তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৫

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৫
নীল মণ

বাইরে রাত নেমে আসছে, আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। হাসপাতালের জানালায় থেমে নেই একটানা বৃষ্টির ধারা। ফোঁটা ফোঁটা জল কাচে আছড়ে পড়ছে আর সেই শব্দ যেন ভেতরের হাহাকারের সুরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রকৃতি আর মানুষ একসাথে কাঁদছে একটা নিথর শরীরের জন্য, একটা ভালোবাসার জন্য, একটা অসমাপ্ত জীবনের জন্য।
পুরো হাসপাতালটা যেন থমকে গেছে। নীরবতার মধ্যেও মানুষের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে শোনাচ্ছে। অপারেশন থিয়েটারের দরজা শক্ত করে বন্ধ, তার উপর লাল বাতি জ্বলছে। দরজার বাইরে সবার বুকের ভেতরে জমে উঠছে এক অজানা ভয়, হাহাকার আর অসহায় প্রার্থনা।

অন্যদিকে, জায়নের অবস্থা আরও ভয়াবহ। প্যানিক অ্যাটাকের ধাক্কায় জ্ঞানহীন অবস্থায় শুয়ে আছে অন্য এক কেবিনে। তার পাশে বসে আছে পলাশ, সাগর আর রায়ান। তিনজনেরই মুখ ম্লান, চোখ লাল, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে কান্না চেপে রাখতে রাখতে। চারদিকে যেন এক শ্বাসরুদ্ধ অস্বাভাবিকতা ভর করেছে।
এমন সময় হুর মুড়িয়ে কান্না করতে করতে হাসপাতালে এসে পৌঁছালো পুরো চৌধুরী পরিবার। যেন ঝড় বয়ে গেল করিডোর দিয়ে কারও চোখে সীমাহীন ভয়, কারও কণ্ঠে অস্থিরতার ঝড়। সঙ্গে আছেন আয়েশা বেগম আর আশরাফ খানও। হাসপাতালের বাতাসটা আরও ভারী হয়ে উঠলো তাদের আগমনে।
পুরুষেরা সাধারণত চোখের জল আড়াল করে রাখে, বুকের ভিতরে ঢেকে রাখে ব্যথা। কিন্তু আজ আর সেই শক্তির মুখোশ টেকেনি। বুক ফুঁড়ে যন্ত্রণা বেরিয়ে আসছে, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। প্রান্তিক সাহেব, প্রণয় সাহেব, তাহসান সাহেব আর আশরাফ খানের চোখ মুখে সেই অসহ্য যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট যেন প্রতিটি মুহূর্ত তাদের বুকের ভেতর শিকল হয়ে কষে ধরছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রান্তিক সাহেব অস্থির হয়ে চারপাশে তাকাতে লাগলেন। চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে, কপালে ঘাম জমে আছে। তাঁর দৃষ্টি যেন মরিয়া হয়ে কাউকে খুঁজছে, বুক কাঁপছে। হঠাৎ তিনি আকাশের দিকে ফিরলেন, কণ্ঠ কেঁপে উঠলো অসহায়তায়,
__” কোথায় আমার মেজো আম্মু , আমার ছেলের বউ ?”
কণ্ঠ ভেঙে আসছিল, বুক কাঁপছিল মনে হচ্ছিল তিনি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারবেন না, যেন এক্ষুনি ভেঙে পড়বেন।
প্রণয় সাহেবের চোখে জমে উঠলো ভয়, দৃষ্টিতে ছটফটানি। চোখ বড় হয়ে গেছে, ঠোঁট কাঁপছে,তিনি ব্যাকুল হয়ে আকাশকে আঁকড়ে ধরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,

__”আমার মেয়ে টা কেমন আছে রে বাবা ? আমার জায়ন ঠিক আছে তো ? কোথায় সে ?”
আকাশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো চোখে পানি চিকচিক করছে, বুক উঠানামা করছে দ্রুত শ্বাসে। গলা ভারী হয়ে এসেছে, ঠোঁট কাঁপছে। শেষ পর্যন্ত ভেজা মুখ নিচু করে প্রণয় সাহেবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, কান্না আর কষ্ট একসাথে গলায় আটকে গিয়ে ফেটে বেরিয়ে এলো,
__” কেউ কেউ ভালো নেই মেজো মামু , বণুর অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে অপরেশন চলছে অবস্থা ভালো না , বনুর অবস্থা দেখে ভাইয়া পাগল হয়ে গেছে মামু পাগল হয়ে গেছে। ভাইয়ার প্যানিক অ্যাটাক করেছে ভালো নেই । ”
এই কথা শুনে কঠিন মনের মানুষ প্রান্তিক সাহেবও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। বুক চেপে ব্যথা সামলাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু শরীর সাড়া দিল না। মুখ বিকৃত হয়ে গেল অস্থিরতায়, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠলো। যেন বুকের ভেতর পাহাড় ধসে পড়ছে। তিনি ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারে। চোখ ভরে উঠলো জল, আর বুকের যন্ত্রণা ছাপিয়ে গেল সব শক্তি।

প্রণয় সাহেব হাত কাঁপতে কাঁপতে বুক চাপরাচ্ছিলেন। চোখ থেকে একের পর এক অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ছিল, গাল ভিজিয়ে নিচ্ছিল। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল, ঠোঁট কাঁপছিল অশ্রুর ভারে।
তাহসান সাহেব আর আশরাফ খান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, কিন্তু চোখের পানি আড়াল করতে পারলেন না। ঠান্ডা নীরবতা ছেয়ে গেল চারপাশে এক ভয়াবহ নীরবতা, যেখানে কেবল কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। হাসপাতালের আলো, দেয়াল, করিডোর সবকিছু যেন এই যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো।
এদিকে রুহেনা বেগম আর মেহজাবীন বেগম ছুটে এসে শক্ত করে ধরে ফেললেন ইউভিকে। দুজনের চোখ লাল, কান্নায় মুখ ভেসে যাচ্ছে। তাদের হাত কাঁপছে, কণ্ঠ ফেটে যাচ্ছে। পেছনে দাঁড়ানো সুরাইয়া বেগম,আয়েশা বেগম আর বৃষ্টি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, তারা একে অপরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে। বৃষ্টি কাঁপতে কাঁপতে ভাঙা কণ্ঠে বলল,

__” ফুফু আমার বোন টা ঠিক হবে তো ? ”
আয়েশা বেগম চোখের পানি থামাতে পারলেন না, আড়াল করার শক্তি ছিল না। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, গলাটা বেদনা আর আশার মিশ্রণে কেঁপে উঠলো,
__” আমার মেজো আম্মু তো আল্লাহর প্রিয় সন্তান সোনা , নইলে কি তার জন্য এরকম একজন ভালোবাসার মানুষ বাছাই করে রাখে মা । সব ঠিক হয়ে যাবে , হতেই হবে । ”
এদিকে রুহেনা বেগম বুক চাপড়ে আর্তনাদ করে উঠলেন। কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ কেটে যাচ্ছিল চারপাশের হৃদয়ে,
__” বাবা আমার মেয়ে টাকে একটু দেখব কোথায় আমার মেয়ে , কোথায় আমার মেয়ে ,?সব মিথ্যে বল বাবা ?”
শব্দগুলো ভেসে গেল করিডোর জুড়ে, হাসপাতালের দেয়াল কেঁপে উঠলো সেই মাতৃবেদনার আওয়াজে।
মেহজাবীন বেগম হঠাৎ কেঁপে ওঠা গলায় চিৎকার করে উঠলেন। চোখ রক্তলাল, দৃষ্টি কটমট করছে।
__” কেউ বলবে আমার মা কোথায় , আমার মা কোথায় ? আর কোথায় সেই পুরুষ যে আমার আম্মু কে রক্ষা করতে পারল না ।”

তার কণ্ঠে জমে থাকা ক্রোধ, যন্ত্রণা আর শূন্যতার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। চারিদিকের সবাই নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলো তার দিকে, কিন্তু কোনো উত্তর কেউ দিতে পারলো না।
তার চোখে আগুন জ্বলে উঠলো। তিনি চারদিকে খুঁজতে লাগলেন জায়নকে, কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেলেন না। আবার আর্তনাদ করে উঠলেন,
__” কোথায় সে এত বউ বউ করে এখন কোথায়?”
প্রান্তিক সাহেব আর সহ্য করতে পারলেন না। চোখ লাল হয়ে উঠলো, বুক ভেঙে আগুনের মতো কণ্ঠে গর্জে উঠলেন। তিনি মেহজাবীন বেগমের হাত শক্ত করে ধরে ঘুরিয়ে মুখোমুখি হয়ে বললেন,

__” একদম আমার ছেলের ভালোবাসায় আঙুল তুলবে না , কেমন মা তুমি ? বলো মেহজাবীন কেমন মা তুমি , বুঝতে পারছ না কেন আমাদের ছেলে এখানে নেই ? বুঝতে পারছ না ? কি করে ভাবলে সে তার নিজের হৃদয় কে এই অবস্থায় দেখতে পারবে ? আমাদের ছেলের মধ্যে সেই শক্তি টুকু নেই মেহজাবীন সেই শক্তি টুকু নেই ।”
প্রান্তিক সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠ চারপাশকে স্তব্ধ করে দিলো। চারদিকে তাকিয়ে থাকা সবার চোখে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার চিহ্ন। মেহজাবীন, রুহেনা, আয়েশা, সুরাইয়া বেগম সবার মুখ কান্নাভেজা, আর চোখে বিস্ময়।
ইউভি এগিয়ে এসে বড় আব্বুর কাঁধে হাত রেখে শান্ত করতে চাইল,

__” বড় আব্বু শান্ত হও শান্ত হও, বড় আম্মু বোঝেনি হয় তো ।,”
কিন্তু প্রান্তিক সাহেব যেন শুনতেই পাচ্ছেন না। তাঁর বুকের যন্ত্রণা এতটা উথলে উঠেছে যে কোনো যুক্তিই আর কানে আসছে না। আবারও ক্রুদ্ধ অথচ কষ্টভরা চিৎকার করে উঠলেন,
__” না কিসের বুঝা বুঝি , কি করে ভুল হয় আমার ছেলে কে চিনতে ?”
প্রান্তিক সাহেবের কণ্ঠে জমে থাকা কান্না, রাগ আর অসহায়তা চারপাশ কাঁপিয়ে তুললো। মেহজাবীন বেগম নির্বাক। কাতর দৃষ্টিতে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর স্বামীর দিকে। এই তিন বছরে হয়তো এ প্রথম তিনি দেখলেন, তাঁদের সন্তানের জন্য প্রান্তিক সাহেব বুক চড়িয়ে দাঁড়ালেন। মেহজাবীন বেগমের বুকের ভেতর হাহাকার জমে উঠলো এই মানুষটা এতদিন কোথায় হারিয়ে ছিলেন? কেন এতদিন নিঃশব্দ ছিলেন?
এরই মাঝে প্রান্তিক সাহেব আর দেরি করলেন না। দৃঢ় অথচ কাঁপা হাতে মেহজাবীন বেগমকে টেনে নিয়ে চললেন জায়নের কেবিনের সামনে। তাঁর চোখ লাল, দৃষ্টি ছুটে চলেছে সেদিকেই। পেছন পেছন সবাই দৌড়ে এলো। করিডোর ভরে গেল দম বন্ধ করা নীরবতায়।

কাচের দরজার ওপাশে যখন সবার চোখ পড়লো জায়নের দিকে, বুকের ভেতর থেকে হাহাকার ছুটে বেরিয়ে এলো। চারপাশে একটা স্রোতের মতো কান্না ছড়িয়ে গেল।
মেহজাবীন বেগম চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলেন দরজার ওপাশে। ঠোঁট কাঁপছে, বুকের ভেতরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। কণ্ঠ ফেটে চিৎকার করে উঠলেন,
__” কি হয়েছে আমার ছেলের ,? কি হয়েছে কেউ বলবে ?”
প্রান্তিক সাহেব আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। এতক্ষণ চোখের জল আটকিয়ে রেখেছিলেন, এবার যেন বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো। বুক ভেঙে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন তিনি,
__” সে সহ্য করতে পারে নি মেজো আম্মুর এই অবস্থা সেও নিজেকে কষ্টে ডুবাতে চাইছে। সহ্য করতে পারে নি পাগল হয়ে গেছে আমাদের ছেলে।”
প্রান্তিক সাহেবের প্রতিটি শব্দ ছিঁড়ে যাচ্ছিল চারপাশের মানুষের বুক। আর এই দৃশ্য দেখে কেউ আর নিজেদের স্থির রাখতে পারলো না। সবার চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে লাগলো। অবশেষে রুহেনা বেগমকে বুকের যন্ত্রণা আর্তনাদ থামাতে ঘুমের ইনজেকশন দিতে হলো, নয়তো তিনি ভেঙে পড়ে শ্বাসই নিতে পারছিলেন না।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে তখন আরেকটা দৃশ্য। হঠাৎ অনন্যা দৌড়ে এসে ইউভিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বুকের ভেতর ফেটে পড়া কান্না আর ভয় মিলেমিশে বেরিয়ে এলো তার কণ্ঠ থেকে। কাঁপতে কাঁপতে, ভাঙা গলায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,

__” আ আপু ঠিক হয়ে যাবে তো বলেন না আপু ঠিক হয়ে যাবে তো? ”
ইউভির ঠোঁট কাঁপছিল, চোখ ভরে পানি বেরিয়ে আসছিল। অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, অথচ ঠোঁট দিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। বুকের ভেতর বেদনা জমে পাহাড় হয়েছে, কিন্তু মেয়েটার কণ্ঠে আবারও আশার আলো জ্বালালো,
__” সব ঠিক হয়ে যাবে পাখি , আল্লাহ তা আলা কখনো এত নিষ্ঠুর হতে পারে না ।”
বৃষ্টি তখন বসে আছে নাজিমের পাশে। মুখ ভেজা অশ্রুতে, চোখ আধখোলা। নাজিম এক হাত দিয়ে বৃষ্টিকে টেনে বুকের ওপর রেখেছে, অন্য হাত দিয়ে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেন নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে বোনটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বৃষ্টি এতটাই ভেঙে পড়েছে যে চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে কেবল একটিই প্রার্থনা করছে,

__” আল্লাহ আমার বনু কে সুস্থ করে দেও ও সুস্থ না হলে ভাইয়া কে বাঁচানো যাবে না। বনু কে সুস্থ করে দাও , বনু কে সুস্থ করে দাও আল্লাহ।”
বৃষ্টির পাশেই বসে আছে ছোট্ট মারিয়া। এতটুকু বয়স, কিন্তু আজকের পরিস্থিতি তারও হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। সে চুপচাপ দু’হাত জোড় করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বারবার আওড়াচ্ছে,
__” আমার বড় ভাই কে তার পৃথিবী ফিরিয়ে দাও, আমার বড় ভাই কে তার পৃথিবী ফিরিয়ে দাও আল্লাহ তা আলা ।”
করিডোরের এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিল আকাশ। মাথা দেয়ালে ঠেকানো, দুই হাত পকেটে গুঁজে রেখেছে। কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই। তার চোখ বেয়ে টলটল করে পানি ঝরছে। বুকের ভেতরে দোষারোপের ঝড় উঠছে। সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। মনে হচ্ছে তার কথাই এই ভয়াবহতার সূত্রপাত। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে
__”কেন আমি ক্যাফের কথা বললাম? কেন?” বনুর এই অবস্থা, বড় ভাই জায়নের এই অবস্থাসবকিছুর জন্য সে নিজেকেই দোষী ভাবছে।সে তো জায়ন ইউভি অনন্যা বৃষ্টি রায়ান তিয়াশা কে কখনো কাজিন হিসাবে দেখে নি দেখেছে নিজের আপন ভাই বোন হিসাবে , তারাও আকাশ আর মারিয়া কে ঠিক একই রকম ভাবে , বিশেষ করে জায়ন সে নিজে না বোঝালেও আকাশ জানে তার বড় ভাই একজন ই ‘ আবরার জায়ন চৌধুরী ‘ ।
তার ভেতরে কষ্টের স্রোত বইছে, হঠাৎই কাঁধে এক চেনা স্পর্শ পেল। সেই উষ্ণ, আশ্বস্ত করা স্পর্শ। পেছন থেকে ভেসে এলো এক কণ্ঠস্বর,

__” শুনছো?”
আকাশ আর কিছু বললো না। পেছনে ঘুরেই ঝড়ের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরোহীকে, বুকের সব যন্ত্রণা ফেটে বেরিয়ে এলো,
__” সব আমার জন্য হয়েছে , বনুর কিছু হলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না সোনা।”
আরোহীও কেঁদে ফেললো, শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আকাশকে। দু’জনের চোখের জল একসাথে মিশে গেল। কাঁপা গলায়, বুক ভরা কান্নার ভেতর দিয়ে আরোহী ফিসফিস করে বললো,
__” তুমি প্লীজ নিজেকে দোষ দিও না , হয় তো আল্লাহ তা আলা ভাইয়া আর আমার বেবির ভালোবাসার গভীরতার পরীক্ষা নিচ্ছে । কিচ্ছু হবে না ওদের কিচ্ছু হবে না ।”

দু’জনেই কিছুক্ষণ এভাবেই একে অপরকে শক্ত করে জড়িয়ে থাকলো। কান্নার মাঝেই যেন সামান্য সান্ত্বনা খুঁজে পেল তারা।
এদিকে বলা হয়, রক্তের কোনো ধর্ম নেই, কোনো সীমারেখা নেই। আজ সেই কথার প্রমাণ হয়ে গেল চৌধুরী পরিবারের চোখের সামনে। তিয়াশার জন্য যখন ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত কম পড়লো, সবাই ছুটে এলো রক্ত দিতে পরিবারের সঙ্গে সাগর, পলাশ, আহান সবাই এগিয়ে এলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ম্যাচ হলো জেমসের রক্তের সঙ্গে। আর ছেলেটা একটুও পিছু হটলো না। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল এই বিপদের রাতে। পরিবারের সদস্যের মতো দাঁড়িয়ে গেল বনুর জন্য।

সকাল অবশেষে নামলো কিন্তু এ সকাল ছিল না রঙিন পাখির ডাক কিংবা সোনালী রোদের উজ্জ্বলতায় ভরা। এ সকালটা ছিল ভারী, নিস্তব্ধ আর ধূসর। হাসপাতালের জানালার বাইরে রাতভর বৃষ্টি শেষে গাছের পাতায় ঝুলছে অশ্রুবিন্দুর মতো বৃষ্টির ফোঁটা। সূর্যের আলো উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তার রঙটা ছিল যেন ফিকে, প্রাণহীন, ক্লান্ত।
করিডোর জুড়ে রাতভর কান্না, দৌড়ঝাঁপ, ডাক্তারদের ছুটোছুটি শেষে এখন নেমে এসেছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। সবার চোখ লাল, মুখ বিবর্ণ, শরীর কাহিল কিন্তু কারও চোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি। যেন পুরো হাসপাতালটাই এক রাতের মধ্যে বুড়িয়ে গেছে।

__” এই যে বর শুনছো আর কত ঘুমাবে ওঠো,
আমি কষ্ট পাচ্ছি যানো , আমার খুব ব্যাথা করছে ? আমি তো তোমায় ছাড়া থাকতে পারছি না , একা একা দম বন্ধ লাগছে , দেখো আমাকে ওরা কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে শুনছো আমাকে ওরা নিয়ে যাচ্ছে আমি যেতে চাই না তোমায় ছেরে, আমাকে নিয়ে যাও আমাকে নিয়ে যাও আমি যেতে চাই না ,….. চাই না।”
হঠাৎ ঘন অন্ধকারের ভেতর থেকে জায়ন যেন এক অজানা গহ্বর থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে এলো। ঘামে ভেজা শরীর, বুকের ভেতরে কেঁপে ওঠা নিঃশ্বাস এক মুহূর্তে তার ঘুম ভেঙে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আতঙ্কে তার চোখ বিস্ফোরিত, বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো, এক অদৃশ্য শূন্যতায় হাত বাড়িয়ে সে আচমকা চিৎকার করে উঠলো,
__” রোদ , রোদ…… আমার জান …কেউ কোথাও নিয়ে যাবে না জান…..”

কিন্তু চোখ মেলে তাকাতেই সে ভেঙে পড়লো বিভ্রান্তির এক গভীরতায়। চারপাশটা অচেনা সাদা দেয়াল, হালকা স্যানিটাইজারের গন্ধ, এক নিস্তব্ধতা যা ভয়ংকর। পাশে বসে আছেন মেহজাবীন বেগম, আহান আর রায়ান। পরনে হাসপাতালের রোগীর পোশাক, হাতে ক্যানুলা গেঁথে রয়েছে, । সব মনে পড়ে গেল তার,গত রাতের সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্ত, সেই চিৎকার, সেই দৌড়ঝাঁপ, সেই রক্ত আর অপারেশনের দরজা। তার বুকের ভেতর আবারও হাহাকার শুরু হলো।
মেহজাবীন বেগম কিছুটা ঘুমে ঢুলে ছিলেন, কিন্তু ছেলের হঠাৎ চিৎকারে কেঁপে উঠে চোখ মেলে তাকালেন। জায়নের দৃষ্টি তখন উন্মত্ত, তার কণ্ঠ কাপছে আতঙ্কে,

__” আমার রোদ কোথায় ,আমার রোদ কোথায়?
আমার রোদ এখানেই ছিল? কোথায় নিয়ে গেল আমার রোদ কে ,?”
জায়নের চিৎকার যেন পুরো কেবিন কাঁপিয়ে তুললো। বুকের ভেতরের দম চেপে ধরে সে আর্তনাদ করতে লাগল। হাতের ক্যানুলা হঠাৎ এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ঝরে পড়তে লাগল মেঝেতে। সেই টপটপ শব্দ যেন ছুরি হয়ে বিঁধছিল মায়ের হৃদয়ে।
ছেলের চোখের সামনে যেন দুনিয়া ভেঙে যাচ্ছে, সে ছটফট করতে করতে উঠে দাঁড়াতে চাইলো কিন্তু শরীর তাকে সঙ্গ দিলো না। অসহায়ভাবে বসে পড়ে বড় বড় চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকিয়ে কাপা গলায় বলল,

__” মা আমার রোদ কোথায় , এখানেই তো ছিল ?”
মেহজাবীন বেগম স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন। বুকের ভেতর ধড়ফড়, চোখে অঝোরে পানি জমেছে, কিন্তু কথা গলায় আটকে যাচ্ছিল। তিনি রায়ান আর আহানের দিকে তাকালেন, যেন উত্তর খুঁজছেন, অথচ নিজের বুকই শূন্য মনে হচ্ছিল। চোখের পানি ঝরতে ঝরতে কেবল ফিসফিস করল জায়ন,
__” আমার রোদ ছিল এখানে , কোথায় নিয়ে গেল ওকে , ওর খুব কষ্ট হচ্ছে, ভয় পাচ্ছে। কোথায় ও?”
রায়ান হতভম্ব। ভাইয়ার কণ্ঠে এতটা অসহায়তা সে কোনোদিন শোনেনি। অথচ তিয়াশা তো অন্য রুমে! তার বুক কেঁপে উঠলো। আহান দ্রুত জায়নের কাঁধ চেপে ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,

__” ভাবি এখানে নেই জায়ন , ভাবি এখন আই সি ইউ তে ।”
কথাটা শোনার পর জায়নের বুকের ভেতরের কষ্ট যেন বিস্ফোরিত হলো। আবারও সে উঠে দাঁড়াতে চাইলো, কিন্তু শরীর তার দুর্বল, প্রতিটি পেশি ব্যথায় টানছে। তবুও সে আর্তনাদ করে উঠলো,
__” আমায় নিয়ে চল কেউ , আমি ওকে দেখতে চাই, ওকে ছুঁতে চাই, ওকে অনুভব করতে চাই নইলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
আহান এবার রাগে-দুঃখে কণ্ঠ উঁচু করে উঠল,

__” নিজের অবস্থা দেখেছিস , আগে নিজে একটু সুস্থ হ। ভাবির পাশে সবাই আছি আমরা।”
কিন্তু জায়ন যেন শুনতেই পাচ্ছে না। তার কণ্ঠ ভেঙে ভেঙে আসছে, চোখ ভিজে ঝাপসা হয়ে গেছে। বুক চেপে সে আবার চিৎকার করে উঠলো,
___” সবাই আছে , কিন্তু ওর পাশে আমি নেই , ওর আমাকে চাই, আমার ওকে চাই।”
এক ঝটকায় চারপাশের সব সরঞ্জাম সরিয়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো, চোখে মুখে অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে। এক পা বাড়াতেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল, কিন্তু থামেনি। আবারও উঠে দাঁড়ালো, টলমল পায়ে হাঁটতে লাগল যেন ওর প্রাণ কেবল এক জায়গায় টানছে।
মেহজাবীন বেগম এর বুকের ভেতরটা তখন ফেটে যাচ্ছে। এই দৃশ্য আর তার সহ্য হলো না। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কণ্ঠ কেঁপে গিয়ে বলে উঠলেন,

__” আহান , রায়ান ওকে নিয়ে যা মেজো আম্মুর কাছে… ওকে না দেখতে পেলে আমার ছেলে টা শেষ হয়ে যাবে রে, নিয়ে যা।”
রায়ান এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জায়নের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। খালি পায়ে হাসপাতালের পোশাক পরা অবস্থায়, কোন বোধ নেই, কোন হুঁশ নেই তবুও তার একটাই গন্তব্য, তার পৃথিবী, তার রোদ। আহানও পেছন পেছন ছুটল।
আই সি ইউ এর সামনে এসে জায়ন এক ঝটকায় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। আকাশ আর ইউভি চেষ্টা করেছিল আটকাতে,

__” কি করছ ভাইয়া বনু আই সি ইউ তে, এইভাবে কেউ যেতে পারবে না।”
কিন্তু জায়নের চোখে তখন নিয়ম, আইন, শৃঙ্খলা কিছুই নেই। ভেতরে ঢুকে সে এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল।
ভেতরে একজন নার্স ছিল সে দেখে অবাক
__” আরে আরে স্যার এভাবে এখানে আসতে পারেন না ডাক্তার বাবু জানলে বকাবকি করবে আপনি প্লীজ এখন থেকে জান ।”
তিয়াশার শরীরটা নানা যন্ত্রে জড়ানো অক্সিজেন মাস্ক, মনিটরের তার, শিরায় শিরায় সূচ ঢোকানো। চোখ বুজে নিস্তব্ধ শুয়ে আছে সে। দৃশ্যটা দেখে জায়নের বুকের ভেতরটা যেন ছিঁড়ে গেল। কণ্ঠে ব্যথা জমে গিয়ে প্রায় ফিসফিসিয়ে উঠল,

__” ওকে স্পর্শ করতে চাই , ওকে আদর দিতে চাই , ওকে বুকে আগলে রাখতে চাই।”
তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারো বলল,
__” শুধু একবার ছুঁয়ে চলে যাব।”
নার্স হতভম্ব হয়ে পড়ল। তার চোখে করুণা, আবার কর্তব্যের বাঁধনও টানছে। তবুও নরম স্বরে বলল—
__” স্যার, ম্যাম এখন ৭২ ঘণ্টার অবজার্ভেশন এ রয়েছে। প্লীজ আপনি এখান থেকে চলে যান।”
কিন্তু জায়নের বুকের আর্তি থামছিল না। কাঁপা কণ্ঠে সে আরেকবার মিনতি করল,
__” প্লীজ শুধু একবার শুধু একবার আমার জান কে ছুঁতে চাই।”
কণ্ঠের ভাঙা সুর যেন দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছিল। আর তারপর নিজের হাত পেছনে রেখে তিয়াশার কপালে এক কোমল, কাতর ভালোবাসার চুম্বন এঁকে দিল। নার্স তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,

__” আরে স্যার কি করছেন, কি করছেন?”
কিন্তু জায়ন উত্তর দিল না। তার বুক তখন প্রায় ফেটে যাচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে এসে দেওয়াল ধরে হাঁপাতে লাগল, বুক চাপড়াতে লাগল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল। যেন সমস্ত পৃথিবী ভেঙে পড়েছে তার ভেতরে।
এই দৃশ্য দেখে মেহজাবীন বেগম আর স্থির থাকতে পারলেন না। ছেলের দিকে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
__” কি হয়েছে কলিজা? শরীর খারাপ লাগছে?”
কিন্তু জায়ন মায়ের বুকেই ভেঙে পড়ল। আর্তনাদ করে কান্না করতে করতে বলল,
__” মা আমার জান কে ঠিক করে দেবে? ওকে ঠিক হতে বলো না মা। আমি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছি , আমি তো বাঁচব না, মরে যাবো ওকে এইভাবে দেখলে।”
মায়ের বুকের ভেতর কাঁপন ধরলো। নিজেও দুঃখে ভেঙে পড়লেও তিনি ছেলের কাঁধ শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে বললেন,

__” বাবা কিছু হবে না আমার আম্মুর, ঠিক হয়ে যাবে আমাদের আম্মু। তোমার উপর আল্লাহ কখনও এত নিষ্ঠুর হতে পারে না সোনা, পারে না।”
জায়নের চোখ তখন ঝাপসা হয়ে আসছে, সবকিছু অন্ধকার মনে হচ্ছিল। কণ্ঠ ভেঙে চুরমার হয়ে সে বলল,
__” আমি কি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি মা? আমি তো আমার বাচ্চাকে এই অবস্থায় দেখতে পারছি না । সবকিছু কেমন অন্ধকার লাগছে ওকে ছাড়া। ওকে একবার ঠিক হতে বলো না মা। বুকের মধ্যে আগলে রাখব। দোয়া করো মা, আল্লাহ তা আলা আমার বাচ্চার সব কষ্ট আমাকে দিয়ে যেন ওই নিকৃষ্ট বিছানায় শুইয়ে রাখে।”
তার এই আর্তনাদ শুনে চারপাশের প্রতিটি বুক কেঁপে উঠলো। কান্নায় ভিজে গেল সবার চোখ। একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল সবার মনে

__”” কেউ এতটাও ভালোবাসতে পারে?”
হ্যাঁ পারে এই তো তাদের সামনে জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ জায়নের বুক ফাটা কান্না, তার নিঃস্বার্থ আকুতি, তার ভালোবাসার তীব্রতা সবাইকে নিস্তব্ধ করে দিল।
আজ তো তাহসান সাহেব ও আবেগে বুক চেপে ফিসফিস করে বললেন,
__” আমাদের জায়ন এর মত স্বামী যেন সব মেয়ের ভাগ্যে জোটে। আল্লাহ তা আলা আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে আর কষ্ট দিয়ো না, সুস্থ করে দেও, সুস্থ করে দাও আমার বাচ্চাদের।”
প্রণয় সাহেব তখন চোখ মুছতে মুছতে প্রান্তিক সাহেবকে জড়িয়ে ধরলেন।
__” আমার মেয়ে খুব ভাগ্যবতী ভাইয়া, খুব ভাগ্যবতী এরকম হিরা কে পেয়েছে তার জীবনে।”
করিডোরের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল সবার। মনে হচ্ছিল এক অদৃশ্য পাহাড় চাপা পড়েছে চৌধুরী পরিবারের বুকে।

আজ চারটে দিন কেটে গেছে দিন মানে আসলে কেবলই সময়ের হিসেব, কিন্তু এই সময়টা যেন জায়নের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে ভয়াবহ চারটা দিন। তার চোখে ঠিকঠাক ঘুম নেই, শরীরে এক ফোঁটা শক্তি নেই, মুখ শুকিয়ে চৌচির, ঠোঁট ফেটে গেছে রুক্ষ মরুভূমির মতো, চোখের নিচে গভীর কালো দাগ যেন প্রমাণ দিচ্ছে সে কতটা নির্ঘুম কাটিয়েছে প্রতিটা রাত। তবুও কেউ তাকে সরাতে পারেনি, কারো কথায় টলেনি সে, তিন দিন ধরে একইভাবে বসে আছে তিয়াশার পাশে।

এর মধ্যে তিয়াশা কে দেখতে তার মামার বাসার লোক রাও এসেছিল। আরোহী সারাদিন এখানেই থাকত সন্ধ্যায় আকাশ দিয়ে আসতো, আরোহীর আব্বু আম্মু ও দেখতে এসেছিল। পরি আর রুবিনা রোজ বিকালে দেখতে আসত।
তিয়াশাকে গত রাতেই আইসিইউ থেকে প্রাইভেট কেবিনে শিফট করা হয়েছে, ডাক্তাররা বলেছে “বিপদ কেটে গেছে।” পরিবারের সবাই একটু নিশ্চিন্ত হলেও কিন্তু জায়নের কাছে বিপদ কেবল একটা শব্দ, তার বিপদ মানে তিয়াশা চোখ না খোলা, তিয়াশার হাত না নাড়া, তিয়াশার কণ্ঠস্বর না শোনা। তাই সে সারাক্ষণ স্তব্ধ বসে থাকে, তিয়াশার হাত শক্ত করে ধরে রাখে যেন এই হাত ছেড়ে দিলে, এই আঙুলগুলো আলগা হয়ে গেলে তিয়াশা তাকে ছেড়ে চলে যাবে।

মেহজাবীন বেগম কতবার খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন, কখনো অনুরোধ করেছেন, কখনো তিয়াশার নামে শপথ করিয়েছেন তবুও জায়ন কখনো দুটো লোকমা খেয়েছে, কখনো একেবারেই খায়নি। এতদিন যে ছেলে নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল ছিল, যাকে দেখলে বোঝা যেত সে কতটা সাজানো গোছানো মানুষ আজ তার চেহারায় কেবলই এক পাগলাটে অবহেলার ছাপ। চারদিনে ওর শরীরটা কেমন অবসন্ন হয়ে পড়েছে, চোখ মুখে যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা। আর তার ঠোঁট শুধু একটাই কথা বিড়বিড় করে ,
__”কিচ্ছু হবে না জান , আমার রোদ, আমার জান…”

তিয়াশার এখনও জ্ঞান ফেরেনি, শুধু নিঃশ্বাস চলছে। ডাক্তাররা আশ্বস্ত করেছেন, কিন্তু জায়নের বুকের ভিতরের অশান্তি কিছুতেই থামছে না। সে চেয়ে থাকে বউ এর মুখের দিকে, কখনো কপালে চুমু খায়, কখনো হাত বুকে চেপে ধরে।
আজকের সকালটা অন্যদিনের মতোই ছিল। জায়ন বসে আছে বিছানার পাশে, তিয়াশার হাত ধরে, নিজের চোখের পানি লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টায় মগ্ন। তার ঠোঁট থেকে ঝরে পড়ছে কণ্ঠভাঙা ফিসফিসানি,
__”ঠিক হয়ে যা… একবার… একবার ঠিক হয়ে যা জান, কক্ষনো আর বকব না, কক্ষনো জেদ করব না। তুই যা বলবি সব কথা শুনবো জান, সব কথা… শুধু তুই আমার কাছে থাকবি। ”
__”আমার জীবনের সুখতারা তুই, আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসের বাতাস তুই জান। আমার জীবনের ঘন অন্ধকারে ,আলোর আতশবাজি তুই। তুই ছাড়া আমি এক সেকেন্ডও বাঁচতে পারব না। আমার পৃথিবী তুই… তুই ছাড়া আমি নেই জান, নেই…”

জায়নের গলা কেঁপে উঠছে, চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরছে সেই অশ্রু গড়িয়ে গিয়ে পড়ছে তিয়াশার বিছানায়। ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন অলৌকিক কিছু ঘটল
জায়নের হাতের ভেতরে হঠাৎ যেন একটা হালকা নড়াচড়া অনুভূত হলো। সে চমকে উঠল, বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল।
তার বড় বড় চোখ একবার তিয়াশার মুখে, একবার তার হাতের দিকে। আরেকটু লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারল,তিয়াশার আঙুল… সত্যিই নড়ছে।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য জায়ন যেন নিঃশ্বাস নিতেই ভুলে গেল। চোখের পানি থেমে গেল, ঠোঁট কাঁপতে লাগল। বুকের ভেতরটা ঝড়ের মতো ধুকপুক করছে। তার মনে হলো চারদিনের অন্ধকার, চারদিনের কষ্ট, চারদিনের মৃত্যু-ভয় সব এক মুহূর্তে আলোয় ভেসে যাচ্ছে।
জায়ন দুহাত দিয়ে বউ এর হাত শক্ত করে ধরে ফিসফিস করে উঠল,

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৪

__”জান… তুই শুনছিস তো? আমি আছি জান, আমি আছি। চোখ খোল… একবার চোখ খোল, আমি এখানে আছি, কোথাও যাব না, কখনো ছাড়ব না, কখনো না কখনো না।”
সেই মুহূর্তে যেন পুরো কেবিনের বাতাস থমকে দাঁড়ালো, জায়নের চোখে আশার আলো জ্বলে উঠল চারদিনের বেদনার সমুদ্রে হঠাৎ যেন এক বিন্দু আলো ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। বুকফাটা চিৎকার করে উঠলো…………
__” ডক্টর……”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৬৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here