইউভির রুম থেকে ইউভি কে কোমরে রসুন তেল মালিশ শেষ করেই যেন ছুটে এসেছেন বৃষ্টির রুমে হাসিমুখে নয়, বরং কী হলো, কেমন আছে ?এই অস্থির ভাব নিয়ে।
বৃষ্টি একটু শান্ত স্বরে উত্তর দিল, যদিও গলায় ছিল একটুখানি মিথ্যের ঝলকানি,

__” হ্যাঁ আম্মু, এখন তোমার জামাই ঠিক আছে। রাতে মেডিসিন দিয়ে ছিলাম। আর বনু আর জায়ন ভাইয়ের কথা বাদ দাও, ভাইয়া কেমন আছে এখন? এখনো কি খুব ব্যথা?”
এদিকে বিছানায় শুয়ে থাকা নাজিম যেন নিজের কষ্টের মাঝেও নাটকীয়ভাবে বিড়বিড় করে উঠল,
__” ঢং করে ঢং ‘হ্যা আম্মু, তোমার জামাই ঠিক আছে’ শা** বউ তো না, যেন ডেঙ্গুর মশা পুরো অসুস্থ করে দিল।”
মুখে বিরক্তির ছাপ থাকলেও তার ভেতরে লুকানো হাস্যরসটা স্পষ্ট যেন কষ্টটাকেও কৌতুকে মুড়ে ফেলছে।
রুহেনা বেগম নাজিমের মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

__” কি বিড়বিড় করছো বাবা?”
নাজিম হকচকিয়ে গেল যেন হাতেনাতে ধরা পড়া দুষ্টু ছেলের মতো। সাথে সাথেই নিজের ভাবনায় পানি ঢেলে, গলায় মিষ্টি ব্যঙ্গ মিশিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল,
__” না না আম্মু, আসলে আপনার মেয়ে এত যত্ন করেছে আমায় যে আমি একদম সুস্থ হয়ে গেছি।”
কিন্তু এই ব্যাঙ্গ করাটা রুহেনা বেগম না বুঝলেও বৃষ্টি ঠিক বুঝেছে , নাজিম কথাটা মুখে বললেও চোখে মুখে একধরনের রাগ, আর সেই রাগটা সঙ্গে সঙ্গেই ধরে ফেলল বৃষ্টি। সে এমন এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিল যেন __‘এখনি তোমায় জীবন্ত গিলে ফেলব।’ কিন্তু এই নীরব চোখাচোখির খেলাটা রুহেনা বেগমের চোখ এড়িয়ে গেল।
তিনি হাসিমুখে নাজিম কে দেখে বললেন,

__” হ্যা বাবা, তুমি সুস্থ হয়ে গেছো এই অনেক। তোমার জন্য হালকা পাতলা জ্যান্ত মাছ আর কাঁচকলা দিয়ে তরকারি রান্না করছে তোমার বড় আম্মু। কিছু উল্টো পাল্টা আর খেয়ো না কিন্তু।”
মুহূর্তটা যেন হাসি ঠাট্টা আর মমতার এক মিশ্রণ
যেখানে রুহেনা বেগমের মাতৃত্ব, বৃষ্টির তীক্ষ্ণ চোখ, আর নাজিমের অদ্ভুত রসিকতা মিলেমিশে ঘরের ভেতর এক হালকা, মজার আবহ তৈরি করল। কয়েকটা কথা, কয়েকটা দৃষ্টি বিনিময় তবুও যেন পুরো সকালটাই গল্পে ভরে গেল।

সারা রাত জায়নের চোখে এক বিন্দুও ঘুম নামেনি কারণ তার দুষ্টু, একগুঁয়ে বউ। তিয়াশা আলাদা রুমে থাকায় জায়ন যেন ক্ষুধার্ত বাঘের মতো দরজার সামনে বারবার ঘুরে ঝামেলা করেছে, ধমক, রাগ, হুমকি সবই চলেছে, তবুও লাভের লাভ কিছুই হয়নি। শেষমেশ হাল ছেড়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমে এসে ধপ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে, আর মনে মনে কসম খায় এভাবে আর চলবে না।

সময় প্রায় ১০ টা বেজে ১৫ , সকাল হলে ও সেই রাগ এখনও তার মুখে লেগে আছে চোখ মুখ গম্ভীর, ঠোঁট চেপে রাখা, একদম যেন ‘এখন কিছু বললেই বিস্ফোরণ ঘটবে’ এমন অবস্থা। আগামীকাল ঢাকা ব্রাঞ্চের অফিসের ওপেনিং, তাই জায়ন গম্ভীর মন নিয়ে রেডি হয়ে ল্যাপটপে বসে আছে, যুক্তরাষ্ট্রের অফিস স্টাফদের সঙ্গে অনলাইন মিটিং চলছে প্রায় তিরিশ মিনিট ধরে। গলায় সেই প্রফেশনাল দৃঢ়তা, চোখে অন্যমনস্ক ভাব।
__”মিস্টার অ্যান্থনি ইফ ইউ ডান টু সেটেল আওয়ার নেক্সট লঞ্চিং দেন ইউ ক্যান সেন্ড ইট জুলি, শি উইল
হ্যান্ডেল ।”
জায়নের স্বাভাবিক কিন্তু কর্তৃত্বময় কণ্ঠে কথাটা ঝরে পড়তেই স্ক্রিনে থাকা বিদেশি পুরুষ ভদ্রলোক ভদ্রভাবে উত্তর দিলেন,

“Sir, I already send it to Miss Julie.”
সঙ্গে সঙ্গেই সেই বিদেশি সুন্দরী রমনী জুলি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
__”Yes Sir, he already done his work. I will send you the data.”
প্রায় পাঁচ ছয় মিনিট পর মিটিং শেষের দিকে গিয়ে যখন সবাই একে একে বেরিয়ে গেল, হঠাৎ জুলির কণ্ঠে একটুখানি কৌতূহল,
__”Sir, I heard from James you are married now. So, who is the lucky girl?”
জায়নের চেহারায় মুহূর্তেই বিরক্তির ছাপ পড়ল চোখ একটু সরু হয়ে গেল, ঠোঁট টাইট হয়ে গেল, যেন বোঝাচ্ছে এই প্রশ্ন মোটেও তার ভালো লাগেনি। গম্ভীর গলায়, একদম প্রফেশনাল টোনে উত্তর দিল,
__”মিস জুলি আই থিঙ্ক ইটস আওয়ার অফিস মিটিং
সো লিভ ইওর কিউরিসিটি ওহেন ইউ এন্টার ইন অফিস, এন্ড ফর ইওর ইনফর্মেশন ইয়েস আই এম হাপিলী ম্যারেড নাউ। ”

ঠিক তখনই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল তিয়াশা। তার চোখ এক নিমেষে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলে গেল আর সেখানে যে ছবিটা দেখা গেল, সেটি যেন তার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল। সেই সুন্দরী Julie কে দেখে তিয়াশার ঈর্ষা এমনভাবে উথলে উঠল যে, ফর্সা মুখ মুহূর্তে রাগে টকটকে লাল হয়ে উঠল। তার চোখে এমন ধারালো দৃষ্টি যেন এখনই স্ক্রিন ভেদ করে ভেতরে ঢুকে সেই মেয়েটাকে চুল ধরে টেনে বের করবে।
ঘরের বাতাস যেন মুহূর্তেই বদলে গেল জায়নের একপাশে অদৃশ্য বিরক্তি কিন্তু আর চোঁখে বউ এর মুখ দেখে বুঝতেই পারছে তার বউ রেগে গেছে । কিন্তু সে নিজেও রেগে আছে তাই ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে
উঠল ,

__” ওকে মিস আই হ্যাভ টু গো নাউ, উই ক্যান ডিসকাস লেটার ফর নেক্সট থিং।”
তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করার শব্দটা যেন ঘরে হালকা কিন্তু তীক্ষ্ণ এক কম্পন ছড়িয়ে দিল।জায়নের চোখ যখন তিয়াশার দিকে পরতেই মুহূর্তেই তার চোখে বিস্ময়ের ঢেউ আছড়ে পড়ল, চোঁখ উঠে গেলো কপালে ,রানি রঙের শাড়িতে কোমল ফর্সা গায়ে ,সবুজ চুড়ির মৃদু ঝংকারে, যেন তার বউ আজ সকালে আকাশের রঙ মেখে নেমে এসেছে।
মুহূর্তের মধ্যে গত রাতের রাগ গলে পানি হয়ে কোথাও হারিয়ে গেল, মনে শুধু একটাই কথা,

“আমার বউ, একেবারে প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর , শা** রাগের আল্লাহহাফিজ করে দিচ্ছে।”
কিন্তু এদিকে তিয়াশার মুখে গুমোট রাগের ছায়া রাগে রাগে পা বাড়ালো ড্রেসিং টেবিল এর দিকে , ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়ানো কারন তিয়াশার বেশির ভাগ জিনিস ই এখন তাদের মানে জায়ন এর রুমে। এক হাত দিয়ে কাজল লাগাচ্ছে, আর পিঠের গভীর খোলা ব্লাউজে যেন অজান্তেই স্বামীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিয়ে দিচ্ছে, ঘোর লেগে যাচ্ছে জায়ন এর চোঁখে , গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ।তার সেই লম্বা, আলগা খোপা করা চুলগুলো ঘাড়ের পাশ দিয়ে নরমভাবে নেমে এসেছে, আর খোলা পিঠের নিঃশ্বাস কাঁপানো দৃশ্যটা দেখে মনে মনে বলল,এই বউ চায় কি ? জায়ন তৃষ্ণায় মরে যাক , কিন্তু হঠাৎ ই তার মনে প্রশ্ন জেগে উঠলো ,

__” বউ এই মার্ডারিয়াস লুক নিয়ে যাচ্ছে কোথায়?”
ভাবতেই বুকের ভেতর অকারণ আগুন জ্বলে উঠল।
কোনও কিছু না ভেবে উঠে দাঁড়াল, পায়ের শব্দে মেঝে কেঁপে উঠল, চোখে অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে সোজা তিয়াশার সামনে গিয়ে দাঁড়াল , গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
__”মরার পাখনা গজিয়েছে নাকি?”
জায়ন এর হঠাৎ এই প্রশ্নে তিয়াশা ভ্রু কুঁচকে দুই হাত কোমরে রাখল, ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের রেখা ফুটে উঠল।দাঁতে দাঁত চেপে, চোখে অবজ্ঞার ঝিলিক ছড়িয়ে বলল,
__””আমি মরব কেন? আমি মরলে আরেকটা বিয়ে করতে পারো তাই না?”
জায়নের চোখে অবিশ্বাস আর বিরক্তি একসাথে ছায়া ফেলল। মনে মনে ভাবল
__”আমার বউ মাঝে মাঝে সত্যিই পাগল হয়ে যায়”
এরপর জায়ন রূঢ়, কিন্তু অদ্ভুত এক স্নেহমাখা স্বরে বলে উঠল,

__” মনে তো হচ্ছে । এই পিঠ খোলা ব্লাউজ পড়ার সাহস কোথা থেকে পেলি ? আর আমি এক বিয়ে করেই বউ ঝাল খাইয়ে মারতে চায় দুই বিয়ে করলে আমার বাচ্চা বউ আমায় জ্যান্ত কবর দেবে ।”
তিয়াশার মনে মনে একটু হাসি পেল কিন্তু এই ঘাড় ত্যাড়া বেডার সামনে মুখে সেই অনুভূতি ফুটিয়ে তুলল না। চোখের দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ করে, হালকা গলা নামিয়ে বলল,
__ ” সাহস এর কি আছে ? আর তুমি যে জেনে গেছো তোমার বউ কি করতে পারে , তাহলে ভেবে চিন্তে কাজ করবে ।”
জায়ন এই কথার মধ্যে আসল কথাই জানতে পাড়ছে না যে তার বউ এই লুক নিয়ে কোথায় যাচ্ছে , তাই সব কিছু বাদ দিয়ে বলল ,

__” এই ভাবে রেডী হয়ে কোথায় যাচ্ছিস?,”
এবার তিয়াশা তার বর কে বাগে পেয়েছে ভেবে কৌশলে জিজ্ঞেস করে উঠল,
__” বলতাসি, তার আগে আপনি বলেন একটু আগে একজনের সঙ্গে ইংলিশে কথা বলছিলে উনি কে জান?”
‘জান ‘ শব্দ শুনতেই যেন জায়ন এর জান থেকে জান বেরিয়ে গেল ,এই শব্দ কানে পৌঁছাতেই যেন বুকের ভেতর বজ্রপাত হলো,হঠাৎ তার বউ এই ভাবে জান বলছে ?মতলব ভালো লাগছে না , হঠাৎ জায়ন ভ্রূ কুচকে বলে উঠলো,
__” জান বলছিস তোর ভাব ভালো লাগছে না।,”
তিয়াশা এবার নাটকীয়ভাবে মাথা নিচু করল, মুখের ভঙ্গিতে যেন ভেতরের দুঃখের এক পাহাড়।
চোখের পাতা ভারী করে ধীরস্বরে বলল,

__” বলো না কে ছিল?”
এবার জায়ন ও বুঝতে পারছে তার বউ কি শোনার জন্য এত নাটক করছে, ভাবল বউ এর সঙ্গে একটু মজা করা যাক কিন্তু সেদিনের কথা মনে পরতেই ভাবল আবার যদি রুদ্রমুখি রূপ ধারণ করে তাহলে সামলানো অসম্ভব ,তবুও গত রাতের রাগের বদলা নিতে বলেই ফেলল,ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে এনে, সেই হাসির আড়ালে দুষ্টুমি মিশিয়ে উত্তর দিল
__” বিদেশের গার্লফ্রেন্ড ছিল।”
এই কথা টা শুনতেই তিয়াশার ভিতরে আগ্নেয়গিরি তৈরি হতে লাগল , যেন এখনি সব শেষ করে দেবে ,
কিন্তু হঠাৎ কি যেন মনে করতেই ভাবলো তার এই ঘাড় ত্যাড়া বাঘের বাচ্চা তাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়ের কথা ভাবেই না ।
তাই নিজেও একটু মজা করতে করতে জায়ন এর পাস কাটিয়ে কাভার্ড থেকে একটা পার্স বের করে বলল,

__” ওহ ভালো ওকে বর যাই তাহলে , ভালো থাকবেন।”
হঠাৎ জায়নের বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্যতা জমে গেল।হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল,
“এই বউ একটুও জেলাস হচ্ছে না? আমায় ইগনোর করছে নাকি?”রাগে শরীরের পেশি টান টান হয়ে গেল।
এক লাফে হাত বাড়িয়ে তিয়াশাকে টেনে আনল নিজের কাছে।তিয়াশার উন্মুক্ত কোমর শক্ত করে টেনে তিয়াশাকে নিজের বুকে চেপে ধরল।
কণ্ঠে কড়া ও কঠিন স্বর ,
__” মানে কি ? কোথায় যাচ্ছিস এই পড়ে ?”
তিয়াশা মুখ ঘুরিয়ে নিল কিন্তু চোখের কোণে জেদী ঝলক।নরম অথচ খোঁচামারা স্বরে বলল,

__’ বিদেশে যাই বয়ফ্রেন্ড বানাতে ।”
এই এক লাইন যেন জায়নের মাথায় বজ্রাঘাত করল।
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল, কপালের শিরা ফুলে উঠল, চোখে শিকারি বাঘের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।মুঠোয় চেপে ধরল তিয়াশার খোপা, যেন এই চুলের ফাঁক দিয়ে রাগ বের করে আনতে চাইছে।ফোঁস করে বলে উঠল,
___” হারামির বাচ্চা মরার পায়তারা করছিস ? বিদেশ
গিয়ে বয়ফ্রেন্ড খোজা মারাচ্ছ ?”
এই ভাবে চুল টানায় তিয়াশার একটু ব্যাথা করে উঠলো, কিন্তু তার মনেও তো রাগ হয়েছিল যখন
বলেছিল বিদেশী গার্লফ্রেন্ডের কথা । তিয়াশাও একভাবে জায়ন এর ওই ভয়ঙ্কর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে নিঃশব্দে
তিয়াশা কিছু বলছে না দেখে জায়ন আবারো রেগে গর্জে উঠলো,

__” বিবাহিত হয়ে বয়ফ্রেন্ড খোজা মারাচ্ছিস, শা**
কু** বাচ্চা মেরে হাত পা গুড়িয়ে রেখে দেবো ।,”
এবার তিয়াশা জায়ন এর এই কথায় রেগে জায়ন চুল টেনে বলল ,
__” তুমিও তো বিবাহিত তাহলে অন্য নারির সঙ্গে কথা কিসের? একটাও চুল থাকবে না বলে দিলাম।”
তিয়াশার এই কথায় জায়ন এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল কণ্ঠে হাল ছেড়ে দেওয়ার ক্লান্তি।গভীর, নির্লিপ্ত গলায় বলল
__” অফিসের স্টাফ ছিল । কোন গার্লফ্রেন্ড ছিল না ।”
তিয়াশা হাত দিয়ে জায়ন শার্ট মুঠোয় নিয়ে সরল গলায় বলল,
__” আমিও সবার সঙ্গে আরোহী দের বাসায় যাব।”

এই কথা শোনা মাত্রই জায়নের চোখে হঠাৎ সেই চেনা কঠোরতার ছাপ ফুটে উঠল। মুখে গম্ভীরতা জমে আছে, যেন সে কোনো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কিন্তু তারপর কি ভেবে জায়ন ভ্রু কুচকে,শর্তের ছুরি চালাল,
__” ঠিক আছে যা তবে এই শাড়ি ব্লাউজ চেঞ্জ করে , যা পড়লে আমার জান এর শরীরের কোন অংশ দেখা না যায় সেটা পড়ে যাবি ,আর এই এই যে বা** ছাল লাগিয়েছিস মুখে সব মুছে যাবি , নইলে বাসায় বসে থাক ।”
জায়ন এর কথায় তিয়াশা বিরক্ত হয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে তার দুই হাত ধীরে ধীরে জায়নের শার্টের বোতাম নিয়ে খেলতে খেলতে সে বলল,

__” তুমি আমায় কখনো সাজতে দেও না কেন ?”
জায়নের চোখ তখন আর কঠোর নয়, নরম হয়ে এসেছে। তিয়াশাকে নিজের দিকে আরো কাছে টেনে নিল। তার কণ্ঠে এবার এমন এক গভীরতা যা শুধু ভালোবাসার মালিকানাই এনে দিতে পারে,
__” জান আমার এই বাচ্চা বউ টা আমার জানের থেকেও দামী, তার সব কিছুর দাবিদার শুধু মাত্র এই আমি , তাই আমি চাই না তার দিকে কারো নজর পড়ুক।”
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিয়াশার বুকের ভেতর জমে থাকা অভিমানের পাহাড় যেন মুহূর্তেই গলে গেল। চোখের কোণে ভালোবাসার নরম আভা ফুটে উঠল, শ্বাস প্রশ্বাস ধীরে ধীরে মিশে গেল জায়নের বুকে। নিজের দুই হাত ধীরে ধীরে জায়নের গলায় জড়িয়ে, তার চোখের গভীরে তাকিয়ে তিয়াশা ফিসফিস করে বলল,

__” আর এই শুধু তুমি আমার জীবনের সব টুকু জুড়ে
শুধু তুমি , তুমি ছাড়া অন্য কেউ তোমার এই জান কে
পাবে না ।”
কিন্তু তিয়াশার এই কথার ভেতর ‘অন্য কেউ’-এর উচ্চারণ জায়নের কানে পৌঁছাতেই যেন তার চোখে হঠাৎ শিকারির আগুন জ্বলে উঠল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল বাঁকা, বিপজ্জনক হাসি। কণ্ঠে হুমকির শীতলতা,
__”অন্য কেউ যদি আমার জানের দিকে তাকানোর সাহসও করে, আমি তার জীবনে এমন ভয়ানক পরিণতি নামিয়ে আনব, যা সে স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। তুইও সাবধানে থাকবি তোর জন্য যেন অন্য কারো জীবন অন্ধকারে না ডুবে যায়।”

জায়নের কথার এই হিংস্র মালিকানাবোধ তিয়াশার বুকের ভেতর শিরশিরে ভয় নামিয়ে আনল। মনে মনে ভাবল
“এই লোকের জীবনে শুধু ধমকি আর হুমকি, আর কোনো স্বাভাবিক কথা নেই কি?” নিজের মনকে সামলে নিয়ে সে জায়নের বাহু থেকে নিজেকে আলতো করে সরিয়ে নিল। ঠোঁটে হালকা বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বলল,
__”যাও তো, সব সময় শুধু তোমার হুমকি আর ধুমকি শোনার জন্য বিয়ে করিনি আমি ।”
জায়ন এবার হালকা হাসি দিল, যেন কথার তিরে আঘাত লাগলেও সে সেটাকে নিজের মতো করে নিয়েছে। শার্ট ঠিক করতে করতে ধীরস্বরে বলল,
__”হ্যাঁ, ছেড়ে দিচ্ছি। তবে জান, আজকে আমি বাসায় ফিরব না।”
এই শেষের লাইন শুনেই তিয়াশার মাথার ভেতর যেন বাজ পড়ল। চোখ বড় হয়ে গেল, বুকের ভেতর রক্ত যেন ফুটতে লাগল। কণ্ঠে গর্জন,

__”মানে কী? বাসায় আসবে না মানে?”
জায়ন তখন মাথা সামান্য নিচু করে, ঠোঁটের কোণে সেই চেনা বাঁকা হাসি রেখে ধীরে ধীরে বলল,
__”কি করব? বউ কাছে আসে না… তাই বাসায় ফিরব না।”
ঠিক সেই মুহূর্তেই হঠাৎ করেই জায়নের ফোন বেজে উঠল। শব্দটা যেন তিয়াশার কানে এক অদ্ভুত অস্বস্তির সুরে আঘাত করল। জায়ন একবারও তার বউয়ের জ্বলন্ত দৃষ্টির দিকে না তাকিয়ে ফোনটা কানে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে তিয়াশা শুনতে পেল তার কণ্ঠ,

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৭ (২)

__”বারোটার আগে আমার বনানীর বাসায় চলে আসবে।”
শব্দগুলো তিয়াশার কানে ঢুকতেই বুকের ভেতর আগুনের ঢেউ আছড়ে পড়ল। শিরা-উপশিরায় রাগের উত্তাপ ছড়িয়ে গেল। শরীর কাঁপছে রাগে, অবিশ্বাসে, আর এক অদ্ভুত শঙ্কায়। মনে প্রশ্নগুলো তীরের মতো এসে বিঁধছে,
__”মানে? আমার বাঘের বাচ্চা রাতের বেলা বনানীর বাসায় কাকে ডাকছে? কেন ডাকছে?

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here