তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ১৫ (২)
নওরিন মুনতাহা হিয়া
মেঘ তার অবাধ্য নেএপল্লব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সে পুনরায় তাকায়, আদ্রিয়ানের দিকে। গভীর মনোযোগ সহিত পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, আদ্রিয়নের মুখশ্রী। আদ্রিয়ান হয়ত মেঘের তাকিয়ে থাকার বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারল, তার অস্বস্তির পরিমাণ বেড়ে যায়। কোনো নারীর সংস্পর্শে সে কখনো আসে নাই, তাই তার মধ্যে একপ্রকার জড়তা কাজ করে। আদ্রিয়ান বলে উঠে __
“- মেঘ তোমার হাত আমার কারণে পোড়ে গিয়েছে, তাই সেই জায়গায় ঔষধ লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। এতো রাতে তোমার রুমে এসেছি, আমি শুধু আমার দায়িত্ব পালন করছি __.
আদ্রিয়ানের কথা শুনে মেঘ হাসে, যদিও তা সুখের হাসি নয়। বরং একরাশ অভিমান, অভিযোগ আর মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কষ্ট আড়াল করার জন্য সে হাসে। আদ্রিয়ান সব দায়িত্ব পালন করে, কিন্তু সে শুধু উদাসীন মেঘের প্রতি। মেঘ যে তার স্বর্বশ উজাড় করে, তাকে ভালোবেসেছে, তার জন্য সাতটা বছর অপেক্ষা করেছে। তার ভালোবাসা, আর অপেক্ষা মুল্য কি সে দিয়েছে? এইটা কি আদ্রিয়ানের দায়িত্ব ছিল না। মেঘ শান্ত স্বরে, আদ্রিয়ানকে প্রশ্ন করে __
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“- আদ্রিয়ান স্যার আপনি কি সত্যি সব দায়িত্ব পালন করেন?
মেঘের কণ্ঠে লুকিয়ে থাকা, এক কষ্ট ছিল যা আদ্রিয়ান উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু সেই কষ্টের কারণ তার জানা নাই, তবে আদ্রিয়ান নিঃসংকোচে মেঘের প্রশ্নের উত্তর দেয় __
“- হুম অবশ্যই আমি সব দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন কেনো করলে তুমি মেঘ? কি এমন দায়িত্ব আছে যা, এই আদ্রিয়ান রোদায়ান পালন করেনি?
আদ্রিয়ানের কথা শুনে মেঘ মনে মনে বলে, আপনার সকল দায়িত্ব, ভালোবাসা শুধু জিয়ার প্রতি। ও আপনার প্রেমিকা। আর আমি বউ হয়ে ও, কখনো আপনার ভালোবাসা তো বহুদূরের কথা। দায়িত্ব ও হাতে পারলাম না। কি অদ্ভুত বিষয়, তাই না। এই পৃথিবীতে প্রতৈকে ভীষণ স্বার্থপর, শুধু মেঘই বোকার মতো নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে গেলো। যে ভালোবাসার নাই কোনো পূর্ণতা, শুধু আছে অপেক্ষা আর যন্ত্রণা।
মেঘের আনমনে ভাবনার মাঝে, হঠাৎ আদ্রিয়ান তার হাত ছেড়ে দেয়। আদ্রিয়ান বলে উঠে __
“- হুম ডান মেঘ। তোমার হাতে মলম লাগানো হয়ে গেছে, এখন আর ব্যাথা করবে। পোড়া জায়গা টা, খুব দ্রুত শুকিয়ে যাবে __.
মেঘ তার হাতের কবজির কাছের, পোড়া জায়গা টা দেখে। এরপর আদ্রিয়ানকে বলে __
“- আপনার দায়িত্ব শেষ, আদ্রিয়ান স্যার __.
“- হুম অবশ্যই __.
“- তবে এখন চলে যান রুম থেকে, ঘুমাব আমি _.
“- ওকে তুমি ঘুমাও মেঘ। আমি রুমে গেলাম __.
আদ্রিয়ান আর কথা বাড়ায় না, সে মেঘের রুম থেকে বের হয়ে যায়। মেঘ দরজা শব্দ করে বন্ধ করে দেয়, এরপর সে আবার তার বিছানায় শুয়ে পড়ে। তবে এখন মেঘের চোখে ঘুম আসছে না, কিছুক্ষণ আগের চোখ জুড়ে ঘুম ছিল। হঠাৎ এখন তা উদাও হয়ে গেছে, মেঘ তার মাথায় হাত ঠেকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে৷ তখনই তার নজর যায়, তার পোড়া কবজির দিকে। সেখানে সাদা রঙের মলম লাগানো, যা একটু আগে আদ্রিয়ান দিয়ে গেছে। মেঘ বলে __
“- ব্যাথা ও আপনি দিবেন, আর ব্যাথার জায়গায় মলম আপনি লাগিয়ে দিবেন। বা্হ আদ্রিয়ান রোদায়ান কি দারুণ পরিকল্পনা আপনার, সত্যি আমি অনেক বড়ো ডক্টর __.
মেঘ কথাটা কি তার ব্যাথার জন্য বলেছে, না নিজের মনের দুঃখের জন্য। তা বুঝা গেলো না। একটু পর মেঘের চোখে ঘুম চলে আসে, মেঘ ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল প্রায় সাড়ে নয়টা। জানালা ভেদ করে তপ্ত রোদের ঝলমলে আলো ঘরে প্রবেশ করছে। আবিহা পিটপিট করে চোখ খুলে তাকায়। কাল সারাদিন বিয়ের অনুষ্ঠানের কারণে, বিশ্রাম নেওয়ার বিন্দুমাএ সুযোগ হয় নি তার। রাতে শরীরে ভীষণ ক্লান্তি থাকায়, চোখে ঘুম চলে আসে তার। খুব তাড়াতাড়ি কাল রাতে ঘুমিয়ে পড়ে আবিহা।
আবিহা তার চোখের উপর রোদের কিরণ অনুভব করে। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ খুলে যায় তার। বাড়ির নতুন বউ এখন সে, এতো বেলা অবধি ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। সময় দেখার উদ্দেশ্য, বালিশের নিচে থাকা ঘড়ির মোবাইল খুজাঁর জন্য পাশে ফিরে তাকায় সে। কিন্তু হঠাৎ সে খেয়াল করে সে কারো বাহুডোরে বন্ধি, খুব শক্ত করে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কেউ। আবিহা যখন তার হাত অনুসরণ করে, সামনে থাকা মানুষটার দিকে তাকায়। তার চোখ মুখ জুড়ে, প্রশান্তি ছায়া বয়ে যায়। তার থেকে সামান্য অল্প দুরত্বে ঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছে, তার স্বামী কারান।
কারানের ঘুমন্ত মুখ, অবলোকন করে আবিহা। ঘুমন্ত অবস্থায় কারানকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, যদিও কারান যথেষ্ট সুর্দশন তাকে সবসময় সুন্দর লাগে। কারানকে প্রথম দেখে আবিহা ছবিতে, যেটা তার বাবা তাকে দিয়েছিল। প্রথম দেখায় কারানের প্রেমে পড়ে যায়, অষ্টাদশী আবিহার মনে প্রথম স্থান দেয় এই মানুষটাকে। আর সেই শেষ। এরপর আবিহার বাবা যখন, তাকে জিজ্ঞেস করে বিয়েতে তার সম্মতি আছে কি না? আবিহা হ্যা সূর্চক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, সে রাজি। কারণ সে চাই, এই ছবিতে থাকা মানুষটা যেনো তার জীবনে বাস্তব হিসাবে ধরা দেয়। তার চোখের অসীম মায়ায়, সে হারিয়ে যেতে চাই। তার শরীর সহ মন ছুঁয়ার বৈধতা শুধু মাএ এই লোককে দিতে চাই __.
“- প্রথমবার যখন কারান আবিহাকে দেখতে আসে, তখন আবিহা ড্রয়িং রুমে বসে ছিল তাদের সামনে। ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে, কিছুক্ষণ পর পর কারানকে দেখছিল সে। তার প্রিয় মানুষকে, সে স্বচোখে দেখেছিল প্রথমবার। কারানকে দেখার ওই তৃষ্ণা আজ অবধি, মিটে নাই আবিহার। কনে দেখার পর আংটি পড়িয়ে দেয় কারান, আবিহার হাতে। এরপর দুই পরিবারের মধ্যে, কথা বর্তা বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ের দিন ঠিক করা হয়। কারান আর আবিহাকে যখন একান্তে কথা বলতে বলা হয়, তখন কারান সাহস জুটিয়ে আবিহার নাম্বার চাই। আবিহা ও তার নাম্বার দিয়ে দেয় কারানকে, এরপর থেকে তারা একে অপরের সাথে প্রায় নিয়মিত কথা বলত।
কারান আর তার বিয়েটা, তার কাছে ভালোবাসার পূর্ণতা। কারণ আবিহা শুরু থেকে কারানকে ভালোবেসে এসেছে। আবিহা অতীতের ঘটনার কথা মনে করে, আর কারানের ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কাল রাতে কারান তার সাথে রোমান্স বা বাসর করে নি, বরং রুমে এসে বলেছে যে জামাকাপড় বদলে ঘুমিয়ে পড়তে। আবিহা যখন ওয়াশরুম থেকে, বিয়ের শাড়ি খুলে বের করে আসে। তখন কারান তার দিকে এগিয়ে যায়, আবিহার মনের মধ্যে ভয় আর সংকোচ ঘিরে ধরেছিল তখন। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সে। তবে আবিহার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে, কারান তার গায়ের গয়না ধীরে ধীরে খুলে দেয়। এরপর তার কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিয়ে, তাকে বলে ঘুমিয়ে পড়তে। কারান আবিহাকে জড়িয়ে ধরে, ঘুমিয়ে ছিল সারারাত।
আবিহা যখন কারানের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে, অতীতের কথা ভাবছিল। তখন হঠাৎ করে তার মনে, এক সুপ্ত চাহিদা জেগে উঠে। তার স্বামী নামক পুরুষের মুখমণ্ডলে, একবার তার হাতের ছোঁয়া দিতে চাই সে। আবিহা ধীরে ধীরে তার, হাত নিয়ে যায় কারানের মুখের কাছে। এরপর ধীরে ধীরে, আলতো হাতে সমস্ত মুখমণ্ডল ছুয়িঁয়ে দেয়। কারানের চোখ, মুখ, নাক, ঠোঁট আবিহার আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে।
অন্যদিকে মেঘের ঘুম ভাঙ্গে সকাল নয়টায়, ঘুম থেকে উঠে সে ওয়াশরুমে যায় ফ্রেশ হতে। আজ আবিহা আর কারানের বউভাতের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান দুপুর দিকে শুরু হবে, আর বিকালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কারণ রাতে রিসোর্ট ছেড়ে আবিহাকে নিয়ে, কারানদের বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। আমেরিকায় কারানের নিজস্ব বাসা আছে, কিন্তু বিয়ে উপলক্ষে কিছুদিন এই রিসোর্টে থাকতে হয়েছে তাকে। আজ তারা সকলে বাড়ি ফিরবে, নতুন বউ নিয়ে __.
মেঘ সকালের নাস্তা এখন ও করেনি। যদিও এই বাড়ির সকলে সকাল নয়টা বা সাড়ে নয়টায় সময় নাস্তা করে। মেঘের প্রচুর খুদা লাগছে, তাই সে পরিপাটি হয়ে রেডি হয়ে খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্য রুম থেকে বের হয়। অন্যদিকে আদ্রিয়ান ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য বের হয়। মেঘ রুমের দরজা খুলে, বাহিরে বের হয়। তখনই তার সাথে দেখা হয়, আদ্রিয়ানের, মেঘ একটু থমকে যায় আদ্রিয়ান ও মেঘকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়৷ তবে মেঘ কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে যখন, চলে যাবে। তখন আদ্রিয়ান বলে উঠে _
“- মেঘ তোমার হাতের ক্ষতর কি অবস্থা? পোড়া জায়গা কি শুকিয়ে গেছে?
মেঘ আদ্রিয়ানের দিকে ফিরে তাকায় না, সে অন্য পাশে থেকে বলে উঠে __
“- হুম পোড়া জায়গা কিছুটা শুকিয়ে গেছে __.
তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ১৪
মেঘ আদ্রিয়ানের সাথে আর কথা বাড়ায় না, সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়৷ আদ্রিয়ান মেঘের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে, এই মেঘ সবসময় তাকে ইগনোর করার চেষ্টা কেনো করে? মনে হয় তার থেকে, দুরত্ব বজায় রাখতে পারলে মেঘ খুশি হয়। কিন্তু কেনো? আদ্রিয়ান তো মেঘের সাথে খারাপ ব্যবহার করে নি? তবুও মেঘের এতো তার থেকে দূরে যাওয়ার তাড়া কেনো?
