তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭৩ (২)
নীল মণ
বিশাল আর জাঁকজমকপূর্ণ সেই বহুল কমিউনিটি হলে এখন যেন আনন্দ আর উত্তেজনার ঢেউ। চার জন কে ঘিরে দাড়িয়ে আছে পুরো পরিবারের সবাই আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক ঝলমল করছে আলোয়, কানে ভেসে আসছে হাসি ঠাট্টা কথোপকথনের গুঞ্জন।
কিন্তু এই ভিড়ের মাঝেওএকদিকে ইউভির চোখ যেন আটকে গেছে কেবল এক জায়গায় তার হৃদয়পাখি অনন্যার দিকে। লাল বেনারসিতে বিয়ের কোণে সাজ গোজে আজকের দিনে অনন্যাকে এতটা অপরূপ লাগছে যে ইউভির বুক কাঁপছে। তার চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আবেগ আর অস্থিরতা। মনে হচ্ছে, সে যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির বাঁধনে বেঁধে গেছে, চোখ সরাতে চাইলেও পারছে না। অনন্যার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার গলা শুকিয়ে আসছে, অথচ দৃষ্টি ফেরানো তার কাছে যেন অসম্ভব এক কাজ।
অনন্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুভূতিতে ভেসে যাচ্ছে। পরিবারের, আত্মীয়দের, সবার মাঝে এইভাবে বসে থাকার মধ্যেও সে অনুভব করছে ইউভির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার ওপর পড়ছে প্রতিক্ষণ। লজ্জায় তার সারা মুখ জুড়ে যেন সাত রঙের আলো নেমে এসেছে। গাল লালচে হয়ে উঠেছে, ঠোঁট কাঁপছে, মাথা নুইয়ে ফেলেছে নিচের দিকে চোখ তো ইউভির চোখে মিলাতে পারছেই না। শুধু বুকের ভেতর ধুকপুকানি আর কানে গরম হয়ে ওঠার অনুভূতি।
আরেক দিকে আকাশ আর আরোহী অবস্থাও কিছু কম নয়। আকাশের মনে হচ্ছে একেবারে বুক ফেটে যাবে উত্তেজনায়। সে বারবার বুকে হাত দিচ্ছে, শ্বাস সামলাতে পারছে না, মনে মনে বিড়বিড় করছে,
__” হায় আল্লাহ, আজ আমি শেষ। এই মেয়ে আজকে আমায় পুরোপুরি শেষ করে দেবে।”
তার চোখে স্পষ্ট ভয় আর মুগ্ধতা একসাথে খেলা করছে। আকাশের মুখ লাল হয়ে গেছে, ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়বে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরোহী খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে আকাশের এই অস্বস্তির অবস্থা। তার চোখের মিষ্টি ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে কৌতুক আর দুষ্টুমি। সবার ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই সে আকাশের দিকে চোখ টিপে দিল। মুহূর্তেই আকাশের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, শ্বাস গলায় আটকে গেল, চারপাশের সবকিছু যেন থমকে গেল তার কাছে। মনে হলো যেন পুরো দুনিয়া একপাশে, শুধু এই চোখের ইশারাটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝড়।
হল ভর্তি মানুষজনের ভিড়েও এই চারজনের ছোট্ট ছোট্ট আবেগ যেন চারপাশকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছিল। হাসি, লজ্জা, উত্তেজনা সবকিছু মিলে যেন অন্যরকম এক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছিল।
হঠাৎ কাজী সাহেব তাঁর সামনে কাগজপত্র খুলে বসলেন। গম্ভীর অথচ শান্ত কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন,,
__”বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আজ আমরা আল্লাহর নামে, রাসুলুল্লাহ এর সুন্নাহ মোতাবেক দুই জোড়া তরুণ তরুণীর পবিত্র নিকাহ্ সম্পাদন করতে যাচ্ছি।”
সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেল, শুধু বুকের ধকধক শব্দ যেন শোনা যাচ্ছিল।
প্রথমে নাম ডাকা হলো ইউভিকে সাদা শেরওয়ানিতে মাথায় পাগড়ী বেঁধে বসে আছে। কাজী সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
__’আসমীন ইউভান চৌধুরী, আপনি কি অনন্যা রাত্রি চৌধুরীকে মোহরানা হিসাবে নির্ধারিত কুরি লক্ষ এক টাকায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রী হিসেবে কবুল করলেন তাহলে তিন বার কবুল বলেন?”
ইউভান এক মুহূর্ত চোখ তুলল অনন্যার দিকে। অনন্যা মাথা নিচু করে বসে আছে, হাতের আঙুল কাঁপছে। সেই দৃশ্য দেখে ইউভানের বুক ভরে গেল। সে দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল,
__”কবুল , কবুল, কবুল ।”
চারপাশে একসাথে “মাশাআল্লাহ” বলে উঠল, মেয়েরা গোলাপের পাপড়ি ছুঁড়ে দিল। ছোট ভাইবোনেরা খিলখিলিয়ে হাসছে ।
তারপর অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন কাজী সাহেব,
__”অনন্যা রাত্রি চৌধুরী, আপনি কি আসমীন ইউভান চৌধুরীকে মোহরানা হিসাবে নির্ধারিত কুরি লক্ষ এক টাকায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বামী হিসেবে কবুল করলেন তাহলে কবুল বলেন?”
অনন্যার ঠোঁট কাঁপল, গলা শুকিয়ে এলো,একটু থেমে ইউভির দিকে হালকা নিচু স্বরে বলল,
__’কবুল , কবুল , কবুল ”
এই এক শব্দেই চারপাশ হাততালিতে, দোয়ায়, হাসি-খুশিতে ভরে উঠল। ইউভানের চোখে পানি চিকচিক করল, আর অনন্যা মাথা নিচু করে লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
এরপর ডাকা হলো আকাশকে। আকাশের অবস্থা তখন একেবারে ঘাম ঝরানো। সে বারবার বুকে হাত দিচ্ছে, মুখে বিড়বিড় করছে,
__”হায় আল্লাহ, আজ আমি শেষ।”
কাজী সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে করলেন,
__”আকাশ খান, আপনি কি আরোহী ইয়াসমিন চৌধুরীকে মোহরানা হিসাবে নির্ধারিত কুরি লক্ষ এক টাকায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্ত্রী হিসেবে কবুল করলেন?তাহলে তিনবার কবুল বলেন ।”
আকাশের চোখ আড়চোখে আরোহীর দিকে গেল। আরোহী মুখ নামিয়ে হেসে ফেলেছে। সেই দৃশ্য দেখে আকাশ বুক ঠুকে বলে উঠল,
__”কবুল ,কবুল , কবুল।”
শেষে কাজী সাহেব আরোহীর দিকে তাকালেন,
__”‘আরোহী ইয়াসমিন চৌধুরী, আপনি কি আকাশ খানকে মোহরানা হিসাবে নির্ধারিত কুরি লক্ষ এক টাকায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বামী হিসেবে কবুল করলেন?”
আরোহী সবার সামনে কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না, ঠোঁটের কোণে হাসি লুকিয়ে নিচ্ছিল। একটু মাথা নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
__”কবুল , কবুল , কবুল।”
এবার সবাই একসাথে হাততালি আর দোয়া দিয়ে উঠল। প্রবীণরা হাত তুলে দোয়া করলেন,
__”বারাকাল্লাহু লাকুমা, ওয়া বারাকা আলাইকুমা, ওয়া জামা’ বাইনাকুমা ফি খইর।”
কাজী সাহেব ঘোষণা করলেন,
_”আলহামদুলিল্লাহ, দুই জুটি এখন থেকে স্বামী স্ত্রী।”
চারদিক মুহূর্তেই হাসি, আনন্দ, ফুলের বৃষ্টি আর মিষ্টি বিলিতে ভরে উঠল। ছোটরা কনে দুজনের মাথায় গোলাপ ছিটিয়ে দিল, ছেলেরা বরদের কাঁধে তুলে নিল, মেয়েরা উল্লাসে গলা মিলিয়ে গান ধরল।
এভাবেই চৌধুরী পরিবারের এই আয়োজনে দুই জুটি, ইউভি-অনন্যা আর আকাশ আরোহী, আল্লাহর নামে, সবার আশীর্বাদে পবিত্র বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলো।
এতো লোকের ভিড়, চারপাশে আলোর ঝলকানি, হাসি-খুশির কলরব কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যেই জায়ন ঠিক পেছন থেকে তিয়াশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। তার চোখেমুখে স্পষ্ট, পৃথিবী যাই বলুক না কেন, তার বউকে নিজের কাছ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরিয়ে রাখা যাবে না। এত লোকের উপস্থিতিতেও যেন তার নিজের ছোট্ট দুনিয়াটা শুধু তিয়াশা আর সে।
তিয়াশা একটু মাথা কাত করে, নরম সুরে ঠোঁটে দুষ্টু হাসি মেখে বলল,
__”বর, আমরা অনেক তারাতারি বিয়ে করে ফেলেছি, এদের দেখে আমার আবার বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে।”
জায়ন কথাটা শুনেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। তার চোখে এক ম্লান অথচ গভীর হাসি ফুটে উঠল। সে তিয়াশাকে আরও শক্ত করে কাছে টেনে এনে গম্ভীর অথচ ভালোবাসায় ভরা কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
__”আমার বয়স বত্রিশ, বেবি। আমার মনে হয় আমাদের বিয়ে অনেক দেরি করেই হয়েছে জান। কিন্তু তুই যদি চাইস, আমি তোকে আরো দশবার বিয়ে করতে রাজি আছি।”
এই এক কথায় তিয়াশার চোখমুখ একেবারে ঝলমল করে উঠল। সে যেন ভিড়ের মাঝেই অস্থির হয়ে উঠল, লজ্জায় রঙিন হয়ে গেল গাল দুটো। কিন্তু জায়ন আবারো থেমে ঠোঁটের কোণে এক বাঁকা হাসি মেখে যোগ করল,
__”কিন্তু বিয়ের সঙ্গে দশবার হাই লেভেলের বাসরও দিতে হবে কিন্তু।”
কথাটা কানে আসতেই তিয়াশা হঠাৎ পেছন ফিরল, ভ্রু কুঁচকে চোখ পাকিয়ে ফোঁস করে বলল,
__”এমনভাবে বলছো যেন তুমি নরমাল বাসর সাড়ো সব সময়?”
জায়ন আবারো তাকে সামনে ফিরিয়ে নিয়ে নিজের বাহুতে আটকে ফিসফিসিয়ে বলল,
,__”জান, এক মাস তোকে ঠিক করে ছুঁই না। বুঝতে পারছিস তো শরীরের মধ্যে কত পরিমাণ আগ্নেয়গিরি জমে আছে? শুধু একবার আমাকে সুযোগ দে, তারপর দেখবি তুই নিজেই বলবি, এতদিন যা ছিল সব নরমাল বাসর ছিল।”
তিয়াশা কথাটা শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, শ্বাস ভারী হয়ে উঠল, বুক ধকধক করছে। রাগে গজগজ করতে করতে গলাটা কাঁপল,
__”খাবিশের বাচ্চা, লুইচ্ছা বেটা জীবনে সুধরোবে না তুমি। তুমি এসব করতে যাচ্ছ, আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছ না?”
জায়ন একটুও বিচলিত হলো না, বরং দুই চোখে দুষ্টু জ্যোতি নিয়ে ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
__”হ্যাঁ সোনা, তোকে কত কিছু ঘুরিয়ে দেখাবো। দিনের বেলায় আকাশের তারা দেখাবো, প্যারাডাইস দেখাবো, জান্নাত দেখাবো।”
প্রথমে কথাটা বুঝতে না পেরে তিয়াশার ভ্রু আরও কুঁচকে গেল, যেন বিভ্রান্তি চেপে ধরেছে। কিন্তু জায়নের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটতেই মাথার ঘন্টা বেজে উঠল তিয়াশার। মুখ রাগে লাল করে দাঁত কিড়মিড় করে হাত ছাড়িয়ে গজগজ করতে করতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল,
__”শয়তান বদজাত বেডা।”
জায়ন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে মুচকি হেসে তার পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বলল,
__”জান, শয়তান এখনো ভর করেনি। যখন করবে তখনই টের পাবি।”
চারপাশে সবাই মজা দেখছে, কেউ হাসছে, কেউ ঠোঁট কামড়ে লজ্জা চেপে রেখেছে। তিয়াশা গজগজ করতে করতে তার বান্ধবীদের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। ওদিকে রুবিনা তো বিয়ে শুরু হওয়ার আগেই চলে গিয়েছিল। আর জায়নের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কায়ানও কিছুক্ষণ আগেই জরুরি কাজের অজুহাত দেখিয়ে বিদায় নিয়েছে।
__” শা* বদজাত পোলা আমার মেয়ে টারে জোর করে বিয়ে করায় দিলো, আমার ছোট্ট মেয়ে টার ওই আধধামড়া ছেলের লগে বিয়ে হয়ে গেলো এই হারাম জাদার জন্য।”
কথাটা বলতে গিয়েই যেন বুক ফেটে রাগ, কষ্ট সব একসাথে বেরিয়ে আসছিলো তাহসান সাহেবের গলায়। পাশেই বসা আত্মীয়রা একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে উঠলো ।
মোজাম্মেল সাহেব সেই ফুঁসে ওঠা মুহূর্তে গভীর এক নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বুক ভরে ঝেড়ে ফেললেন ভেতরের ক্ষোভ, তারপর হঠাৎ করেই গর্জে উঠলেন,
__” আমার মেয়েটার বিয়ে টাও এক হারামজাদার জন্য দিতে হলো। আমার মেয়েটা রে এক বদমাইশ এর হাতে তুলে দিতে হলো। হারামজাদা টা আমায় এমন ধমকানি দিসে যে আমার লুঙ্গি ঝড়ে উড়ে গেছে।”
কথাটা শেষ হতেই তাহসান সাহেব এবার মোজাম্মেলের দিকে কটমট তাকিয়ে, ভুরু কুঁচকে দাঁত চেপে গর্জে উঠলেন,
__” কোন হারামজাদার কথা বলছো মোজাম্মেল ভাই?”
তার স্বরে যেন এক ধরনের হুমকি, আবার বুকের ভেতরে টগবগে উত্তাপও মিশে ছিল। চারপাশে থমথমে নীরবতা নেমে এলো।
মোজাম্মেল সাহেব দাঁত কিড়মিড় করে, গলার রগ ফুলিয়ে উত্তর দিলেন,
__” তোদের বাসায় তো চার টা হারামজাদা তার মধ্যে বড় হারামজাদার পাওয়ার সব খানে চলে, এখন নাম কওয়া যাইবে না। শুনলে এবার ল্যং**টা করায় পাঠাবে।”
এবার যেন ঘরে কেউ শ্বাস নিতেও ভুলে গেল। ভেতরে ভেতরে আবারও কারো কারো মুখে চাপা হাসি ফুটে উঠলো, কিন্তু কেউ সাহস করে হেসে ফেললো না।
তাহসান সাহেব এবার এমন ভঙ্গিতে দাঁত মুখ খিঁচে কথা বললেন, যেন পুরো ঘরে বজ্রপাত হলো,
__” ওই বদজাত এর কথাই আমি বলতাছি মোজাম্মেল ভাই, কিন্তু বদজাত টারে আমি জমবের ভালোবাসি। আমি বলতেই পারি আমার ভাতিজা রে কিন্তু আমার ভাতিজা রে অন্য কেউ হারামজাদা বলবে সেইটা আমি মানবো না মোজাম্মেল ভাই। তাই তোমারে আজ আমি ল্যং*টা করেই বাসায় পাঠাবো আমার ভাতিজা রে বলে।”
এই কথাটা শোনামাত্র এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হলো মোজাম্মেল সাহেব শ্বাস আটকে তাকিয়ে রইলো।
মোজাম্মেল সাহেবের চোখ তখন বড় বড়, ঠোঁট শুকনো, কণ্ঠ কাঁপছে ভয়ে। হঠাৎই থতমত খেয়ে কাকুতিমাখা স্বরে বলে উঠলেন,
__” ভাই, এইডা তুই করিস না, মাফ চাই ভাই।”
সামনে তাকিয়ে বুক চওড়া করে ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ় গলায় তাহসান সাহেব বললেন,
__” নেক্সট টাইম যেন না শুনি মোজাম্মেল ভাই। আমার পরিবারের সব ছেলে মেয়ে আমার কলিজার টুকরা।”
তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে, ওনার দিকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। তার চলার ভঙ্গিতে ছিল গর্ব, আত্মবিশ্বাস, আর নিঃশব্দ হুমকির ছায়া।
পেছনে বসে থাকা মোজাম্মেল সাহেবের মুখ হাঁ হয়ে গেলো। চোখে মুখে স্পষ্ট হতভম্ব ভাব, বুকের ভেতর কেমন যেন ভয়-অস্বস্তি জমে গেল। মাথা নাড়তে নাড়তে মনে মনে বিড়বিড় করলেন,
__” সব এক গোয়ালের গরু…”
চারপাশে এবার আবারো হালকা হাসির ফিসফিস শুরু হলো। আন্টিরা ভুরু কুঁচকে একে অপরকে তাকালেন, তরুণরা মুখ চেপে ফিসফিসিয়ে হাসলো, বাচ্চারা তো কিছুই বুঝলো না শুধু বড়দের দিকে চেয়ে রইলো। পুরো দৃশ্যটা রাগ, কষ্ট, মজা আর খুনসুটিতে মিশে একেবারে জমজমাট হয়ে উঠলো।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আত্মীয়স্বজনেরা একে একে বিদায় নেওয়ার পর বিশাল কমিউনিটি হলটা যেন হঠাৎ করেই ফাঁকা হয়ে গেল, সারা দিনের হইচই থেমে গিয়ে কেবল চেয়ার টেবিলের ঠুংঠাং শব্দ আর শ্রমিকদের গুছিয়ে নেওয়ার ব্যস্ততাই ভেসে আসছিল। চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা তখনও দল বেঁধে গুছিয়ে বের হচ্ছিলেন, কারো মুখে তৃপ্তির হাসি, কারো চোখে ক্লান্তির ছাপ, আবার কারো মনে কেবলই আনন্দ আর উত্তেজনা আজকের দিনটা এতটাই বিশেষ ছিল যে কেউই সহজে ভুলতে পারবে না।
গাড়ির জানালা দিয়ে শহরের আলো ঝলমল করে ভেসে আসছিল, আর ভেতরে ছিল নানা রকম কথাবার্তা আর খুনসুটি। কেউ ক্লান্তির ভান করে হাই তুলছিল, আবার কেউ হাসতে হাসতে বলছিল, এত খাওয়া হলো যে শ্বাসই নেওয়া যাচ্ছে না। রাত দশটার দিকেই বাসায় পৌঁছানো গেল, কিন্তু ততক্ষণে সবার মধ্যে একটা দুষ্টু উত্তেজনা জমে উঠেছিল কারণ সামনে অপেক্ষা করছে একেবারেই অন্যরকম যাত্রা।
আজ আর কোনো নিয়ম মানা হবে না, কোনো বাঁধাধরা আচার বা শৃঙ্খলা নেই, কারণ চোখের সামনে ভেসে উঠছে ভোররাতের ফ্লাইট। জায়ন-তিয়াশা, ইউভি-অনন্যা আর আকাশ আরোহী যেন নতুন এক দুনিয়ার দরজা খুলে ফেলেছে, সবাই ফ্রেশ হয়ে যে যার মতো ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুত হচ্ছিল। মাথার ভেতর কেবল মালদ্বীপের সমুদ্রের নীল জল, আকাশের তারা আর একসাথে কাটানো অনন্ত সময়ের স্বপ্ন তাই ক্লান্তি কিংবা রাত জাগা নিয়ে কারো মাথাব্যথাই নেই।
পুরো পরিবেশটা ভরে উঠেছিল হাসি-ঠাট্টা, মজা আর অদ্ভুত এক উত্তেজনায়, যেন আজকের রাতটা তাদের কাছে শুধু একটা যাত্রার নয়, বরং জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের প্রথম পদক্ষেপ।
রাত তখন প্রায় এগারোটা বাজে। ঢাকা শহরের রাস্তাগুলো প্রায় ফাঁকা শুধু দু একটা গাড়ির আলো হন হনিয়ে ছুটে যাচ্ছে। সেই নির্জন রাতের ভেতর দিয়ে চৌধুরী পরিবারের দুটি গাড়ি সোজা এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে।গাড়ির ভেতরে সবার মনে উত্তেজনা, হাসি, ক্লান্তি আর অদ্ভুত এক আনন্দ একসাথে হানিমুনে যাওয়ার মজা তো অন্য রকমই।
কিছুক্ষণ পরেই এয়ারপোর্টের আলো চোখে পড়লো এয়ারপোর্ট পৌঁছাতেই গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তটা যেন আসলেই এক সিনেমার দৃশ্য প্রত্যেকটা মুখে আলাদা আভা, পোশাকে আধুনিকতা, ভঙ্গিমায় তারুণ্যের ঝলক। দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছিল সিনেমার তারকারা গাড়ি থেকে নামছে।পুরো এয়ারপোর্টে দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার মতো।
জায়ন যেন অন্য এক রূপে হাজির হয়েছে হোয়াইট পোলো টি-শার্ট, গলায় হালকা আকাশী সোয়েটার, ডেনিম জিন্স আর পায়ে অ্যাডিডাস এর সুস। চুলগুলো আজ ব্যাকব্রাশ নয়, বরং সিল্কি চুল সামনে ঝুঁকে এসে একেবারে মায়াবী আভা ছড়াচ্ছিল। হাতে বেল্টওয়ালা রিস্টওয়াচ যেন পুরো লুকটাকে পরিপূর্ণ করেছে। এয়ারপোর্টের ভেতরে প্রায় প্রতিটি মেয়ের চোখ অনায়াসেই তার দিকে গিয়ে পড়লো।
কিন্তু সেই নজরদারি একেবারেই সহ্য হলো না তিয়াশার। মুখমণ্ডল মুহূর্তেই বদলে গেল, ঠোঁট চেপে ধরে রাগী চোখে চারপাশে তাকালো সে। নিজের বরের হাত শক্ত করে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো, যেন সবার সামনে স্পষ্ট ঘোষণা
__”এই মানুষটা শুধু আমার।”
বরের সাথে মানানসই সাজে তার উপস্থিতিও কম ছিল না হোয়াইট সুতির গাউন, পায়ে হোয়াইট স্নিকার্স, খোলা লম্বা চুল আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। ওদের দুজনকে একসাথে দেখে অন্যরাও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আকাশ ছিল একেবারেই কুল ভঙ্গিতে হাঁটু ছোঁয়া শর্টস, কলারওয়ালা টি শার্ট, স্নিকার্স আর হাতে বেল্টওয়ালা ঘড়ি। তার পাশে দাঁড়ানো আরোহী ব্ল্যাক হাই ওয়েস্ট জিন্স আর বাদামি টপে যেন একেবারে ঝকঝকে লাগছিল, চুলগুলো পনিটেলে বাঁধা, পায়ে স্লিপার্স স্যান্ডেল চোখে মুখে আত্মবিশ্বাস।
অন্যদিকে ইউভির আরামপ্রিয় স্টাইল ওভারসাইজ টি-শার্ট, ব্যাগি কার্গো প্যান্ট, হাতে স্মার্টওয়াচ, পায়ে স্নিকার্স। তার পাশে অনন্যা ডার্ক ব্লু স্কার্ট আর হোয়াইট টপে, পায়ে ফ্ল্যাট স্যান্ডেল,চুল ছোট্ট পাঞ্চ ক্লিপে আটকানো সিম্পল অথচ আকর্ষণীয়।
আজ ছেলেরা সবাই ফরমাল লুক বাদ দিয়ে স্বাভাবিক সাজে এসেছে। আর তাদের পাশে থাকা বউরা দুই হাতে বরের হাত জড়িয়ে ধরে আছে মনে হচ্ছিল প্রত্যেক টা মেয়ের নজর কে বুঝিয়ে দিতে এই পুরুষ গুলো একান্তই তাদের ।
তাদের লাগেজ গুলো ড্রাইভার চাচারা লাগেজ কার্টের উপরে উঠিয়ে বিদায় জানিয়ে দিল।
ছেলের তাদের লাগেজ কার্ট যে যার দুই হাত ধরে এয়ারপোর্ট এর ভেতরে আগাতে লাগল।
জায়ন বাকা হাসি দিয়ে তিয়াশার কানের কাছে গিয়ে ধীরে ফিসফিস করে বলল,
__” বউ আর ইউ ফিল জেলাস ?”
তিয়াশা সঙ্গে সঙ্গে মুখ বাঁকিয়ে চোখ কুঁচকে তাকাল জায়নের দিকে, ঠোঁটে একরাশ অভিমান আর খুনসুটির ঝিলিক। সে ভ্রু উঁচিয়ে উত্তর দিল,
__” আচ্ছা যখন কোন ছেলে আমার দিকে তাকাবে তখন আমিও বলব বর আর ইউ ফিল জেলাস ?”
শুনেই জায়নের চোখ বড় বড় হয়ে গেল, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। যেন সে মুহূর্তেই ভিতর থেকে কেঁপে উঠল, কণ্ঠে হুঁশিয়ারির ঝাঁজ মিশিয়ে বলে উঠল,
__” আমি কিছু বলছিনা , মুখ থেকে যেন এসব না বেরোয় ।”
ঠিক তখনই পাশের গেট দিয়ে হেঁটে আসা দুটো বিদেশী মেয়ে আকাশ আর জায়নের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিল। এক মেয়ে সরাসরি আকাশকে চোখ মেরে দিল, আরেক মেয়ে জায়নের দিকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিল! মুহূর্তেই এয়ারপোর্ট এর বাইরের চারপাশের পরিবেশ জমে উঠল, যেন আগুনে ঘি পড়েছে। ইউভি আর অনন্যা হাসি চেপে রাখতে পারছে না, মুচকি মুচকি তাকাচ্ছে। কিন্তু তিয়াশা আর আরোহীর চোখে যেন বজ্রপাত নামল।
আকাশ আর জায়ন থতমত খেয়ে গেল, একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল আজ রক্ষা নেইকারন জানে তাদের বউ এবার এই মেয়ে দুটোর হাল খারাপ করে ছাড়বে আর যদি বাধা দিতে যায় তার প্রভাব পড়বে আকাশ আর জায়ন এর উপর, তাদের বউদের চোখে এখন রাগের আগুন, মুহূর্তেই ঝড় উঠতে চলেছে। জায়নের বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো,
__” বা*ল গেলো আমার হানিমুন।”
তিয়াশা জায়নের হাত শক্ত করে টেনে নিল, আরোহী আকাশের হাত মুঠো করে চেপে ধরল। দু’জনার মুখে আগুন জ্বলা দৃঢ়তা সরাসরি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল ঐ দুটো মেয়ের সামনে। চারদিকের যাত্রীরা তাকিয়ে দেখছে, যেন এয়ারপোর্টের মাঝখানে এক সিনেমার দৃশ্য শুট হচ্ছে। আকাশ তো হা হয়ে গেল, মনে মনে ভাবছে,
__””আজ আর বাঁচবো না!”
একদিকে তিয়াশা জায়নের হাত শক্ত করে টেনে ধরল, আরোহী আঁকড়ে ধরল আকাশের হাত। দু’জনে একসাথে টানতে টানতে এগিয়ে গেল ঐ বিদেশী মেয়েদের দিকে। দৃশ্যটা এতটাই আকস্মিক যে যাত্রীদের চোখ আটকে গেল এয়ারপোর্ট যেন মুহূর্তে নাট্যমঞ্চে পরিণত হলো।
বিদেশী মেয়েদের সামনে দাঁড়াতেই আরোহী একেবারে আগুন ঝরিয়ে নিজের বাঁ হাত উঁচিয়ে অনামিকা আঙুল দেখিয়ে গর্জে উঠল,
__” ভালো করে চোঁখ দিয়ে দেখে নে ফক্কিনীর দল, আমি ওর বিয়ে করা বউ , কতবড় ছোট লোক তোরা পাশে দেখতাসিস বউ রইসে তবুও লাইন মারিস আমার বর এর উপর আর ভাইয়ার উপর চোখ গালায় দিব।”
ওদিকে তিয়াশা তো আর থেমে নেই। রাগে তার মুখ লাল টকটকে, যেন একেবারে বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে আঙুল চোখের দিকে তাক করে ভয়ংকর স্বরে বলল,
__” আমি তো ওদের ঠোঁট আর চোঁখ গালিয়েই দেব শা*লা বান্দির বাচ্চা আমার বর রে চুমু দিস ওরে ফকিন্নির বাচ্চা ফকিন্নী।”
আরোহীর আর তিয়াশার এই তেজী ভঙ্গি দেখে চারপাশের মানুষ হতভম্ব, কেউ হেসে ফেলছে আবার কেউ ফিসফিস করছে
__”বাংলাদেশি বউ মানে এমনই!”
জায়নের বুক কেঁপে উঠল। সে দ্রুত তিয়াশার কোমর জড়িয়ে ধরে ভেতরের দিকে টেনে নিল। ঠোঁটে জোর করে হেসে গেল, গলাটা কেঁপে উঠল তবুও কাঁপা গলায় শান্ত করার চেষ্টা করল,
__” ব্যাস জান ব্যাস আমরা হানিমুন যাচ্ছি না মুড খারাপ করে না বউ ।”
কিন্তু তিয়াশার ভ্রু কুঁচকে আছে, চোখ থেকে রাগের ঝিলিক পড়ছে। সে মুখ ফুলিয়ে একরাশ অভিমান নিয়ে বলে উঠল,
__” তোমরা দুজন কিছু করেছো ওই মেয়ে দুটোর দিক তাকিয়ে নইলে ইউভি ভাইয়ার দিকে তো কেউ কিছু করলো না তোমাদের ই কেন করলো । ছাড়ো আমায় তুমি ।”
জায়নের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল
__”এই বউকে এখন ছাড়লে, বউ কোনদিকে হাটা দেবে তার ঠিক নেই ।”
তাই তিয়াশা যতই রেগে যাক না কেন, সে শক্ত করে এক হাতে আঁকড়ে রাখল আরেক হাতে লাগেজ কার্ট।
ওদিকে বিদেশী মেয়েরা আরোহীর কথা কিছুই বুঝল না, কিন্তু তাদের চোখে ধরা পড়েছে রাগের তীব্রতা। আরোহীর আঙুলের আংটি দেখে আঁচ করতে দেরি হলো না এরা আসলেই ম্যারেড কাপল। দু’টো মেয়ে চুপচাপ কিছুটা পেছনে সরে গেল।
ঠিক তখনই আকাশ কানে কানে বলল আরোহীকে, নরম স্বরে,
__” সোনা চলো এইটা এয়ার্পোর্ট, সিনক্রিয়েট করে না সোনা ।”
কিন্তু আরোহীর চোখে আগুন। সে কটমট করে তাকাল আকাশের দিকে, ঠোঁটে ঝড়ের গর্জন,
__” রাঙ্গা মুলোর বাচ্চা তোরে তো আমি পরে দেখতাছি।”
আকাশ থরথর করে কেঁপে উঠল, গলাটা শুকিয়ে গেল। সে কাপা কাপা গলায় বলল,
__” আমি কি করলাম ? ”
কিন্তু আরোহী একেবারেই শুনছে না। রাগে গজরাতে গজরাতে ভেতরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে গর্জে উঠল,
__” তোর দিকেই কেন চোঁখ মারল ? নিশ্চই তুই চোঁখ মারছিস?
আকাশ হতভম্ব, যেন আকাশ থেকে পড়েছে। তড়িঘড়ি করে দৌড়ে গেল আরোহীর পেছনে, আতঙ্কিত স্বরে বলতে লাগল,
__” সোনা তোমার কসম আমি চোখ কি আমি তো ঠোঁট ও নারাই নাই ।”
কিন্তু আরোহী এখন এতটাই ক্ষেপে গেছে যে কানে কিছুই ঢুকছে না।
ইউভি অনুর হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে হাসি থামাতে না পেরে মুচকি মুচকি বলে উঠল,
__” দুটোই পাগল।,”
হাসি, রাগ আর খুনসুটির ঝড়ে এয়ারপোর্টের পরিবেশ মুহূর্তেই জমে উঠল। যেনো সবাই জানল এই দম্পতিদের জীবনে ঝগড়াটাও প্রেমের আরেক রূপ, আর মজার এপিসোড না হলে তাদের গল্প অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
বোর্ডিং পাস কমপ্লিট হতেই যেন চারপাশের হইচই ম্লান হয়ে গেল, শুধু স্পষ্ট হলো জায়ন আর তিয়াশার ভেতরের টানাপোড়েন। জায়ন হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে তিয়াশার নরম আঙুলগুলো, যেন সেই স্পর্শ দিয়ে সব রাগ-অভিমান মুছে দিতে চায়। কিন্তু তিয়াশার মুখ তখনও রাগে লাল, আগুনে জ্বলছে চোখদুটো। জেদি সেই চাহনিতে স্পষ্ট, সে এখনো সহজে নরম হবে না। অন্যদিকে আকাশ যখন মিষ্টি ভঙ্গিতে আরোহীর হাত ধরতে গেল, তখনই আরোহী ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিলো, ঠোঁট ফুলিয়ে একপাশে তাকাল। তার চোখেমুখে অভিমান জমে আছে, যেন আকাশকে সহজে ক্ষমা করার মুডে নেই।
এই তিন দম্পতির মধ্যে একমাত্র শান্তি আর হাসির ঝলক ছড়িয়ে আছে ইউভি আর অনুর মধ্যে। ইউভির মনে তখন আনন্দের ঝড়, সে ভিতরে ভিতরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে উঠলো,
__” ভবের বাচা বেঁচেছি ভাই, নইলে এক মেয়ে যে আমার দিকেও হাত দেখাইছে এই আমার পাখি দেখলে, ঘুরতে যাওয়া তো দূর, কতদিন ছুঁইতেই দিত না তার ঠিক নেই?”
ভাবতেই ঢোক গিলে ফেলে সে। চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়, প্রাণ খুলে হেসে অনুর হাত জড়িয়ে ধরে রাখে। অনুও তখন হাসিমাখা মুখে চুপচাপ স্বপ্নে ডুবে গেছে, মন ভরে ভাবছে,
__” এই লোকটা এখন তার স্বামী।”
সেই চিন্তাতেই অনুর ঠোঁটে একরাশ লাজুক কিন্তু নিশ্চিন্ত হাসি খেলে যায়।
ফ্লাইটের বিজনেস ক্লাস পার্সোনাল কেবিনে ঢুকতেই চারপাশের ঐশ্বর্য আর নতুনত্বে কেঁপে উঠলো মেয়েগুলো। তারা কেউ কোনোদিন ফ্লাইটে ওঠেনি, প্রথম অভিজ্ঞতার ধাক্কায় উত্তেজনা আর ভয়ের রেশ মিলেমিশে গেছে শরীরভাষায়। ঠিক তখনই তিয়াশা এক ঝলক চোখ ফেরালো জায়নের দিকে, আর মুহূর্তেই তার রাগ গলে এক অদ্ভুত ভয়ে রূপ নিল। বুক কাঁপতে কাঁপতে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
__” বর, ভয় লাগছে তো, যদি ভেঙে পরে প্লেন?”
জায়ন ধীরে ধীরে নিজের বুকের কাছে টেনে নিলো তাকে, যেন সমস্ত ভয়ের বিরুদ্ধে এক বিশাল আশ্রয়। পার্সোনাল কেবিনে বসতে বসতে ঠোঁটে এক শান্ত হাসি খেলে গেল, সে নরম কণ্ঠে আশ্বস্ত করলো,
__” আমার বোকা বউ, আমি থাকতে তোর ভয় কিসের?”
সেই আশ্বাসের শব্দে তিয়াশার বুকের ধুকপুকানি যেন সামান্য কমে এলো। এদিকে আরোহীও ভয়ে একদম শক্ত করে আকাশের হাত চেপে ধরেছে, যদিও চোখেমুখে রাগের ছাপ তখনও স্পষ্ট। তাদেরও আলাদা কেবিনে বসার পর একটু চাপা নীরবতা নেমে এলো। ইউভি আর অনুও নিজেদের কেবিনে বসলো, কিন্তু সেখানে রয়ে গেল এক অন্য রকম হাসিখুশি আমেজ, একরাশ নিশ্চিন্ততা।
ফ্লাইট টেক অফ ঘোষণার সাথে সাথে কেবিনের ভেতর যেন উত্তেজনার স্রোত বইতে শুরু করল। ফ্লাইটের ভারী দেহ যখন কেঁপে উঠতে লাগল, ঠিক তখনই তিয়াশা আর কোনো কিছু না ভেবে এক লাফে সিটবেল্ট খুলে উঠে গেল জায়নের কোলে। জায়নের বুকের পাহাড় সমান শক্ত বুকে গিয়ে ঠেসে বসল, টিশার্ট খামচে ধরে চোখ শক্ত করে বন্ধ করে ফেলল। তার ছোট্ট শরীর পুরোপুরি কাঁপছিল ভয়ে।
ওপাশে আরোহী একদম প্রাণপণ আকাশের হাত আঁকড়ে ধরেছে, যেন হাত ছাড়লেই সব ভেঙে যাবে। অনুও ভয়ে সারা শরীর কুঁকড়ে গিয়ে ইউভির বুকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। তিন কেবিনের ভেতরে তিন রকম অনুভূতি কোথাও রাগ, কোথাও ভয়, আবার কোথাও হাসি-ভরা শান্তি।
তিয়াশা তখনো চোখ বন্ধ করে কাপতে কাপতে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
__” বর, ভয় করছে তো।”
জায়ন তার বউকে এভাবে ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে দেখে শক্ত করে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিলো, যেন পৃথিবীর সব সুরক্ষা তার বুকে লুকিয়ে আছে। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
__” কিছু হবে না জান, আমি আছি তো সোনা।”
কিন্তু তিয়াশার কোলে এসে বসার ভঙ্গিমা, বুকের টিশার্ট খামচে ধরার তীব্রতা সব মিলিয়ে জায়নের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ হারানোর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। গলার অ্যাডামস অ্যাপল দ্রুত ওঠানামা করছে, বুকের ভিতর ধকধক শব্দ যেন নিজেকেই তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাইরে ফ্লাইটের দেহ আকাশ ছুঁতে উঠছে, আর ভেতরে জায়নের বুক তত জোরে কাঁপছে।
হঠাৎই জায়ন কেবিনের লাইট বন্ধ করে দিলো। সময় তখন আড়াইটা রাত, আকাশের অন্ধকারে তাদের কেবিনও ডুবে গেল ম্লান আলোর গভীরে। পাশের কেবিন থেকে আসা ক্ষীণ আলোয় শুধু অস্পষ্ট ছায়া দেখা যায়। তিয়াশা ভয়ে কেঁপে কেঁপে ফিসফিসিয়ে বলল,
__” আমি ভয় পাচ্ছি, তুমি লাইট অফ করলে কেন?”
জায়ন তখন এক নেশাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিয়াশার দিকে, চোখের ভেতর মাদকতা জ্বলছে। ধীরস্বরে উত্তর দিলো,
__” সব ভয় এই আকাশের বুকে মিশিয়ে দিতে চাই তাই।”
তিয়াশার ঠোঁট কেঁপে উঠলো, ভেতরে ভেতরে বুঝে ফেললো জায়নের চোখে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে বলল,
__” মানে?”
জায়নের চোখ ততক্ষণে গভীর হয়ে উঠেছে, কণ্ঠস্বর নরম অথচ ভারী
__” কোন আওয়াজ করবি না।”
এই বলে সে ঝুঁকে পড়লো, ঠোঁ*ট বসিয়ে দিল তিয়াশার ঠোঁ*টে। একঝটকায় তীব্র চু*ম্বনের জোয়ার ভাসিয়ে দিল দুজনকে। জায়নের হাত চলে গেল তিয়াশার বু*কে জামার উপর, হাতের ঝড় উঠিয়ে দিল বু*কের উপর,পাগলের মতো চুম্বনে ডুবে গেল সে। তিয়াশা হতবাক হয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, কণ্ঠ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। কোনোভাবে ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে তিয়াশা কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
__” বর প্লীজ, আমি পারবো না এখানে।”
কিন্তু তিয়াশার এই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে কথা বলা যেন জায়নের বুকের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দিল। তার দৃষ্টি মুহূর্তেই গাঢ় হয়ে উঠল, ঠোঁ*ট হঠাৎ ঘুরে গিয়ে নামল তিয়াশার গলায়। প্রতিটি স্প*র্শে নরম ত্বক কেঁপে উঠতে লাগল, গলার গহীনে জমে উঠতে লাগল ভেজা উত্তাপ। হাস্কি স্বরে জায়ন ফিসফিস করে বলল,
__” আমি কি শুধু শুধু বিজনেস ক্লাসের কেবিন বুক করেছি? আমি জানি আমি নিয়ন্ত্রণ হারাবো। শুধু কোন আওয়াজ করবিনা। আর তুই প্রমিজ করে ছিলি সাত দিন আমার কথা শুনবি।”
তিয়াশার চোখ বড় বড় হয়ে উঠল, দৃষ্টিতে ভয় আর অদ্ভুত এক অচেনা উত্তেজনা একসাথে জমে গেল। তার বুকের ভেতর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ঠিক তখনই জায়ন কেবিনেটের মধ্যে তাদের পাশে রাখা একটা নরম ব্ল্যাঙ্কেট টেনে নিল, দুজনকে আড়াল করে আঁকড়ে ধরে কাছে টেনে নিল। তিয়াশার নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে আসছিল, অথচ শরীরের প্রতিটা রগে অদ্ভুত শিহরণ।
জায়নের হাত ধীরে ধীরে তিয়াশার ফ্রকের অভ্য*ন্তরীন থেকে বুলিয়ে কো*মরের কাছে উঠিয়ে দিল , তারপর আবার হাত নামতে নামতে ছুঁয়ে ফেলল তার উন্মু*ক্ত উরু, যেখানে চলছে হাতের ঝড়। প্রতিটি স্পর্শে তিয়াশা শিউরে উঠছিল, শরীর কাঁপছিল অনিয়ন্ত্রিত ভাবে। চোখ মুখ শক্ত করে বন্ধ করে জায়নের চুল আঁকড়ে ধরল সে, যেন নিজের ভয় আর অজানা সুখ একইসাথে সামলাতে চাইছে।
জায়নের ঠোঁ*ট একের পর এক স্পর্শ ছড়াতে লাগল তার বুকের উপর, নিশ্বাসে নেশা মিশে যাচ্ছিল। গাউনের পেছনের চে*ন টেনে নামিয়ে ঘা*ড়ের কাছ থেকে গাউন সরিয়ে এক ঝটকায় মুখ ডুবিয়ে দিল সেখানে। কয়েক মুহূর্ত বু*কের উপর ঠোঁ*টের ঝড় চালাতে চালাতে হঠাৎ নেশায় ভরা চোখ তুলে তাকাল সে, কণ্ঠ কেঁপে উঠল,
__ ” বেইব, এখন যদি আমি ছুঁ*তে না পারি তোকে গভীর ভাবে, তাহলে আমি শেষ হয়ে যাব।”
কথার সাথে সাথেই তাড়াহুড়ো করে নিজের প্যা*ন্টের বে*ল্টে হাত দিল জায়ন। তার চোখে তখন অদ্ভুত এক ক্ষুধা, নিঃশ্বাস ভারী আর দেহ কাঁপছে অস্থিরতায়। তিয়াশা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে উঠল, বুকের ভেতর দম যেন আটকে গেল, ঠোঁট কাপছিল অবিরাম। আতঙ্ক আর চমকে ওঠা গলায় সে কাঁপা স্বরে বলে উঠল,
__” কি করছো তুমি, পাগল হয়ে গেছ, এখানে?”
কিন্তু জায়ন তখন আর থামার মতো অবস্থায় নেই। তার হাত তাড়াতাড়ী করে বে*ল্ট খুলে ফেলছে, মুখ থেকে গরম নিঃশ্বাস ছুটছে, আর চোখে জমে আছে অসহায় আকাঙ্ক্ষা। তীব্র গলায় হাহাকার মিশিয়ে সে বলল,
__” বললাম না, এখন না পেলে পাগল হয়ে যাব। প্লীজ জান, ডোন্ট মেক সাউন্ড, নইলে আমি আরো পাগল হয়ে যাব।”
তিয়াশা কাঁপা হাতে জায়নের হাত শক্ত করে চেপে ধরল। বুকের ভেতর ভয় আর একধরনের অচেনা অনুভূতি তাকে ছটফট করাচ্ছে। তবুও সাহস জোগাড় করে, ঠোঁট শক্ত করে সে বলে উঠল,
__” এখন না ব্যাস না, আমি কিন্তু ভাইয়া দের কেবিন ছেড়ে পালিয়ে যাব।”
জায়নের বুক উঠানামা করছে দ্রুততর, ভারী নিঃশ্বাস ফেলে কাপা গলায় সে ফিসফিস করল,
__ ” ওদের ডিস্টার্ব কেন করবি, তুই আমাকে তোকে ছুঁতে দে ব্যাস । তুই জা জান প্লীজ বোঝার চেষ্টা কর আমি আউট অফ কন্ট্রোল , আই এম সো …..”
কিন্তু তিয়াশা তখন একেবারে অটল। তার চোখে দৃঢ়তা, ঠোঁটে স্পষ্ট অস্বীকৃতি। কাঁপা কণ্ঠে সে জেদ করে বলে উঠল,
__” না এতদিন সহ্য করেছো আরেকটু করো।”
জায়ন যেন পাগলপ্রায় অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে,গলা শুকিয়ে গেছে, কথা ঠিকমতো বেরোচ্ছে না, বুকের ভেতর জ্বলছে আগুন। নিঃশ্বাস কাঁপতে কাঁপতে শুধু অনুনয় করে উঠল,
__” জান প্লীজ।”
__” না।”
এই জেদের উত্তরে জায়নের দাঁত কিড়মিড় করে উঠল, চোখে জমল রাগ আর অস্থিরতা। গলার স্বর ভারী করে সে প্রায় গর্জে উঠল,
__” এইটা যদি ফ্লাইট না হতো না, তোর যে কি করতাম। অনেক জ্বালাচ্ছিস, জান প্লীজ মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আই নিড ইট।”
তিয়াশা এবার তার দিকে গভীরভাবে তাকাল। দৃষ্টিতে ভয় আছে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে সামান্য দুষ্টুমি মিশে আছে। নিঃশ্বাস সামলে মজার ছলে সে বলল,
__” আমি ভয় পাচ্ছি প্লাস আমার ঘুম ও পাচ্ছে। এবার তুমি বলো তোমার বুকে ঘুমোতে দেবে না কি নিজের সিটে গিয়ে ঘুমাবো?”
জায়নের বুক থেকে বেরোচ্ছে দীর্ঘশ্বাস, কিন্তু ঠোঁট আর খুলল না। রাগ, অভিমান আর ভালোবাসার এক অদ্ভুত মিশ্রণ তাকে নীরব করে দিল। শুধু তিয়াশাকে জোরে নিজের বুকে টেনে নিল, বুকের গভীরে আটকে রাখল। তার নীরব আলিঙ্গনই বোঝাল হ্যাঁ, এই বুকই তার আশ্রয়।
তিয়াশা বুঝে নিল ইঙ্গিতটা। ক্লান্ত শরীর আর চোখের ঘুমের টান তাকে হার মানাল। সে মাথা নামিয়ে রাখল জায়নের বুকে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত ঘুমের রাজ্যে ঢলে পড়ল। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি, শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রশান্তি।
কিন্তু জায়নের কাছে এই মুহূর্তটা ছিল শাস্তি ছাড়া কিছুই নয়। বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলছিল, তা আরও বেড়ে গেল। তিয়াশার শান্ত ঘুমের পাশে সে এক সেকেন্ডও স্বস্তি পেল না। চোখ তুলে এয়ার উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল, বুকের গভীরতা থেকে বিড়বিড় করে উঠল,
__” এরকম করে কোলেই বা কেন উঠলি, আমার বাতিই বা কেন জ্বালালী। নিজে গেলি ঘুমের দেশে, রেখে আমাকে অস্থির বেশে। রোমান্স আমায় দেখে বলে তুই একটা মস্ত বড় বা*ল তাই তোর ধারে কাছেও আসি না আজকাল । বা*লের জিন্দেগী।”
তার ঠোঁটে ক্ষুধা, চোখে আকাঙ্ক্ষা, বুকের ভেতর তোলপাড় কিন্তু তার বুকে শুয়ে থাকা তার পৃথিবী নির্দোষ ঘুমে ঢলে পড়েছে। এই দ্বন্দ্বই যেন সবচেয়ে বড় শাস্তি হয়ে দাঁড়াল জায়নের জন্য।
__” সোনা ভাইয়ারা কি ফ্লাইটের মধ্যে মারামারি করছে?”
আকাশের হঠাৎ করা প্রশ্নে আরোহী যেন মুহূর্তেই চমকে উঠল। ভ্রু কুঁচকে, চোখ বড় বড় করে তাকাল স্বামীর দিকে। এখনো রাগটা পুরোপুরি কাটেনি তার।
আরোহী ভয় পেয়েছিল টেক অফের সময়,বুকের মধ্যে তখন দম আটকে আসছিল, হাত ঘেমে যাচ্ছিল, ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন যখন প্লেনটা আকাশে ভেসে আছে অনেকটা সময় ধরে, ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক হয়েছে, নিজের সিটে হেলান দিয়ে স্ক্রিনে মুভি দেখায় মন দিচ্ছিল। তবুও আকাশের হঠাৎ বেফাঁস প্রশ্নে তার ভেতরের রাগটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
চোখ পাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে আরোহী বলেই ফেলল,
__”ওরা কেন ফ্লাইটের মধ্যে মারামারি করবে?”
কথাটা বলার ভঙ্গিতে যেন রাগের সাথে একধরনের অসহায় বিরক্তি মিশে আছে।
আকাশ এমন চাহনি দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গেল। মুহূর্তে চোখ নামিয়ে আবার উপরে তুলল, একদম ধরা পড়া ছেলের মতো অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল,
__” এয়ারপোর্ট এর ওই ঘটনার জন্য ঝামেলাও করতে পারে, একটু আগে ওদের কেবিন থেকে কেমন শব্দ আসছিল হাতড়া হাতড়ির।”
আকাশের কথা শুনে আরোহী যেন সত্যি সত্যিই আকাশ থেকে পড়ল। কি পাগলের পড়েছে সে। মুহূর্তের মধ্যেই মুখ গম্ভীর করে গজগজ করে উঠল,
__” অপদার্থ! ওদিকে নজর না দিয়ে নিজের বউকে নজর দাও। নজর শুধু চারিদিকে সবসময়।”
কথার ভেতরে যেন অভিমান, ভালোবাসার দাবি, আর সেই চিরচেনা বকুনি একসাথে গলে মিশে গেল। আকাশ চুপচাপ বসে রইল, মুখে সেই মিষ্টি নির্দোষ হাসি যেন ছোট্ট বাচ্চা কোনো দুষ্টুমি করে বকুনি খেয়েছে। আরোহী যতই রাগ দেখাক, ভেতরে ভেতরে আকাশ জানে এই রাগই তার সবচেয়ে বড় আদর, এই অভিমানই তার সবচেয়ে মধুর টান।
__” পাখি এখন আর ভয় লাগছে না তো? আর এখনো চার পাঁচ ঘণ্টা লাগবে ল্যান্ড হতে।”
ইউভি ধীর, নরম অথচ গভীর গলায় ফিসফিস করে অনন্যার কানের কাছে বলল। শব্দগুলো যেন উষ্ণ শ্বাসের মতো গিয়ে ছুঁয়ে গেল অনন্যার গলা, মুহূর্তেই তার শরীরে শিহরণ খেলে গেল।
অনন্যা একটু চমকে তাকাল তার দিকে, তারপর চোখ নামিয়ে লাজুক এক হাসি ফুটিয়ে দিল। সেই হাসিতে কেমন যেন এক প্রশান্তি, এক নিরাপত্তার আভাস লুকিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে সে ফিসফিস করে উত্তর দিল
__” একটু আগে ভয় লাগছিল, এখন ঠিক আছে। আপনি পাশে আছেন তো, হয়তো তাই।”
কথাটা বলেই অনন্যার গাল লালচে হয়ে উঠল। যেন স্বীকার করেও না করেই জানিয়ে দিল ইউভির উপস্থিতিই তার সাহস, তার ভরসা।
ইউভি ঠোঁটে বাকা এক হাসি খেলাল। চোখে জ্বলল দুষ্টুমি আর অকৃত্রিম ভালোবাসার মিশেল। সে আলতো করে অনন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম অথচ দৃঢ় গলায় বলল,
__” আজ থেকে আমি তোর বর, আর এই মানুষটা সবসময় তোকে আগলে রাখবে।”
এই বাক্য যেন অনন্যার বুকের ভেতর বাজির মতো ফুটল। চোখ দুটো ঝলমল করে উঠল খুশিতে, হৃদয়ের ভেতর যেন ঢেউ খেলল আনন্দের। এতদিনের ছোট ছোট স্বপ্নগুলো যেন মুহূর্তেই বাস্তব হয়ে উঠল।
হঠাৎ ইউভির হাতের স্পর্শ বদলে গেল। মোলায়েম হাত বুলোনো থেকে একরকম টেনে নেওয়া চুল আঁকড়ে ধরল সে, আর তার চোখের ভেতর ফুটে উঠল একরাশ নেশাল দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে খেলে গেল বুনো এক হাসি, যা দেখে অনন্যার বুকের ভেতর ধক করে উঠল।
চমকে গিয়ে কাঁপা গলায় বলল সে,
__” কি করছেন?”
ইউভির ঠোঁটে তখনও সেই বাকা, উস্কানিময় হাসি। চোখে জ্বলল এক অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা, যেন হাজারো শব্দের থেকেও বেশি কিছু বলছে। ধীর গলায় সে উত্তর দিল,
__” হঠাৎ আকাশের বুকে সমুদ্রে ডুবতে মন চাইছে।”
অনন্যা কথাটা পুরোপুরি বুঝতে পারল না। চোখ বড় বড় করে, দিশেহারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার বর-এর দিকে। বুকের ভেতর কেমন হুহু করে উঠল, শরীর কাঁপতে লাগল অজানা উত্তেজনায়। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল,
__” মানে?”
কিন্তু আর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ দিল না ইউভি। আচমকাই মুখ এগিয়ে গিয়ে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিল অনন্যার ঠোঁটে। অনন্যা মুহূর্তের জন্য চমকে উঠল, চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, হাতের আঙুলগুলো অনিচ্ছায় সিট আঁকড়ে ধরল। কিন্তু সেই চমক ধীরে ধীরে বদলে গেল অচেনা এক উষ্ণতায়, অচেনা এক কামনার ঝড়ে।
প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত হলেও এক নিঃশ্বাস পরে তার হাত নিজে থেকেই জড়িয়ে গেল ইউভির গলায়। সেই সম্মতি পেয়ে ইউভির ভেতরে যেন আগুন জ্বলে উঠল। চুম্বন হয়ে উঠল আরও উগ্র, আরও গভীর। ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে নেওয়ার কোনো তাড়া নেই, বরং প্রতিটি মুহূর্তে বাড়তে লাগল টান, শ্বাসপ্রশ্বাস মিশে গেল, চারপাশ যেন গলে গেল অদৃশ্যতায়।
ইউভি আরও কাছে টেনে নিল তাকে, চুল আঁকড়ে ধরল শক্ত করে, যেন জানিয়ে দিচ্ছে
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৭৩
__” আজ থেকে তুই শুধু আমার, কেবল আমার।” আর অনন্যা, যে আগে ভয় পেয়েছিল, লাজুক ছিল, সে এখন সেই আগুনের ভেতরে ডুব দিলো ধীরে ধীরে, স্বেচ্ছায়।
ফ্লাইটের জানালা দিয়ে বাইরের আকাশে অন্ধকার আর তারাদের মেলা , কিন্তু এই দুই হৃদয়ের ভেতরে তখন ঝড় বইছিল একটা মাদকতাময়, উগ্র ঝড়।
