তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৩
নীল মণি
_” আরে বউ কই তুই?”
নিজের উপর বিরক্তি হয়ে জায়নের চোখমুখ একেবারে লাল হয়ে উঠেছিল। অস্থির হাতে নিজের শার্টটা টেনে ছিঁড়ে ফেলার মতো করে ছুঁড়ে মেরে দিলো বিছানার দিকে। এদিকে আবার বউ রুমে নেই বউকে চোখের সামনে না দেখলেই যেন মাটির তলা থেকে আগুন বেরিয়ে আসে। পা ঠুকতে ঠুকতে খুঁজলো ওয়াশরুমে, কিন্তু সেখানে নেই। তৃষ্ণার্ত মনে অদ্ভুত কৌতূহল জেগে উঠল, এক নিমেষেই শুধু ট্রাউজার পরেই সোজা তিয়াশার রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
আজ অবশ্য তার গলা বুক জুড়ে জ্বলজ্বল করছে তিয়াশার দেওয়া চিহ্নগুলো। দাগগুলো যেন শুধু চামড়ায় নয়, হৃদয়ের গভীরে গেঁথে গেছে।মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবী বুঝতে পারছে সে আজ কার ছোঁয়ায় দগ্ধ হয়েছে।
তিয়াশার রুমের দরজার সামনে দাঁড়াতেই দেখতে পেল ভেতর থেকে লক করা।হাত দিয়ে জোরে নক দিয়ে গলা চড়িয়ে উঠলো,
__” বউ তুই কি এই রুমে , থাকলে দরজা খোল ? আর এই রুমে কি করছিস তুই ? এই রুম এখন তোর বাপের বাড়ি, আমার পারমিশন ছাড়া বাপের বাড়ি আসার পারমিশন কে দিলো তোকে ?”
কথার সাথে সাথে গলার স্বর কেঁপে উঠছিল মিষ্টি রাগ, মিষ্টি অভিমান আর অদৃশ্য এক মিশ্রণে।
এক নাগাড়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল জায়ন, হঠাৎই দরজা খুলে গেল আর সেই মুহূর্তেই যেন তার সমস্ত রাগ, অভিমান কোথাও মিলিয়ে গেল।চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল, মুখ হা হয়ে রইল। কি বলতে এসেছিল সব ভুলে গেল সে।
দরজার ফাঁক দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াশা অলিভ কালারের নরম জামদানি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আছে , হয়তো এটাই তার শশুরের দেওয়া জন্মদিনের উপহার। সঠিকভাবে শাড়ি গুছিয়ে পরারও সুযোগ হয়নি। তবু সে যে কতো সুন্দর, সারা ঘর যেন আলোয় ভেসে উঠলো তার উপস্থিতিতে।
কপাল কুঁচকে বিরক্তি মেশানো গলায় তিয়াশা বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
__” কি হয়েছে কি? চিৎকার কেন করছো এত? ”
জায়ন দরজার ফ্রেমে হেলান দিলো। ঠোঁট কামড়ে বাকা হাসি খেলিয়ে চোখের ভেতর ঝড় তুলে বলল,
__” বউ তুই তো ঠিক করে শাড়ি ই পরিশ নি,আমিপরিয়ে দেবো ? তোর শশুর এর চয়েস আছে বলতে হবে। ”
তার চোখে ছিল নিঃশব্দ আগুন, বুকের ভেতরে অশান্ত ঝড়।চোখ সরাতে পারলো না একটুও। সারাদিন বউ কে যদি সামনে রেখে দেওয়া হয় , তাও কম হবে কিছুটা থেমে আবারও বলল,
__” না আমার বউ অনেক বেশি সুন্দর তাই বাকি জিনিস ও সুন্দর করে দেয় । দেখ তোর ছোঁয়া পেয়ে আমিও কত সুন্দর হয়ে গেছি ।”
কথার ভেতর গর্ব, আদর, মিষ্টি নেশা সবই মিশে আছে।তিয়াশা ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মুখ ভেংচিয়ে বলল,
__” বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে তোমার সুন্দর না ছাই তুমি যাও তো রেডি হতে দাও ।”
কথাগুলোতে ঠাট্টা থাকলেও ভেতরে ভেতরে সে নিজেই বুঝছিল বুকের ভেতর কেমন ধাক্কা খাচ্ছে।
জায়ন একচুলও পিছালো না। দরজা সরিয়ে পা বাড়ালো ভেতরে। তিয়াশা চোখ বড় বড় করে চমকে উঠলো,
__” বললাম না যাও তাহলে এদিকে এগোচ্ছ কেন?”
তার চোখের গভীরে আতঙ্কের সাথে এক অচেনা কাঁপন খেলতে লাগল।
চোখে চোখ রেখে জায়ন বাকা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে হুট করে তাকে টেনে নিলো বুকে। দুই বাহুর শক্তিতে বাঁধা পড়ে গেল তিয়াশা।
__” তোর কি হিসাবে আমাকে বুড়ো মনে হয় বেইবু ? তোর যদি আমাকে বুরোই মনে হয় তাহলে ই বুড়ো কে সামলাতেই হিমসিম খেয়ে জাস কেন ?”
কথার সাথে সাথে চোখে ঝিলিক, ঠোঁটে নেশা। এক হাতে আলতো করে স্লাইড করতে লাগল তিয়াশার মুখের উপর দিয়ে, গালের টলমল নরমতায় ডুবে যাচ্ছিল আঙুল।
তিয়াশা ভিতরে ভিতরে কেমন যেন নিসংকোচ, অস্থির। বুক ধড়ফড় করছে, অথচ মুখে জোর করে হাত সরাতে সরাতে বলল,
__” কি করছ এখন জাও বলছি, রেডি হচ্ছি তো ? ”
কিন্তু জায়ন যেন কানে নিচ্ছেই না। বরং আরো জোরে টেনে আনলো কাছে। কণ্ঠের প্রতিটি শব্দে ছিল দাবির আগুন,
__” আমার সামনেই হ, আমার তো সব দেখা সব জানা তোর শরীরে কোথায় কি আছে , এর পরেও কিসের লজ্জা ? তোর জন্য আজ, আমার শশুর আর তোর শ্বশুর দুজনের সামনেই ইজ্জতের আস্তাগফিরুল্লাহ করে আসলাম, আর তুই এখন…….”
বাক্য শেষ করার আগেই হঠাৎ দরজার আড়াল থেকে ভেসে এলো চাপা হাসি। আর হাসির কন্ঠ শুনেই বুঝে গেলো এটা,
আরোহী
জায়নের বুকের ভেতর যেন ধপ করে আগুন নেমে এলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মাথার ভেতরে তীব্র ঝড় আজ সকাল থেকে তার ইজ্জত বারবার যেন পুড়ে যাওয়া ফানুস এর মত সবার সামনে খসে পড়ছে। নিজেকেই চড় মারতে ইচ্ছে করছিল, তার পর
উন্মুক্ত শরীর নিয়ে উফফ কি জ্বালা । জায়ন যেন ইশারায় বলতে চাইছে “ও এখানে কি করছে?”
কিন্তু তিয়াশা কোন ইশারাই বোঝার চেষ্টা করল না বরং নিজেই তখন মজা নিচ্ছে। সুযোগটা লুফে নিয়ে জায়নকে ঘুরিয়ে তার পিঠে হাত রেখে বাইরে ঠেলে দিতে দিতে বলল,
__” কখন থেকে বলছি যাও যাও শোনোই না, ভাই বউ
এর সামনে রোমান্স শুরু করে দিয়েছ , যখন ইচ্ছা যেখানে ইচ্ছা শুরু করে দাও । আর নেক্সট টাইম এরকম ভাবে বিনা শার্ট এ রুমের বাইরে বেরোলে তোমার খবর আছে , এখন নিজের রুমে যাও ।”
বুকের ভেতরে গর্জন জমলেও জায়ন একবার পেছনে ঘুরে তিয়াশার দিকে মূখ ঘুরিয়ে মুখ ফুলিয়ে জবাব দিল ,
__” কি করব আমার বউ হলো ম্যাগনেট শুধু আমায় অ্যাট্রাকশন করে । আর এইভাবে বেরোলে কি হবে জান ?”
তিয়াশা গভীর এক নিঃশ্বাস ছাড়লো মাথা উচু করে জায়ন এর দিকে তাকাল ।চোখে এক অদ্ভুত নেশা মাখা আলো, ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি, একটু ধীরে, একটু হাস্কি স্বরে বলল,
__” আসলে আমার বর টা একটু বেশিই অ্যাট্রাকটিভ যদি অন্য কেউ নজর দেয় , তার জন্য আমি চাইনা আমার বর এইভাবে বাইরে বের হোক”
একটু থেমে জায়ন কে আরো জ্বালানোর জন্য বলে
উঠলো ,
__” বুঝলে ড্যাডি।”
শব্দগুলো বাজতেই জায়নের শরীর জমে গেল। কানের লতি লাল, গাল লাল, বুকের ভেতর কেমন আগুন জ্বলে উঠলো।
কিন্তু এর আগেই তিয়াশা হেসে ঠেলে দিল বাইরে,দরজাটা একেবারে মুখের সামনে ধপ করে
বন্ধ করে দিল।
জায়ন দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। বুকের ভেতর তোলপাড়, শরীরে জ্বালা, মাথায় ধোঁয়া। বিরক্তির ভঙ্গিতে মাথায় হাত দিলো, একটু রেগেই গম্ভির স্বরে চিৎকার করে বলে উঠলো
__” সিডিউস করে মারতে চাস আমায় বেয়াদব মহিলা।”
কোন জবাব না আসায় ধীরে ধীরে পা বাড়ালো নিজের রুমের দিকে।
মুখের ভেতরে রাগ থাকলেও ঠোঁটের কোণে চাপা এক হাসি লেগেই রইল,আজ আবারও হারলো সে, অথচ এই হারাতেই যেন বিজয়ের মিষ্টি স্বাদ লুকিয়ে আছে।
এতক্ষন দরজার আড়ালে দাঁড়ানো ছিল আরোহী । সে আসলে নিজের মত করে রেডি হতে এই রুমে এসেছিল, কিন্তু জায়ন এভাবে হঠাৎ চলে আসায় দড়জার আড়ালে লুকিয়ে পরে । জায়ন এর কথা শুনে
দুজনেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে ।
__”বেবী ভাইয়া তো সব সময় তোর মধ্যে ডুবে থাকে।”
হঠাৎ আরোহী হাসতে হাসতে কথা টা আরোহীর দিকে
ছুঁড়ে দিল ।তিয়াশাও অবাক হয়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর নিজেকে সামলে আবারো হেসে ফেলল। শাড়ি ঠিক করতে করতে মিষ্টি গলায় বলল,
__”তোর ভাইয়া একটা পাগল, কি না কি বলছে ,
ওসব কান থেকে বের করে দে তো।”
কথাটা বলেই তিয়াশা থামল। যেন ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ভেবে আবারো কপাল কুঁচকে আরোহীর দিকে তাকিয়ে হালকা জোর করেই গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
__”তোর ভাইয়ার দিকে তাকাস নি তো?”
তিয়াশার গলায় হালকা ভয় মিশে ছিল, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত কৌতূহল।আরোহী তো থামার মেয়ে নয়, খিলখিল হেসে তিয়াশার কাছে গিয়ে দুহাত দিয়ে ওর মুখটা টেনে নিল। দুষ্টু ভঙ্গিতে বলল,
__”আমার বার্থডে গার্ল, আমি শুধু কথা শুনেছি। ওইখান থেকে কিছু দেখার উপায় ছিল? তবে তোমাকে দেখে ঠিকই বুঝতে পারছি সোনা ভাইয়া সত্যিই অনেক পাগলামি করেছে।”
এই দুষ্টুমি ভরা কথাগুলোতে তিয়াশার মুখ পলকে রাঙা হয়ে উঠল। গাল বেয়ে যেন লজ্জার লাল আভা ছড়িয়ে গেল। সে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শব্দ গুলো গলায় আটকে গেল। লাজুক হাসি চেপে রেখে একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়ে বলল,
__”বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি চল ,বড় আব্বু তো নিচে বসে অপেক্ষা করছে।”
সত্যিই তো মুহূর্তের জন্যে আরোহী ভুলেই গেছিল যে, সবাই অনেকক্ষণ ধরেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আর ঝগড়া ঠাট্টা না বাড়িয়ে এবার সে তাড়াহুড়ো করে রেডি হতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর পুরো পরিবার একসাথে ড্রইংরুমে জমে গেল। চারপাশে হাসি, কোলাহল, আনন্দের উচ্ছ্বাস,সব মিলিয়ে ঘর ভরে উঠল এক বিশেষ আবেগে। তবু ভিড়ের মাঝেও এক ঝলক তাকালেই বোঝা যাচ্ছিল, তাহসান সাহেবের মুখটা দেখার মত মনে হয় ওনার উপর টাইফুন বয়ে গেছে,যেন ভেতরে ভেতরে নিজেকেই গালাগালি করছে ।
এক এক করে পরিবারের সবাই এগিয়ে এসে তিয়াশার হাতে উপহার তুলে দিল। নানা রঙের মোড়কে মোড়ানো বাক্সগুলো জমে উঠল তার সামনে , তার মুখে হাত রেখে একে একে বড়রা দোয়া করতে লাগল, আর ছোটরা মিষ্টি খুনসুটি জুড়ে দিল।
এই জন্মদিন তিয়াশার কাছে অন্য সব জন্মদিনের থেকে একেবারেই আলাদা। কারন, আজ তার চারপাশে সবাই থাকলেও সবচেয়ে বড় সত্যি হলো, তার ভালোবাসার মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে একদম ঠিক তার পাশে। সেই অদ্ভুত নিরাপত্তা আর আনন্দে বুকের ভেতরটা ভরে উঠছে। চোখের কোণে অজান্তেই জমে উঠল স্বপ্নের আলো।
কেক কাটার মুহূর্তে ঘরে হইচই লেগে গেল। করতালি, শুভেচ্ছা, হাসি সব মিলিয়ে সেই আনন্দের ঝলক যেন পুরো বাসায় ভরে দিল। কেক মুখে তুলে খাওয়ানোর খেলায় ছোট বড় সবাই মেতে উঠল। এর পর একে একে নানারকম খাবার পরিবেশন হতে লাগল। হাসতে হাসতে, খেতে খেতে কখন যে বেলা গড়িয়ে গেল, কেউ বুঝতেই পারল না।
তবুও ভিড়ের মাঝেও তিয়াশার মনে হচ্ছিল,আজকের এই জন্মদিনের দিনটা তার জীবনের সবচেয়ে স্পেশাল দিন। কারণ, তার হৃদয়ের যে মানুষটিকে এতদিন শুধু নিঃশব্দে অনুভব করেছে, আজ সেই মানুষটিই তার পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে, অথচ সবচেয়ে দৃঢ় উপস্থিতিতে।
খাইয়া দাওয়া শেষ হতেই বাড়ির সামনের ফুলে ভরা বাগানের পাশের বসার জায়গাটা যেনো ছোটদের জন্য এক রকম আড্ডার আসরে পরিণত হলো। চারপাশে গরম আলো ঝিকমিক করছে, হাওয়ার সাথে ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, সবার চোখেমুখে খাওয়ার আনন্দের রেশ এখনও লেগে আছে। হাসাহাসি, গল্পগুজব সব মিলে মুহূর্তটা যেন একেবারেই হালকা আনন্দ।
সবার মাঝেই কেবল অনুপস্থিত মারিয়া। কারণ, খাওয়া দাওয়া শেষ করেই সে তাড়াহুড়ো করে এই বাসা থেকেই টিউশনে চলে গেছে। বাকি সবাই মিলে গোল হয়ে বসে আছে আকাশ, রায়ান, ইউভি, অনন্যা, বৃষ্টি, আরোহীর কোলে ছোট্ট রেজোয়ান, আরেক পাশে নাজিম, জায়ন তার একেবারে গা ঘেঁষে, একটু সংকোচে মুখ নিচু করে বসে আছে তিয়াশা।আর ঠিক মাঝখানে বসে আছে মহারানী
তিয়াশা যদিও মুখ নিচু, লজ্জায় লাল, তবু তার দুই হাতের একটিকে জায়ন দৃঢ়ভাবে নিজের হাতে নিয়ে বসে আছে। মাঝে মাঝে আঙুলের সাথে আঙুল মেলাচ্ছে, কখনো দুই হাতের মধ্যে নিয়ে আঙুলে টানাটানি করছে। সামনে ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন থাকলেও জায়নের চোখে যেন দুনিয়ার আর কিছু নেইশুধু তার ছোট্ট বউ। কে কি ভাবলো তাতে তার কিছু যায় আসে না।
এর মাঝেই আকাশ হেসে উঠে কথা বলল,
__” ভাইয়া আজ আমাদের ভাবির জন্মদিন একটা ট্রিট দাও, ভালো কোন ক্যাফে থে।”
আকাশের এই প্রস্তাব শুনে ইউভি, বৃষ্টি আর নাজিম একসাথে হট্টগোল শুরু করে দিলো, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই যেতে হবে।”কেবল রায়ানই সবার মাঝে চুপচাপ বসে আছে, হয়তো তার চোখে মনে ভেসে উঠছে কারো অনুপস্থিতি। আরোহী আর অনন্যা হাসছে, কিন্তু ওরা কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।
তিয়াশা লজ্জায় ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার বুকের ভেতর দম আটকে যাচ্ছে, চারপাশে তার আপুরা, দুলাভাইরা, বড় ভাইরা বসা তাদের সামনে এই লোকটার এমন নির্লজ্জ খুনসুটি তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। কতবারই বা ইশারা করেছে হাত ছাড়ার জন্য, কিন্তু জায়ন যেন আরো বেশি জেদি হয়ে হাতের টানাটানি চালিয়ে যাচ্ছে। এবার প্রায় বিরক্ত হয়েই উঠলো এই লোকটা যে কতক্ষণ ধরে হাত চেপে বসে আছে।
এদিকে আকাশের কথার জবাবে জায়ন শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
__” ঠিক আছে তোরা যা ঘুরে আয়। আমি অনলাইন পেমেন্ট করে দেবো।”
জায়নের ঠাণ্ডা স্বর শুনে ইউভি ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
__” আমরা যাব মানে ? তুমি যাবে না ?”
জায়ন নির্লিপ্ত মুখে জবাব দিলো,
__” না আমরা যাব না, তোরা যা।”
জায়নের ‘ আমরা ‘ শব্দ শুনে সবাই অবাক হয়ে উঠল।স্পষ্টই বোঝা গেলো, সে নিজেকে যেমন বোঝাচ্ছে, তেমনই তিয়াশাকেও বোঝাতে চাইছে করেছে। অথচ আজ তো তিয়াশার জন্মদিন ,জার জন্য সবাই এত প্ল্যান করল , সেই নায়িকা যদি না যায়, তবে কি করে হয়?
তিয়াশার বুকের ভেতর যেন এক ঝটকায় বজ্রপাত হলো। তার বড় বড় চোখ রাগে কটমট করে জায়নের দিকে গিয়ে থামলো। আর বৃষ্টি আর আরোহী তো সরাসরি প্রতিবাদ করেই ফেললো,
__” ভাইয়া এটা কি করে হয় ? তোমরাই যদি না যাও তাহলে যাওয়ার কি মানে?”
জায়ন ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি টেনে যেন সবার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করলো,
__” আরে তোরা আনন্দ কর, আমার কাজ আছে অনলাইনে, মিটিং আছে একটা সন্ধ্যায়।”
কিন্তু আরোহী কোমল সুরে কাকুতি করে বলল,
__” ভাইয়া অনন্ত তিউ যাক ?”
এই কথাটা শুনেই জায়নের চোখে অল্প বিরক্তির ছায়া ভেসে উঠলো। যদিও মুখের গাম্ভীর্যে তা কেউ বুঝতে পারলো না, তবুও তার গলাটা ভারি হয়ে গেলো,
__” তোমরা যাও বোন, আমি যাচ্ছি না ওকে কে দেখ….”
কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই তিয়াশা হঠাৎ এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। চোখে-মুখে রাগ, বুকের ভেতর যেনো ফেটে যাওয়ার মতো আবেগ। গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ালো। তার দৃষ্টি এমন ভয়ঙ্কর যে মুহূর্তেই চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। সবাই হা করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। পাশে রাখা বাস্কেটে থাকা মহারানীও যেন তার মেজাজ বুঝে অকারণে উচ্চবাচ্য শুরু করলো।
তিয়াশা গর্জে উঠলো, তার কণ্ঠে যেন জমে থাকা সমস্ত অভিমান ছুঁড়ে দিলো,
__” আমি ছোট বাচ্চা আমাকে দেখে রাখতে হবে? কেন হ্যাঁ কেন সব সময় এরকম করবে তুমি আমার সঙ্গে ?এই করা যাবে না, ওই পড়া যাবে না, কোথাও যেতে দেবে না, সাজতে দেবে না? না তো নিজে যাবে না, না আমায় যেতে দেবে । আমার কি কিছু ইচ্ছা করে না? কেন, আর লোকের বউ নেই? বউ তোমার একার আছে তাই না? সবসময় নিজের ইচ্ছামতো চালাবে খবিশ এর বাচ্চা, ইবলিশ একটা।”
কথার ঝড়ে ভিজে উঠলো তিয়াশার চোখ। মুহূর্তেই সে ঘুরে বাসার ভেতরে চলে যেতে লাগলো। তার ভেতরের সমস্ত রাগ, ক্ষোভ, কষ্ট যেনো একসাথে ফেটে বেরিয়ে এলো।
জায়ন হকচকিয়ে গেলো, যেন মাথার উপর থেকে সবকিছু ভেঙে পড়েছে। তারাতারি উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে সবার উদ্দেশ্যে হড়বড় করে বলে উঠলো,
__” আচ্ছা তোরা প্ল্যান কর, আমরাও যাব। আর সাগর দেরও ডেকে নিস।”
কথাটা যেন ভেসে এলো সবার কানে।
তারপরেই তিয়াশার পেছনে দৌড়ে ছুটে গেলো। তাড়াহুড়োয় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
__” আমার জান বউ রাগ করে না প্লিজ, আমরাও যাব তো।”
তিয়াশা থামলো না হেঁটে যেতে যেতে কেবল একবার পিছন ফিরে তাকালো। চোখের দৃষ্টিটা এত ভয়ঙ্কর, এত তীক্ষ্ণ যেন জায়নের বুক ভেদ করে ছিঁড়ে ফেলবে। তারপর আবার ঘুরে মুখ নিচু করে এগিয়ে যেতে লাগলো।
পেছনে বসা সবাই এ দৃশ্য দেখে হেসে হেসে লুটিয়ে পড়লো। নাজিম তো হেসেই বলে উঠলো,
__” এই খাবিশ রে আমার শালি ই একমাত্র টাইট দিতে পারে।”
রায়ান ঠোঁটে হাসি টেনে যোগ করলো,
__” দুলাভাই, এই যে তুমি শালি বলছো, তিউ আপুরে বড় ভাই শুনলে তোমায় টাইট দিয়ে দেবে।”
রায়ান এর কথা শুনে আবারো আকাশ, ইউভি, অনন্যা, বৃষ্টি আর আরোহী হো হো করে হেসে উঠলো। কিন্তু নাজিমের মুখ মুহূর্তেই শুকিয়ে গেলো কারণ রায়ান মিথ্যা বলেনি।
অনন্যা ঠাট্টা করে বলল,
__” তবুও দেখলা, বড় ভাই তিউ আপুকে একা যেতে দিল না।”
আরোহী আবার যোগ করলো,
__” হ্যা ভাইয়ার নাকি মিটিং, এখন আর মিটিং নাই।”
রায়ান মনে মনে একটু বাকা হাসি টেনে ভাবল,
__”নিজের বউকে অন্য কারো সঙ্গে কেন পাঠাবে বড় ভাই? আমি হলে আমিও পাঠাতাম না এই খচ্চরদের সঙ্গে তো মোটেই না।”
হাসাহাসিতে গোটা আড্ডাটা আবার প্রাণ ফিরে পেলো।
এদিকে সিঁড়ি বেয়ে হনহন করে উপরে উঠে যাচ্ছে তিয়াশা। তার মুখে রাগের ছাপ, চোখে কান্নার ভিজে রেখা। পেছনে কাকুতি মিনতি করতে করতে ছুটছে জায়ন।
ড্রয়িং রুম থেকে এ দৃশ্য দেখে সবাই অবাক হয়ে গেলো। রূহেনা বেগম দুশ্চিন্তা মুখে মেহজাবীন বেগমকে বললেন,
__” আপা আবার কি হলো গো ওদের?”
মেহজাবীন বেগম হেসে জবাব দিলেন,
__” আরে মেজ, তুইও না, মেজ আম্মু রাগ করেছে, আর আমার ছেলে এখন মানাচ্ছে এইটাও কি দেখে বুঝিস না?”
সুরাইয়া বেগম হঠাৎ মুখ টিপে হেসে উঠলেন,
__” সত্যি বড় আপু, জায়ন কে এই দেখলে কেউ বলবে, যে সে বউপাগলও হতে পারে।”
বসার ঘরে এভাবেই তিন বেগমের কথাবার্তা চলতে থাকলো। কর্তারা নিজেদের ঘরে আরাম করছে, তাই ড্রয়িং রুমে তাদের উপস্থিতি নেই।
এদিকে করিডোর বেয়ে সামনে হাঁটছে তিয়াশা, তার রাগে ভরা মুখটা এখনও গম্ভীর। পিছনে দৌড়ে আসছে জায়ন, গলায় কাকুতি মিনতির সুর।
__” জান শোন না, সব সময় এই মুখ ফুলিয়ে নিস কিছু হলেই। এগুলো ঠিক না।”
তার কণ্ঠে একসাথে অসহায়তা আর ভালোবাসা। যেন পুরো পৃথিবী থেমে গেছে এই করিডোরের সংকীর্ণ আলো ছায়ার মধ্যে।
তিয়াশা মুখ ফুলিয়ে নিজেদের রুমে গিয়ে দরজা লাগাতে যাবে তখন জায়ন হঠাৎ নিজের জোর খাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দরজাটা নিজেই বন্ধ করে ভেতর থেকে লক দিলো। মুহূর্তে তিয়াশা অবাক হয়ে পেছন ফিরতেই, জায়ন তাকে কোলে তুলে নিয়ে নরম সোফায় বসে পরল। তিয়াশা বিরক্তিতে ফুঁসছে, বুক ওঠানামা করছে রাগে।
__”ছাড়ো তোমার সবসময় বাড়াবাড়ি , ভালো লাগে না আর।”
তিয়াশা রাগী কণ্ঠে ছুড়ে দিলো কথাটা।
জায়ন কিন্তু চুপচাপ কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, যেন চোখের ভেতর দিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। তিয়াশার এলোমেলো চুলগুলো কপালে এসে পড়েছিল, সেগুলো আলতো করে সরিয়ে দিয়ে বলল,
__”বললাম তো যাব, তবুও রাগ কিসের।”
তিয়াশার বুকের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ এবার একটু নরম হতে শুরু করলো। চোখ নামিয়ে টান টান করে জায়নের টিশার্ট মুচড়াতে মুচড়াতে আস্তে আস্তে বলল,
__”আমায় ওদের সঙ্গে একা কেন যেতে দিলে না?”
জায়ন নিঃশ্বাস ফেলে তিয়াশাকে কোলের মধ্যে আরো জাপটে বিয়ে কণ্ঠটা গম্ভীর করে বলে উঠল,
__”সরি বউ, এমন আবদার করো না যার অনুমতি আমি দেব না। তাতে তুমি রাগ করলেও কিছু করার নেই। যদি যেতে হয় আমি নিয়ে যাব।”
এই কথা শুনে তিয়াশার বুক ভারী হয়ে উঠল। সে যেন অসহায় বাচ্চার মতো চোখ বড় করে তাকাল, কণ্ঠটা নরম আর কেঁপে কেঁপে বের হলো,
__”এরকম কর কেন সবসময়? কি হয় গেলে? ওরা তো নিজের মানুষ। তোমার সঙ্গে যাওয়া না যাওয়া সমান।”
তিয়াশার কথা সুনে জায়নের কপাল কুঁচকে গেল ,তিয়াশার গালটা আলতো করে আঙুলে টেনে নিল, তারপর মৃদু অথচ দৃঢ় সুরে বলল,
__”এইসব ইমোশনাল ফেস দেখিয়ে লাভ নেই বউ। তুমি জানো আমি মানব না। যেতে চাও তো আমার সঙ্গে চলো।”
কোনো উপায় নেই বুঝে তিয়াশা কেবল কাঁপা কাঁপা হাতে জায়নের বুকে কয়েকটা ছোট কিল মেরে মাথাটা তার বুকের ভেতর ডুবিয়ে দিল। কণ্ঠ কেঁপে গেল, চোখ জলে ভরে উঠলো,
__”ভালো লাগে না। তুমি একটা বাঘের বাচ্চা।।।”
জায়ন ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে তিয়াশার মাথায় হাত বুলিয়ে যেতে লাগল। এক ধরনের প্রশান্তি ভেসে উঠল তার চেহারায়।
কিন্তু ঠিক তখনই দরজায় টক টক করে নক শোনা গেল। দুজনেই চমকে উঠল। জায়ন মুখ ভার করে তিয়াশাকে একটু সরিয়ে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, দরজা খুলতেই দেখা গেল সামনে রায়ান দাঁড়িয়ে আছে, মুখে হালকা অপ্রস্তুত ভাব।
জায়নের চোখ সংকুচিত হলো, যেন ইশারাতেই বলছে “কি চাই?”
রায়ান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
__”ভাইয়া, বাইকের চাবি টা দেবে একটু?”
জায়ন বিস্মিত হয়ে তাকালো, এই ছেলে বাইকের চাবি দিয়ে কি করবে ? কথাটা চেপে না রেখে বলেই ফেলল,
__”বাইকের চাবি দিয়ে কি করবি?”
__”একটু বাইরে যেতাম।”
__”না, একদম না। যদি কোথাও যেতে হয় ড্রাইভার চাচা কে নিয়ে যাও নয়তো ইউভি বা আকাশ কে বলে দিয়ে আসতে।”
রায়ান কাতর কণ্ঠে মিনতি করল,
__”ভাইয়া প্লীজ, দেও না। পাশেই যাব।”
জায়ন এবার সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
__”মেইন রোড যাবি না তো?”
__”না ভাইয়া, গলি দিয়েই যাব। দেও না প্লীজ।”
জায়ন দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
__”যদি কোন অঘটন ঘটাস, চাপকে লাল করে দেব।”
রায়ান কিছু বলল না শুধু হেসে ফেলল হালকা করে,তারপর জায়ন বলল,
__”ঠিক আছে, দারা।”
জায়ন আর কিছু না বলে রুম থেকে চাবি এনে রায়ানের হাতে ধরিয়ে দিল। আর একটাই বাক্য
বের হলো,
__” সাবধানে কিন্তু ।”
রায়ান চাবিটা নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল
__” ওকে ভাইয়া ।”
পড়ন্ত বিকেল। শহরের কোলাহল চারদিকে। রাস্তায় ব্যস্ত মানুষ, গাড়ির হর্ন, ধুলোবালি উড়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তার এক কোণে ছোট্ট একটা চটপটির দোকান টিনের ছাউনি, ধোঁয়া উড়ছে ভাজার কড়াই থেকে। সেই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মারিয়া ও তার টিউশনের কয়েকজন বন্ধু। হাসি ঠাট্টার ভেতর দিয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল।
__”মামা, ঝাল বেশি করে দেবে কিন্তু।”
মারিয়া এই বলতেই সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
মারিয়া চঞ্চল চোখে মামার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
__”হ্যা, একটু বেশি করে দিও মামা, যাতে নেক্সট টাইম খাওয়ার কথা ভুলে যায়।”
ঠিক তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো গভীর গম্ভীর এক কণ্ঠ। সেই কণ্ঠস্বর শুনে মারিয়ার বুক ধক করে উঠল। সে কণ্ঠ খুব ভালো করেই চেনে।
__”শাকচুন্নি, এখানে কি করিস?”
চমকে পেছনে ফিরতেই চোখে চোখ পড়ল রায়ানের সঙ্গে। তার চোখে তীব্র রাগ, মুখে গম্ভীরতা ,যা দেখে মুহূর্তেই মারিয়ার বুক কেঁপে উঠল।মনে মনেই
বলে উঠলো,
__” এই গন্ডারের বাচ্চা এখানে কি করে ?”
মুখ শুকিয়ে গেলেও নিজের ভয় ঢেকে, কাঁপা গলায় বলল,
__”চ চ চটপটি খাচ্ছিলাম ভাইয়া।”
মারিয়ার কথা শেষ হতেই রায়ানের চেহারা আরো কুঁচকে উঠল, চোখ লালচে হয়ে আছে যেন রাগে জ্বলে যাচ্ছে। ঠোঁট শক্ত করে চাপা গলায় বলল,
__”ডোন্ট কল মি ভাইয়া। তোকে বোন বানানোর ইচ্ছা অনেক বছর আগেই বস্ত্র বিতরনে বিলিয়ে দিয়েছি।”
কথাটা শুনে মারিয়ার বুকটা হঠাৎ আঁকড়ে ধরল। মাথা ঘুরে গেল যেন। সে বুঝতেই পারছে না রায়ান কি বোঝাচ্ছে। শুধু ভাবছে হয়তো ও তাকে পছন্দই করে না, তাই বোন ভাবতে চায় না। বুকটা হঠাৎ কষ্টে ভারী হয়ে উঠল। তাই দাঁতে দাঁত চেপে, গলায় কষ্ট ঢেকে বিরক্তি নিয়ে বলল,
__”তাহলে এখান থেকে বিদায় হও। এখানে কি করছ?”
রায়ান মারিয়ার কথাকে পাত্তাই দিল না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে এক ঝলক তাকাল তার পাশে দাঁড়ানো দুই ছেলের দিকে। চোখে আগুন জ্বেলে উঠলো ,ঠোঁট শক্ত করে বলল,
__”ছেলে গুলো কারা? আর আমার কাছে খুব ভালো চটপটি আছে। সেই চটপটি খেতে না চাইলে ১ মিনিটের মধ্যে এখানে যেন তোর ছায়া না দেখি।”
এই কথায় মারিয়া বিরক্তিতে ফুঁসে উঠল, ঠোঁট কেঁপে গেল,
__”টিউশন ব্যাচে একসঙ্গে পড়ি। কেন? ওকে আমার ছায়া দেখতে হবে না, তুমি বিদায় হও এখান থেকে।”
রায়ানের মুঠি শক্ত হয়ে গেল, দাঁত চাপা পড়ল। কণ্ঠ ভরাট হয়ে উঠল রাগে,
__”কাল থেকে আর টিউশন যেতে হবে না। ৫১ সেকেন্ড বাকি কিন্তু।”
মারিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, বিভ্রান্তি আর ক্ষোভ মিলেমিশে বলল,
__”কেন? কিসের জন্য?”
রায়ান দাঁত চেপে গর্জে উঠল,
__”আমি বলেছি তাই, ৪৩ সেকেন্ড বাকি কিন্তু।”
মারিয়ার চোখে পানি জমতে লাগল, আবার রাগও চেপে ধরল। মনে মনে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছিল,
“তুমি বলার কে?” কিন্তু ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে ধীম গলায় বলল,
__”তুমি বলার কে? একটু আগেই তো বললে তোমার বোন লাগিনা।”
রায়ানের চোখে আগুন জ্বলছে, গলা নরম না হয়ে বরং আরো শক্ত হলো,
__”তুই ফিউচার লাগিস। বোন লাগিস না তাই বলেছি। এবার ওঠ। ৩০ সেকেন্ড বাকি।”
মারিয়া এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল এই ছেলে কি বলছে বুঝে ঊঠতে পারছে না ,বুক ধক করে উঠছে, গলাটা শুকিয়ে গেল।
__”কোথায় উঠব?”
মারিয়ার প্রশ্ন শুনে রায়ান মনে মনে এক মুহূর্তের জন্য বলল, “কোলে ওঠ।” ঠোঁটে ক্ষণিকের হাসি এলো, কিন্তু সেটা সে গোপন করেই রাখল।
তারপর উচ্চ গলায় বলল,
__”বাইকে ওঠ, বেশি না বোকে শাকচুন্নি। ১৯ সেকেন্ড বাকি কিন্তু, তারপর তোর খবর আছে।”
সবাই তাকিয়ে আছে। আশেপাশের মানুষের দৃষ্টি জ্বালিয়ে দিচ্ছে মারিয়াকে। গাল লাল হয়ে গেছে লজ্জায়। বিরক্তি আর অপমানে বুক কেঁপে উঠল,
__”এরকম করে বললে কেউ উঠবে না। ভালো করে বলা যায় না।”
রায়ানের চোখ এবার চকচক করে উঠল, ঠোঁটে চাপা হাসি এলো।
__”কারো, উঠতে হবে না। যার উঠতে হবে তাকেই বলছি ,’বেবিগার্ল, ক্যান ইউ প্লীজ সিট অন মাই ব্যাক সিট?’ এর থেকেও ভালো করে বলব বল। বাট প্রোসেস কিন্তু অন্য হবে। ৭ সেকেন্ড বাকি কিন্তু, এরপর যা হবে বুঝে নিস।”
মারিয়া বুঝল আর উপায় নেই। জানে যদি এখন না ওঠে, রায়ান এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে আর সবার চোখ তার দিকে। চোয়াল শক্ত করে, চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে বাইকে উঠে বসে গেল। ঠোঁট কেঁপে উঠল,
__”চলো।”
রায়ান এক তীব্র দৃষ্টি ছুড়ে দিলো ওই দুই ছেলের দিকে। সেই দৃষ্টিতে যেন আগুন ছড়াল। চোখেই বলে দিল “নেক্সট টাইম এই মেয়ের আশেপাশে যেন না দেখি।”
ছেলেগুলো চুপসে গেল ভয়ে, মারিয়ার বন্ধুরা হা করে তাকিয়ে রইল।
রায়ান ঠোঁটে ক্ষণিকের মুচকি হাসি নিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। চারপাশে ঝড় তোলার মতো গর্জন তুলে বাইক ছুটে গেলো। সাথে তার কিশোরী মারিয়া, যাকে সে কেবল নিজের বলে দাবি করতে চায়।
ঘরের ভেতরটা যেন আলো অন্ধকারের খেলায় ভরা। সাদা হালকা লাইটে পুরো রুম উষ্ণ একটা আভা ছড়াচ্ছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তিয়াশা বারবার জামা বদল করছে। বিছানার একপাশে গাদা গাদা করে রাখা তিন চারটা ড্রেস ছড়ানো, আর আয়নায় তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। ঠোঁট একটু ফুলিয়ে আছে, চোখে যেন আগুনের ঝিলিক,
__” আমি যাবই না , ভালো লাগে না এই নিয়ে চার
বার ড্রেস চেঞ্জ করলাম ।”
তার কণ্ঠে কষ্ট মেশানো অভিমান।
বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকা জায়ন দৃশ্যটা উপভোগ করছে নিজের মতো করে। তার ঠোঁটে খেলা করছে বাঁকা একটা হাসি, চোখের দৃষ্টিতে গভীরতা, মালিকানার ছাপ স্পষ্ট।
__”কি করবো আমার বউ যা পরে তাতেই সুন্দর লাগে আমি চাই না আমার বউ এর দিকে কেউ তাকাক। সে তুই যদি যেতে না চাস তাহলে আমারই ভালো ।”
কথার সুরে হাসি থাকলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে তার নিজের অধিকারবোধ। যেন সে প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিচ্ছে।
তিয়াশা গলা পর্যন্ত লাল হয়ে গেছে রাগ আর লজ্জায়। জানে, এই মানুষটা একবার যদি সত্যি করে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আর কোন শক্তি নেই যেটা দিয়ে তাকে রাজি করানো যায়। তাই এবার অন্য পথ বেছে নিল। ধীরে ধীরে বিছানার দিকে এগিয়ে এসে, দুই হাত দিয়ে জায়নের গলা জড়িয়ে ধরল। তার মুখে আদুরে পাউট, চোখে ভেজা ভেজা আবেদন।
__” আর চেঞ্জ করতে ইচ্ছা হচ্ছে না , এইটা পরে যাই প্লীজ ড্যাডি।”
‘ড্যাডি’ শব্দটা যখনই সোনে তখনই যেন বজ্রপাতের মতো আঘাত করে জায়নের সারা শরীরে। মুহূর্তেই তার ভেতরে অস্থিরতা তৈরি হলো। বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ যেন কানে বাজতে লাগল। দৃষ্টি গভীর হয়ে গেল, শ্বাস দ্রুততর।
অমনি তিয়াশাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে জায়ন নিচু গলায় বলে উঠল,
__” একটা শর্ত আছে।”
তিয়াশার মনে হলো, এই লোকের মনের ভেতর কি চলছে সে একদম জানে। বিয়ের পর থেকে প্রতিটা দিনই তার চোখে চোখে রেখেছে, বুঝে গেছে সব ইঙ্গিত। তাই এবার সেও খেলার ছলে তার কলার টেনে নেশালো কণ্ঠে জবাব দিল,
__” কি ড্যাডি? ”
জায়নের চোখে যেন ঝড় নেমে এলো। সে হঠাৎ করে তিয়াশাকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। মুখে কষ্টের ছাপ, কিন্তু চোখে প্রচণ্ড দহন।
__” এরকম করিস না বউ প্লিজ এখন ,মাথা খারাপ হয়ে যায়।”
তিয়াশা হেসে ফেলল, চোখে মুখে দুষ্টুমি, ঠোঁটে চঞ্চল হাসি। সে জানে কিভাবে জায়নের ধৈর্য নাড়াতে হয়। তাই গলার স্বর নামিয়ে কৌতুকের সুরে বলল,
__” আরে তুমি শর্ত টা বলবে তো কি? ”
জায়ন এবার আর ধরে রাখতে পারল না। আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে তার কানের পাশে ঠোঁট নিয়ে গেল। নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় তিয়াশার বুকের ভেতর কাঁপুনি ধরল। ভারী গলায় বলল,
__” আজকে রাতেও যেন শুধু ড্যাডি বলা হয় ।”
কথাটা শুনে তিয়াশার শরীর বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠল। গাল মুহূর্তেই লাল হয়ে উঠল, চোখে লাজুক ঝিলিক। তবুও নিজেকে সামলাতে হবে। তাই জায়নকে ঠেলে দিয়ে হাসি চাপা কণ্ঠে বলল,
__” সেটা রাতে দেখা যাবে এখন জাও রেডি হয়ে আসো ।”
জায়নের চোখে ভেসে উঠল তৃপ্তির ছায়া, আর তিয়াশার মুখে লাজুক কিন্তু বিজয়ী হাসি। দুজনের এই খুনসুটি যেন ঘর ভরিয়ে তুলল এক অদ্ভুত উষ্ণতায়।
রুমের বাইরে হয়তো সবাই অপেক্ষা করছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের কাছে পৃথিবীর অন্য কেউ নেই।
সবাই গাড়ি থেকে নামতেই যেন আলোর মেলা। চারতলা জুড়ে বিশাল বিল্ডিং, বাইরের দেয়ালে কাচের ঝিকিমিকি আর সোনালি আলোয় সাজানো রাজকীয় শোভা। দূর থেকে দেখলেই মনে হয় যেন কোনো আধুনিক প্রাসাদের সামনে এসে দাঁড়ানো। প্রবেশদ্বারের সামনে ফোয়ারার নীলাভ আলোয় পানির ফোঁটা হাওয়ায় নাচছে, দুপাশে সারি সারি ফুল আর মোমবাতির সুগন্ধে বাতাস ভরে উঠেছে। গাড়ির হর্ন, বাইরের মানুষের হাসাহাসি আর চারদিকের ব্যস্ততা মিশে এক অন্যরকম উৎসবের আবহ তৈরি করল।
জায়ন তিয়াশার হাত ধরে নামলো, যেন এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়তে রাজি নয়। ইউভি অনন্যার হাত ধরা, আকাশ আঁকড়ে রেখেছে আরোহীকে। নাজিম এসেছে বৃষ্টির হাত ধরে, আর রেজওয়ানকে রেখে আসা হয়েছে বাসায়। অন্যদিকে রায়ান আর মারিয়া এগিয়ে আছে সামনের দিকে, আর সাগর, আহান, পলাশ, জেমস আগে থেকেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সবাই মিলে এমন একটা মুহূর্ত তৈরি হলো যা চোখ এড়ানো অসম্ভব, কিন্তু সবার দৃষ্টি তবুও বেশি আটকালো এক জোড়া দম্পতির উপর জায়ন আর তিয়াশা। তাদের একসাথে দাঁড়ানোতেই যেন অন্যরকম এক জ্যোতি ছড়াচ্ছে।
ভেতরে ঢুকতেই স্বয়ংক্রিয় গ্লাসের দরজা খুলে গেল। এক নিমিষে যেন ঢুকে পড়লো বিদেশি কোনো সিনেমার সেটে। মেঝেতে চকচকে সাদা মার্বেল, মাথার উপর ঝলমলে সোনালি ঝাড়বাতি, দেয়ালে আধুনিক আর্টের ফ্রেমে সাজানো শিল্পকর্ম সব মিলিয়ে চারপাশে এক জাঁকজমক ছড়িয়ে পড়ছে।
সাগর, পলাশ, আহান আর জেমস হাসিমুখে তিয়াশাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো, হাতে উপহার তুলে দিল। মুহূর্তটা ছিল উচ্ছ্বাসে ভরা। চারপাশের টেবিলগুলো ঝিকিমিকি আলোয় ভাসছে, গ্লাসে প্রতিফলিত মোমবাতির শিখা নাচছে যেন। সবাই টেবিল ঘিরে বসলো, চলছে অর্ডার দেওয়া, হাসাহাসি, খুনশুটি।
এই পরিবেশেই হঠাৎ তিয়াশা নরম গলায় জায়ন এর কানে কানে বললো,
__” বর আমি ওয়াশরুম যাব।”
জায়ন থেমে ধীরে বললো,
__” চল আমি যাচ্ছি।”
তিয়াশা চোখ উল্টে বলল,
__” লেডিস ওয়াশরুম তুমি কি করতে যাবে? আমি একাই যাচ্ছি।”
জায়ন একটু থেমে গম্ভীরভাবে উত্তর দিলো,
__” আচ্ছা আরোহী বা অনু কে নিয়ে যা একা যেতে হবে না।”
তিয়াশা আর কথা না বাড়িয়ে আরোহী আর অনন্যাকে নিয়ে গেল। কিন্তু জায়নের মন বসলো না। প্রতি মুহূর্তে সে পেছন ঘুরে তাকাচ্ছে, চোখে অস্থিরতা। যেন তার বুকে এক অজানা অস্বস্তি। সাগর মজা করে বললো,
__” কি রে মামা, ভাবি তো ওয়াশরুমেই গেছে, এত ঘুরপাক খাচ্ছিস কেন?”
সাগরের কথায় পলাশ যোগ দিলো,
__” আরে ভাই, তোর বউকে কেউ নিয়ে যাবে না। মানলাম, আমাদের ভাবি অনেক সুন্দরী—চোখে পড়ার মতো…”
কথাটা শেষ হবার আগেই গর্জে উঠলো জায়ন। সেই গর্জন শুনে টেবিলের চারপাশ হিম হয়ে গেল।
__” বাঁ* তোদের কতবার বলি তবুও ভুলে যাস, বলেছি না, ওকে নিয়ে একটাও কথা বলবি না!”
সবার মুখ শুকিয়ে গেল। আহান ফিসফিস করে পলাশের কানে বললো,
__”ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে তুললি কেন?”
পলাশ হতভম্ব গলায় উত্তর দিলো,
__”ভাই, বিশ্বাস কর ভুলে গেছিলাম।”
ইউভি দ্রুত শান্ত করার চেষ্টা করলো,
__”ভাইয়া, প্লীজ শান্ত হও। আর কেউ কিছু বলছে না।”
কিন্তু জায়নের চোখে রাগ, ঠোঁটে কড়া কথা,
__”নেক্সট টাইম আমার বউ নিয়ে একটা কমেন্ট করবি না। তোদেরও বলছি।”
পরিবেশ জমাট বাঁধলো, হাসাহাসি এক নিমিষে থেমে গেল। তখনই আকাশ মজার ছলে বললো,
___”আরে বড় ভাই, আমাদের বউরাই এত ডেঞ্জারেস, আস্তাগফিরুল্লাহ, আমরা যদি কিছু করি তো আমাদের জানাজা পড়ে যাবে। তুমি টেনশন নিও না। হি হি।”
তার কথায় হালকা হাসি ছড়ালো চারপাশে, কিন্তু জায়নের দৃষ্টি তখনো টানটান। বারবার মনে মনে বলছে,
__”এখনো আসে না কেন ওরা…”
তিয়াশারা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে টেবিলের দিকে যাচ্ছিল। চারপাশে হালকা আলো, গ্লাসের দেয়ালে ঝিকমিক করছে রঙিন আলো, নরম সুরের গান ভেসে আসছে সবকিছুই যেন এক আরামদায়ক অনুভূতি দিচ্ছিল। ঠিক তখনই, হঠাৎ এক ছেলেটি হাতে কফি নিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল, আর অন্যমনস্ক হয়ে তিয়াশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল। মুহূর্তেই গরম কফি ঝরে পড়ল তিয়াশার কোমল হাতে
“আহ!” ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে তিয়াশার কণ্ঠ কেঁপে উঠল।
আরোহী আর অনন্যার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, তারা ছুটে এসে হাত ধরতে গেল। কিন্তু তার আগেই ছেলেটি অপরাধবোধে ভরা মুখে তিয়াশার হাত ধরে বলল
__”সরি ম্যাম, সরি আমি দেখিনি ম্যাম আই এম এক্সট্রিমলি সরি!”
তার কণ্ঠে আতঙ্ক, অপরাধবোধ। তিয়াশার চোখের কোণ ভিজে উঠেছে ব্যথায়, কিন্তু তবুও শান্ত থাকার চেষ্টা করে , তিয়াশা হাত ছড়াতে ছড়াতে কষ্ট সামলে বললো,
__”ইটস ওকে ভাইয়া।”
ছেলেটি যেন নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিল না।
__”না না আমি খুব গিল্টি হচ্ছি ম্যাম।”
এই বলে সে এক মুহূর্তও দেরি করল না, তিয়াশার হাত শক্ত করে ধরে ক্যাফে কাউন্টারের দিকে টেনে নিল। পেছন পেছন অনন্যা আর আরোহীও দৌড় দিল, তাদের চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক ।
তিয়াশা বারবার কাঁপা কণ্ঠে বলছিল,
__”ভাইয়া প্লীজ হাতটা ছেড়ে দিন।”
কিন্তু ছেলেটা কেবল অপরাধবোধে ডুবে গেছে।
__”না না, আইস দিতে হবে এখনই।”
সে দ্রুত বরফ নিয়ে এসে তিয়াশার হাতে ডলতে লাগল। বরফের ঠাণ্ডা স্পর্শে ব্যথা কিছুটা কমলেও তিয়াশার বুকের ভেতর কেমন একটা ভয় কুঁকড়ে উঠছিল। ছেলেটির দৃষ্টি হঠাৎ স্থির হলো তিয়াশার মুখে, আর সে মুহূর্তেই যেন থমকে গেল তার চোখে বিস্ময় আর মোহ।
এদিকে অনন্যা আর আরোহীর শান্ত সুর যেন এক ঝটকায় থেমে গেল নজর গেল দূর থেকে ভারী পদক্ষেপে ঝড়ের বেগে আসছিল জায়ন। তার চোখে আগুন, চোয়ালে শক্তির রেখা, কপালে শিরা স্পষ্ট। চারপাশের মানুষজনও বুঝতে পারছিল, কিছু ভয়ংকর ঘটতে যাচ্ছে।
অনন্যার ঠোঁট কেঁপে উঠল, সে আতঙ্কে বলেই ফেলল
__”আপু… ভাইয়া।”
তিয়াশার বুক হঠাৎ ধক্ করে উঠল। সে মরিয়া হয়ে ছেলেটির হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ছেলেটি যেন এক অদ্ভুত ঘোরে বন্দি, হাত ছাড়ছে না বরং আরও শক্ত করে ধরে রাখল।
ঠিক তখনই বজ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল জায়ন। মুহূর্তেই ছেলেটিকে এক ঝটকায় তিয়াশার থেকে ছাড়িয়ে দিল, আর চোখ মুখে ঘুষি বসিয়ে মারতে শুরু করল। প্রতিটি ঘুষির সঙ্গে যেন ভেতরের আগুন ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে। জায়নের চিৎকার, তিয়াশার কান্না, আর লোকজনের হইচই মিলে যেন পুরো রেস্টুরেন্ট কেঁপে উঠল।
তিয়াশা তার হাতে আঁকড়ে ধরে থামাতে চাইছে, তার কণ্ঠ কাঁপছে,
__”প্লীজ থামো, এইটা এক্সিডেন্ট ছিল, মেরো না।”
কিন্তু জায়নের গর্জন গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল,
__”কু* বাচ্চা, তুই ওকে ছোঁয়ার সাহস পেলি কোথা থেকে?”
চারপাশের মানুষ বিস্ময়ে জমে গেছে, কেউ কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না। ছেলেটা অসহায়ভাবে কাতরাচ্ছে, তবুও জায়নের হাত থামছে না।
ইউভি ছুটে এসে কপালে হাত দিয়ে দাঁড়াল, আরোহী আর অনন্যা ভয়ে একে অপরকে আঁকড়ে ধরল। সাগর, আহান আর নাজিম মরিয়া হয়ে জায়নকে ধরে সরানোর চেষ্টা করল।
জায়নের চোখ তখনও জ্বলছে, সে দাঁত চেপে বলল,
__”ছাড় বলছি ছাড়, ওর চোখে ছিল কু দৃষ্টি। ওর সাহস কি করে হলো আমার বউ এর গায়ে হাত দেয়?”
জায়ন এর অবস্হা দেখে সাগরের গলা রাগে কেঁপে উঠল,
__”এইটা তোর ঘর না, পাবলিক প্লেস! এরকম করিস না।”
কঠিন চেষ্টায় বন্ধুরা জায়নকে টেনে বাইরে নিয়ে গেল। তিয়াশা পেছন পেছন দৌড়ে এলো, চোখ ভিজে গেছে, কণ্ঠ কাঁপছে।
সে কাঁপা হাতে জায়নের হাত ধরল,বোঝানোর চেষ্টা করল
__”ওর কোন দোষ নেই, আমার হাতে…”
কিন্তু বলতে পারল না, তার আগেই জায়ন ঝড়ের মতো নিজেকে ছাড়িয়ে তিয়াশার কাছে এগিয়ে এলো কারন জায়ন সেই ছেলের চোখে দেখেছে তিয়াশাকে নিয়ে মোহ। কপালে শিরা ফুলে উঠেছে, চোখ লালচে আগুনের মতো জ্বলছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। সে তিয়াশার মুখ শক্ত করে ধরে কর্কশ গলায় গর্জে উঠল,
__” ওই ছেলেকে ছোঁয়ার অনুমতি কি করে দিস, তোকে বলেছিলাম না পরপুরুষের ছোঁয়া লাগাবি না তোর গায়ে , মনে তো হচ্ছে …. ”
চারপাশ থমকে গেছে। চারদিক থেকে মানুষের ভিড়, তবু যেন সবাই স্তব্ধ। কেউ সাহস করছে না এক পা এগোনোর। তিয়াশার চোখ ভিজে উঠছে ভয়ে আর অপমানে।
একটু থেমে আবারও বজ্রপাতের মতো কণ্ঠে জায়ন বলে উঠল,
__”আমার সামনে থেকে এখন সর, নইলে আমি কি করবো ঠিক নেই ।”
তার গলা কাঁপছে রাগে, বুকের ভেতর যেন আগুন দাউ দাউ করছে। এরপর হঠাৎ তিয়াশার মুখ ছেড়ে নিজের চুল মুঠি করে ধরে টানতে লাগল। চারপাশে কোলাহল, কিন্তু তার ভেতরের ঝড় বাইরের সব শব্দকে ঢেকে দিচ্ছে। যেন এই মেয়েটির সামনে দাঁড়ালে আর নিজেকে সামলাতে পারবে না। তাই হনহনিয়ে রাস্তার দিকে বেরিয়ে গেল নিজেকে এই মুহূর্তে দূরে রাখাই তার একমাত্র উপায়।
তিয়াশা ভেঙে পড়া হৃদয়ে কাঁদতে কাঁদতে পেছন পেছন ছুটতে লাগল। চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তবুও থামছে না।
তখনই ইউভি সামনে এসে বোনকে থামাতে চাইলো, তার কণ্ঠ কাঁপছে চিন্তায়
__”বনু, কথা শোন। এখন যাস না। ভাইয়ার রাগ কোমলেই নিজেই চলে আসবে।”
কিন্তু তিয়াশা যেন সবকিছু অস্বীকার করে দিল। কান্নার ভেজা মুখ নিয়ে ইউভির হাত সরিয়ে দিল। রাস্তার দিকে ছুটল, এদিক ওদিক দেখল না, সামনে শুধু জায়নকে খুঁজছিল।
তার কণ্ঠ ভাঙা, বুক থেকে উঠে আসছে হাহাকার,
__”শোনো আমার কথা টা..”
আর বাক্য শেষ করতে পারল না শেষ হবার আগেই হঠাৎ করেই চারপাশ কেঁপে উঠল। ব্যস্ত রাস্তায় চাকা ঘষার তীক্ষ্ণ শব্দ, হর্নের বিকট চিৎকার, আর মুহূর্তের মধ্যেই এক ভয়ঙ্কর ধাক্কা।
তিয়াশার শরীর ছিটকে পড়ল দূরে, রক্তে ভিজে উঠল রাস্তার পিচ।
চারদিক থেকে হাহাকার উঠল। ইউভি চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে বুক ফেটে চিৎকার করে উঠল,
__”বনু!”
জায়ন ঠিক তখনই হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে ছিল। হঠাৎ সেই ভয়ঙ্কর শব্দে তার নিঃশ্বাস আটকে গেল। সে পেছন ফিরে তাকাল। চোখের সামনে নিজের পৃথিবীটা থমকে যেতে দেখল। রক্তে ভেজা তিয়াশার দেহ মাটিতে পড়ে আছে।
জায়নের কানে কিছু আর ঢুকছে না। চারপাশে মানুষের চিৎকার, অনন্যা আরোহীর কান্না, রায়ান মারিয়ার আর্তনাদ সব একসাথে কানে বাজছে, তবুও তার মাথায় যেন এক অচেনা ঝড় বইছে।
ইউভি ছুটে এসে বোনের রক্তাক্ত দেহ বুকে তুলে নিল। তার কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠল ,
__” বনু বনু….
কিন্তু জায়নের পা যেন মাটিতে আটকে গেছে। সামনে এগোতে পারছে না। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসছে। বুক ধুকপুক করছে, শরীর কাঁপছে, আর হঠাৎই তার নাক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ল।
তবুও সে কাঁপতে কাঁপতে এগোল, প্রতিটি পদক্ষেপে বুক ফেটে যাচ্ছে, হাত কাঁপছে, চোঁখ থেকে বেয়ে পড়ছে পানি , বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু ঝাপসা লাগছে সব কিছু ধীর পায়ে সেখান গিয়ে নিচে পড়ল ইউভির কাছ থেকে জোরে ছিনিয়ে নিল তিয়াশাকে।
রক্তে ভেজা মুখটা হাতের তালুতে তুলে ধরে এক পাগলামির হাসি নিয়ে , চোঁখ এ পানির ধারা ,নাক বেয়ে গড়িয়ে পরছে রক্ত, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।কাঁপা গলায় ডাকতে লাগল মুখে
__”জা জান এ এই জা জান… জান রে জা ন চো চো খ খোল জা জান”
কিন্তু তিয়াশার নিথর দেহ কোনো সাড়া দিল না। তার চোখগুলো যেন গভীর ঘুমে ডুবে আছে, ঠোঁট নিস্তব্ধ কোনো শব্দ নেই। এক মুহূর্তের জন্য জায়নের মনে হলো সময় থেমে গেছে।
আকাশ যেন ভেঙে পড়ল জায়নের উপর। চারপাশের রঙ, শব্দ সব মিলিয়ে অন্ধকারে ডুবে গেল , তিয়াশাকে বুকে চেপে ধরে সে ভয়ঙ্কর আর্তনাদে কেঁদে উঠল কান্নার সেই শব্দ এতটাই হাহাকারময় যে মনে হলো পৃথিবীর বুক ফেটে যাবে।
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬২
__”জা জান……”
__” দে দেখ না আমার বউ চোখ খুলছে না , চোঁখ খুলতে বল না ।”
চারপাশের ভিড় নির্বাক। কেউ কেউ মুখ ঢেকে কাঁদছে, কেউ আবার চেয়ে আছে অবিশ্বাসে। অনন্যা আরোহী মারিয়া বৃষ্টি আকাশ ইউভি ভেঙে পড়ছে কান্নায়, রায়ান আর নাজিম একে অপরকে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করছে। সাগর আহান নিথর হয়ে দাড়িয়ে জেমস আর পলাশ ছুটে গেছে গাড়ি আনতে , তবুও জায়নের কণ্ঠ সবচেয়ে করুণ, সবচেয়ে বেদনাদায়ক,জায়নের গলা ছিঁড়ে যাওয়া আর্তনাদ,
__”কে কেউ গাড়ি নিয়ে আয় প্লিজ তারাতারি।”
চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল, শুধু কান্নার শব্দ গড়িয়ে পড়ছে আকাশ ভেদ করে।
