তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ৩
নওরিন মুনতাহা হিয়া
আদ্রিয়ানের প্রশ্ন শুনে সৃষ্টি ভয় পেয়ে যায়, সে ভয়ে সামান্য শুকনো ঢুক গিলে। আদ্রিয়ান মেঘের ছবি সৃষ্টিকে দেখায়, আর বলে __
“- ছবিতে থাকা মেয়েটা কে সৃষ্টি? ও কি কোনো আত্মীয় হয় আমাদের? আর আমার আলমারিতে ওর ছবি কি করছে?
সৃষ্টি এগিয়ে যায় আদ্রিয়ানের কাছে, তার হাতে থাকা মেঘের ছবি সৃষ্টি দেখে। ছবিটা অনেক পুরাতন, স্পষ্ট করে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মেঘের চেহারার কোনো অংশই বোঝা যাচ্ছে না, শুধু মেঘের দুই – চোখ ছাড়া। আর দীর্ঘদিন আলমারিতে ছবি থাকার কারণে, প্রায় অনেক অংশ ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আর আদ্রিয়ানের কথা শুনে সৃষ্টি বুঝতে পারে, মেঘের চেহারার অংশ সে দেখতে পায় নি। শুধু সে তার চোখ দেখেছে, আর কিছুই না। সৃষ্টি আদ্রিয়ানকে মেঘের কথা বলে না, কারণ মেঘ আর তার এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর মেঘ ও দূরে চলে গেছে, এখন আদ্রিয়ানের মেঘের বিষয়ে না জানাই ভালো। সৃষ্টি মেঘের কথা আড়াল করে, আদ্রিয়ানের প্রশ্নর মিথ্যা জবাব দেয় _
“- ভাইয়া এই ছবি আমাদের এক দূরের আত্মীয়ের।ছবিটা অনেক দিন আগের, হয়ত তোমার ঘরে তোমার আলমারিতে রেখে দিয়েছে __.
সৃষ্টির যুক্তিটা আদ্রিয়ানের বিশ্বাস হয় নি। তবে সে ছবিটা নিয়ে বেশি ভাবে না, কে, ছবিটা পাশের টেবিলে রেখে দেয়। তবে আদ্রিয়ান মুগ্ধ হয় ছবির মধ্যে থাকা, নারীর অস্পষ্ট আঁখি জুড়ার উপর। আদ্রিয়ানের হৃদয়ের গহীনে এক বাসনা জাগে, এই আগন্তুক নারীকে দেখার জন্য। যার চোখ এতো সুন্দর, তার রূপ না জানি কতই সুন্দর হবে। আদ্রিয়ার তার ইচ্ছাকে ধমিয়ে রাখে, সে আর ছবির দিকে ফিরে তাকায় না। সৃষ্টি এতোখন আদ্রিয়ানকে আনমনে কিছু ভাবতে দেখে, প্রশ্ন করে উঠে
“- ভাইয়া হঠাৎ করে কি এমন ভাবনায় ডুবে গেলে তুমি? নিচে চলো আম্মু ডাকছে তোমাকে, খাবার খাওয়ার জন্য __.
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
সৃষ্টির কথা শুনে আদ্রিয়ান ঘোর থেকে বের হয়ে আসে। আদ্রিয়ান সৃষ্টির সাথে দুপুরের খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্য, রুম থেকে বের হয়ে যায়। তালুকদার বাড়ির সকল সদস্য এখন , দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য টেবিলে বসে আছে। তারা সকলে আদ্রিয়ানের জন্য অপেক্ষা করছে। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে আদ্রিয়ার, তার পিছনে রয়েছে সৃষ্টি। আদ্রিয়ান টেবিলে এসে বসে, রুহুল আমিন ও জুনাইদ আগে থেকেই বসে ছিল। নীলিমা বেগম আর শার্লিন বেগম রান্না ঘর থেকে সকল খাবার নিয়ে আসেন, টেবিলে সকলের সামনে সকল কিছু সাজিয়ে রাখেন। খাবার টেবিলে প্রায় বিশ রকমের রান্না দেখে, আদ্রিয়ান অবাক হয়ে বলে ___
“- আম্মু এতো খাবার রান্না করেছ কেনো? এতো খাবার খাওয়া কি সম্ভব?
আদ্রিয়ানের কথা শুনে সৃষ্টি বলে উঠে ___
“- ভাইয়া আম্মু তো আরো রান্না করতে চেয়ে ছিল। তুমি বাড়িতে চলে এসেছ বলে, রান্না করে নি। না হলে আজ একশোর বেশি খাবার রান্না করত আম্মু __.
সৃষ্টির কথা শুনে শার্লিন বেগম বলে ___
“- সাত বছর পর আমার ছেলে বাড়িতে ফিরে এসেছে, ওর জন্য বিশ রকম রান্না করব না তো কি করব? আমেরিকায় থেকে ওইসব ইংরেজদের খাবার খেয়ে, দেখ৷ কতো শুকিয়ে গেছে। যতদিন বাংলাদেশে থাকবে, আমার ছেলের জন্য আমি বিশ পদই রান্না করব ___.
বোন আর মায়ের ঝগড়া দেখে আদ্রিয়ান হাসে, বিদেশে থাকতে সে এই ছোট ছোট ঝগড়া আর খুনসুটি ভীষণ মিস করেছে। আদ্রিয়ান আর কথা বাড়ায় না, সে খাবার খাওয়া শুরু করে দেয়। জামান সাহেব এখন বাড়ি ফিরেন নাই, তাই তাদের সাথে একসাথে বলে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করতে পারেন নি। অন্যদিকে মেঘ তার ফ্লাটে যায়, চারতলায় দুইটা ফ্লাট রয়েছে। একটা ভাড়া দেওয়া, আর অন্যটায় থাকে মেঘ। মেঘের অপরের ফ্লাটে থাকে মধ্য বয়স্কী একজন মহিলা তার স্বামী, আর তাদের একমাত্র মেয়ে আবিহা। আবিহা এখন জাতীয় ভার্সিটিতে পড়াশোনা রয়েছে, তার পড়াশোনা প্রায়ই শেষের দিকে।
মেঘ দরজা খুলে তার ফ্লাটে প্রবেশ করে। ফ্লাটটা বেশ বড়, আর ভীষণ পরিপাটি করে সাজানো। জামান সাহেব আগে থেকেই, মেঘের প্রয়োজনীয় জিনিস ফ্লাটে রাখার ব্যবস্থা করে রেখেছে। মেঘের ফ্লাটটা পছন্দ হয়েছে, তবে চারদিকে কেমন যানি তার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভীষণ একাকিত্ব বোধ হয় মেঘের। তবে মেঘ তো সারাজীবন একাই ছিল, তার সঙ্গী তো কেউ কখনো ছিলই না। মেঘ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে, এরপর তার ব্যাগপএ নিয়ে ফ্লাটের ভিতরে চলে যায়। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে, আর প্রচুর খুদা ও লেগেছে মেঘের। কিন্তু সে এখন কোথা থেকে খাবার পাবে? রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যায় মেঘ। যদি রান্নাঘরে বাজার রাখা থাকে, তবে সিম্পল সাধারণ কিছু রান্না করে খেয়ে নিবে।
রান্নাঘরে যাওয়ার আগেই মেঘের ফ্লাটের দরজার বেল বেজে উঠে, মেঘ দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলে দিতেই, তার দিকে খাবারের বাটি এগিয়ে দেয় আবিহা। মেঘ প্রথমে আবিহাকে চিনতে পারে নি, পরে আবিহা তার পরিচয় দেয়। আবিহা বলে ___
“- আমার নাম আবিহা। তোমার পাশের ফ্লাটে থাকি আমি। এখন দুপুরের খাওয়া সময়, তুমি হয়ত কিছু খাও না। তাই আম্মু তোমার জন্য খাবার পাঠিয়েছে ___.
আবিহার হাতে খাবার দেখে মেঘ খুশি হয়ে যাক। তাকে এখন রান্না করতে হবে না। এতো সময় জার্নি করে এসে, তার রান্না করতে ইচ্ছা করছিল না। আবিহা যখন খাবার নিয়ে এসেছে, তখন তাকে আর দুপুরে রান্না করতে হবে না। মেঘ আবিহাকে ধন্যবদা জানায়, এবং তাকে ফ্লাটের ভিতরে আসতে বলে। তবে আবিহার জরুরি কাজ থাকায় সে, আর ফ্লাটের ভিতরে আসে না। আবিহা চলে যাওয়ার পর, মেঘ খাবার নিয়ে ভিতরে চলে আসে। দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়, আবিহার মায়ের রান্নার হাত অনেক খাবার। ভীষণ সুস্বাদু হয়ে খাবারটা।
[ সময় রাত ৯:০০ টা ]
রাত প্রায় নয়টার সময় জামান সাহেব বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর ফ্রেশ হয়ে, রাতের খাবার খান। জামান সাহেব যখন খাওয়া দাওয়া শেষ করে, ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। শার্লিন বেগমের কাছ থেকে আদ্রিয়ানের বাড়ি ফিরার কথা শুনেছেন, তবে ওনি রুমে গিয়ে আদ্রিয়ানের সাথে দেখা করেন নি। জামান সাহেবের বাড়ি ফিরার কথা শুনে, আদ্রিয়ান নিজ রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। ড্রয়িং রুমে জামান সাহেবকে দেখে, আদ্র তার পাশে গিয়ে বসে। আদ্রিয়ান বলে __
“- কেমন আছেন আব্বু?
আদ্রিয়ানের প্রশ্ন শুনে, জামান সাহেব ছোট করে উত্তর দেয়
“- হুম ভালো। দেশে কতদিন থাকার পরিকল্পনা আছে তোমার?
“- দেশে খুব বেশি দিন থাকব না। মাএই পিএইচডি করলাম, এখনো হাসপাতালে জয়েন কর হয় নি। সামনের সপ্তাহে আমার জয়েনিং, এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার আমেরিকায় ফিরে যেতে হবে আমার ___.
আদ্রিয়ানের কথা জামান সাহেব শান্ত হয়ে শুনেন, এরপর বলেন ___
“- সারাজীবন কি আমেরিকায় থাকার পরিকল্পনা করে রেখেছ না কি?
আদ্রিয়ান উত্তর দেয় __
“- না সারাজীবন না। তবে যতদিন না কেরিয়ার সেট হচ্ছে, ততদিন আমেরিকায় থাকতে হবে __.
জামান সাহেব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যান, এরপর রুমের যাওয়ার দিকে পা বাড়ায়। জামান সাহেব বলে ____
“- আদ্রিয়ান জীবন তোমার, কেরিয়ার ও তোমার। তুমি যা সিদ্ধান্তে নিবে তাই হবে। আমি আর কি বলব __.
জামান সাহেব চলে যান, আদ্রিয়ান কিছু সময় ড্রয়িং রুমে শান্ত হয়ে বসে থাকে। জামান সাহেবের এমন ব্যবহারের কারণ সে যানে, তবে কিছু বলে না। আদ্রিয়ান কিছু সময় পর, তার রুমে ফিরে আসে।
[ রাত প্রায় ১০ : ০০ ]
তালুকদার বাড়ির সকলে এখন আদ্রিয়ানের রুমের ভিতরে। কারণ আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা, সকল গিফট পরিবারের সকলে দিচ্ছে আদ্রিয়ান। জুনাইদা, সৃষ্টি, শার্লিন বেগম, রুহুল আমিন, নীলিমা সকলে তাদের গিফট পেয়ে খুশি । তখনই আদ্রিয়ানের রুমে প্রবেশ করে জামান সাহেব,জামান সাহেবকে দেখে আদ্রিয়ান বলে __
“- আব্বু তুমি?
জামান সাহেব বাড়ির সকলের দিকে তাকায়, এরপর আদ্রিয়ানের রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। জামান সাহেব গম্ভীর গলায় বলে ___
“- তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা আছে আমার আদ্রিয়ান __.
জামান সাহেবের সাথে আদ্রিয়ানের প্রায় এক ঘণ্টা আগেই দেখা হয়েছে। তখন জামান সাহেব তাকে কিছুই বলে নি, হঠাৎ করে এক ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেলো? আদ্রিয়ান বলে _
“- হুম আব্বু বলেন? কি কথা?
জামান সাহেব দেয়াল ঝুলন্ত আদ্রিয়ানের ছবির কাছে যায়। ছবির নিচের টেবিলের ডয়ারে, ডিভোর্স পেপার রাখা। যেখানে মেঘের সাইন করা, জামান সাহেব ড্রয়ার থেকে ডিভোর্স পেপার বাহির করেন। জামান সাহেবের হাতে থাকা কাগজটা যে ডিভোর্স পেপার, তা শার্লিন বেগম যানে। শার্লিন বেগম চান না আদ্র আর মেঘের ডিভোর্স হোক, বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা বা মজা নয়। আদ্রিয়ান যতই মেঘকে স্ত্রী হিসাবে না মেনে নিক, কিন্তু সত্যি এইটাই মেঘ তার বিবাহিত স্ত্রী।
জামান সাহেব ডিভোর্স পেপার নিয়ে এগিয়ে আসেন আদ্রিয়ানের কাছে। মেঘ যে এখানে পেপার রেখেছে তা, জামান সাহেব যানেন। জামান সাহেব বলে __
“- এই নাও ডিভোর্স পেপার আদ্রিয়ান। তোমার বিদেশ থেকে ফিরে আসার অন্যতম শর্ত ছিল এই ডিভোর্স। ও [ মেঘের নাম নেই না ] আগের ডিভোর্স পেপারে সাইন করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এখন তুমি ও সাইন করে, এই বিয়ের থেকে নিজেকে মুক্ত করে নাও __.
আদ্রিয়ান ভাবে নাই জামান সাহেব তাকে ডিভোর্সের কথা বলবে। তবে সে খুশিই হয়, কারণ এই জোর পূর্বক বিয়ের থেকে মুক্তি চাই তার। আদ্রিয়ান ডিভোর্স পেপার হাতে নেয়, তার চোখ যায় সেখানে সাইন করে মেয়ের লেখার দিকে। যার নাম মালিহা। মেঘের সম্পূর্ণ নাম মালিহা জান্নাত মেঘ, তার বাবা তাকে ভালোবেসে মালিহা বা মেঘ উভয়ই নামেই ডাকত। স্কুল, কলেজ, সহ জাতীয় আইডির সব জায়গায় মালিহা তার নাম, তাই মেঘ মালিহা নাম দিয়েই সাইন করেছে।
তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ২
আদ্রিয়ান নামটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, যে তার যার সাথে বিয়ে হয়েছিল তার নাম মালিহা। যদিও তাকে সে কখনো দেখে নি, আর দেখার ইচ্ছা ও নাই তার। আদ্রিয়ান ডিভোর্স পেপার হাতে নেয়, জামান সাহেব তার হাতে কলম দেয়। শার্লিন বেগম কিছুতেই এই ডিভোর্স হতে দিবে না, অসম্ভব। তালুকদার বাড়ির বড় বউ মেঘ, একমাত্র মেঘের যোগ্যতা আছে এই তালুকদার বাড়ি আর তার ছেলকে সামলানোর। শার্লিন বেগমকে কিছু একটা করে, এই ডিভোর্স হওয়া থেকে আটকাতো হবে।
আদ্রিয়ান ডিভোর্স পেপার টেবিল রাখে, এরপর নিচুঁ হয়ে বসে সাইন করার জন্য কলম নিয়ে যায় পেপারের কাছে। আদ্রিযান কাগজে মেঘের পাশে তার সাইন কর
