তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৯
নীল মণি
রুহেনা বেগম হঠাৎ বিরক্তি আর বিস্ময়ের মিশ্র দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। কণ্ঠে চাপা রাগ আর অস্থিরতার সুর মিশিয়ে বলে উঠলেন,
__”এই তুই তো যাওয়ার জন্য নাচানাচি করলি, সকাল থেকে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই লাফালাফি করছিলি আমি যাব তোমাদের সঙ্গে, আমি যাব তোমাদের সঙ্গেএখন আবার কেন যাবিনা? এইভাবে চুপচাপ মুখ ফুলিয়ে কেন বসে আছিস?”
মায়ের এই তীক্ষ্ণ প্রশ্নে তিয়াশার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক বিরক্তির ঢেউ আছড়ে পড়ল। মাথার ভেতর যেন শব্দগুলো বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। তার মনের অসহায় অবস্থা কেউই বুঝছে না, এমনকি নিজের আম্মুও না। ভেতরে জমে থাকা রাগ হঠাৎ করেই ঠোঁট ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো, স্বর একটু উঁচুই হয়ে গেল,
__”আম্মু, প্লীজ বোঝার চেষ্টা করো , আমার ভালো লাগছে না, তাই যাব না।”
কিন্তু রুহেনা বেগম থামলেন না। মায়ের চোখে এক অদ্ভুত উৎকণ্ঠার ছাপ। মুখে কৌতূহল, মনে সন্দেহ, খুব স্পষ্ট মনে পড়ছে তার গত রাত অবধি জায়নের গলা চড়া হচ্ছিল, যেন ভেতরে কোনো দমকা ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সকালে ঘুম ভাঙার পর মেয়েকে দেখে তো একেবারেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, উজ্জ্বল আর প্রাণচঞ্চল, কিন্তু এখন? হঠাৎ এভাবে মনমরা হয়ে বসে আছে ,বুকের ভেতর চিন্তার আঁচ লেগে গেল। তিনি আর সামলাতে পারলেন না কৌতূহলটা। ধীরে, কিন্তু সোজাসাপ্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
__”হ্যা রে আম্মু তোর আর জায়নের মধ্যে রাতে এত চেঁচামেচি হচ্ছিল কেন? সব কিছু ঠিক আছে তো?”
এই প্রশ্ন শুনে তিয়াশা যেন হকচকিয়ে উঠল। শরীরের ভেতর দিয়ে শিরশিরে বিদ্যুতের ঝাঁকুনি বয়ে গেল। চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠল, কী বলবে সে? মাথার ভেতর হঠাৎ যেন তুমুল ঝড় বয়ে গেল।
অবশেষে সে জোর করে হাসির আভা ফোটালো ঠোঁটে, কিন্তু চোখের দৃষ্টি তাতে ফাঁস করে দিল লুকানো অস্থিরতা। কণ্ঠ নরম করেও অস্বস্তির কাঁপন লুকোতে পারল না,
__”আম্মু, সব ঠিক আছে। কিছু হয়নি। তোমাদের লেট হচ্ছে না? তাড়াতাড়ি যাও।”
রুহেনা বেগম কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।কিন্তু সময়ের তাড়া, সবাই প্রস্তুত। তিনি আর কথা বাড়া লেন না।
তিয়াশা এক মুহূর্তেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্টটা যেন আরো ভারী হয়ে চাপল।
জায়ন এর শেষ কথায় তিয়াশার মাথায় ঝড় বইয়ে দিচ্ছে।
“আসতে পারি?”
ইউভির কোমড়ে এখনো ব্যথা মেডিসিন , তলমালিশ এর কারনে ব্যথা টা একটু কম তবুও হঠাৎ এই আওয়াজে মনে হলো বুকের ভেতর কেউ যেন শিলাখণ্ড ছুড়ে মারলো। তাহসান সাহেবের এই গম্ভির কন্ঠস্বর আসতেই ইউভি কেঁপে উঠলো, গলা শুকিয়ে আসছে , কাল থেকে তাহসান সাহেব ইউভি কে বাগে পায়নি । এবার নিশ্চই ঝড় তুলবে ,তবুও ইউভি নিজেকে সামলে নিয়ে কাপা কাপা গলায় বললেন,
__” হ্যা চাচু ভেতরে আসো দরজা খোলাই আছে ।”
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন তাহসান সাহেব,
হাত দুটো পেছনে বাঁধা এক গম্ভির মুখ
করে দৃষ্টি অন্য দিকে গেঁথে আছে , তবুও সেই দৃষ্টির ভার যেন ঘরের বাতাস গিলে খাচ্ছে। ভেতরে ঢুকেই ঠান্ডা অথচ ভারী কণ্ঠে বললেন,
__” এখন কোমড়ে ব্যথা কেমন আছে?”
ইউভি মনে মনে একটু অবাক ই হলো , বাবা হবু শ্বশুড় পারলে আমার উপর বুলডোজার চালিয়ে দিতে চায়
কিন্তু এ তো দেখছি মেঘ না চাইতেই পানি ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে ? নাকি ঝড় আসার আগে অদ্ভুত নীরবতা? ইউভি একটু হাসি মুখ করেই বললো,
__” জী চাচু এখন আলহামদুলিল্লাহ একটু ভালো আ………..”
পুরো বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারল না মুহূর্তের মধ্যেই সেই গোপন আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ল ।দাঁত কিঁচিয়ে, মুখ কুঁচকে এক গর্জন ছুড়ে দিলেন তাহসান সাহেব
__” হ্যা রে হারামজাদা তুই দুনিয়ায় আর মাইয়া পছন্দ করার জন্য চোখে দেখিস নাই , আমার ওই বাচ্চা ফুটফুটে মেয়ে টাই চোখে পরল ?”
ইউভি ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠল, ভাবছে কি হলো , বাবা মেয়ে দুজনেই দেখি বহুরূপী, মেয়ে আগেরদিন মিষ্টি কথা বলে বাসায় এনে কলার খোসায় পিছল খাওয়ালো আর বাপে অ্যাটিটিউড নিয়ে আমার রুমে ঢুকে এখন দাঁত খিঁচিয়ে
উঠছে , কিন্তু এখন সে কি বলবে ? কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সাহস জোগাড় করল। তারপর হালকা রসিকতার ভঙ্গিতে গলা চেপে বলল
__” শ্বশুর আব্বা নিজেই তো বলে দিলেন মেয়ে আপনার মিষ্টির মত , আর আপনি তো জানেন আমি মিষ্টি কত ভালো খাই , ছোট বেলায় তো আপনি ই আমাকে মিষ্টি বেশি খাওয়া তেন ।”
এই খোঁচা শুনে যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিল ,ইউভির এক এক লাইন শুনে তাহসান সাহেব এর পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে যাচ্ছে। চোখ মুখ কুচকে গেলো,দাঁত কিঁচিয়ে রাগে যেন গিলে ফেলবেন।
__”কি কি বললি , লজ্জা সরম কি হাটে বেঁচে এসেছিস? এই বদজাত আমি তোর কোন পুরুষের শ্বশুর রে? হ্যা আমি বেশি করে মিষ্টি খাইয়েছি আর সেই মিষ্টি এখন আমার পেছনে ছুড়ে মারছিস ? এক
বদজাত কম ছিল বাসায়? এখন আরো তিন বদজাত
তৈরি হয়েছে ।”
তাহসান সাহেব এর কথায় ইউভি একটু ঠোট বাকা হাসি দিয়ে , হেডবোর্ড এ হেলান দিয়ে শুয়ে থাকা থেকে একটু বসে নিল ,চোখে খেলছে দুষ্টুমি, গলায় খোঁচা মেশানো ব্যঙ্গের সুর,
__” শ্বশুড় আব্বু আপনারই তো জামাই , লজ্জা যদি হাটে না বেচি তাহলে কি আর চলবে ? অনেক দিন ভালো ছিলাম এখন না হয় একটু বদজাত ই তৈরি হলাম। আচ্ছা দাড়ান আমি একটু বড় আব্বু কে ডাক দেই । তারপরে ওনার সামনে না হয় বলবেন?”
এদিকে প্রান্তিক সাহেব এর তাহসান সাহেবের বুকের ভেতর কেমন যেন হোঁচট খেল,কেমন যেন গুটিয়ে গেলেন , মুহূর্তেই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠলো ,কিন্তু পরক্ষনেই আবার নিজের দুর্বলতা আরাল করতে গর্জে উঠে বললেন,
__” বড় ভাই কে ডাকিস কেন আমি কি ভয় পাই? হারামজাদা আমায় ভয় দেখাস ? এখন আমার সময় নেই ওই আরেক বদজাত এর হবু শ্বশুড়বাসায় যেতে হবে । আমার অনেক দায়িত্ব, তোদের মতন নাকি?”
এই বলেই এক সেকেন্ড ও আর দাঁড়ালেন না। গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন , এদিকে ইউভি নিজের হাসি আর থামিয়ে রাখতে পারল না , শ্বশুড় কে জ্বালাতে আরেকটি বাক্য বাতাসে ছুড়ে দিল যাতে
তার কান পর্যন্ত যায়,
__” হ্যা সময় নিয়ে আসবে চাচু , সব কিছু ঠিকঠাক
তারাতারি হলে আপনাকে একটা মিষ্টি নাতনি গিফট করবো।”
তাহসান সাহেব শুনতে পেলেন কিনা জানেন না কিন্তু ইউভি মনে মনে অবাক হল সে কবে থেকে তার বড় ভাইয়ের মত ঠোঁট কাটা কথা বার্তা বলতে লাগলো।
আরোহী আজ লালচে মেরুন রঙের শাড়ি পরে বসেছে, যেন লজ্জায় তার গালও শাড়ির রঙে রাঙা হয়ে চৌধুরী পরিবারের বড় দের সামনে বসে আছে, আজ বাড়ির ছোটরা কেউ আসেনি । আরোহীর সৌন্দর্য আজ যেন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ঝলমল করছে। চোখে মুখে লজ্জা, তবুও ভেতরে কোথাও আনন্দের ঢেউ বইছে। তবে মনে মনে একটা কষ্টও তাকে কুরে খাচ্ছে যে গত রাতে যেভাবে তার রাঙ্গামূলকে শাস্তি দিয়েছে পরে নিজের ই খারাপ লাগছিল । তারপর থেকে আকাশের সঙ্গে একবার ও কথা হয়নি। রাগ হয়তো এখনো তার ভেতরে জমে আছে, কিন্তু সেই বদমাইস ডাক্তারকেই তো সে মন দিয়ে বসে আছে।
আরোহীর পাশে বসা তার আব্বু মোজাম্মেল সাহেব।মুখে মিষ্টি হাসি, কিন্তু ভেতরে একধরনের সতর্কতা এই হাসি না আনলেই হয়তো জায়ন এর তাণ্ডব সহ্য করতে হবে। আরোহীর আম্মু সবাইকে নাস্তা পানি দিতে ব্যস্ত ।
এর মধ্যেই আশরাফ সাহেব নিজের খুশির ধৈর্য
আর লুকিয়ে রাখতে না পেরে বলে উঠলেন,
__” আমার ছেলে যে এত সুন্দর বৌমা পছন্দ করেছে
ভাবতেই পারছি না , সরি সরি বৌমা না আমাদের আরেক মেয়ে ।”
তার কথায় ঘরের সবাই মুচকি হেসে উঠল,
আশারফ সাহেব এর এই অবস্থা দেখে প্রান্তিক সাহেব
একটু হেসে বললেন ,
__” আরে আশরাফ তোমার খুশি দেখে মনে হচ্ছে, তুমি
আমাদের আরোহী আম্মু কে পারলে আজ ই ছেলের
বউ করে বাসায় নিয়ে যাবে।”
প্রান্তিক সাহেবের কথায় ঘরের মধ্যে যেন এক হাসির ফোয়ারা বয়ে গেল , এরমধ্যেই আশরাফ খান বলে উঠলেন,
__”বড় ভাইয়া আপনি আমার মনের কথা টা বলে দিলেন ।”
এইসব কথাবার্তার মাঝে আরোহীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, সে কেবল নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।এমন সময় আয়েশা খান মৃদু হেসে বললেন,
__”আরে, ধৈর্য ধরুন, সময়মতো সব হবে তাড়াহুড়া করে মিষ্টি এত মিষ্টি খেলে হবে ।”
এই হাসা হাসি খাওয়া দাওয়া , দুই পরিবারে
কথাবার্তার টানাপোড়েন শেষে অবশেষে ঠিক হয়ে গেল যে আকাশ আর আরোহীর বিয়েটা হবে একসাথে অনন্যা আর ইউভির বিয়ের দিনেই, তবে সময়ের হিসেব মেলানো হবে অনন্যার এইচএসসি পরীক্ষার পরে, যাতে মেয়েটার জীবনের প্রথম বড় দায়িত্বের পথচলায় কোনো বিঘ্ন না ঘটে, আর আরোহী কে বাসায় ওঠানো হবে যখন আকাশ তার ডাক্তারি পড়া শেষ করে জীবনের অনিশ্চয়তা গলে আসা ক্লান্তি ঝেড়ে নতুন দায়িত্ব নিতে একেবারে প্রস্তুত হবে।সবকিছু শুনে পরিবারের সবার বুক ভরে উঠল অদ্ভুত তৃপ্তি আর স্বস্তির অনুভূতিতে, যেন এই বড় সংসারের সব টুকরো টুকরো স্বপ্ন একসাথে গেঁথে দেওয়া হলো ভবিষ্যতের রঙিন সুতোয়।
আরোহীর বুকের ভেতর তখন আনন্দে ভরে যাচ্ছে। লজ্জায় সে কিছু বলছে না, কিন্তু মনে মনে অনুভব করছে আজ থেকে তার জীবনের নতুন পথচলার দরজা খুলে গেল। আকাশের সঙ্গে মিলনের দিন হয়তো এখনো একটু দূরে, কিন্তু আজকের এই সিদ্ধান্ত যেন তাকে সেই স্বপ্নের আরো কাছে টেনে নিল।
__” ইউভি ভাই,নাজিম ভাই খুশি তো লাগছে কিন্তু
এই চুলকানির কুটকুটানি এখনো যায় নাই। আর
এই চুলকানি মনে করায় দিচ্ছে কি ডেঞ্জারাস আমার
জলপরী, স্বপ্ন দেখলাম জলপরীর আর ধরিয়ে দিল
বিচুটি পাতা।”
আকাশের এই কথাটা শুনেই ঘরের ভেতর এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। হাসার মতো হলেও, আসলে কেউ হাসতে পারলো না। সবাই এক অসহায় মুখ করে বসে আছে কারণ তারা নিজেরাই ভুক্ত ভোগী।
ইউভির ঘরে তিনজন এখন বসে আছে, একদিকে আকাশ নিজের ব্যথা চুলকানির মধ্যে ডুবে আছে, আরেকদিকে ইউভি এখনো হালকা কোমর ব্যথায় শুয়ে আছে, সাথে আছে নাজিম পেটের অবস্থা আগের থেকে একটু ভালো ,আজ নাজিম আর বৃষ্টির চলে যাওয়ার কথা ছিল তাদের বাড়ি। কিন্তু নাজিম এর শরীর টা একটু অসুস্থ থাকায় এই বাসার বড়রা তাকে কিছুতেই যেতে দিবে না কিছুতেই।
__” আচ্ছা আমাদের তো এই অবস্থা করেছে আমাদের বউরা, জায়ন এর কি অবস্থা ? দেখে তো মনে হল কিছুই হয় নাই , তাহলে আমার শালি অনেক ভালো
বলতে হবে ।”
নাজিম এর কথা শুনে ইউভি ঠোঁটের কোণে একরকম দুষ্টু হাসি টেনে নিল। হাসিটা যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল চোখের কোণ পর্যন্ত, কণ্ঠে ফুটে উঠল মজা আর কটাক্ষের রেশ। সে আস্তে আস্তে, একটু টেনে টেনে বলল,
__” না না নাজিম ভাই তোমার শালি মানে আমার বোন
আরেক ডেঞ্জরাস , ভাইয়া রাতে বলল তার বউ কি নাকি তাকে চোখ বেঁধে মরিচের জ্যুস খাওয়াইছে, ভাবতে পারছ তাও আবার বড় ভাই কে ।”
ইউভির এই কথা শুনে দুজনেরই মুখ হাঁ হয়ে রইল। চোখে মুখে স্পষ্ট বিস্ময়ের ছাপ এও কি সম্ভব, তারা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। অথচ সত্যি তো অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ, যে জায়ন একসময় রাগী, কঠিন, ঝড়ের মতো চরিত্রের ছিল, সেই জায়ন এখন বউ এর ঝালের জ্যুস খাচ্ছে । সে আর সেই আগের জায়ন নেই সে এখন বউ পাগলা জায়ন,প্রতিটা মুহূর্তে বউকে নিয়ে ডুবে থাকতে রোমান্সের দুনিয়ায়।
ঘরের ভেতরের সেই মজার গল্পগুজবের রেশ কাটতে না কাটতেই দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল অনন্যা। নিঃশব্দ দাঁড়ানোয় যেন তার উপস্থিতিই ঘরের হাওয়ায় অন্যরকম এক চাপা স্রোত বয়ে দিল। অনন্যাকে দেখেই যেন ইউভির বুকের ভেতর ঢেউ খেলানো একটা অস্থিরতা জেগে উঠল। সেটা টের পেয়েই আকাশ আর নাজিম চোখাচোখি করে দুষ্টু হাসি দিল। একটু বাকা মুচকি হাসি নিয়ে ইউভির দিকে তাকাল তারা।
হাসতে হাসতে ওরা উঠে দাঁড়াল বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু যাওয়ার আগে নাজিম ইউভির কাছে এগিয়ে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বলে গেল,
__”সাবধান ছোট ভাই , বাসায় কেউ নাই সেই সুযোগে
যেন কোমর ব্যথার বদলা নিয়ে নিও না।”
এই কথায় ইউভির কান লাল হয়ে গেল। মুখভর্তি লজ্জা আর অস্বস্তির ছাপ গোপন করতে না পেরে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল নাজিমের দিকে। আকাশ আর নাজিমের ফিসফিসি হাসি ঘর ভরিয়ে তুলল, আর মুহূর্তের মধ্যেই তারা অনন্যার পাশ কাটিয়ে চলে গেল বাইরে।
এবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল শুধু অনন্যা মাথা নিচু, দৃষ্টি মেঝেতে। হয়তো বুকের ভেতরে জমে থাকা অপরাধবোধ, হয়তো কিছু অজানা অনুসোচনা তাকে থামিয়ে রেখেছিল।
ইউভি তার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল , একটু করুন সুরে ঢং করে বলে উঠল,
__” আমার পাখি তো আমায় পছন্দ করে না , কিন্তু আমার দড়জার সামনে দাড়িয়ে আছে ।”
মুহূর্তেই অনন্যা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইউভির বুকে। বুকের ভেতর মুখ গুঁজে নিল, শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। আচমকা এইভাবে জড়িয়ে ধরা ইউভির জন্য সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত এক মুহূর্ত সে অবাক হয়ে থেমে গেল। নিজের শার্টের বুকের কাছে টের পেল হালকা ভেজা ভেজা স্পর্শ। একফোঁটা, দুফোঁটা অনন্যার চোখের পানি তার বুকে ভিজে উঠছে।
ইউভি আস্তে করে হাত বাড়িয়ে অনন্যার চিবুক তুলে ধরল। তার দৃষ্টি আটকাল সেই ভেজা চোখে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু যেন হৃদয় বিদারক এক ব্যথা ছড়িয়ে দিল ইউভির বুকজুড়ে। নরম কণ্ঠে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
__” আমার পাখির চোখের পানি খুব দামী আমার কাছে , অকারণে সেই পানি পরলে আমার বুকে ব্যথা
করে ।”
তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই অনন্যার বুকের ভেতরে বাঁধ ভেঙে গেল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে, কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল,
__” সরি সরি আমি আপনাকে একটু বেশি ই ব্যথা দিয়ে
ফেলেছি । আপনি মিথ্যে বলেছেন বড় ভাইয়ার জন্য
আমায় তিউ আপু সব বলেছে , সরি সরি ইউভি ভাইয়া।”
অনন্যার কণ্ঠে অপরাধবোধ আর অনুতাপ মিশে আছে।ইউভি মনে মনে অবাক হল , তার বোন বলেছে ? তাদের তো তাদের মিথ্যে বলতে বলেনি তাদের বড় ভাই , তবুও আমার বোন আমাদের জন্য সব দোষ বড় ভাইয়ের উপর চাপিয়ে দিল। ইউভি নিজের ভাবনা বাদ দিয়ে অনন্যার চোখের পানি মুঝতে মুখতে ইউভি কোমল সুরে বলে উঠলো,
__” পাখি তোর যত ব্যথা দিতে ইচ্ছা করে সব ব্যাথা আমি খুশিতে গ্রহণ করতে রাজি । শুধু কখনো বলবি না দূরে যাওয়ার কথা , বা আমায় পছন্দ করিস না ।
এসব আমি নিতে পারবো না ।”
ইউভির কথা গুলো বলার সময় গলা কেঁপে উঠল, কিন্তু অনন্যার মনে সেই কণ্ঠ বাজল এক অদ্ভুত জাদুর মতো। বুক ভরে উঠল ভালোবাসার বর্ণিল অনুভূতিতে, যেন চারদিকে রঙিন রামধনু ছড়িয়ে পড়ল। তার চোখ ভেজা চাহনি নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইউভির দিকে। এই চাহনি ইউভির বুকের ভেতর অস্থির ঝড় তুলল। শরীরের প্রতিটি স্নায়ুতে কাঁপন জাগিয়ে তুলল অনন্যার এত কাছে আসা। হৃদস্পন্দন দ্রুততর হতে লাগল। আর নিজেকে থামাতে পারল না ইউভি। হঠাৎ করে অনন্যাকে আরও শক্ত করে টেনে নিল নিজের বুকে। তার এত কাছে টানায় অনন্যার শরীর এক ঝাঁকুনি দিয়ে তুলল, কিন্তু চোখে মুখে কিছু বলতে পারল না। ইউভি অনন্যার দিকে ঝুঁকে এসে তার মাদকতার দৃষ্টি নিয়ে অনন্যার চোখে তাকাল, আর নরম কণ্ঠে বলল,
__” কিন্তু একদিন আমাকে দেওয়া এই সব ব্যথার ফল স্বরূপ তোকেও এক ব্যথার ভাগিদারি হতে হবে ।”
অনু ইউভির এই কথা না বুঝে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে উঠল,
__” মানে আপনিও আমায় ব্যাথা দিতে চান ।”
ইউভি ঠোঁটের কোণে এক বাকা হাসি টেনে উত্তর দিল,
__” যে ব্যথা দিতে চাই , তা না হয় আমাদের বাসরেই
দেখিয়ে দেব।”
ইউভির কথা শুনে অনুর কান লাল হয়ে উঠল , লজ্জায় কেঁপে উঠল সারা শরীর। ঠোঁটে কেবল একটাই শব্দ ফসকে বেরোল
__” বেহায়া ।”
লজ্জায় মাথা নিচু করে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করল অনন্যা। কিন্তু ইউভি এবার আর তাকে ছাড়ল না। শক্ত করে টেনে নিল আবার নিজের বুকে। তারপর আস্তে আস্তে ঠোঁট বসিয়ে দিল অনন্যার ঠোঁটে।
মুহূর্তের মধ্যে যেন থেমে গেল সময়। হৃদয়ের সব শব্দ মিলিয়ে গিয়ে কেবল বাকি রইল দুজনের শ্বাসের শব্দ আর স্পর্শের নেশা।
সময় তখন সন্ধ্যা ৭টা বেজে ২০,আরোহী দের বাসা থেকে বিকেলেই এসে পড়েছে সবাই। চারপাশে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস, সবার মুখে হাসি, মন জুড়ে বয়ে চলেছে এক মিষ্টি খুশির অনুভূতি, যেন উৎসবের বাতাস ভেসে বেড়াচ্ছে প্রতিটি কোণে। কিন্তু এই আনন্দের মাঝেই তিয়াশার বুকের ভেতরটা সকাল থেকেই কেমন ছটফট করছে। মনে হচ্ছে এক অস্থির ঢেউ তার ভেতরটাকে ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে সে বারবার ফোন করেছে জায়নকে, প্রতিবারই একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েছে, কিন্তু ওপাশে কোনো সাড়া মেলেনি। বিকেলে একবার ফোন রিসিভ হয়েছিল ঠিকই, তবে সেই কণ্ঠস্বরের নির্লিপ্ততা তাকে আরও ভেঙে দিয়েছে শুধু বলেছিল সে ব্যস্ত। এর বেশি কিছু নয়।
তিয়াশা ফোনটা কানে চেপে ধরে বহুক্ষণ নির্বাক হয়ে ছিল, যেন কথাগুলো শোনার পর শরীর থেকে সমস্ত শক্তি খসে পড়েছিল মুহূর্তে। তার ভাই কেও যে8গ্য়েস করেছিল কিন্তু সে ও বলেছে ভাই ব্যস্ত ।তারপর থেকে বারবার মনে হয়েছে সে কি সত্যিই এতটাই ব্যস্ত যে একটুখানি সময়ও বের করতে পারছে না? না কি ইচ্ছাকৃতভাবে দূরে সরিয়ে রাখছে তাকে? এই প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে তার মনকে কেমন ভারী করে তুলেছে।
এদিকে সারাদিন তিয়াশা কিছুই খেতে পারেনি ঠিক ঠাক। টেবিলে খাবার সাজানো হলেও তার সামনে বসে মনে হয়েছে গলায় কাঁটা আটকে আছে। প্রতিবারই খাবারের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার থেমে গেছে, যেন ভেতরের সমস্ত ক্ষুধা, সমস্ত রুচি মুছে গেছে অজানা এক কষ্টে। শরীরটা ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, কিন্তু মন বোঝাতে পারছে না নিজেকে। তার মনে হচ্ছে চারপাশের এই আনন্দে সেও থাকুক, কিন্তু বুকের ভেতরের শূন্যতা যেন সবকিছু ম্লান করে দিচ্ছে।
মনে মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছে তিয়াশা,
__” এই বদমাইস বাঘের বাচ্চা তোকে পেলে যে কি করবো ।”
কিন্তু এই লোক রাতে কাকে ডেকেছে তাদের
বাসায় এই চিন্তায় আরো চিন্তার ঝড় তুলে দিচ্ছে মাথায় । বৃষ্টি অনু রায়ান মারিয়া আকাশ নাজিম
সবাই আছে তাদের পাশেই বসে আছে তিয়াশা।
কিন্তু তার এই বয়ে চলা মনের ঝড় কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না ।
সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত, তিয়াশা আর শান্ত রাখতে পারছে না নিজেকে। বুকের ভেতরে কেমন অস্থিরতা, যেন শ্বাস নিলেও শান্তি নেই, না নিলেও দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখে-মুখে অঝোর অস্থিরতার ছাপ, মন ভেতর থেকে কাঁদছে কিন্তু চোখের জল বের হচ্ছে না। ঠিক তখনই ছুটে গেল ইউভির রুমে।
ইউভি তার বোনকে এমন অস্থির, এলোমেলো দেখে অবাক হয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে, কণ্ঠে উদ্বেগ মিশিয়ে বলে উঠল,
__”কি রে, এরকম লাগছে কেন তোকে?”
কিন্তু তিয়াশা যেন আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নয়। তার চোখে শুধু একটাই তাড়া কোথাও পৌঁছানোর, কারও সামনে দাঁড়ানোর। তাই ভাইয়ের প্রশ্ন উপেক্ষা করে সোজা বলে উঠল,
__” ভাইয়া আমায় এক্ষুনি আমাদের বনানীর বাসায়
দিয়ে আসো। ”
ইউভির চোখে কৌতূহল, মনে সন্দেহ তবুও শান্ত কণ্ঠে বলে,
__” কিন্তু তুই এত রাতে ওখানে কেনো যাবি, ভাইয়া
কোথায় ?”
তিয়াশার কণ্ঠ এবার কঠিন, তবুও কাঁপা,
__” তোমার ভাইয়া ওখানেই আছে। তুমি চিন্তা করো না
আমায় শুধু ঐ বাসায় ছেড়ে দেও।”
ইউভি এক গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে বোনের চোখের দিকে তাকাল। তার বোনের এই অস্থির চোখের জল আটকানো চাহনি ইউভির বুক কাঁপিয়ে দিল। মনে হলো, কোনো কারণ আছে, তাই সে ধীরে বলল,
__”আমি তো যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই রে বনু, আমি আকাশকে বলে দিচ্ছি।”
শোনামাত্র তিয়াশার চোখে ক্ষণিকের স্বস্তি খেলে গেল। বুকের ভেতর কেমন হালকা হলো, ঠোঁটে ফুটল একরাশ তৃপ্তির হাসি। কিছুক্ষণ পরেই আকাশ তাকে নিয়ে রওনা দিল বনানীর উদ্দেশ্যে।
শহরের রাতের রাস্তায় বাতি জ্বলছে একের পর এক, কিন্তু তিয়াশার চোখে কেবল অন্ধকার। বাইকের পেছনে বসে তার মন যেন ঝড়ের মতো ছুটছে কখন পৌঁছাবে, কখন সামনে দাঁড়াবে, কখন সেই অস্থিরতার জবাব পাবে। পনেরো কুড়ি মিনিট পর অবশেষে পৌঁছে গেল তারা জায়নের সেই লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে।বাইক থেকে নামতেই তিয়াশার বুকের ভেতর দুরুদুরু করে উঠল। পা যেন কাঁপছিল, তবুও তাড়াহুড়া করে এগোতে লাগল। আকাশের কণ্ঠ পেছন থেকে ধরা দিল,
__” আমি আসবো রে বনু ?”
তিয়াশা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে উঠলো,
__” না ভাইয়া তুমি যাও আর ধন্যবাদ ভাইয়া।”
আকাশ বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলে উঠলো ,
__” থ্যাংক্স ইউ বলতে হবে না ভাবি , এইটা আমার দায়িত্ব।”
তিয়াশার বুক ভরে গেল আবেগে, তবুও সে কিছু বলল না। আকাশ চলে গেল, আর সে পার হল স্লাইডিং গেট। ধীর পায়ে এগোতে লাগল, কিন্তু প্রতিটি পা যেন অস্থিরতায় কাঁপছিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিল, বুকের ভেতর যেন জ্বলন্ত আগুন। কাঁপা হাতে পাসওয়ার্ড কি চাপল , এই বাসার দুটো কি একটা জায়ন এর কাছে একটা তিয়াশার কাছে ।
দরজা খোলামাত্র চোখ ছিটকে গেল সারা বাসায় রোমান্টিক লাইটিং, ঝলমলে আলোর ঝিকিমিকি। কিন্তু এই আলো যেন তিয়াশার চোখে বিষ হয়ে বিঁধল। বুক কেঁপে উঠল, আর শরীরের ভেতর এক তীব্র আগুন জ্বলে উঠল। মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল,
__”শা* চিটিংবাজ, তুই আমায় বিয়ে করে এখন অন্য মেয়েকে ডেকে এনে রোমান্স করবি? কর, আজই তোদের এই বাসাসহ পোড়াবো।”
ড্রয়িং রুমের দিকে ঠিকমতো তাকানোরও সুযোগ পেল না ,হঠাৎ এই নিচতলার ওয়াশরুম থেকে ভেসে এলো তার অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর তার বাঘের বাচ্চা, জায়নের সেই কণ্ঠস্বর যেন তার বুকের ভেতরের লাভা আরও ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটাল।
__””ওয়াও, তুমি তো অনেক সফট, কিউট এর সঙ্গে সঙ্গে এত সফটও, তোমাকে টাচ করছি, তুমিও দেখি আমার বউয়ের মতো নড়াচড়া করছো। আমার বউ তোমায় দেখলে নিশ্চই খুব জেলাস হবে ।”
এই শব্দগুলো কানে যেতেই তিয়াশার রক্ত ফুটে উঠল। শরীরের ভেতর যেন লাভার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল, চোখের মণি লাল হয়ে গেল, যেন সেই চোখ দিয়ে কাউকে ছিঁড়ে ফেলবে। দাঁত কিড়মিড় করে কিচেনের দিকে ছুটল, হাতে তুলে নিল একটা ছুরি। বুকের ভেতরের আগুন তাকে আর থামতে দিল না।
চোখ মুখ লাল,শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী ঠাস করে খুলল বাথরুমের দরজা, দড়জা খুলতেই চোখ মুখ বুঁজে , কণ্ঠে বিষ ছিটকে বলল,
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫৮
__” হারা** বাচ্চা তুই বাসায় বউ রেখে এখানে সফট
স্কিন এর প্রশংসার গুণ গান করছিস , তোদের দুটোকেই আজ কবর দিব।”
জায়ন সামনে যা দেখল, সেই দৃশ্যে তার বুকের ভেতর ধাক্কা খেয়ে গেল। চোখ হা হয়ে গেল, ঠোঁট কেঁপে উঠল কারণ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার তিয়াশা, আগুন হয়ে, বজ্র হয়ে, মৃত্যুর মতো ভয়ঙ্কর হয়ে।
