তোমার জন্য সব পর্ব ১৯
রেহানা পুতুল
স্যার আপনার সঙ্গে আমার গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আছে।”
“ওহ সিউর কলি। বলুন। কান পেতে আছি।”
“এখন নয়। পরে অবশ্যই বলবো।”
কলির শুকনো গলায় কথাটা শুনে মাহমুদ চিন্তায় পড়ে গেলো। বিয়ে পড়ানোর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই মেয়ের কোন ভরসা নেই। না জানি আবার কোন কঠিন শর্ত নিয়ে হাজির হয় এই হৃদয়হীনা!
ওর শর্ত টা কি হতে পারে? অন্য কিছু? অন্যকিছু হলে বিবেচনা করা যায়। কিন্তু অন্যকিছু নয়। এটা একশো পার্সেন্ট সিউর। নিশ্চয়ই সেই অমানবিক আবদার। বিয়ে এক বছর পেছানো। নো ফুলকলি। সেটা কিছুতেই হবে না। দুই পরিবার মিলে যেখানে ডেট পাকা করে ফেলল,সেটা পেছানো এখন কোনভাবেই সম্ভব নয়। বিয়েটা কি ছেলেখেলা ওহে ফুলকলি। এমন সব ভাবনার বেড়াজালে আটকে গিয়ে ছটপটাতে লাগলো মাহমুদ।
কলি শুয়ে শুয়ে ভাবছে, অন্তত এর থেকে গান শোনা যাবে আর যাইহোক। এটা একটা ভালোলাগার দিক তারজন্য। কিন্তু কিভাবে তাকে সব উজাড় করে দিবো। শেইম! শেইম!
পা ভালো হলে কলি ক্লাসে গেল। কলি চোরাচোখে মাহমুদের আপাদমস্তক দেখে নিলো এক ঝলক। চমকিত মনে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কি ব্যাপার? এই বান্দা আজ প্রেমিকের সুরত নিয়ে হাজির হলো? নিউ জিন্স,নিউ টিশার্ট। যুবক থেকে তরুণ হয়ে গেলো দেখি। ঝরঝরে ঘন চুলগুলো আজ বেশ উড়ু উড়ু। অন্যদিনের চেয়ে বেশী স্মার্ট ও সুন্দর লাগছে। কাহিনী কি? যাক গা। খাল্লি বাল্লি।
মাহমুদ ক্লাসে কলিকে মুখে কিছু বলল না। চোখের ইশারাতেও কিছু বলল না। সে পরিবেশ বুঝে চলতে জানে। সীমা লংঘন না করার ক্ষমতা তার যথেষ্ট। ভার্সিটিতে সে আগের মতই কলির সঙ্গে টিচার, স্টুডেন্ট সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে লাগলো। বরং একটু বেশিই সতর্ক হয়ে চলে। কলি যেন বিরক্ত না হয় সেদিকে বিশেষ সজাগ থাকে। পারসন হিসেবে মাহমুদ খুব কেয়ারিং প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই।
সে অফিসে এসে মেসেজ দিলো,
“কলি ‘ডার্লিং’রেস্টুরেন্টে চলে যাবেন। খুব জরুরী কথা আছে।”
‘খুব’ শব্দটা মাহমুদ ইচ্ছে করে ব্যবহার করেছে কলিকে গুরুত্ব বোঝানোর জন্য। নয়তো কলি নাও আসতে পারে।
কলি ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করে বলল,
দরকারতো আমার নিজেরই। কলি এক শব্দে ফিরতি মেসেজ দিলো।
“আচ্ছা স্যার।”
মাহমুদ ঠোঁট ভিড়িয়ে বাঁকা হাসি হাসলো। এ কি বিয়ের পরেও আমাকে স্যার স্যার করতে থাকবে নাকি। আগে অধিকারে আসুক রমনী।
কলি ‘ ডার্লিং ‘রেস্টুরেন্ট আগেই পৌঁছে গিয়েছে। এর নাম বন্ধুদের কাছে সে আগেও শুনেছে। কিন্তু সে এলো আজই প্রথম। সে পুরো রেস্টুরেন্টে বার দুয়েক মোহনীয় দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো।
অদ্ভুত সম্মোহনী পরিবেশ ‘ডার্লিং’ এর ভিতরে। কৃত্রিম সবুজাভ গাছগাছালী দিয়ে সজ্জিত। হালকা আলোর লাইটিং। রয়েছে একটি ছোট্ট পানির ফোয়ারা। নিচে দেয়া হয়েছে অসংখ্য পাথর। স্বচ্ছ পানিতে পাথরগুলো দেখতে বেশ নান্দনিক লাগছে। প্রতি টেবিলে কাপল বসা। টেবিলগুলো বাঁশের ছোট্টো বেড়ার বেষ্টনীতে ঘেরা। কলি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
একজন ওয়েটার এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো,
“ম্যাম আপনি কলি?”
“হ্যাঁ।”
“আপনি এদিকে আসুন। স্যার আগেই রিসিপশনে ফোন করে বুক দিয়ে রেখেছে।”
কলি ছেলেটার সঙ্গে হেঁটে গেলো। ওয়েটার একদম লাস্টের কর্ণারের টেবিলে নিয়ে গেলো কলিকে।
” এটা আপনাদের দুজনের। বসুন ম্যাম। ”
কলি বসলো। টেবিলে মেন্যুলিস্ট , গ্লাস,টিস্যু রাখা আগে থেকেই। সে খেয়াল করে দেখলো পুরো রেস্টুরেন্টে এসাইডটাই কাপল জোন। তার মানে এটা কাপল ফেভার রেস্টুরেন্ট।
সিঙ্গেল চেয়ার নেই এখানে। একটা টেবিলের জন্য একটাই বেঞ্চ দুজন বসার হিসেবে। বলা যায় একটা মিনি রুম। কলি আশ্চর্য হলো ! বিরক্তি জমা হলো চোখের পাড়ে। এত নিরিবিলি প্রাইভেট প্লেস কেন বুকিং দিলো?
মাহমুদ ভার্সিটির সামনের পরিচিত কাঁচাফুলের দোকানটার গেলো। বাইক থেকে নেমে গেলো। আদেশ দিয়ে বলল,
“মামা যত রকমের ফুল আছে। সবগুলো থেকে একটা করে নিয়ে সুন্দর একটা পুষ্পতোড়া রেডি করুন।”
ফুল দোকানী হাতের কাজ রেখে দিলো। মাহমুদের অর্ডারের কাজ ধরলো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে কথা। অতিরিক্ত ইজ্জত দিতেই হয়। মাহমুদ সব ফুল দেখে দুটো টকটকে তাজা বড় লাল গোলাপ বেছে নিলো। সেই দুটো গোলাপ আলাদা রাখলো। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিলো ফুটপাতের উপরে এসে। কয়েকটা সুখটান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দিলো শূন্যের মাঝে। ভাবলো,
আরেহ মদন মাহমুদ, তুইতো হেব্বি প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেলি কলির ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে। প্রেম এমনিই বুঝলি। জগতের বড় বড় মহাপুরুষেরাও ভালোবাসার মানুষ পেলে কাবু হয়ে যায়। আর তুই ত কোন ছার। হাহ! তোর আজকের ক্যালকুলেশন ঠিকই আছে। হবু বউকে বিয়ের আগে একটু ইজি করে নিতে হয়।
ফুলের তোড়া প্রস্তত হয়ে গেলো। দামাদামিতে গেল না মাহমুদ। ফুল বিক্রেতা চা চাইলো তাই দিলো মাহমুদ। ফুলগুলোকে যত্ন করে বাইকে রাখলো। বাইক ছেড়ে গেলো দুর্বার গতিতে। ফুল বিক্রেতা মুচকি হাসলো মাহমুদের যাওয়ার ভঙ্গি দেখে। সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
মাষ্টার সাব কি প্রেমে পড়ছে? না বিয়া ঠিক হইছে? হইলে আমার কি। এই ভেবেই বিক্রেতা তার বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো বারি সিদ্দিকীর বিখ্যাত বিচ্ছেদের গানের দু’চরণ।
“আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে /পুবালী বাতাসে-বাদাম দেইখ্যা/ চাইয়া থাকি,
আমার নি কেউ আসে রে।
যেদিন হতে নতুন পানি আসল বাড়ির ঘাটে/
অভাগিনীর মনে কত শত কথা উঠে রে…”
কলি বসে বসে মোবাইলে ইউটিউবে একটা সিনেমার ট্রেইলার দেখছে। মাহমুদ তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কলি চোখ তুলে তাকাতেই তব্দা খেলো। মাহমুদের চোখে বড় সানগ্লাস। অধরকোণে ঝুলছে মৃদু রোমাঞ্চিত হাসি। হাতে এক গুচ্ছ ফুলের তোড়া। বাকি হাত পিছনে লুকানো। দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ সুন্দর ও রোমান্টিক লাগছে। পরিবেসশের সঙ্গে উপযুক্ত গেট আপ।
আচ্ছা! তাহলে এইজন্যই আজ প্রেমিক সাজ উনার। ‘ডার্লিং’ এ আমাকে নিয়ে আসা। বুঝলাম।
দোল খাওয়া অনভূতি নিয়ে গোপনে উচ্চারণ করলো কলি।
মাহমুদ দাঁড়িয়েই রইলো। পিছনে তার গোলাপ ধরে রাখা হাতটি সামনে নিয়ে এলো। কলির সামনে বাড়িয়ে ধরলো।নিবেদিত কন্ঠে বলল,
“কলিকে ভালোবাসি।”
কলি চমকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা হাতে ফুলটি ধরলো। সানগ্লাসে ঢাকা মাহমুদের দু’চোখ। কলি তার চোখের ভাষা পড়তে পারল না। কন্ঠকে খাদে নামিয়ে লাজুক স্বরে বলল,
“থ্যাংক ইউ স্যার।”
“ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।”
মাহমুদ ফুলের তোড়ার পাশ থেকে আরেকটি সিঙ্গেল গোলাপ কলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো। কলি জিজ্ঞাসু চোখে মাহমুদের মুখে চাইলো।
“সেটা দিয়ে আমি আপনাকে ভালোবাসার প্রপোজ করেছি। আর এটা আপনার হয়ে কিনেছি। আপনি ত আর আমার জন্য ফুলও কিনবেন না। প্রপোজও করবে না। আমি যেচে নিচ্ছি আর কি। সেটা আমাকে দিন। শুনিয়ে না বলুন। মনে মনে যা বলার তা বলুন। হৃদয়ের কথা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করে নিবো।”
কলি গোলাপটি বাড়িয়ে ধরলো মাহমুদের দিকে। মাহমুদ প্রাণ দিয়ে কলির হাত থেকে গোলাপটি নিলো। কলির পাশে বসে পড়লো। কলি বেঞ্চের শেষ মাথায় গিয়ে দেয়াল ঠেসে বসল। মাহমুদ সানগ্লাস খুলে টেবিলের উপরে রাখলো। ফুলের তোড়াটি দু’হাত দিয়ে ধরে কলির দিকে বাড়িয়ে ধরলো।
“শুভ বিবাহ মোবারকবাদ। আপনার অনাগত যুগল জীবন মধুর ও শান্তির হোক।”
কলি হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়াটি নিলো। ভিতরে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তবুও যথাসম্ভব নিজের মাঝে কাঠিন্যতা ধরে রাখলো। কলি ফুল নিয়ে কিছু বলল না। মাহমুদ নিজ থেকেই বলল,
“আমাদের পরিবারে আমরা সবাই যেকোনো কিছু আর্টের সঙ্গে শুরু করি। আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আজকের সেলিব্রেশনটা সেদিনই করার ইচ্ছে ছিলো। বিয়েতে ইনভাইটেশন যেন পাই।”
কলি মৌন রইলো। সে নিজেও জানে তার কেমন লাগছে। মাহমুদ বলল,
“অর্ডার করেছেন কলি?”
” না স্যার। আপনি দেন।”
মাহমুদ চিকেন ফ্রাইড রাইস অর্ডার করলো। কলি পূর্বের অবস্থান ও অবস্থাতে থেকেই খেয়ে নিলো। মাহমুদ কলির দিকে চেয়ে বলল,
” দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে যাবেন। এদিকে এসে বসুন।”
কলি না শোনার ভান করে রইলো।
মাহমুদ এক হাত প্রসারিত করে দিলো কলির দিকে। কলি ভ্রুক্ষেপহীনভাবে চেয়ে রইলো অন্যদিকে। মাহমুদ প্রথমে উঠে দাঁড়ালো সোজাসুজি হয়ে। কলি মনে করলো হয়তো ওয়াশরুমে যাবে। কিন্তু না। মাহমুদ তার খুব কাছে গিয়ে বসে পড়লো।
টেবিলের নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে খপ করে কলির একহাত ধরে ফেলল। কলি হাত মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো। কিন্তু পারছে না আলগা করতে। এমতাবস্থায় তাদের দুজনের চোখ গেলো মাত্র চারহাত দূরত্বে পাশের টেবিলের এক জোড়া কপোত-কপোতীর দিকে। তাদের দুই জোড়া ঠোঁট একজোড়া হয়ে আছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটু একটু তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তখানি। তারা দুজন কাজটাতে এতটাই বিভোর হয়ে আছে। যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে অন্য টেবিলের কাপলদের একই কাজের সঙ্গে। যে জুটি যত দীর্ঘসময় অধরে গাঢ় চুম্বন করে যেতে পারবে। তাকে কর্তৃপক্ষ হতে বিশেষ পুরুস্কার দেওয়া হবে।
মাহমুদের প্রেমিকচিত্ত প্রশ্রয় পেয়ে উঠলো। কলির ঘাড়ে ফুঁ দিলো দুবার। কলির কপালের অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
“আচ্ছা এমন একটা রোমাঞ্চকর কাজের পুরুস্কার কি হতে পারে বলুন তো?”
কলির লজ্জার সীমা রইল না। মাথা নামিয়ে বসে রইলো। অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠলো,
“স্যার কি করছেন? এমন অসভ্যতামি করার জন্য এখানে আসা?”
মাহমুদ কলির হাত ছেড়ে দিলো। দুটো আঙ্গুল কলির ঘাড় থেকে একটু নিচে বুকের উপরে এনে থামালো। বলল,
“মেয়েদের বুক ফাটে তবু মুখ ফাটে না। এই প্রবাদটা জানি। আবার একটা গান আছে না কি যেন? ওহ। মনে পড়েছে। ‘বাহির বলে দূরে থাকুক ভিতর বলে আসুক না।’
আমার সান্নিধ্য কি আপনাকে আনন্দ দান করেনি কলি? আর শুনুন মিস কলি, হাজব্যান্ড ওয়াইফ হয়ে জীবনকে উপভোগ করা আর গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড হয়ে উপভোগ করার বিশাল পার্থক্য। ক্লিয়ার? মন্দ কিছুই করিনি। অকারণে অপবাদ দিলেন। সেলিব্রেট করার জন্য এমন পরিবেশ পারফেক্ট। এটাই ছিলো মূখ্য।”
কলি থম মেয়ে বসে রইলো।
“ও হ্যাঁ। যেহেতু আমরা দুজন পূর্ব পরিচিত। সেই সুবাদে বিয়ের সাজপোশাক বা সবকিছু নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত কোন সাধ থাকলে বলতে পারেন। আমি সর্বস্ব দিয়ে আপনার সেই সাধ পূর্ণ করার চেষ্টা করবো।”.
” নাহ স্যার। আমার এই বিষয়ে কোন চাওয়া পাওয়া নেই। এটা লাভ ম্যারেজ নয়। ‘অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ।”
চাহনি অন্যদিকে ফেলে জানাল কলি।
” তাহলে বুঝি কিছু বলা যায় না? হতে পারে। এই হাদিস বা রুলস আমার অজানা। এনিওয়ে,
আমার পার্ট শেষ। আপনি কি যেন বলবেন? প্লিজ বলুন। নিউ কোন কন্ডিশন বিয়ে নিয়ে?”
” নাহ স্যার। তবে কন্ডিশন।”
অফ মুডে বলল কলি।
তোমার জন্য সব পর্ব ১৮
“কন্ডিশন আর কন্ডিশন। হায়রে। বলুন?”
“বিষয়টা আমার পরিবার নিয়ে স্যার।”
” ওহ হো! সিউর কলি। প্লিজ।”
কলির মুখ ম্লান। দৃষ্টি আনমনা। কন্ঠ ভারি। সে বলতে লাগলো,