তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭৩

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭৩
নীল মণ

__” সমস্যা কি বইন তোদের , সব সময় আমার রুমের দরজা তেই কেন তোদের নক দিতে হয় ?”
হঠাৎ করেই দরজা খুলে এক গম্ভীর মুখে বিরক্তি মাখানো কণ্ঠে গর্জে উঠল জায়ন, চোখ দুটো লালচে, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে, যেন মুহূর্তের জন্য পৃথিবীর সব দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দরজার অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টির উপর। বৃষ্টি হতবাক হয়ে একদৃষ্টে বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, বুক ধকধক করছে, কপালে ঘাম জমেছে, সে ভাবতেই পারছে না সে কী এমন ক্ষতি করল যে বড় ভাই এতটা রেগে গেল। ভয়ে আর দ্বিধায় তার গলা কাঁপতে কাঁপতে বের হলো,

__”আসলে ভাইয়া, তুমি যাদের আনার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছিলে, ওনারা এসে গেছে …. বড় আম্মু ড্রয়িং রুমে বসিয়েছে।”
কথাগুলো বলতে গিয়েও সে গিলতে লাগল, যেন শব্দ আটকে যাচ্ছে গলায়।
জায়নের মুখে প্রথমে যে কঠিন রাগী ছায়া জমেছিল, বৃষ্টির সেই উত্তর শুনেই ধীরে ধীরে তা মিলিয়ে যেতে লাগল। কপালের ভাঁজ নরম হলো, শ্বাস স্বাভাবিক হলো, আর গলা বদলে গেল শান্ত সুরে। হালকা মাথা নাড়িয়ে সে নরম ভঙ্গিতে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

__”ও রাইমা রা চলে এসেছে, তাই নাকি? ঠিক আছে, ওদের একটু স্ন্যাকস আর কোল্ড্রিংকস দিতে বল। আমি ফেস হয়েই নামছি। আর খেয়াল রাখিস যেন ওরা আনকম্ফোর্টেবল ফিল না করে।”
কথার ভেতরে ছিল যত্ন, দায়িত্ব আর বাড়ির অতিথিদের প্রতি সম্মান।
বৃষ্টি চোখ নামিয়ে সম্মান ভরে মাথা নাড়ল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, আর হালকা হাসি চাপতে চাপতে বলল,
__”জী ভাইয়া।” তারপর দ্রুত পায়ে সরে গেল সিঁড়ির দিকে।
এদিকে আবারো রুমের দরজা দিয়ে জায়ন ফিরে এল তিয়াশার দিকে। চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, তার বউ কপাল কুঁচকে মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁট চেপে ধরে আছে যেন ভেতরে কিছু চাপা ক্ষোভ জমে আছে। জায়নের মনে হলো, এই তো কিছুক্ষণ আগেও হাসিখুশি ছিল, দু’মিনিটে এমন রূপ কেন ধারণ করল? ভ্রু উঁচু করে কৌতুকমাখা অবাক স্বরে সে জিজ্ঞেস করল,

__”কি হয়েছে জান?”
তিয়াশা ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এল, চোখে একরাশ বিরক্তি, ঠোঁটে রাগের আঁচ, আর কণ্ঠে অভিমান মেশানো অভিযোগ
__”আপুর উপর এত জোড়ে চিৎকার কেন করলে?”
জায়ন মুহূর্তেই বুঝে ফেলল তার বউয়ের রাগের কারণ। ঠোঁটের কোণে বাঁকা একরকম দুষ্টুমি মেশানো হাসি খেলে গেল। ওয়াশরুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হালকা মজার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, __”রোমান্সের টাইমে এসে ডিস্টার্ব করলে কি মুখ বুজে থাকবো?”
ওয়াশরুমে ঢোকার আগে থেমে আবার তার দিকে তাকাল, এবার কণ্ঠে একটু গম্ভীরতা মেশানো অধিকারী স্বর,

__”আজকে মেকআপ করতে চেয়েছিস ওকে বাট ভাইদের বিয়ে যদি দেখতে হয়, শাড়ি ঠিক করে পর। ওই হাওয়ার গ্লাস কোমর আর আমার বউ এর ওই এট্রাকটিভ পিঠ যেন কারও চোখে না পড়ে।”
তার চোখে তখন একচিলতে ঝড়, যা শুধু ভালোবাসা থেকেই আসে।
কথাটা শেষ হতেই তার মাথায় যেন হঠাৎ কিছু মনে পড়ল। ঠোঁটের কোণে আবার বাঁকা হাসি খেলে গেল, চোখে মজার ঝিলিক এনে দুষ্টুমি ভরা স্বরে সে যোগ করল,
__”কিন্তু যখন আমরা প্রাইভেসিতে থাকবো, তখন তুই কিছু না পড়লেই বেশি খুশি হবো জান।”
কিন্তু তিয়াশার মুখ লাল হয়ে উঠল, সে রাগে গজগজ করতে লাগল, সেই রাগেও লুকানো ছিল মিষ্টি হাসি আর লজ্জা আর ভালোবাসা। ছোট্ট হাতের জোরে পাশের কুশনটা তুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়ে মারল জায়নের দিকে। আর চোখ পাকিয়ে অভিমান ভরা কণ্ঠে বলে উঠল,

__”এই সব আস্তাগফিরুল্লাহ কথা বার্তা বন্ধ করে
যাবে তুমি ফ্রেশ হতে? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো নাকি আমি চলে যাব নিচে ।
জায়ন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলল, তারপর ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে গম্ভীর অথচ আদরমাখা সুরে বলল,
__ “আমায় ছাড়া এক পাও নরবি না । পাঁচ মিনিট ওয়েট কর জান, দশ মিনিটে আসছি।”
তিয়াশা একা দাঁড়িয়ে রইল, প্রথমে চোখ পাকাল, তারপর হঠাৎ কোমরে দুই হাত দিয়ে ভেঙে পড়ল হাসিতে। চোখে ছিল একচিলতে ভালোবাসার ঝিলিক, মুখে মিষ্টি খুনসুটি মেশানো অভিমান। হেসে হেসে বিরবির করে বলল,
__”পাগল বর একটা আমার।” তার কণ্ঠে মিশে গেল রাগ, লজ্জা আর সীমাহীন মায়ার নরম ছোঁয়া।”

কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো জায়ন আর তিয়াশা। যেন পুরো বাড়ির আলো একসঙ্গে তাদের দিকেই ছুটে এলো। জায়নের পরনে আজ “হোয়াইট শার্টের ওপর কাটডেনা ট্যাক্সেডো, গলায় টাই-এর বদলে শোভা পাচ্ছে ঝকঝকে কালো বো-টাই, চুলগুলো জেল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করা, সেই স্লিক স্টাইল তাকে যেন আরও রাজকীয় করে তুলেছে। হাতে ট্যাগ হেউয়ের এর চেইন-ওয়ালা রিস্টওয়াচ চকচক করছে, পায়ে রালফ লরেন-এর লেদার জুতো তার প্রতিটা পদক্ষেপকে ভারী আর অভিজাত করে তুলছে। এমন এক চেহারা, এমন এক উপস্থিতি যেন সবার চোখে ঝাঁঝি লাগিয়ে দিচ্ছে, ড্রয়িং রুমে বসা কারো পক্ষেই তাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরানো সম্ভব হচ্ছে না।
তার পাশে থাকা তিয়াশার হাতটা নিজের বাহুর মধ্যে এমন দৃঢ় ভঙ্গিতে জড়িয়ে রেখেছে যে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবকিছুর ভিড়েও এই দুজন শুধু একে অপরের জন্য। তিয়াশার গলায় হালকা ডায়মন্ডের সেট , পরনে স্নিগ্ধ সাজ, মুখে এক অপার্থিব দীপ্ত দুজনকে একসঙ্গে দেখে মনে হচ্ছিল আল্লাহ তা’আলা সত্যিই কিছু কিছু জুটি বিশেষভাবে বানান, যাদের দিকে তাকালে বিশ্বাসই করা যায় না যে তারা সাধারণ মানুষের মতো। পুরো ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গিয়ে একসঙ্গে সবার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এলো, “মাশাল্লাহ করো, নজর না লাগুক।”

কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই গতকালের ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে রাইমা চোখ বড় বড় করে তিয়াশার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত বিস্ময় আর লাজুক কৌতূহল জমে উঠল
_””আচ্ছা… এই মায়াবী সুন্দরী আপুই তাহলে বড় ভাইয়ার জান!”
সেই ভাবনাতেই ওর বুক কেমন যেন ধকধক করে উঠছিল।
জায়ন আর তিয়াশা যখন রাইমা আর ওর আম্মুর দিকে তাকালো, ঠোঁট ভরে নরম ম্লান হাসি ছড়িয়ে দিল। রাইমা আর তার মা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, রাইমার আম্মুর কোলে ছিল চার বছরের ছোট্ট ছেলেটা। রাইমা এক দৌড়ে এসে সম্মান নিয়ে সালাম করলো জায়ন কে

___”আসসালামু আলাইকুম বড় ভাই।”
জায়নের ঠোঁটে সঙ্গে সঙ্গে কোমলতা ফুটে উঠলো, হেসে মৃদু স্বরে বলল
__”ওয়ালাইকুম সালাম, বোন।”
সেই মুহূর্তে রাইমার আম্মু ও সালাম জানালেন দুজনকে, আর জায়ন ও তিয়াশা একসঙ্গে ভদ্র ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন
__”ওয়ালাইকুম সালাম আপু।”
কিন্তু রাইমার চোখ তখনো তিয়াশার দিকেই নিবদ্ধ। তার ভেতরে মিশে গেছে লজ্জা আর ভয় এমন সুন্দরী, এমন রাজকীয় ভাবী কি আদৌ তার সঙ্গে কথা বলবেন? জায়ন বিষয়টা বুঝে ফেলতেই ওর পাশে গিয়ে মুচকি হাসি দিলো, মাথায় স্নেহভরা হাত বুলিয়ে মজার ছলে বলল,
__”কি হলো? ভাবীর সঙ্গে আলাপ করবি না? কাল তো ছটফট করছিলি ভাবীকে দেখবি বলে! কেমন লাগলো ভাবী?”
রাইমা চোখ কচলাতে কচলাতে হঠাৎই এক গাল হেসে ফেললো। তারপর একদম উজ্জ্বল চোখে তিয়াশার দিকে তাকিয়ে শিশুসুলভ মুগ্ধতায় বলল,

__”বড় ভাইয়া, ভাবী তো পুরো পরীর মত, পুরো পুতুলের মত! অনেক সুন্দর ভাবী….”
ওর নিষ্পাপ কথাগুলো শুনে তিয়াশার গাল দুটো লজ্জায় টুকটুকে লাল হয়ে উঠলো। পাশেই দাঁড়ানো জায়ন ঠোঁট কামড়ে এমনভাবে হেসে দিল যেন বুকের ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে নিজের বউয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে গর্বে বুক ভিজে যাচ্ছে।
এরপর রাইমা একটু ইতস্তত করে তিয়াশার দিকে to এগিয়ে এসে বলল,
__”ভাবী আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন? আমি না ভয় পাচ্ছিলাম যদি কথা না বলেন, তাহলে আমার অনেক কষ্ট হবে।”
তিয়াশা ওর সরল আবেগে ভেসে গেল। মায়াভরা চোখে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে মৃদু হেসে বলল,
__”আরে কেন কথা বলব না সোনা? তুমি তো নিজেই একটা পরি। এই দেখো তোমার দেওয়া চুড়ি পড়ে আছি। সুন্দর লাগছে না?”
রাইমা চোখ বড় করে তাকাল, তারপর দুহাত জোড় করে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে বলল,

__”সত্যি আপু! অনেক সুন্দর লাগছে।”
ওদের এই কথোপকথনের মাঝেই তিয়াশা ফ্রিজ থেকে একগাদা চকলেট নিয়ে এসে রাইমা আর ওর ভাইয়ের হাতে গুঁজে দিল। রাইমা আনন্দে উল্লাসে চিৎকার করলো, যেন পৃথিবীর সব চকলেটই তার কাছে এসে গেছে।
এদিকে পাশে বসে জায়ন কথা বলছে রাইমার আম্মুর সঙ্গে।
প্রান্তিক সাহেব, প্রণয় সাহেব আর মেহজাবীন বেগম বসে শুনছেন মনোযোগ দিয়ে।
সুরাইয়া বেগম আর রূহেনা বেগম গেছেন অনু আর আরোহীর সঙ্গে ।
রাইমার আম্মু চোখ মুছে ভেজা গলায় বললেন,

__” আপনাদের যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো বুঝে উঠতে পারছি না। আমার মেয়েটা কাল বাসায় ফিরে সারাক্ষণ আপনার কথা বলেছে। প্রথমে আমি ওকে অনেক বকা ঝকা করেছি। কিন্তু যখন ও বলল আপনি ওকে পড়াশোনা করাবেন, আমাদের এই বাসায় আসতে বলেছেন, তখন সত্যি আমি চমকে গিয়েছিলাম। যেখানে নিজের পরিবার-পরিজন আমাদের খোঁজ নিতে আসে না, সেখানে একজন অচেনা মানুষ আমার মেয়ের মাথায় হাত রাখবেন এটা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।”

কথা বলতে বলতে কান্নায় গলা ভেঙে এলো তার, অশ্রু টলমল করে গড়িয়ে পড়ল চোখ থেকে।
মেহজাবীন বেগম তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মমতাভরা কন্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
__” আরে মেয়ে, একদম এভাবে কান্না করবে না। একদম চুপ, একদম শান্ত হও। যার কেউ নেই, তার জন্য আল্লাহ তা আলা আছেন । আর আমার ছেলে তো আল্লাহর অনেক প্রিয় সন্তান, তাই তার হাত ধরেই তোমার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।”
জায়ন গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম স্বরে বলে উঠল,
__” আপু, প্লিজ… কাঁদবেন না।”
তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
__” বাবা, আমি ওদের দুই ভাইবোনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে চাই। আর বাবা, তুমি আপুর জন্য এমন কোনো কাজ দিয়ে দাও ন, যা উনি ঘরে বসেই করতে পারবেন। ওনার জন্য বাইরে গিয়ে কাজ সামলানো কঠিন হবে। তুমি কি পারবে?”

প্রান্তিক সাহেব হাসিমাখা চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
__” খুব ভালো সিদ্ধান্ত। হ্যাঁ, কেন পারব না?”
তারপর রাইমার আম্মুর দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত স্নেহভরা সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
__” মা, তুমি কি লেখাপড়া জানো?”
রাইমার আম্মু চোখের জল মুছে নিয়ে কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন,
__” জী স্যার, মোটামুটি জানি। আমার আম্মু আব্বু যখন মারা যান তখন আমি ভার্সিটিতে পড়তাম। তারপর ভাইয়ারা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি , আমার স্বামী যতটুকু
পারতেন স্ত্রী সন্তান কে খুশী ই রেখেছিল হঠাৎ কি যেন হল আর সব শেষ হয়ে গেল ।”
প্রান্তিক সাহেব হেসে সামান্য ঝাঁঝি দিয়ে বললেন,

__” এই যে মা, একদম স্যার বলবে ন, আর একদম কাদবে না আমি তো তোমার বাবার বয়সী হবো। তাই আমাকে স্যার নয়, বড় চাচা বলবে। আমার ছেলে যখন বলেছে, তুমি কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। কোনো সমস্যায় পড়লে এই বড় চাচা কিংবা আমার ছেলেকে মনে করবে। এখন আপাতত তোমাদের যা দরকার, সব আমি নিজেই পাঠিয়ে দেব তোমাদের বাসায়।”
রাইমার মা বিস্ময়ে চোখ বড় করে তাকালেন।
তিনি মাথা নেড়ে বললেন,
__” না না বড় চাচা, ছোট ভাই এমনি আমার ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। আর কিছু লাগবে না। আমি জানি না, এই ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব।”
জায়ন একটু গম্ভীর স্বরে দৃঢ়ভাবে বলল,

__” আপু, ঋণ শোধ করবেন ভেবে আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি ওদের বড় ভাই হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। ওদের যা যা দরকার সব আপনার বাসায় পৌঁছে যাবে। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সব সামলে নেবে। শুধু আপনার কাজ দুটো ওদের মানুষের মতো মানুষ করে তোলা আর নিজের খেয়াল রাখা।”
জায়নের কণ্ঠের দৃঢ়তায় ঘর যেন মুহূর্তেই নীরব হয়ে গেল।
রাইমার আম্মু আর সামলাতে পারলেন না, আবারো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
কিন্তু চারপাশ থেকে সবাই এগিয়ে এসে তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন।
কিছুক্ষণ হাসি-কান্নায় ভরা আলাপচারিতার পর অবশেষে ওদের নিয়ে যাওয়া হলো কমিউনিটি হলে।
জায়ন আর তিয়াশা উঠল আলাদা করে ওদের জন্য জায়নের কালো মার্সিডিজ অপেক্ষা করছিল।
বাড়ির সবার চোখে-মুখে তখনো রয়ে গেছে মিশ্রিত আবেগের ছাপ কেউ খুশির অশ্রু মুছছে, কেউবা নতুন আশার আলোয় বুক ভরাচ্ছে।

__” ইউভি ভাই, জোশ লাগতাছে আমায় তাই ন, শা* বউরে আজকে পাগল কইরা ছাড়ুম।”
আকাশ নিজের শেরওয়ানি পরে, মাথায় ঝকঝকে পাগড়ি গুঁজে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে উচ্ছ্বাসে ভেসে উঠল। ওর গলায় সেই বিয়ের উত্তেজনা আর দুষ্টু মিষ্টি আত্মবিশ্বাস কেমন যেন টগবগ করছিল।
কথাটা শুনেই রায়ান নিজের টেক্সেডোর কলার ঠিক করতে করতে মুচকি হেসে কাঁটায় কাঁটায় কথা ছুঁড়ে দিল,
__” তাহলে তো ভাই, তোমার কমিউনিটি হলে যাওয়ার দরকারই নাই। বরং সরাসরি পাবনার হসপিটালে একটা সিট বুক করে রাখো, রুহি আপু তোমায় দেখলেই যদি পাগল হয়, তাহলে বিয়ের আর কি প্রয়োজন?”
রায়ানের কথার ভঙ্গিতে ঘর ভরে উঠল হো হো করে হাসিতে। ইউভি নাজিম তো প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছে হাসতে হাসতে। কিন্তু আকাশের মুখের ভঙ্গি মুহূর্তেই বদলে গেল রাগে চোখ লাল, দাঁত কিড়মিড় করছে।

__” রায়ান এর বাচ্চা, তোর কিন্তু খুব মুখ চলতাছে!”
রায়ান হাসি থামাল না, বরং আরো বাড়িয়ে দিল। হেসে হেসে আকাশের দিকে এগিয়ে এসে কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল,
__” চিল ব্রো বিয়ে করতে যাচ্ছ, মিষ্টি মুখ নিয়ে যাও। এইরকম মুখ করে গেলে রুহি আপু তো বিয়ের মঞ্চ থেকেই পালাবে!”
আকাশ জানে এই রায়ানের সঙ্গে তর্কে গেলে তার নিজেরই হার হবে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে মুখ বন্ধ করল, চোখ কুঁচকে শুধু রাগ চাপল বুকের ভেতর।
পরিস্থিতি যখন একটু টানটান, তখনই নাজিম হেসে আলাপ ঘুরিয়ে দিল,
__” তো শালাবাবু, সম্ভন্ধি…..কবে বেরোবে তোমরা মালদিভসের জন্য?”
নাজিমের প্রশ্নে ইউভি উত্তর দিলো গম্ভীর গলায়,
__” নাজিম ভাই, ভাইয়া বলেছে রাতেই বেরোবে।”
রায়ান তখনই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে বলে উঠল,
__” কি ,তোমরা মালদিভস যাচ্ছ ভাইয়া? আমিও যাব!”
ইউভি কিছু বলতে যাবার আগেই আকাশ দেরি না করে ঝট করে রায়ানের মাথায় একটা ঠাস করে চাপড় বসিয়ে দিল,

__” এই, আমরা যাচ্ছি হানিমুন করতে। তুই কি করতে যাবি রে? বড় হ, বিয়ে কর, তারপর আবারো যাব সবাই মিলে।”
রায়ান মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে নিজের মনে গজগজ করল,
__” তোমার বোনের বয়স হয় নাই হানিমুনে যাওয়ার, না আমার হয়েছে। তো আমি কিভাবে যাই হানিমুনে? থাক, পরেই যাব…..”
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলল,
__” কি বিড়বিড় করছিস রে?”
আকাশের গলা কানে আসতেই রায়ান দ্রুত নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে একটু বাকা হাসি দিয়ে বলল,
__” ভাবছিলাম ,আমার হানিমুনে তোমাদের মত আপদ নিয়ে আমার হানিমুন খারাপ করতে চাইনা । বড় ভাই যে কেন নিয়ে যাচ্ছে তোমাদের আল্লায় জানে?”

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই আকাশের চোখ রাগে চকচক করে উঠল, ইউভিও গম্ভীর মুখে তাকাল রায়ানের দিকে। দুজনের মেজাজ একসঙ্গে চড়ে উঠতেই রায়ান ফিকফিক করে হেসে দরজার দিকে দৌড় দিল। বেরিয়ে যেতে যেতে সে হেসেই চলল, পেছনে নাজিমও সেই হাসি চেপে রাখতে পারল না, মুখ ঢেকে হেসে হেসেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
রুমে তখন দাঁড়িয়ে আছে বর সাজে দুই পুরুষ আকাশ আর ইউভি।
চোখে রাগের দুষ্টু-মিষ্টি ঝিলিক, মনে নতুন জীবনের অদ্ভুত আলোড়ন।মুহূর্তে ওরা দুজনই চুপ হয়ে গেল, বাইরে রায়ানের দুষ্টুমি ভেসে আসছে কানে, আর ভেতরে বুকের ভেতর কেবলই ধুকপুক করছে নিজের প্রিয় মানুষকে পাওয়ার অস্থিরতা।হাসি, রাগ, দুষ্টুমি আর স্বপ্ন সব মিলিয়ে যেন নতুন জীবনের দরজা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

বিশাল বহুল কমিউনিটি হলটা যেন আলোকমালার ঝলক আর ফুলের সাজে একেবারে স্বপ্নপুরীর মতো ঝকঝক করছে। চারপাশে অতিথিদের ভিড়, কোলাহল আর হাসির ঝিলিক—প্রতিটা কোণে যেন উৎসবের আবহ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই চৌধুরী পরিবার, আরোহীর পরিবার, বৃষ্টির শ্বশুরবাড়ির লোকজন সবাই এসে গেছে। পরি জেমসের হাত ধরে অপরূপ সাজে তার পরিবারের সঙ্গে প্রবেশ করল, যেন চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য। সাগরের বউ ছেলে, আহানের বউ ছেলে, পলাশের মেয়ে আর বউ নিয়ে সবাই এসে বসেছে নিজেদের জায়গায় হলটা ভরে উঠেছে পরিচিত মুখে, আত্মীয়তার আবেশে।

এই ভিড়ের ভেতরেও আলাদা করে সবার চোখ আটকে আছে এক জায়গায় জায়ন আর তিয়াশার উপর। জায়ন নিজের বাহু দিয়ে তিয়াশার কোমর এমনভাবে জড়িয়ে রেখেছে যে নড়ার কায়দাই নেই তার। অতিথিদের ভিড়ের মধ্যে সবাই তাদের দিকে চুপিসারে নিয়ে তাকাচ্ছে, তিয়াশা মনে মনে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। কারণ, চারপাশে অতিথিদের সমাগম, তাই মুখে ভদ্র হাসি রেখেই সবাইকে আপ্যায়নে ব্যস্ত।
তিয়াশা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিল, মুখে হাসি রেখেও দাঁতে দাঁত চেপে ধীর গলায় জায়নের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

__” ছাড়তে কি নেবে? সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে ,আমার লজ্জায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে।”
জায়ন যেন এসব মুহূর্ত ভীষণ উপভোগ করছে। অতিথিদের আপ্যায়ন করতে করতে দুষ্টু হাসি টেনে নরম গলায় উত্তর দিল,
__” তাহলে যা চাইবো তাই দিবি জান।লজ্জায় ডুবতে হবে না ,কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করো, তোমায় এমন জায়গায় ডোবাবো যেটা কল্পনারও বাইরে।”
তিয়াশা কথার মানে বুঝেই রাগে চোখ বড় করে তাকাল, ঠোঁট কামড়ে বলল,
__” অসভ্য, সুধরবে না কখনো।”
জায়ন মৃদু হাসি দিয়ে সেদিকে তাকাল, চোখে যেন ভয়ংকর খুনসুটির ঝিলিক,
__” তুই ছাড়া বাকি কেউ জানে না আমি কতটা ভয়ংকর অসভ্য।”
তিয়াশা জানে, এই লোক একবার শুরু করলে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বলবে। তাই অন্য দিকে মোড় ঘোরাতে গলায় বিরক্তি মেখেই বলে উঠল,

__” আমার ফ্রেন্ডরা এসে গেছে, ওদের কাছে যাবো। ছাড়ো আমায়। ভাইয়ারাও আসবে, গেট ধরতে হবে।”
কথাটা শুনেই জায়নের চোখ কঠিন হয়ে উঠল। ভ্রু কুঁচকে ভয়ানক দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
__” ওইসব গেট ফেট ধরতে গেলে আমি কিন্তু প্রমিজ ভুলে যাবো। তোকে ধরে এমন আছাড় মারব না, যে বেড থেকে উঠতে পারবি না ।ওখানে এক গাদা ছেলে থাকবে, ইউভি-আকাশের ফ্রেন্ডরা। আমি কি শুধু শুধু আগে আগে এসেছি? আমার বউ আমাকেই সামলে রাখতে হবে। একটা মাত্র কলিজার টুকরো আমার, সেদিকে কেউ তাকালে এই সব প্রোগ্রামের আল্লাহ হাফেজ করে দেব আমি।”
তিয়াশা বিরক্তিতে নাক-মুখ ফুলিয়ে গজগজ করে বলল,

__” অন্তত ফ্রেন্ডদের কাছে তো যেতে দাও। আমি কি বিয়ে দেখতে এসেছি, না কি স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়াতে এসেছি?”
এরপর আর দেরি করল না জায়ন। মুহূর্তের মধ্যে তিয়াশাকে কোলে তুলে নিল,হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে তিয়াশা দ্রুত জায়নের গলা জড়িয়ে ধরল, লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে তার। চারপাশের মানুষের চোখ এড়িয়ে জায়ন হেঁটে গিয়ে এক সোফায় বসিয়ে দিল তাকে, যেন নিজের কব্জায় রাখতেই হবে। পাশে বসে জায়ন হেসে বলল,
__” এবার শান্ত হয়ে বসে থাক, তবে আমার সঙ্গে থাকতেই হবে। আমি পরিকে ডেকে দিচ্ছি। আমার ওই তুরকিশ ফ্রেন্ড ও আসবে, তোকে বলেছিলাম না?”
তিয়াশা ভুরু উঁচিয়ে তাকাল, নরম গলায় বলল,

__” হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে। তো এখনো আসেনি কেন?”
জায়ন ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি টেনে উত্তর দিল,
__” ফোন করেছিল নিজেই বলল একটু লেট হবে আসতে।”
এইভাবে উৎসবমুখর ভিড়ের ভেতরে দাঁড়িয়েও আলাদা এক জগৎ তৈরি করেছে দুজন। একদিকে জায়নের দুষ্টুমি আর দখলদারি, অন্যদিকে তিয়াশার লজ্জা, বিরক্তি আর অস্থিরতার মিশ্রণ। হাসি, রাগ, ভালোবাসা আর অধিকার সব মিলিয়ে যেন সেই মুহূর্তে তাদের চারপাশের কোলাহল মিলিয়ে গেছে, বাকি আছে শুধু দুজনের নীরব খুনসুটি আর অদ্ভুত টান।

ওদের কথার মাঝেই কমিউনিটি সেন্টারের আলোক ঝলমলে প্রাঙ্গণে হঠাৎ যেন সবাই একসঙ্গে নিশ্বাস আটকে তাকাল গেটের দিকে দুই লাল পরি যেন আসমান থেকে নেমে এসেছে, টুকটুকে লাল বেনারসির আভায় আচ্ছাদিত, মুখ নিচু করে লজ্জার আবরণে ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে ভেতরে আসছে অনন্যা আর আরোহী; এমন সৌন্দর্যের সামনে মুহূর্তেই সমাগমের সব কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেল, যেন বাতাসও নিঃশব্দে শুধু এই দৃশ্যটাকে উপভোগ করছে।
সুরাইয়া বেগম আর তাহসান সাহেব মেয়েকে দেখে থমকে গেলেন। চোখের কোণ ভিজে উঠলো, খুশির সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়লো গালে। তাদের চোখে যেন ভেসে উঠলো অতীতের সব ছবি সেই ছোট্ট মেয়ে অনন্যা, যে একদিন কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে যেত, মায়ের আঁচল ছাড়া এক পা চলতে পারতো না, আজ সে লাল শাড়িতে বধূ সাজে দাঁড়িয়ে। এক অদ্ভুত অনুভূতি তাদের বুক ভরিয়ে দিলো একদিকে শান্তি, মেয়ে বিয়ের পরও একই বাড়িতে থাকবে, কিন্তু আবার বুকের ভেতর কষ্ট, কারণ বিয়ের পর মেয়ে অন্য কারো জীবনের দাবি হয়ে যাবে।

অন্যদিকে মোজাম্মেল সাহেব আর তার স্ত্রীর চোখের পানি যেন থামতেই চাইছে না। আরোহীর এই কনের সাজ তাদের চোখে আনন্দের মতোই কষ্টও নিয়ে এলো। এই রূপ যেন স্পষ্ট করে দিয়ে গেলো আজকের পর থেকে তাদের সবচেয়ে প্রিয় মেয়ে আর কেবল তাদের একান্ত থাকবে না, অন্য কারো জীবনের অংশ হয়ে যাবে। যদিও সান্ত্বনা এই যে, আরোহী এখনই পুরোপুরি বিদায় নিচ্ছে না তিন বছর পর আকাশের সংসারে যাবে। তবুও এই মুহূর্তটা বাবা মায়ের বুকের ভেতর কেমন যেন শূন্যতা তৈরি করছিল।
ছেলের বিয়ের খুশিতে আশরাফ সাহেবের মুখ জ্বলজ্বল করছে, যেন তিনি ভেতরে ভেতরে আনন্দে ভেসে যাচ্ছেন। তার হাসির ঝলক, অতিথিদের সঙ্গে মেলামেশা, সবকিছুতেই বোঝা যাচ্ছিল আজ তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে খুশি মানুষ। প্রণয় সাহেবের ভেতরেও যেন একই রকম আবেগ কাজ করছিল নিজের পরিবারের এই মিলনমেলার দিনে বুক ভরে আনন্দ অনুভব করছিলেন।

এদিকে তিয়াশার অবস্থা অন্যরকম, চোখে আছে অস্থিরতা, তার ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে বান্ধবী অনন্যা আর বনুর পাশে দাঁড়াতে, কিন্তু এই ঘাড় ত্যাড়া বাঘের বাচ্চা বরের অবাধ্য দখলদারি তাকে একেবারেই ছাড়ছে না তাই সে তার ডাগর ডাগর চোখে একেবারে মায়াভরা চাহনিতে জায়ন এর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় মিনতি করে বলল
__”জান, ওদের কাছে যেতে দাও না বর প্লিজ।”
এই ‘জান’ শব্দটা শোনামাত্র জায়নের বুকের ভেতর যেন ভূমিকম্প নেমে এলো, যেন তার সবকিছু থমকে গেল, সেই মধুর সম্বোধন শুনে মনে হলো প্রাণটাই বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে হাতে চলে আসবে, নিঃশ্বাস আটকে গেল, বুকের ধুকপুকানি দ্রুত হয়ে উঠলো, হঠাৎই সে তিয়াশার হাত শক্ত করে ধরে নিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললো,

__” এসব বলিস না জান, বিয়ে দেখা বাদ দিয়ে এখনই বাসায় নিয়ে চলে যাবো।”
তারপর একটু থেমে আবার নরম গলায় কৌশলী ভঙ্গিতে বলে উঠলো
__” ঠিক আছে যেতে দিতে পারি তবে একটা শর্তে।”
তিয়াশা কৌতূহল ভরা চোখে তাকিয়ে বললো,
__” কি শর্ত?”
তখন জায়ন ঠোঁটে বাকা হাসি টেনে নিয়ে আঙুল বাড়িয়ে তার নরম কোমল গাল আলতো করে টেনে বললো,
__” আগামী এক সপ্তাহ আমি যা বলবো তাই তোমার শুনতে হবে।”
তিয়াশার ভেতরে তখন একরাশ অস্থিরতা, ওদের কাছে যাওয়ার তাড়নায় সে না বুঝেই ছটফট করে বলে উঠলো,

__” ওকে ওকে বর সবকিছুতে রাজি, এবার যাই প্লীজ?”
তার কথার সঙ্গে সঙ্গেই জায়ন ভ্রু উঁচু করে আবারো সেই চেনা দুষ্টু হাসি টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
__” প্রমীজ তো?”
তিয়াশা অধীর গলায় উত্তর দিলো,
__” হ্যাঁ হ্যাঁ প্রমীজ।”
জায়ন তখন তৃপ্তির হাসি মেখে চোখে দুষ্টু ঝিলিক নিয়ে বললো,
__” ওকে যা তবে, তবে মনে রাখিস আমার নজর কিন্তু সারাক্ষণ তোর দিকেই থাকবে, আর গেট ধরার পাশে যেন তোকে একবারও না দেখি।”

তিয়াশা তখন তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো আর এক দৌড়ে ছুটে গেলো অনু আর আরোহীর কাছে, যেখানে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টি, মারিয়া আর পরি।
আর জায়ন একভাবে তাকিয়ে আছে তিয়াশার যাওয়ার দিকে তারপর এক বাকা হাসি দিয়ে সে ও চলে গেলো জেমস, সাগর, পলাশ, আহান
দের কাছে ।
তিয়াশা প্রথমেই অনুকে জড়িয়ে ধরতেই তার চোখেমুখে এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস ফুটে উঠলো, যেন বরের বউয়ের সাজে বান্ধবীকে দেখে সে নিজের বুকের ভেতর জমে থাকা আনন্দ আর আবেগ আর ধরে রাখতে পারছে না। তার স্নেহভরা গলায় কথাগুলো যেন গলগল করে বেরিয়ে এলো,

_””ওয়াও বনু, তোকে দেখে আমার ভাইয়া আজ একেবারে পাগল হয়ে যাবে।””
অনু হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে গেল, তার মুখের কোণে এক টুকরো মিষ্টি হাসি ঝলকে উঠলো। মাথা সামান্য নিচু করে মৃদু গলায় সে ফিরতি খোঁচা দিয়ে বলল,
__”আর তোমায় রোজ দেখে আমার ভাইয়া তো এমনিতেই পাগল হয়ে আছে, এখন শুধু পাবনায় পাঠানো বাকি।”
এই এক লাইনেই যেন পুরো পরিবেশ হেসে গড়িয়ে পড়লো। পরি, মারিয়া আর আরোহী একসঙ্গে দম ফাটানো হাসিতে ফেটে পড়লো, এমনকি তিয়াশাও চুপ থাকতে পারলো না, কিন্তু হঠাৎই নিজের গাল লাল হয়ে গেলো, সে সামলে নিতে না পেরে একেবারে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।
ঠিক তখনই আরোহী হঠাৎ মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো, ঠোঁট বাঁকিয়ে দুষ্টু-মিষ্টি রাগের সুরে খেপিয়ে বলল,

__”বনুর সঙ্গে খাতের হয়ে গেলি? এখানে আমি আছি, কেউ কি দেখতে পাচ্ছে না?”
তিয়াশা দুষ্টু হাসি নিয়ে অনুকে ছেড়ে এবার আরোহীকে জড়িয়ে ধরে খুনসুটি ভরা সুরে ফিসফিস করে বলল,
__”তুই তো আমার চুমু বেবি। আজকে তোকে দেখে আমার ভাইয়া সত্যিই আবারো টাস্কি খাবে বেবি। লাল পরী লাল পরী লাগছিস।”
এমন সময় মারিয়া হেসে চোখ মুছতে মুছতে মজা করে বলে উঠলো,
__”রুহি ভাবি, আমার ভাইয়া হার্ট সার্জন হবে বলে কথা। কিন্তু তোমাকে দেখে যতবার টাস্কি খায়, আমার ভয় হয় উনিই না একদিন হার্টের রোগী হয়ে বসে থাকে ।”
সবাই একসাথে ফেটে পড়লো হাসিতে, কারো হাসি থামছেই না, কারো আবার হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। সেই হাসির ভিড়ের মধ্যে বৃষ্টি গম্ভীর ভঙ্গিতে কিন্তু মিষ্টি কণ্ঠে বলে উঠল,

__”আমাদের ভাই গুলো এক একজন অবতার, আর এই অবতারদের ভিড়ে আমরা বেচারিরা একেবারে নিষ্পাপ হয়ে এসে পড়েছি।”
বৃষ্টির নাটকীয় ভঙ্গি আর কথার শেষে আবারও সবাই হো হো করে হেসে উঠলো, যেন স্টেজ হাসির ঝড়ে দুলে উঠলো।
__”কিন্তু আমাদের এই নিষ্পাপ ফ্রেন্ড দের মধ্যে সেই উলোইচণ্ডী ফ্রেন্ড টা কোথায় মাল টা বলে ছিল রাস্তায় এখনো আসলো না ।”
পরি কথাটা বলেই এমন ভঙ্গিতে চারদিকে তাকালো যেন এখনই যদি রুবিনা এসে পড়ে তবে ঝট করে ধরে শাসন করে দেবে। চোখে মুখে অস্থিরতা, বিরক্তির সাথে মিশে আছে মজা করার ভঙ্গি।
এরপরই আরোহী দম ধরে রাখা হাসিটা ছেড়ে দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বিরক্তি ভরা গলায় বলে উঠলো,

__”ও আজকে আসুক, কোন চিপায় গিয়ে পড়সে কে জানে। ফোন করলে পাওয়া যায় না, না তো ফোন ধরলে ঠিকঠাক কথা বলে। বদমাস বেডি আসুক আজ, দেখি আমি কেমনে ছাড়ি।”
তার গলায় বিরক্তি থাকলেও চোখেমুখে ছিলো এক অদ্ভুত আনন্দের ঝিলিক, যেন বন্ধুদের নিয়ে এমন বকাঝকা করাটাও আসলে আনন্দেরই অংশ।
এর মধ্যেই তিয়াশা হেসে আরোহীর গাল টেনে নরম স্বরে একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
__”এরকম বলিস না আমাদের রুবি বেবি কে, হয়তো কোন সমস্যায় আছে। বুঝিস, ওর আকদের দিন ওর হবু বর চলে গেল আকদ না করেই, কেমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বল তো। ও যে তোর বিয়েতে আসছে এই অনেক বড় ব্যাপার।”

তিয়াশার গলায় ছিলো মায়া, চোখে ছিলো মমতার ঝিলিক, যেন ও সত্যিই রুবিনার জন্য কষ্ট অনুভব করছে। তার কথায় এক মুহূর্তেই চারপাশটা ভারী হয়ে উঠল।
তিয়াশার কথা শুনে আরোহী আর পরি দুজনেই থেমে গেলো। দুজনের মুখের দুষ্টুমি মিলিয়ে গিয়ে এল নিঃশব্দ বোঝাপড়ার ছাপ। তারা দুজনেই বুঝলো তিয়াশা ঠিকই বলছে, রুবিনার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে।
এরমধ্যেই তাদের চোখ গিয়ে আটকালো হল গেট পেরিয়ে আসা এক ঝলমলে রূপসী রমনীর উপর। গাঢ় নীল রঙা শিকিউঞ্জের শাড়ি পরে, ফুল হাতা ব্লাউজে যেন আলো ছড়াচ্ছে রুবিনা। ঢেউ খেলানো চুলগুলো কাঁধের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে, মাঝে মাঝে সে হাত দিয়ে চুল সরিয়ে আবার হাসি ছুঁড়ছে দুর থেকেই তাদের দিকে । ঠোঁটে পিংক লিপস্টিক, মুখে হালকা মেকআপ, আর গলায় হালকা জুয়েলারি সব মিলিয়ে তাকে আজ যেন কোনো সিনেমার নায়িকা থেকে একটুও কম লাগছে না। রূপের ঝলকে যেন মুহূর্তেই সবাইকে ঘায়েল করে দেবে সে।
রুবিনাকে দেখে পরি হা করে তাকিয়েই তিয়াশা আর আরোহীর উদ্যেশ্যে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

__”এই মাল টার না বিয়ে ভেঙে গেছে, তাহলে বেবি টারে এত বিবাহিত বিবাহিত কেন লাগছে?”
তার কণ্ঠে বিস্ময়ের সাথে লুকানো খুনসুটি, চোখে মুখে মিশে আছে কৌতূহলের ঝলক।
তিয়াশা সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকিয়ে পরির দিকে তাকিয়ে রাগ ভরা ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
__”তোর কি দেখে ওড়ে বিবাহিত মনে হলো? যতসব আজাইরা কথা বার্তা! আর ওর বিয়ে হলে আমরা জানবো না নাকি?”
অন্যদিকে আরোহী রুবিনার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে হেসে ফেলল, যেন তার চোখ বিশ্বাস করতে চাইছে না এ একি রূপ,হাসতে হাসতেই সে পরির কোথায় যোগ দিয়ে বলল,

__”না রে বেবি, পরি ঠিক বলছে। মালটার নাকে দেখ, নাকফুল তারপর দেখ না কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। অবশ্য তোরা সব হলো সুন্দরী, তোদের এক এক সময় এক এক রূপ গজায়, কে জানে কেমনে?”
তিয়াশা হেসে খুনসুটি ভঙ্গিতে কুনুই দিয়ে আরোহীকে গুত মেরে বলল,
__”নিজে কি কম সুন্দর, আর নাকফুল পড়ছে তাই হয়তো ওরকম লাগছে।”
তার কণ্ঠে খোঁচা দেওয়ার আনন্দ, চোখেমুখে উজ্জ্বলতা—যেন বন্ধুদের নিয়ে এই খুনসুটির মাঝেই বিয়ের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে।

এর মধ্যেই হাওয়ার ঝাপটার মতো এসে রুবিনা হেসে খেলে দু’হাত মেলে ওদের দুজনকে জড়িয়ে ধরল। তার আলিঙ্গনে ছিল উষ্ণতা, আবার ভেতরে ভেতরে এক অদৃশ্য শূন্যতার ছাপও লুকিয়ে ছিল। তারপর স্নেহমাখা অনুভূতি নিয়ে অনুকে জড়িয়ে ধরে ওর প্রসংশা করল একটু পরেই সে আরোহীর হাত ধরে মিষ্টি হেসে এমন ভঙ্গিতে বলল,
__”আমার বেবি টা তো মনে হচ্ছে আজকে আকাশ ভাইয়া কে এই রূপ দিয়ে খু”ন করে দেবে।”
তার কথায় যেন হাসির খুনসুটি মিশে গেলো চারপাশে, কিন্তু চোখে কোথাও যেন চাপা কষ্টের ছায়া ঝলসে উঠছিল।
আরোহী এক মুহূর্তের জন্য ভ্রু কুঁচকে, কৌতূহলী দৃষ্টিতে রুবিনার দিকে তাকিয়ে মৃদু রাগী ভঙ্গিতে বলে উঠল,
__”আমার কথা বাদ দে, তুই বল তোরে কেন অন্যরকম লাগছে?”
তার কণ্ঠে ছিলো এক অদ্ভুত মিশ্রণ মজা করার ভঙ্গিও আছে, আবার সন্দেহের শীতল ছোঁয়াও রয়েছে।”
রুবিনা অবাক হয়ে চমকে তাকাল, ভ্রু উঁচু করে অবিশ্বাসের সুরে বলল,

__”কি রকম লাগছে?”
সে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না, আর তার অস্বস্তিটা মুহূর্তেই চারপাশে ছড়িয়ে গেল।
আরোহীর জবাব আসার আগেই পরি মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া স্বরে বলে ফেলল,
__”বিবাহিত বিবাহিত।”
এক কথাতেই যেন চারপাশের আবহাওয়া বদলে গেল।
কথাটা শোনা মাত্র রুবিনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, তার নিশ্বাস যেন আটকে গেল। হাত দুটো অজান্তেই কাঁপতে শুরু করল, ঠোঁট শুকিয়ে গেল, আর হঠাৎ করেই গলায় যেন কিছু আটকে কাশি উঠে গেল তার। সেই কাশির মধ্যে লুকিয়ে রইল গভীর অস্বস্তি, আতঙ্ক আর অতীতের দগদগে স্মৃতি।
তিয়াশা ভয় পেয়ে দ্রুত দৌড়ে গেল, টেবিল থেকে একটা পানির গ্লাস তুলে নিয়ে রুবিনার সামনে এগিয়ে দিল। তার কণ্ঠে অসন্তোষ আর মমতা একসাথে মিশে গিয়ে বেরিয়ে এলো,

__”দেখলি তো তোদের উল্টো পাল্টা কথায় ওর কাশী উঠে গেলো।”
তিয়াশার চোখে রাগ ঝলসে উঠল, যেন সে নিজের বন্ধু রুবিনাকে কোন দোষারোপ সহ্য করতে পারছে না।
তিয়াশা রুবিনাকে ধীরে ধীরে সোফায় বসিয়ে দিল, তার কাঁধে হাত রেখে আশ্বাসের ছোঁয়া দিল। বাকি সবাইও দ্রুত এসে কাছে বসলো, চারপাশটা এক মুহূর্তে গম্ভীর হয়ে উঠল, যেনো আনন্দের মাঝেই হঠাৎ অজানা এক ভারী ছায়া নেমে এলো। শুধু স্টেজে তখনো রয়ে গেল অনন্যা আর আরোহী,।
এদিকে জায়ন দাঁড়িয়ে ছিল তার বন্ধুদের সঙ্গে, ঠোঁটে হালকা হাসি, কিন্তু চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি গিয়ে আটকে আছে তার বউয়ের দিকে। ভিড়ের মাঝেও সে যেন কেবল তাকেই খুঁজে পাচ্ছে, তার প্রতিটা অঙ্গভঙ্গিই যেন জায়নের নজর কেড়ে নিচ্ছে।

চারপাশে আবার হাসি-আনন্দ ফিরতে শুরু করলো। একে একে সবাই এগিয়ে এসে আরোহী আর অনন্যার সাথে ছবি তুলতে লাগলো, ক্যামেরার ফ্ল্যাশে আলো ঝলসে উঠতে থাকলো, মুহূর্তগুলো বন্দী হয়ে যাচ্ছিল আনন্দময় ছবিতে।
তারপর একে একে সবাই চলে গেল গেটের দিকে বরযাত্রী দের জন্য গেট ধরতে। কিন্তু সেই কোলাহলের ভেতরেও এক কোণে সোফায় পাশাপাশি বসে রইল তিয়াশা আর রুবিনা দুজনের মনেই তখনো চাপা কথা আর অস্বস্তির ছায়া।
আর সেই মুহূর্তেই জায়নও ধীরপায়ে এগিয়ে এসে তিয়াশার পাশে দাঁড়ালো। তার উপস্থিতি যেন এক নিঃশব্দ ভরসার মতো, চারপাশের ভিড়ের মাঝেই ওদের কাছে আসা যেনো এক অন্যরকম গুরুত্ব নিয়ে এলো।

কিছুক্ষণ ধরে পুরো হলঘর জুড়ে শুধু হাসি-আনন্দ আর ক্যামেরার ঝলকানি। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু আর বান্ধবীরা সবাই নিজেদের মতো করে ফটোসুটে ব্যস্ত কেউ স্টেজে দাঁড়িয়ে দলবেঁধে ছবি তুলছে, কেউ আবার কনে-বরের সাথে মিষ্টি মুহূর্তগুলো ধরে রাখছে। চারপাশে এক অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠেছে পরিবেশ, যেন প্রতিটা মুখে সুখের আলো ঝলমল করছে।

আকাশ আর ইউভির জন্য সাজানো হয়েছে একদিকের স্টেজ সোনালী আলো আর লাল-সাদা ফুলে ভরা জমকালো সাজসজ্জা, যেখানে দুই পরিবারের লোকেরা সারি বেঁধে ছবি তুলছে। অন্যদিকে আলাদা এক স্টেজে বসানো হয়েছে আরোহী আর অনুকে, রাজকীয় সাজে তাদেরও ঘিরে রয়েছে হাসিখুশি ভিড়। তবে রীতিমতো নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে বিয়ের মুহূর্ত না আসা পর্যন্ত বর-কনের মুখোমুখি দেখা হবে না, যেন আনন্দে ভরা ঐতিহ্যের নিয়মটাও ঠিকঠাক মেনে চলা হয়।

কিন্তু এই নিয়মের মাঝেই হালকা হাসির রেশ ছড়িয়ে গেলো, কারন জায়ন এসব নিয়ম কিছুই মানেনি ।আসলে জায়নের সেই বিয়ের দিনটা ছিল একেবারেই আলাদা। তার চোখে তখন ছিল শুধু এক অদম্য তাড়না কখন তার বউ আসবে, কখন একবার সামনে বসবে। নিয়ম-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান সবকিছুর বাইরে গিয়ে যেন তার ভেতরে কেবল এক অস্থির ভালোবাসার খোঁজ ছিল।
যেখানে আজ আকাশ আর ইউভি, কিংবা আরোহী আর অনুর বিয়ে ঘিরে নিয়ম মেনে সাজানো পরিবেশে ধৈর্য ধরে সবাই অপেক্ষা করছে, সেখানে জায়নের বিয়ের দিনটা একেবারে অন্যরকম গল্প হয়ে থেকে গেছে পরিবারের সবার মনে।
হলঘরের ভিড়ের ভেতরে, আলো ঝলমল আর হইচইয়ের মাঝেই রায়ানের কানে ভেসে এলো এক চেনা কণ্ঠস্বর,

__” রায়ান ভাই কেমন লাগছে?”
শব্দটা শোনার সাথে সাথেই যেন রায়ানের বুকের ভেতর কেমন এক অজানা ঝড় বয়ে গেলো। এতক্ষণ সে আকাশ আর ইউভির সঙ্গেই ছিল, হাসি-মজা, ছবি তোলায় ব্যস্ত, কিন্তু মনটা অদ্ভুতভাবে খালি খালি লাগছিল। আসলে সে জানতো, এই ভিড়ের মধ্যে তার চোখ সবসময় খুঁজছে কেবল মারিয়াকে।
পেছন ফিরে তাকাতেই যেন নিঃশ্বাস আটকে গেলো, তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মারিয়া তার দেওয়া সবুজ গাউনটায়, লম্বা খোলা চুল বাতাসে দোল খাচ্ছে, দুই হাত ভর্তি ডিজাইনার কাঁচের চুড়ি থেকে কাচের মিষ্টি টুংটাং শব্দ বেরিয়ে আসছে। সেই রূপে রায়ানের চোঁখ যেন ধাঁধিয়ে গেলো, মনে হলো এই ভিড়ের মাঝে সে একাই আলো ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রায়ান তার কিশোরীর দিকে তাকিয়ে যেন নিজের বুকের ভেতরের অস্থিরতাকে শব্দে বেঁধে ফেলতে চাইল, গভীর আবেগমাখা কণ্ঠে বলে উঠলো,

__”মৃত প্রাণীর জীবন্ত হয়ে ওঠার কারণের মত লাগছিস, থমকে যাওয়া বাতাসের বুকে ঝড় তুলে দেওয়ার ক্ষমতার মত লাগছিস, অমাবস্যায় জোনাকি হয়ে আলোর কিরন ঢেলে দেওয়ার মত লাগছিস তুই।”
কথার প্রতিটা শব্দে ছিল অব্যক্ত ভালোবাসা, এক অদম্য আকাঙ্ক্ষার স্বর, কিন্তু এতো কাব্যিক অনুভূতি মারিয়ার মাথার উপর দিয়েই চলে গেলো। সে চোখ পাকিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
__” মানে?”
রায়ান গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে দুই হাত কোমরে রেখে একটু বিরক্ত অথচ মায়াভরা সুরে বলল,
__”কথা গুলো মনে করে রাখ, যেদিন এই কথা গুলোর মানে বুঝবি? সেদিন এসে জবাব দিবি, কারণ এই সব শব্দের মধ্যে আমার অনুভূতি খুঁজে পাবি।”
তার চোখে ভাসছিল একরাশ প্রতীক্ষা, যেন সে জানে একদিন এই কিশোরী তার কথার গভীরতা বুঝতে পারবে। একটু থেমে আবার কঠিন অথচ নরম সুরে হুঁশিয়ারির মতো বলে উঠল,

__”সোজা গিয়ে তিউ আপুর পাশে বসবি, এদিক ওদিক লাফাতে দেখলে, মাইর একটাও নিচে পড়বে না।”
কথাটা বলার সময় তার চোখে মায়া লুকোনো ছিল, কিন্তু স্বরটা রাগী গণ্ডারের মতোই শোনালো মারিয়ার কাছে।
মারিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে ছোট্ট বাচ্চার মতো মুখ গোমড়া করে বলে উঠল,
__”ধুর ভাল লাগে না, এক তো কি বলো বুঝি না, উপর থেকে গন্ডারের মত ধমকি দিতে থাকো। জিজ্ঞেস করতে আসাই ভুল হয়ে ছে।”
এই বলে গোমরা মুখ করে পা ঠুকতে ঠুকতে চলে গেলো সে, তার হাতের কাঁচের চুড়ি গুলো টুংটাং করে কেঁপে উঠলো। রায়ান তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো, চোখ আবার গিয়ে আটকালো তার কিশোরীর চলে যাওয়া দিকেই। ঠোঁটে অচেতনভাবে একটা হালকা তেতো-মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো, ভেতরের অস্থিরতাকে সামলে নিয়ে আস্তে গলায় ফিসফিস করে বলে উঠল,

__”যেতে দিচ্ছি, কারণ একবার ধরলে আর যেতে পারবি না বাচ্চা।”
কথাটার মধ্যে ছিল একরাশ গোপন টান, দখলদার ভালোবাসা, আর এক অদম্য প্রতিশ্রুতি, যা হয়তো শুধু রায়ান নিজেই শুনতে পেলো সেই ভিড়ের কোলাহলের ভেতরে।

জেমস এসে জায়নের কানে কানে কি যেন বলল। হঠাৎ জায়নের চোখে এক উজ্জ্বল ঝিলিক খেলে গেলো। মুহূর্তেই সে উঠে দাঁড়িয়ে তিয়াশার দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বলে উঠল,
__” জান, বস… আমার ফ্রেন্ড এসে গেছে, রিসিভ করে আসি।”
তিয়াশা চুপচাপ মিষ্টি হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল, তার চোখে যেন বোঝা যাচ্ছিল স্বামীর আনন্দ মানেই তার আনন্দ।

জায়নের পা এগিয়ে গেল গেটের দিকে। গেটের কাছে পৌঁছাতেই যেন পুরো পরিবেশ বদলে গেল। কালো রঙের ঝকঝকে রোলস রয়েস গাড়ি ধীর গতিতে এসে দাঁড়ালো। তার পেছনে এসে থামল আরেকটা কালো রঙের জী ভেগান, যার চাকা ঘুরতেই মনে হচ্ছিল মাটি কেঁপে উঠছে।
পেছনের গাড়ি থেকে নেমে এলো চারজন বিদেশী দেহরক্ষী। লম্বা চওড়া, চোখে কালো সানগ্লাস, গায়ে ব্ল্যাক স্যুট, হাতে রাইফেল। তাদের পায়ের শব্দেই যেন বাতাস ভারী হয়ে উঠল। মুহূর্তেই বোঝা যাচ্ছিল এরা কেবল বডিগার্ড নয়, যেন চলন্ত দেওয়াল, যাদের উপস্থিতিতে কেউ সাহস করে নিশ্বাসও ফেলতে পারছে না।

সামনের গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে নামলো এক লম্বা সুঠামদেহী লোক কালো জ্যাকেট, কালো জিন্স আর কালো ক্যাপ তার গায়ে যেন এক রহস্যের আবরণ জড়িয়ে দিয়েছে। নিঃশব্দে, কিন্তু কর্তৃত্বে ভরা পদক্ষেপে সে এগিয়ে এসে প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা খুলতেই মুহূর্তেই চারপাশের মানুষের চোখ আটকে গেলো সেই দরজার গায়ে। যেন পুরো হলঘর নিস্তব্ধ হয়ে একমাত্র সেই মানুষটির আগমনের অপেক্ষা করছে।
গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তে মনে হলো দমকা এক ঝড় বয়ে গেলো, বাতাসের সঙ্গে তার দেহের তাপ আর ব্যক্তিত্ব যেন মিশে চারপাশের মানুষের শরীর কাঁপিয়ে দিলো। জায়নের মতোই লম্বা, কিন্তু আরও বেশি রুক্ষ ও ভয়ানক আকর্ষণীয় টোনড ফর্সা গায়ের রঙ, সুঠাম ক্রীড়াময় দেহ। ডার্ক ব্লু ব্র্যান্ডেড টাক্সেডোর ঝলমলে কাপড় গায়ে লেগে তার প্রতিটি মাংসপেশীর রেখা ফুটিয়ে তুলছে। বুকের ওপর কালো শার্টের দুটো বোতাম খোলা, সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে কালো কালি মাখা উল্কি, যেন এক অন্ধকার অতীতের গল্প বলছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর আর একই সঙ্গে মোহনীয় ছিল তার ধূসর নীলাভ চোখ যে চোখের দিকে তাকালে মনে হবে নিজের ইচ্ছাশক্তিই কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে, পতন অনিবার্য। পাতলা গোলাপি ঠোঁট নিকোটিনের দাগে হালকা বাদামি, কিন্তু তাতেও এমন এক দাপট লুকিয়ে আছে যে সবার বুকের ভেতর হাহাকার তুলল। আর দামী রিস্টওয়াচ, ব্র্যান্ডেড জুতো, চওড়া কাঁধ আর হাঁটার ভঙ্গিতে প্রকাশ পেলো এ লোকের আগমন মানে বিপদের অশনি সংকেতও বটে।
হলঘরে উপস্থিত সবাই হা করে তাকিয়ে আছে, যেন সময় থমকে গেছে। কেবল জায়নের ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক প্রাণখোলা হাসি। দুজনের চোখাচোখি হতেই যেন পুরোনো বন্ধুত্বের উষ্ণতা আর ঝড়ের তেজ মিশে গেলো। জায়ন এগিয়ে গিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
কায়ান দেমির আর্সলান হেসে উঠলো, ভারী কণ্ঠে গমগম করে বললো,

__”আফটার সো ম্যানি মান্থস ব্রো, এন্ড ইউ লুক সো ড্যাশিং ম্যান।”
জায়নও হেসে পিঠ চাপড়ে জবাব দিলো,
__”এন্ড ইউ লুক মার্ডারিয়াস ম্যান।”
দুজনের হাসাহাসি আর উচ্ছ্বাসের মধ্যেই যেন ঘরটা আবার প্রাণ ফিরে পেলো। এরপর কায়ান পাশে দাঁড়ানো টুপি পরা লোকটার দিকে আঙুল তুলে বললো,
__”মিট মাই বেস্ট ফ্রেন্ড কাম বডিগার্ড, নিকোলাই রুশো।”
জায়ন নিকোলাইয়ের সঙ্গে দৃঢ় হ্যান্ডশেক করে ভেতরে নিয়ে গেল, তারপর তার মা বাবা আর পরিবারের সবার সঙ্গে একে একে পরিচয় করিয়ে দিল। চারপাশে কৌতূহলী চোখ, নতুন মুখ দেখে ফিসফিসানি, আর গম্ভীর উপস্থিতির সঙ্গে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল হল ঘরে।
এর মধ্যেই কায়ান ভেতরে এসে চারপাশ দেখে একখানা হেসে উঠল। জায়নের কাঁধে হাত রেখে সে বলে উঠল,

__” আমাদের ভাবী কোথায় ব্রো? যে আমার কোল্ড ম্যান এর মন চুরি করে বসে আছে।”
জায়ন ঠোঁট কামড়ে একটু দুষ্টু হাসি দিয়ে কায়ানকে সেই দিকেই ইশারা করল, যেখানে তিয়াশারা বসে আছে। ভারি পদক্ষেপে ওদের দিকে এগোলো কায়ান, আর তার পিছনে আসছে পাঁচজন সুঠাম দেহরক্ষী। তাদের কালো পোশাক, শীতল চোখ আর চাপা দাপটে যেন গোটা কমিউনিটি হলটা মুহূর্তেই কেঁপে উঠল। চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা নারী-পুরুষ, বিশেষ করে মেয়েরা, বিস্ময়ে আর আকর্ষণে চোখ ফেরাতে পারছিল না একদিকে জায়ন, অন্যদিকে তার বিদেশি বন্ধু কায়ান, যেন দুই ভিন্ন আভিজাত্যের আগুন।
তিয়াশাদের কাছে পৌঁছাতেই কায়ানের চোখ আটকে গেল। মুহূর্তেই তার দৃষ্টি চমকে উঠল তিয়াশার পাশে বসা রুবিনার দিকে। রুবিনা যেন হঠাৎ অস্বস্তিতে ঘেমে গেল, শাড়ির আঁচল শক্ত করে মুঠো করে ধরল, ঠোঁট শুকিয়ে আসছে, চোখ বড় বড় হয়ে তাকিয়ে আছে।
ঠিক তখনই জায়ন সবার সামনে গর্বভরে বলে উঠল, তিয়াশাকে দেখিয়ে,

__” মিট মাই ওয়াইফ, মাই লাইফ।”
তিয়াশা হালকা লজ্জায় মাথা নিচু করল, আবার কায়ানের দিকে সালাম জানাল। পাশে বসা রুবিনা ইতিমধ্যে অস্থির হয়ে উঠেছে, কাঁপা হাতে শাড়ির প্রান্ত চেপে ধরছে, যেন ভিড়ের মাঝেই হঠাৎ নিশ্বাস নিতে পারছে না। কায়ানের পাশের দেহরক্ষীরা পর্যন্ত কয়েক মুহূর্ত রুবিনার দিকে তাকিয়ে রইল, যা ওর অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিল।
কায়ান দৃষ্টি সরিয়ে আবার তিয়াশার দিকে তাকাল, ঠোঁটে বাঁকা হাসি, আর কণ্ঠে মিশল কটাক্ষ আর প্রশংসা
__” তাহলে আপনি আমার কোল্ড ম্যানের লাইফ। ভেরি গুড, ভেরি গুড।”
তিয়াশা লাজুক ভঙ্গিতে সালাম করল, তারপর জায়নের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
__” নাইস চয়েস ম্যান, সি লুক লাইক এঞ্জেল।”
কিন্তু জায়ন তৎক্ষণাৎ চোখ পাকিয়ে, স্বরে খানিক গম্ভীর হয়ে জবাব দিল,
__” ম্যান, প্লিজ এরকম আর বলো না। আমি সহ্য করতে পারি না।”

কায়ান হেসে উঠে আবার জায়নের পিঠ চাপড়াল, সেই হাসির ভেতরে যেন খানিক ব্যথার সুর মিশে গেল। সে বলল,
__” ডোন্ট ওয়ারি ম্যান। তুমি আমাকে ভালো করেই চেনো। আমার শুধু একজনই ছিল, কিন্তু এখন সে আর নেই।”
এমন বলতে বলতেই হঠাৎ রুবিনার দিকে এক পলক তাকাল কায়ান। তারপর ঠাণ্ডা কণ্ঠে আরও যোগ করল,
__” কিন্তু আমার এক এনিমি আছে। তার দিকে নজর আমি নিশ্চই রাখব।”
কথাগুলো শেষ হতেই দুজন বন্ধু আবার জোরে হেসে উঠল, হাসির আড়ালে জমাট বাঁধা রহস্য আর পুরনো শত্রুতার ইঙ্গিত যেন কেউ টেরও পেল না। তবে রুবিনার অবস্থা তখন একেবারেই খারাপ। সে ঘেমে চুপচুপে হয়ে গেছে, বুক ধকধক করছে, আর চোখের পাতা থরথর কাঁপছে তবুও মুখে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।
কায়ান এবার সরাসরি রুবিনার দিকে তাকিয়ে, মুখে ব্যঙ্গের ছাপ নিয়ে তিয়াশাকে প্রশ্ন করল,

__” উনি কে ভাবী? ওনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে এক্ষুনি অসুস্থ হয়ে যাবেন।”
তিয়াশা কাঁধের ওড়না ঠিক করে হালকা হেসে বলল,
__” ও আমার ফ্রেন্ড রিদিয়া রুবিনা শেখ। হ্যাঁ, একটু অসুস্থ লাগছে, তাই আমার সঙ্গে বসেছে।”
কায়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে, গলায় হালকা তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলে উঠল,
__” ও আচ্ছা… শেখ।”
এরপর সে হাত বাড়িয়ে দিল রুবিনার দিকে, আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,
__” হ্যালো মিসেস শেখ… ওহ, সরি মিস শেখ।”
চারপাশের পরিবেশ যেন মুহূর্তে জমাট বেঁধে গেল। জায়নের তীক্ষ্ণ চোখে ধরা পড়ছিল গণ্ডগোলের আভাস, কিন্তু তার চতুর দেমাগ ঠিক বুঝতে পারছিল না আসল গলদটা কোথায়।
রুবিনা নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে, চোখ ফিরিয়ে, কায়ানের হাত অগ্রাহ্য করল। তারপর কেবল তিয়াশার দিকেই তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে বলল,

__” দোস্ত, আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি। চোখে-মুখে পানি দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”
এই বলেই রুবিনা ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। ভেতরে ঢুকেই যেন শ্বাস নিতে পারছিল না, বারবার টলমল হাতে কল খুলে ঠাণ্ডা পানি ছিটাচ্ছিল চোখে-মুখে। আয়নায় তাকিয়ে যেন নিজের প্রতিবিম্বকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যাকে এত বছর এড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছে সেই মানুষটা আজ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁট কাঁপছে, বুক ওঠানামা করছে অস্বাভাবিকভাবে, চোখের ভেতর এক অদৃশ্য ভয় গেঁথে বসে গেছে।
প্রায় দশ মিনিটের মতো ওয়াশরুমে কাটানোর পর সে বেরোতে উদ্যত হলো। দরজাটা ঠেলে বাইরে আসতেই বুকটা হিম হয়ে গেল। ঠিক দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কায়ান। ঠোঁটে বাঁকা হাসি, চোখে সেই পুরনো হিংস্র আলো।
রুবিনা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে পেছন থেকে ভেসে এলো কায়ানের কণ্ঠ,

__” আচ্ছা তাহলে আমার ফ্রেন্ডের ওয়াইফ আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড মিস দের ফুটিয়া… উপস! সরি, মিসেস আর্সলান। দেখে মনে হলো বিয়ের কথাটা এখনো হয়তো বেস্ট ফ্রেন্ডরা জানে না, তাই না মিসেস আর্সলান?”
এক ঝলক দৃষ্টি ঘুরিয়ে রুবিনা তাকালো কায়ানের দিকে। চোখ দুটো যেন আগুনে জ্বলছে। দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠল,

__” আপনার মত একটা ওলাউটা জায়ন ভাইয়ার মত ভালো মানুষের ফ্রেন্ড হয় কী করে? যদি জানতাম এই চেহারাটা এখানে এসেও দেখতে হবে, তাহলে আসতামই না।”
কায়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে, বিদ্রূপের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে জবাব দিল,
__” তোর বেস্ট ফ্রেন্ডরা জানে তুই কেমন ডেঞ্জারাস সবার লাইফে?”
রুবিনার বুক ওঠা-নামা করছে, কিন্তু স্বর আরও কঠিন, আরও ধারালো হয়ে বেরিয়ে এলো,
__” জায়ন ভাইয়া জানে আপনি কেমন আমার পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে আমাকে বিয়ে করেছেন। আমি যে কি না আপনার দূরসম্পর্কের ভাগ্নী । আপনি কতটা জঘন্য।”
কায়ান পকেটে হাত ঢুকিয়ে, গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, ভারি গলায় বলল,
__” উরে এসে জুড়ে বসা ভাগ্নী ছিলেন মিস দের ফুটিয়া… বাট নাউ ইউ আর মিসেস আর্সলান এন্ড তোকে দেখে অসুস্থ লাগছে সো গিয়ে গাড়িতে বস।”

শরীর কাঁপছিল রাগে। রুবিনা প্রায় থরথর করতে করতে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। বেরোনোর মুহূর্তে ঘুরে তাকিয়ে, চোখ লাল করে, দাঁতে দাঁত চেপে মিডিল ফিঙ্গার দেখিয়ে গর্জে উঠল,
__” ফাঁ*ক ইওর গাড়ি , ফাঁ*ক ইইউ ব্লা*ডি হেল শা*লা অ্যানাকোন্ডার জাত।”
ওই মুহূর্তেই কায়ানের গলায় ফেটে পড়ল এক ভয়ানক শীতল হাসি। হাসতে হাসতেই বিষ ছুঁড়ে দিল,
__” সরি টু সে, মিসেস দের ফুটিয়া, আই কান্ট ফাঁ*ক গার্লস লাইক ইউ। বাট ইফ ইউ ওয়ান্ট… আই উইল ফাঁ*ক ইউ লাইক এ হোর এন্ড অল নাইট।”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭২ (২)

হাওয়ায় ভেসে এলো কথাগুলো। পা চালিয়েই যাচ্ছিল রুবিনা, মুখে আর কোনো উত্তর নেই, কিন্তু ভেতরের কান্না, অপমান আর ক্ষোভ যেন কানে আগুন ধরিয়ে দিল। বুকের ভেতর ধুকপুক করে চলছিল, মনে হচ্ছিল চারপাশের বাতাসটাই থেমে গেছে।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭৩ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here