তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৪

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৪
নীল মণি

ব্যাস্ত শহরের রাতের কৃত্রিম হলদে আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে । মানুষের ব্যস্ততা এই শহর টাকে যেন এক অন্যরূপ দিতে থাকে রোজ , জীবনের প্রতিটি ছন্দ এক নতুন ধারায় বাজতে থাকে । কিন্তু এই জীবনের নতুন ধারা মাঝে মাঝে অন্ধকার নামিয়ে আনে কিছু মানুষের বুকে , হাহাকার করে দেয় প্রতিটি ছন্দ , ও ছন্দ না বরং জ্বলতে থাকে এক মনের গহীনের দহন।
এই ব্যস্ত শহরের বুকে এক স্বামী তার স্ত্রীর জন্য বুক চাপড়ে যাচ্ছে ,বুকের ভেতর তখন শুধু ঝড়, অমানুষিক এক দহন। নিথর তিয়াশাকে বুকে নিয়ে তার মনে হচ্ছিল বুক ফেটে ভেতরের সব রক্ত বেরিয়ে আসছে। শ্বাস যেন গলায় আটকে যাচ্ছে, তবুও কণ্ঠ ছিঁড়ে বেরোচ্ছে একটাই আর্তনাদ,

__”জা জান।।।।।।জান চোখ খোল প্লিজ।।।।”
চারপাশে মানুষের চিৎকার, দৌড়াদৌড়ি, হর্নের শব্দ, কান্না সবকিছু গুঞ্জনের মতো বাজছে দূরে। কিন্তু জায়নের কানে কিছুই পৌঁছাচ্ছে না। পৃথিবী থেমে গেছে, চারপাশ অন্ধকার, শুধু তার চোখের সামনে রক্তে ভেজা তিয়াশা।
জেমস গাড়ি আনতেই, সাগর ভাঙা গলায় কাঁপতে কাঁপতে তার কাঁধে ঝাঁকিয়ে উঠল,
__”ভাই, ভাবি কে গাড়িতে ওঠা।”
এই কথাটা যেন বাজ পড়ার মতো আঘাত করল। মুহূর্তেই জায়ন পাগলের মতো লাফিয়ে দাঁড়াল,কাঁপা হাত দিয়ে তিয়াশাকে আরও শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে, পা দুলতে দুলতে, হোঁচট খেতে খেতে ছুটল গাড়ির দিকে, প্রতিটি পদক্ষেপে তার শরীরটা ভেঙে পড়ছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, নাক বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, কিন্তু সে থামছে না। কারণ তার বুকে আছে তার পুরো পৃথিবী, তার প্রাণ, তার বেঁচে থাকার নিঃশ্বাস,তার প্রণয় এর একমাত্র নারী।
বৃষ্টি আর ইউভি ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে হাত বাড়ালো। ইউভির বুক ফেটে যাচ্ছে বোনকে এভাবে দেখে। ভাঙা গলায় সে কেঁদে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

__”ভাইয়া বনু কে আমার কাছে দেও… আমি নিচ্ছি…”
জায়নের মুখটা তখন লালচে, চোখ দুটো বেয়ে গড়িয়ে পরছে পানি তবুও যেন আগুন জ্বলে উঠলো । প্রতিটি শিরা ফেটে ব্যথায় কাঁপছে,হঠাৎই গর্জনের মতো ফেটে বেরোল তার কণ্ঠ,
__”একদম ছুঁবি না। একবারও না! আমার জান দেখছিস না আমার কোলে ঘুমোচ্ছে,ওকে আলাদা করতে চাস আমার থেকে?”
সেই আর্তনাদে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ইউভির চোখে ভয় আর অসহায় কান্না জমে উঠল, তবুও তার বুক কেঁপে উঠল ভাইয়ের সেই ভয়ঙ্কর দৃঢ়তায়।
সাগর আর জেমস তাড়াহুড়ো করে গাড়ির দরজা খুলে দিল। জায়ন ঝড়ের মতো ভেতরে বসে পড়ল। তিয়াশার মাথাটা কোলে তুলে ধরে বুকের সাথে এমনভাবে চেপে রাখল, যেন তাকে একফোঁটা বাতাসও ছুঁতে না পারে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে জামা, বুক, হাত কিন্তু কিছুই টের পাচ্ছে না সে।
ইউভি গিয়ে সামনে বসলো , জেমস কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং ধরতেই, জায়ন চিৎকার করে উঠল,

__” তাড়াতাড়ি হসপিটাল চলো! দেরি করলে আমি সব শেষ করে ফেলব, সব শেষ করে ফেলব তাড়াতাড়ী চলো।”
হাত কাঁপছে জেমস এর। তার চোখ ভিজে গেছে পানিতে। কোনোদিন এভাবে ভাঙা জায়নকে দেখেনি সে। তবুও গাড়ি ছুটে চলল রাতের অন্ধকার ছিঁড়ে। চারপাশের হেডলাইট ছুটে যাচ্ছে, বৃষ্টির ফোঁটায় কাচ ঝাপসা হয়ে আসছে।
পেছনে বসে জায়ন পাগলের মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছে। বারবার তিয়াশার কপালে চুমু বসিয়ে যাচ্ছে ।সে তিয়াশার রক্তে ভেজা মুখটা দু হাতের তালুতে ধরে বারবার ডাকছে,

__”জা জান….জান আমার সাথে কথা বল…..”
তার চোখ দিয়ে অশ্রু নেমে আসছে নদীর মতো। কণ্ঠ ছিঁড়ে যাচ্ছে, বুক থেকে প্রতিটি শব্দ বেরোচ্ছে ছিঁড়ে আসা যন্ত্রণার মতো।
__”ই ইউভি, দে দেখ তোর বো বোন কেমন রাগ করে আছে, কথা বলতে চাচ্ছে না চাচ্ছে না…..”
ইউভি আবার কাঁপা গলায় হাত বাড়িয়ে বলল,
__”ভাইয়া প্লিজ বনু কে আমার কাছে দাও….তুমি ঠিক নেই, ওকে সামলাতে পারবা না….”
কিন্তু জায়ন যেন কিছুই শুনছে না। তার চোখ লালচে, ঠোঁটে কাঁপা হাসি পাগলের মত, আবার কান্না মিলিয়ে গেছে একসাথে। সে নিথর তিয়াশার হাত চেপে ধরে কেঁদে হেসে বলল,
__”না, আ আমি আমার জান কে দেবো না , আমার থেকে আলাদা করতে পারবি না। ”
ইউভির চোঁখ ভেজা কাতর দৃষ্টি মুখে ভাসা হারিয়ে ফেলেছে। জায়ন আবার ও পাগলের মতো হাসি কান্না মিশিয়ে তিয়াশার হাত ধরে আর্তনাদ করছে ।

__”দেখ না আ আমার মার বাচ্চার হাত গুলো কেমন ছোট ছোট… মুখটা কেমন করে রেখেছে….রাগ করেছে রাগ করেছে আমার উপর ।”
তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে বারং বার , গাল ভিজিয়ে বুকের উপর পড়ছে। প্রতিটি শব্দ যেন বুক ছিঁড়ে বেরোচ্ছে,
__”আমার জানের কষ্ট হচ্ছে…. আমার বাচ্চা কষ্ট পাচ্ছে তো…. তাড়াতাড়ী চলো প্লিজ প্লীজ প্লীজ” ।
হাঁপাচ্ছে নিঃশ্বাস আটকে আসছে তবুও কান্না থামছে না ,হঠাৎই বুক ফেটে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে,
__”খুব কষ্ট হচ্ছে আ আমার জানের অনেক কষ্ট হচ্ছে ওর…..”
এদিকে পেছনে, বৃষ্টি, আরোহী, অনন্যা আর মারিয়া,সবাই মিলে নাজিমের গাড়িতে বসে আছে। বাইরের রাত তখন ভয়াবহ ভারি। কাচে টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে, রাস্তার হেডলাইটগুলো অন্ধকার ভেদ করে ঝাপসা আলো ফেলছে। গাড়ির ভেতরে শুধু কান্নার শব্দ হাউমাউ করে, বুকফাটা চিৎকারে ভরে গেছে চারপাশ।
বৃষ্টি দুহাতে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ মাথা তুলে নাজিমকে চিৎকার করে উঠল,

__”কি গো তারাতারি চালাও, আমার বোনটার কাছে নিয়ে চলো।”
তার কণ্ঠে যেন মৃত্যু ভয় মিশে আছে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু জামা ভিজিয়ে দিচ্ছে। কণ্ঠ এতটাই ছিঁড়ে গেছে, যেন বুকের ভেতর থেকে ফেটে বেরোচ্ছে আর্তনাদ।
অনন্যা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আরোহীর বুকের ভেতর লুকিয়ে পড়ল। গলাটা ধরে গেছে কান্নায়, তবুও কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,
__”রুহী আপু….. আমার তিউ আপু ঠিক হয়ে যাবে তো?”
তার প্রশ্ন শুনেই আরোহীর বুকটা ছিঁড়ে গেল। সে চোখের পানি মুছতে মুছতে কাঁপা হাতে অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। গলা ভাঙা কণ্ঠে বলল,

__”ওকে তো ঠিক হতেই হবে বনু….. নইলে আমরা যে বেঁচেও মরে যাব।”
এ কথা বলে আরোহী হঠাৎ মারিয়াকেও জড়িয়ে ধরল। তিনজনের বুক মিশে গেল একসাথে, কান্নার শব্দে গাড়ির ভেতর যেন কেঁপে উঠল।
ওদিকে অন্য গাড়িতে বসে রায়ান হঠাৎই আর্তনাদ করে উঠল। পলাশের উপর সে গর্জে উঠল, কণ্ঠে রাগ, কষ্ট আর অসহায়তা মিশে,
__”পলাশ ভাই তাড়াতাড়ি চলো আমার আপুর কাছে। গাড়ির স্পিড বারাও।”
মাত্র বাচ্চা ছেলে, অথচ এত বড় ভাইয়ের উপর এভাবে চিৎকার করছে, কারণ তার মাথা কাজ করছে না। তার চোখের সামনে ভাসছে শুধু রক্তে ভেজা তার আপুর নিথর দেহ।
আকাশ চুপচাপ বসে আছে। তার চোখ স্থির, ঠোঁট শুকনো। কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে যেন ভেঙে পড়ছে সে যদি তখন এই ক্যাফে আসার কথা টা না বলত তাহলে এখন সব স্বাভাবিক থাকত । নিজের বোনকে এই অবস্থায় দেখে তার শরীর জমে গেছে, মাথা কাজ করছে না।

রায়ানের এই অস্থিরতা দেখে আহান হঠাৎ এগিয়ে এলো। সে কাঁপা গলায়, গলায় অশ্রুভেজা সুরে বলল,
__”শান্ত হ রায়ান যাচ্ছি তো সব ঠিক হয়ে যাবে ,আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”
গাড়ির ভেতরের হাহাকার থামছে না। পলাশ স্টিয়ারিংয়ে হাত শক্ত করে ধরেছে, তার হাত কাঁপছে। সে অসহায় কণ্ঠে, গলা ভারি হয়ে উঠে হঠাৎ বলে উঠল,
__”আহান সাগর আমাদের জায়ন ঠিক নাই রে কেমন পাগলের মতো করছিল রে ভাবির যদি কিছু…….”
এই কথাটা শেষ হওয়ার আগেই, আকাশ আর রায়ান হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,
__”পলাশ ভাই, আর একটাও শব্দ না।”
দুজনের চোখেই আগুন। বুক ভরা কান্না, কিন্তু তার থেকেও বেশি রাগ কারণ তারা জানে জায়নের কথা নিয়ে কোনো সন্দেহ করা মানেই মৃত্যু।
সাগরও আর সহ্য করতে পারল না। সে চিৎকার করে উঠল,

__”পলাশ, আর ইউ ম্যাড। ভাবির এই অবস্থা, আর তুই এমন কথা বলছিস।খবরদার জায়নের সামনে যদি একবারও এসব বলিস, ও তোকে মেরেই ফেলবে, তার আগেই আমি তোকে আমার হাতে মেরে ফেলব।”
আকাশ আর রায়ান হয়তো এই প্রথম তাদের হাস্যরসিক সাগর ভাইকে এতটা গম্ভির দেখলো এতটা সিরিয়াস দেখলো।
গাড়ির ভেতর হঠাৎ নিস্তব্ধতা নেমে এলো। শুধু বৃষ্টির শব্দ, হাউমাউ কান্না আর গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন। কারও মুখ দিয়ে আর কোনো কথা বেরোল না।
গাড়ি দুলছে, রাস্তার পাশে গাছগুলো ভিজে অন্ধকার ছায়ার মতো ছুটে যাচ্ছে। চারপাশের শব্দ মিশে যাচ্ছে কান্নার সাথে।
প্রতিটি মুহূর্তে জায়নের শরীর ভেঙে পড়ছে, কিন্তু বুকের ভেতরে একটা অদম্য পাগলামি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সামনে। যেন সে নিজেই শেষ হয়ে যাবে, তবুও তিয়াশাকে হারতে দেবে না।
সে নিথর তিয়াশাকে শক্ত করে জাপটে ধরে কাঁপা গলায় ফিসফিস করছে বারবার,

__”কষ্ট হচ্ছে বাচ্চা?আমার জানের কষ্ট হচ্ছে….আমার জানের কষ্ট হচ্ছে…. আমার জানের কষ্ট হচ্ছে…..তারাতারি চালাও….”
গাড়ির ভেতরে শুধু রক্তের গন্ধ, কান্নার শব্দ আর শ্বাসরুদ্ধকর হাহাকার। যেন মৃত্যু হুঙ্কার দিচ্ছে, তবুও সবাই দৌড়াচ্ছে জীবন বাঁচাতে।
পুরো রাত, পুরো পরিবেশ, বৃষ্টিভেজা রাস্তা সবকিছু মিলে সেই মুহূর্তটা দাঁড়িয়ে আছে জীবনের সাথে মৃত্যুর ভয়ঙ্কর দৌড়ে।

হঠাৎ করেই চৌধুরী বাড়ির নিস্তব্ধ পরিবেশ চিরে ভেসে এলো এক ভয়ঙ্কর আর্তনাদ।সেই আর্তনাদ যেন বুক কেটে বেরোচ্ছে, কর্কশ, গলাভাঙা, অশ্রুভেজা।
__”বড় আপ মেজো আপা…”
চিৎকার করতে করতে ভেঙে পড়ছে সুরাইয়া বেগম। তাঁর দুই হাত বুকের ওপর আছড়ে পড়ছে বারবার, চোখের পানি ঝরে ভিজে যাচ্ছে আঁচল।
সুরাইয়া বেগমের সেই আর্তনাদ শুনে রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি ছুটে এলো মেহজাবীন বেগম আর রূহেনা বেগম। এদিকে শোবার ঘর থেকে প্রান্তিক সাহেব আর প্রণয় সাহেবও ছুটে এলেন।
বড় হলরুমে সবাই একসাথে জমে গেল। বাতাস ভারি হয়ে উঠল এক অজানা আতঙ্কে।
মেহজাবীন হতবম্ভ হয়ে ফ্যাকাশে মুখে বলে উঠলেন,

__”এই ছোট এইভাবে কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে?”
সুরাইয়া বেগমের গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। তিনি কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে আছেন, মুখ বেয়ে নিরবধি অশ্রুধারা। কিছু বলছেন না, শুধু বুক ভেঙে আসা কান্না।
এই দৃশ্য দেখে রূহেনা বেগম আর মেহজাবীন বেগমের বুকের ভেতরও যেন ঝড় বয়ে গেল। আতঙ্কে চোখ বড় হয়ে উঠল, হাত পা কাঁপতে লাগল। মনে হলো, কোনো ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে।
কিন্তু সুরাইয়া বেগম আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না। বুক ফেটে কেঁদে উঠলেন তিনি,
__”বড় ব বড় আপা…..মেজো আপা…. …তিয়াশা..তিয়াশা…”
তিয়াশার নাম শুনতেই যেন এক ঝড় বয়ে গেল চৌধুরী বাড়ির দেয়ালে, সবার বুক কেঁপে উঠল ভয় আর অবিশ্বাসে।
রূহেনা বেগম ছটফট করতে করতে চিৎকার করে উঠলেন,
__”এই ছোট, কি বলছিস? তিয়াশা? কি কি?”
তার চোখে ভয় জমে উঠছে, বুক কেঁপে যাচ্ছে,মনে হচ্ছে মাটি যেন হঠাৎ নিচে থেকে সরে যাচ্ছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে নিজের ঘোর থেকে বেড়িয়ে এলো তাহসান সাহেব। তাঁর কণ্ঠ ভারি, কান্নায় ভরা, তবুও চেষ্টা করছেন শব্দ গুছিয়ে বলতে।

__”ভাবি ভাইয়া…..আমাদের এখনি হসপিটাল যেতে হবে।”
এই ‘হসপিটাল’ শব্দটা শুনেই প্রণয় সাহেব আর প্রান্তিক সাহেবের চোখ চমকে উঠল। হঠাৎ যেন শরীর জমে গেল।
এই কথা টা শুনে মেহজাবীন বেগম আর রূহেনা বেগমের হাত কেঁপে উঠল। মুখ সাদা হয়ে গেল।
তাহসান সাহেব এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো গলাভাঙা কণ্ঠে বললেন,
___”তিয়াশা আম্মুর অনেক বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে,,,,রায়ান ফোন,,”
আর কোনো কথা শেষ করার আগেই রূহেনা বেগম বুক ফেটে চিৎকার করে উঠলেন,
__”আ…. আ….. আমার মেয়ে কোথায়? না….না….আমার ভাল মেয়ে গেলো…. আ আজ তো আমার মেয়েটার জন্মদিন। না,না,তোমরা মিথ্যে বলছ!”
তার কান্নায় পুরো বাড়ি কেঁপে উঠল, বুক ধড়ফড় করছে, শ্বাস আটকে যাচ্ছে।
মেহজাবীন বেগম যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। মাথা ঘুরে আসছে, তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন, কণ্ঠ ভেঙে যাচ্ছে।আর প্রণয় সাহেব নিঃশব্দে বসে আছেন, চোখ ভিজে উঠছে বারবার। তার ঠোঁট কাঁপছে, ফিসফিস করে বলছেন,

__”আমার মেয়েটা …… আমার মেয়ের কাছে যাব।”
প্রান্তিক সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর চোখ স্থির, শরীর অবশ, ঠোঁট নড়ছে না। মনে হচ্ছে তাঁর ভেতরকার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ করেই রূহেনা বেগম বুক ভেঙে ছটফট করে উঠলেন,
__”আ মায় কেউ নিয়ে চলো আমার মেয়ের কাছে, নিয়ে চলো আমার মেয়ের কাছে।”
তিনি মেহজাবীন বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।সেই মুহূর্তেই বদলে গেল চৌধুরী বাড়ির পরিবেশ। এত বড় বাড়ি, এত কোলাহল কিন্তু হঠাৎ যেন সবকিছু নিস্তব্ধ।
শুধু ভেসে আসছে বুক ফাটা কান্নার শব্দ।।।।।
প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি ঘর, প্রতিটি কোণায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।অসহায় চিৎকার, ভয়ঙ্কর আর্তনাদ আর মায়েদের বুক ভাঙা কান্না।

গাড়ির ব্রেক চেঁচিয়ে থামতেই পুরো পৃথিবীটা যেন থেমে গেল। চোখ ধাঁধানো আলোয় ভেসে উঠল সেই বিশাল বহুতল হাসপাতাল। উঁচু সাদা ভবনটা যেন অন্ধকার আকাশ ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে ঝলমলে লাইটের আলো। লম্বা কাঁচের দরজাগুলো থেকে বারবার রোগী আর ডাক্তার ঢুকছে-বের হচ্ছে। সামনে দাঁড়ানো অ্যাম্বুলেন্সের লাল-নীল সাইরেন চিৎকার করে যাচ্ছে, ভেতরে বাইরে ছুটোছুটি করছে মানুষজন। করিডোর থেকে ভেসে আসছে কারও কান্নার শব্দ, কারও চিৎকারমনে হচ্ছে গোটা হাসপাতালটা যেন এক দমবন্ধ অস্থিরতার কারাগার।
এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই জায়ন কাচের দরজা পেরিয়ে ছুটলো তার পৃথিবী কে নিয়ে। জায়নের বুকের ওপর নিথর হয়ে পড়ে আছে তিয়াশা। তার সাদা শার্টটা ভিজে গেছে লালচে রঙে, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে সেই ভয়ঙ্কর রক্তের গন্ধ। দুহাত কাঁপছে, শরীর দুলছে, কিন্তু সে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে তিয়াশাকে, যেন সামান্য আলগা করলেই পৃথিবীটা ওর হাতছাড়া হয়ে যাবে।

জায়নের চোখ লাল, নিঃশ্বাস ছুটে আসছে হাপরের মতো। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে অবিরাম, কিন্তু সে নিজের দিকে তাকাচ্ছে না। তার সমস্ত দৃষ্টি আটকে আছে তিয়াশার মুখে সেই মুখে নেই কোনো হাসি, নেই কোনো রঙ। নিথর ঠোঁট, ফ্যাকাশে গাল দেখে মনে হচ্ছে যেন সময় থেমে গেছে।
হঠাৎ চারপাশে হুড়মুড় করে ছুটে এল নার্সরা। একজন স্ট্রেচার টেনে আনলো, আর ডাক্তার ছুটে আসল কিছু নার্স ঝাঁপিয়ে পড়লো জায়নের দিকে তিয়াশাকে
নেওয়ার জন্য।কিন্তু জায়ন হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলো, ফুঁপিয়ে কেঁদে ছিঁড়ে ফেললো তাদের হাত,

__”না……না। কেউ হাত দিও না আমার জানকে….. আমি নিয়ে যাব….. কো কো থায় নিতে হবে বলেন
আমি নিয়ে যাব!”
তার গলা ফেটে যাচ্ছে, বুক ধড়ফড় করছে, চোখে ভাসছে অসহায় হাহাকার। সাদা দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো তার চিৎকার। আশেপাশে ভিড় জমে গেল। অপরিচিত মানুষজন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে, কেউ চুপচাপ মাথা নিচু করে ফেলছে।
পেছন থেকে বৃষ্টি হাউমাউ করে ছুটে এসে কান্না ভাঙা কণ্ঠে বললো,

__”ভাইয়া, প্লিজ, ডাক্তারকে দেখতে দাও…”
আহান ছুটে এসে জায়নের হাত ধরতে গেল, নাজিম সামনে দাঁড়িয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জায়নের কানে কিছু ঢুকছে না। সে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো তিয়াশাকে, বুক ফেটে চিৎকার করলো,
__”আমিই নিয়ে যাব, আমার জানকে আমি ছাড়বো না কারও কাছে!”
জায়ন এর পাগলামি দেখে নার্স কাঁপা গলায় বললো,
__”স্যার, পেশেন্টকে নিয়ে যেতে দিন, সময় নষ্ট করলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। আপনার ও তো নাক থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, আপনার এখন ই একটা চেক আপ দরকার।”
কথা শেষ হতে না হতেই জায়নের গলা থেকে বেরিয়ে এলো হৃদয়বিদারক চিৎকার। সে তিয়াশাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে,

__”ওকে একদম পেশেন্ট বলবেন না। ও আমার বউ আমার পৃথিবী আর একবার পেশেন্ট বললে আমি সব শেষ করে দেব,আমার জান ও পেশেন্ট না, পেশেন্ট না। বলেন কোথায় নিতে হবে। আমার কাছ থেকে ওকে নিয়ে গেলে আমায় কোন চেক আপ ঠিক করতে পারবে না। আমি মরে যাবো।”
চারপাশ কেঁপে উঠলো তার চিৎকারে। অনন্যা আরোহীর বুকে ভেঙে পড়লো, মরিয়া থরথর কাঁপতে কাঁপতে বারবার উচ্চারণ করছে,

__”আল্লাহ আমার তিউ আপু আল্লাহ প্লিজ ঠিক করে দিও।”
চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। কেউ নীরবে চোখ মুছছে, কেউ নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন পুরো হাসপাতালটা শোকের ছায়ায় ঢেকে গেছে।
এর মধ্যেই পেছন থেকে রায়ান হনহনিয়ে এগিয়ে এলো। তার চোখ ভিজে আছে অশ্রুতে, তবুও মুখে ভয়ঙ্কর দৃঢ়তা। কোনো দ্বিধা না করে, নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে জায়নের কোল থেকে তিয়াশাকে টেনে নিল। জায়ন এমনভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল যেন তার বুক থেকে জীবনটাই ছিঁড়ে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
রায়ানের চোখে তখন অসহ্য যন্ত্রণা, চোয়াল শক্ত করে সে বলল,

__” ভাইয়া আপুর এখন ডাক্তার প্রয়োজন ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন ।”
তার কণ্ঠে কান্না, তবুও সেই কণ্ঠ ছিল অটল। যেন সেই মুহূর্তে তার বুক ফেটে গেলেও, সে জানে তার আপুকে বাঁচাতে এটাই করতে হবে।
কিন্তু জায়নের চোখ লাল রুদ্র দৃষ্টিতে জ্বলছে। সে তাকিয়ে আছে রায়ানের দিকে, যেন মুহূর্তেই ছিঁড়ে ফেলবে তাকে। এত বড় ভিড়ের মাঝে জায়নকে আটকে রাখা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল। আহান, সাগর, ইউভি, পলাশ একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার শরীর ধরে ফেলল। তবুও যেন পাহাড় ঠেকানোর মতো অবস্থা জায়নের শক্তি আর উন্মাদনা থামানো প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
সবার হাতের ফাঁক গলে সে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, আর্তনাদ করে চিৎকার করছে,

__” ওকে আমার কাছে দে, নিস না আমার থেকে ,
দে না রে প্লীজ ।”
তার চিৎকারে পুরো করিডোর কেঁপে উঠলো। নার্সরা থমকে দাঁড়িয়ে গেল, অন্য রোগীর আত্মীয়রা চোখে হাত দিল। সবার বুক ফেটে যাচ্ছিল জায়নের এই হাহাকার শুনে।
অবশেষে রায়ান কোনো মতে তিয়াশাকে স্ট্রেচারে শুইয়ে দিল। স্ট্রেচারের উপর ওই ভাবে শুয়ে থাকা তিয়াশাকে দেখে মুহূর্তেই জায়নের বুক যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। সে নিজের বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলো, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো, চোখ দিয়ে রক্তের মতো অশ্রু ঝরতে লাগলো।তবুও তার কান্না থামছিল না।
জায়ন এর পাগলামো দেখে আহান চিৎকার করে উঠলো,

__” জায়ন প্লীজ পাগলামো করিস না , ভাবির ইমিডিয়েট ট্রিটমেন্ট লাগবে ।”
ইউভি ও আর দেখতে পারছে না তার ভাই বোনের এই
অবস্থা , শরীর জোর পাচ্ছে না কন্ঠে নেই কোন চেতনা তবুও বলে উঠলো,
__” ভাইয়া তুমি এরকম করলে বনু কি ভাবে ঠিক হবে।”
কিন্তু জায়ন নিজেকে থামাতে পারলো না, বুকের ভেতর থেকে অসহ্য ব্যথার আর্তনাদ ,
__” আমি যাব ওর সঙ্গে , আমায় ছার না তোরা প্লীজ
আমি আর আমার মধ্যে নেই আমাকে যেতে দে,।”
তার চোখে অন্ধকার, কণ্ঠে অসহায়ত্ব, যেন সে আর মানুষ নেই মৃত্যুর মুখে ছুটে যাওয়া এক ভাঙা স্বামী।
এদিকে ডাক্তার দ্রুত এগিয়ে এলো। সে তিয়াশার চোখ আর পালস চেক করতে লাগলো। সবার নিঃশ্বাস আটকে গেল। করিডোরে কোনো শব্দ নেই শুধু মনিটরের টিকটিক শব্দ আর সবার বুকের ধুকপুকানি। নার্সরা তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে, যেন তার ঠোঁট থেকে বেরোনো প্রতিটা শব্দ জীবন মৃত্যুর রায়।
ডাক্তার মাথা তুলে তাকালেন, তারপর ইশারা দিলেন নার্সকে।আকাশ কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে এলো। তার চোখে জল টলমল করছে, তবুও কণ্ঠে সেই দৃঢ়তা,

__” স্যার আই আই থিঙ্ক মাই সিস্টার লস টু মাচ ব্লাড,
এন্ড সি নিড অপারেশন।”
ডাক্তারের কপালে ঘাম জমলো, কণ্ঠ গভীর আর ভারী
__” ইয়েস ইউ আর রাইট আকাশ , সি লুস টু মাচ ব্লাড, সি নিড ব্লাড ।”
শব্দটা শুনতেই চারপাশ কেঁপে উঠলো। সবার বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠলো।
আর সেই মুহূর্তেই জায়ন পাগলের মতো ছিঁড়ে চিৎকার করে উঠলো,
__” আ আমার শরীরের সব ব্লাড ওর নামে করা , আমার ব্লাড নিয়ে নিন , সব নিয়ে নিন শুধু আমায় ওর কাছে যেতে দিন ওকে সুস্থ করে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন ।”
তার চোখ দিয়ে বন্যার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, বুকের ভেতর থেকে বেরোচ্ছে কণ্ঠ ফাটা শব্দ। নার্স, ডাক্তার, সবার চোখে পানি এসে গেল। মনে হচ্ছিল তারা আজ প্রথমবার ভালোবাসার প্রকৃত রূপ দেখলো যেখানে মানুষ টা নিজের প্রাণ, নিজের শরীর সব কিছু দিয়ে দিতে রাজি, শুধু তার প্রিয় মানুষটাকে বাঁচানোর জন্য।
ডাক্তার কড়া স্বরে বললেন নার্সদের,

__”ইমিডিয়েটলি ওটিতে নিয়ে যাও।”
স্ট্রেচারে শুয়ে আছে নিথর তিয়াশা। আলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, চাকাগুলোর ধাতব শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে কানে বাজছে। স্ট্রেচার ছুটে যেতে থাকলো করিডোর ধরে,রায়ান, আকাশ, নাজিম ছুটলো এদিকে জায়ন কে ছেরে ইউভিও পেছন পেছন ছুটলো।
কিন্তু পেছনে দাঁড়ানো জায়ন ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে সবাইকে, বুক ফেটে আর্তনাদ করে উঠলো,
__” আমা আমাকে ছাড় তোরা। , নিস না তোরা ওকে নিস না আমার কাছ থেকে ,ওকে নিয়ে যাস না, আমি শেষ হয়ে যাব ।”
শব্দগুলো করিডোরের দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো, প্রতিধ্বনি হয়ে যেন পুরো হাসপাতালটা কাঁপিয়ে তুললো।
কেমন যেন তেল ফুরিয়ে যাওয়া নিভতে থাকা বাতির আলোর মত জায়ন এর আর্তনাদ ও ধীম হতে লাগল,

__” আ আমাকে আমার জানের কাছে যেতে দে , আমি যাব ওর সঙ্গে ও ভয় পায় একা থাকতে ও ভ ভয় পায় আমি যাব আমি, আ আমি যাব আ মি যা ….”
কিন্তু হঠাৎই জায়নের শরীর দুলে উঠলো। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে গেল। গলায় আটকে গেল কান্না। মুহূর্তের মধ্যে ঢলে পড়লো আহানের বুকে।
“__জায়ন………”সাগরের বুক ফাটা চিৎকারে পুরো ফ্লোরটা কেঁপে উঠলো।
আহান এই দেখে এক নার্স এর উদ্যেশ্য বলে উঠলো,
__” প্লীজ নার্স এদিকে আসুন প্লীজ….”
বৃষ্টি অনন্যা ছুটে এসে জায়নের হাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
__” ভাইয়া …… ভাইয়া চোখ খোলো,”
পলাশ ঝাপিয়ে পড়ল জায়ন কে ঠিক করে ধরার জন্য। আরোহী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মরিয়া কাঁপা হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে শুধু একটাই শব্দ উচ্চারণ করলো

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৩

__”আল্লাহ্ আমার বড় ভাইয়া কে তার পুরো পৃথিবী কে সুস্থ করে ফিরিয়ে দাও।”
ওদিকে ভারী দরজার শব্দে অপারেশন থিয়েটার গর্জে বন্ধ হলো। মুহূর্তেই করিডোর নিস্তব্ধ হয়ে গেল, শুধু চারদিকে কান্না আর হাহাকার।
একদিকে নিথর তিয়াশা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে ভেতরে, অন্যদিকে তার প্রণয়ের একমাত্র পাগল পুরুষ বাইরে পড়ে আছে জ্ঞানহীন অবস্থায় আহানের বুকে ।
সেই করিডোরের বাতাসও ভারী হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল দেয়ালগুলোও কাঁদছে তাদের সঙ্গে।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here