তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ৫
নওরিন মুনতাহা হিয়া
আমেরিকার বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে মেঘ। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির শারীরিক গঠন, আর জামাকাপড় দেখে তার বাঙালি মনে হয়। আবিহা হয়ত তাকে রিসিভ করার জন্য, এই লোককে পাঠিয়েছে। মেঘ এগিয়ে যায় আগন্তুক মানুষটার কাছে, সে পিছনে ফিরে ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলছে। মেঘ তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়, মনের মধ্যে সংকোচ নিয়ে। উল্টো দিকে ঘুরে থাকা ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে __
“- এক্সকিউজ মি। আপনি কি মিস্টার : আন?
মেঘের কণ্ঠ শুনে পিছনে ঘুরে থাকা ব্যক্তি ফোনে কথা বলা থামিয়ে দেয়৷ ফোন কথা বলা বন্ধ করে, মেঘের দিকে ঘুরে তাকায়। মেঘ তার সামনে থাকা ব্যক্তির মুখ দেখে, কিছুসময় তাকিয়ে থাকে। মেঘের এমন তাকিয়ে থাকা দেখে, সামনে থাকা ব্যক্তি বুঝতে পারে মেঘ তাকে চিনতে পারে নি। লোকটা তার মুখে মিষ্টি হাসি বজায় রেখে বলে ___
“- হাই মেঘ। আমি কারান, আবিহার হবু বর __.
আবিহার কথা শুনা মাএই মেঘের সমস্ত দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। তার মানে আবিহার হবু বরকে, মেঘকে রিসিভ করার জন্য পাঠিয়েছে আবিহা । মেঘ তার মুখে মিষ্টি হাসি বজায় রাখে, আর বলে __
“- আসসালামু আলাইকুম কারান ভাইয়া।
কারান প্রথমে হাই বলেছিল, কিন্তু মেঘ তাকে সালাম দিয়েছে দেখে সে তার উত্তর দেয় __
“- ওয়ালাইকুম সালাম মেঘ __.
মেঘের মনে পড়ে আবিহা বলেছিল আন নামে কেউ একজন তাকে রিসিভ করবে। কিন্তু ওনি তার নাম কারান বলছে কেনো? মেঘ কারানকে জিজ্ঞেস করে __
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“- আবিহা না বলেছিল আন নামের কেউ একজন আমাকে রিসিভ করতে আসবে। কিন্তু আপনার নাম তো কারান?
মেঘের কথায় সম্মতি জানায় কারান, কারান বলে __
“- হুম তোমাকে রিসিভ করার জন্য আনের আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ওর কিছু জরুরি কাজ পড়ে যায়, যার জন্য আসতে পারে নি। আবিহা তোমাকে পরে ফোন বা মেসেজ করে জানায় নি, যে তোমাকে রিসিভ করার জন্য আমি আসব __.
কারানের কথা শুনে মেঘ তার ফোনের কথা মনে পড়ে,। বিমানে উঠার পর তার ফোন বন্ধ করে রেখে ছিল। মেঘ তার ফোন অন করে, অন করার সঙ্গে সঙ্গে তার ফোনে আবিহার মেসেজ আসে। আবিহা মেসেজ করে বলে দিয়েছে, যে মেঘকে রিসিভ করার জন্য আন নয় বরং কারান আসবে। আর কারানের কিছু ছবি আবিহা তাকে সেন্ড করেছে, যাতে বিমানবন্দরে এতো লোকের ভিড়ে কারানকে খুঁজতে অসুবিধা না হয়। মেঘ কারানের ছবির দিকে তাকিয়ে দেখে, তার সামনে দাঁড়ানো লোকটার কথায় আবিহা মেসেজে বলেছে। মেঘ কিছুটা অপরাধী সূচক কণ্ঠে বলে __
“- সরি কারান ভাইয়া। বিমানে উঠার পর ফোন বন্ধ করে রেখে ছিলাম আমি, যার জন্য আবিহার মেসেজ সিন করতে পারি নাই। সব দোষ আমার __.
কারান মেঘের এমন অপরাধী সূচক কণ্ঠ শুনে, শব্দ করে হেঁসে উঠে। কারান মেঘকে বলে _
“- ওহ মেঘ এখানে সরি বলার কি আছে? আর বিমানে ফোন সাইলেন্ট বা বন্ধ করে রাখতে হয়, এইটচই নিয়ম। আচ্ছা এখন চল বাড়ি ফিরা যাক, আবিহা হয়ত তোমার জন্য অপেক্ষা করছে __.
কারানের ব্যবহারে মেঘ মুগ্ধ হয়। কারান বেশ হাসি খুশি মেজাজের লোক, তার ব্যবহার ভীষণ সুন্দর। মেঘের সাথে কিছুক্ষণের পরিচয়ে, বেশ ভালো বন্ধুর মতো সম্পর্ক পড়ে উঠেছে। আবিহার জন্য তার পরিবার যোগ্য একজন মানুষকে পছন্দ করছে যা, মেঘ বুঝতে পারে। কারানের মতো এমন স্বামী যার ভাগ্য থাকবে, সে ভীষণ সুখী হবে। সত্যি আবিহা ভাগ্যবতী। তবে সবার ভাগ্য মনে হয় এত ভালো হয় না, সকলে স্বামী হিসাবে এমন যত্নশীল মানুষ পায় না৷ কিন্তু নারী মেঘের মতো কপাল পোড়া ও হয়।
বিমানবন্দর থেকে ফিরে আসার সময় জামান সাহেব, তার জরুরি কিছু কাজ আছে বলে মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে যান। শার্লিন বেগম, সৃষ্টি সহ তালুকদার বাড়ির সকলে, গাড়ি করে বাসায় ফিরে যায়। জামান সাহেব গাড়ি থেকে নেমে, অন্য একটা রিকশা ভাড়া করেন। প্রায় পাঁচ মিনিট পর রিকশা গিয়ে থামে, একটা কবরস্থানের সামনে। জামান সাহেব রিকশা থেকে নেমে, ভাড়া পরিশোধ করেন। এরপর কবরস্থানের ভিতর প্রবেশ করেন, ধীরে ধীরে হেঁটে এগিয়ে যান একটা করবের কাছে। জামান সাহেবের দাঁড়িয়ে থাকা কবরের সামনের দেয়ালে, খোদায় করে লেখা রয়েছে ___ মৃত সাদাদ সাহেব, পেশায় একজন ব্যবসায়ী.
সাদাদ সাহেব এই মানুষটা অন্য কেউ না, ওনি মেঘের বাবা। জামান সাহেবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, আর প্রিয় বন্ধু। সাদাদ সাহেবের মৃত্যুর, আজ প্রায় আট বছর পূরণ হয়েছে। জামান সাহেব কবরের দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার চোখ পানির ফোঁটায় ছলছল করছে। যদিও জামান সাহেব তার চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে দেন না, কারণ পুরুষ মানুষের কান্না করতে হয় না। জামান সাহেব নিচুঁ হয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে যায় কবরের মাটির কাছে। হাত দিয়ে স্পর্শ করে তার বন্ধুর কবরের মাটি, এরপর তার মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কিছু অব্যক্ত কথা বলে উঠে _
“- যানিস সাদাদ আজ তোর মেয়ে মেঘ স্কলারশিপে পড়াশোনা করতে আমেরিকায় গিয়েছে। ডক্টরি নিয়ে মেডিক্যালে পড়াশোনা করছে ও। ভীষণ মেধাবী ছাএী। মেডিক্যাল কলেজের শত শত ছাএ ছাএীর মধ্যে, তোর মেয়ে সবার প্রথম হয়েছে। পড়াশোনায় খুব মনোযোগ ওর, বড়ো হয়ে তোর সপ্ন পূরণ করতে চাই ডক্টর হতে চাই। আচ্ছা কি অদ্ভুত তাই না, তোর সেই চৌদ্দ বছরের বাচ্চা ছোট মেঘ আজ কতো বড়ো হয়ে গেছে। ওর বর্তমান বয়স বাইশ বছর। কতো তাড়াতাড়ি দিন, আর বছর অতিক্রম হয়ে যায় তাই না।
জামান সাহেব আর বলে উঠে ___ ___
“- মেঘের বয়স যখন চৌদ্দ বছর, তখন ওর সাথে দেখা হয় আমার ওর চাচীর বাসায়। আমায় দেখে তার চাচীে পিছনে লুকিয়ে পড়েছিল, প্রথম দেখেছিল তাই চিনতে পারে নি। আমি যখন ওর ভীতু আর ভয়ার্ত চেহা রা দেখেছি, ভীষণ মায়া কাজ করছে ওর প্রতি। যার জন্য ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি, তবে আদ্রিয়ানের সাথে ওর বিয়ে আমি কখন দিতে চাই না। কিন্তু তখন পুলিশ আর ওর চাচীর নোংরা ষড়যন্ত্রের কারণে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে এই ভুলটা করে মেঘের জীবন আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। আদ্রিয়ানকে মেঘ কখনো দেখি নি, তবুও ওর প্রতি মেঘের মনে ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। আদ্রিয়ানের ডিভোর্স দেওয়ার কথা শুনে, মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমি ওকে কষ্ট দিতে চাই না, তবে বাবা হিসাবে অপারক ছিলাম আমি ___.
তবে তুই চিন্তা করিস না। আমার ভুল সংশোধন করে নিব আমি। মেঘের পড়াশোনা শেষ করে, ওর সাথে অন্য কারো বিয়ে দিব। দেখবি খুব সুখী হবে তোর মেঘ। তবে একটাই আফসোস থেকে গেলো, মেঘকে আমি তালুকদার বাড়ির পূএবধূ রূপে দেখতে পারলাম না। এই তালুকদার বাড়ির বড় গিন্নি হিসাবে মেঘের সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারলাম না রে। মেঘকে যদি আদ্রিয়ান ভবিষ্যতে বউ হিসাবে মেনে নিত, কতো ভালো হতো তাই না? আচ্ছা তুই বল আমেরিকায় গিয়ে কি মেঘের সাথে আদ্রিয়ানের দেখা হবে। আমার পাষাণ ছেলেটা কি, নিষ্পাপ মেঘের প্রেম পড়বে? মেঘ কি সত্যি কখন তালুকদার বাড়ির বড় বউ হবে?
কারানের সাথে গাড়ি করে আমেরিকার রিসোর্টে গিয়ে পৌঁছায় মেঘ। যেখানে আবিহা আর কারানের বিয়ে হবে। মেঘ আর কারান গাড়িতে বসে অনেক কথা বলছে, সত্যি কারান মানুষটা ভীষণ হাসি – খুশি আর ভদ্র। রিসাের্টের সামনে গাড়ি এসে থামে, মেঘ গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। সামনে থাকা বাড়ির উপর তার চোখ, সাজসজ্জা আর ডিজাইন দেখে মনে হচ্ছে এইটা বাড়ি নয় বরং রিসোর্ট। মেঘ কারানকে প্রশ্ন করে ___
“- কারান ভাইয়া এইটা বাড়ি নয় বরং রিসোর্টি মনে হচ্ছে? আমরা রিসাের্টে কেনো আসলাম?
“- আবিহা আর আমার বিয়ের একসাথে এই রিসাের্টে হবে। যার জন্য সম্পূর্ণ রিসাের্ট বুক করা হয়েছে __.
“- ওহ ওকে __.
মেঘ আর কারান আর কথা বাড়ায় না৷ তারা রিসাের্টের ভিতরে চলে যায়। বাহির থেকে রিসোর্ট টা যতটা সুন্দর মনে হচ্ছে, ভিতর থেকে তা আরো বেশি সুন্দর। আমেরিকার রিসোর্ট বলে কথা, সাজসজ্জা আর ডিজাইন অবশ্যই উন্নত হবে। মেঘ বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে, দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে। আবিহা সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসে, সে ছুটে এসে মেঘকে জড়িয়ে ধরে। মেঘ ও এতোদিন পর তার বন্ধুকে দেখে আবেগ প্রবণ হয়ে যায়, তাই আবিহাকে জড়িয়ে ধরে। আবিহা বলে ___ __
“- মেঘ তুই যানিস তোকে আমি কত মিস করেছি? আমেরিকা চলে আসার পর তোর কথা সবসময় মনে পড়ত, আই মিস ইউ মাই বেস্ট টু ___.
মেঘ ও আবিহাকে জড়িয়ে ধরে বলে __
“- আই মিস ইউ টু আবিহা৷ তুই চলে আসার পর ফ্লাটে আমার একা একা লাগত, কারো সাথে কথা বলার সুযোগ ছিল না। তবে এখন কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি আমি যাব না, তোর বিয়ের সব অনুষ্ঠানে ইনজয় করব। আমার বেস্ট টুর বিয়ে বলে কথা ___.
“- তুই যেতে চাইলে ও তোকে যেতে দিব না। যতদিন না পড়াশোনা শেষ হবে, ততদিন তুই আমার সাথে থাকবি। এরপর তোকে ও আমেরিকা কোনো রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দিয়ে, এখানেই আমার কাছে রেখে দিব __.
বিয়ের কথা শুনে মেঘের মুখে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। সৃতির পাতায় আদ্রিয়ান নামক নামটা আবার ধরা দেয়। বিয়ে শব্দটা কি সত্যি মেঘের জীবনে আছে? সংসার, স্বামী সুখ এইসব সকল নারীর ভাগ্য থাকে। আর মেঘের ভাগ্য তো অবশ্যই নাই। মেঘকে এমন অন্যমনস্ক হতে দেখে, আবিহা বলে __
“- আচ্ছা এখন চল তোর রুমে যায়। অনেক সময় বিমানে জার্নি করার কারণে তুই হয়ত টার্য়াড ফিল করছিস.
আবিহার কথায় মেঘ সম্মতি জানায়, সত্যি তার এখন বিশ্রাম দরকার। আমেরিকায় আসবে বলে, কাল সারারাত ঘুম হয় নি তার। আর সকাল থেকে ব্যাগপএ গুছিয়ে রাখা সহ, ফ্লাটে করে এতোখন আসার কারণে সারাদিনে একবার ও ঘুমাতে পারে নি। মেঘে আর আবিহা সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায়, আর কারান মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বউ বন্ধুকে পেয়ে তাকে ভুলে গেছে, বেচারা কারান কি আর করবে। কিছুসময় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর, সে ও তার রুমে চলে যায়।
অন্যদিকে আমেরিকার এমসিসি হাসপাতালে ওট্রির মধ্যে অপারেশন করে যাচ্ছে আদ্রিয়ান। বিকালে তার মেঘকে রিসিভ করার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে হাসপাতাল থেকে কল আসে ইমারজেন্সি সেখানে যেতে অপারেশন করতে হবে। খুব জরুরি প্রয়োজন এখন তার হাসপাতালে। আদ্রিয়ান আর কি করবে, বাধ্য হয়ে হাসপাতালে চলে আসে। তবে আসার সময় কারানে বলে, মেঘকে রিসিভ করে বাড়ি নিয়ে যেতে। তার জরুরি অপারেশন রয়েছে, যার জন্য সে যেতে পারবে না। প্রায় পাঁচ মিনিট পর অপারেশন শেষ করে, ও্রটি থেকে বের হয়ে আসে আদ্রিয়ান। এরপর কিছুসময় বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্য, তার কেবিনে চলে যায়।
কেবিনের দরজা খুলে ভিতর প্রবেশ করে আদ্রিয়ান। তার সাথে কিছু জুনিয়র ডক্টর ছিল, তাদের সকলে কেবিনে গিয়ে বিশ্রাম নিতে বলে আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ান তার গায়ে পরহিত এর্ফরন, আর হাতে থাকা সেফটি গ্লাপস খুলে ফেলে। আদ্রিয়ান যখন তার গায়ের টিশার্ট খুলতে যাবে, তখনই পিছন থেকে তাকে কেউ একজন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ করে এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরায়, আদ্রিয়ান কিছুটা থমকে যায়। পিছনে থাকা নারীর হাত ধরে, এক ঝটকায় তার থেকে দূরে সরিয়ে দেয় আদ্রিয়ান। আদ্রিয়ান পিছনে ঘুরে দেখে, তার সামনে জিয়া দাঁড়িয়ে আছে। জিয়াই যে তাকে এতোখন জড়িয়ে ধরে রেখে ছিল, তা সে বুঝতে পারে। সাথে সাথে তার মাথা গরম হয়ে যায়, রাগান্বিত কণ্ঠে বলে উঠে __
“- হোয়াট ননসেন্স জিয়া? তোমাকে কতবার বলেছি আমার থেকে দূরে থাকবে তুমি, এমন হুটহাট করে জড়িয়ে ধরা আমার পছন্দ নয়। এক কথা কি দশবার বললে ও শুনতে পাও না?
আদ্রিয়ান কথাটা ধমকের সুরে বলে উঠে। জিয়া কিছুটা ভয় পেয়ে যায় আদ্রিয়ানের রাগান্বিত কণ্ঠ শুনে, সে ভার্য়াত কণ্ঠে বলে উঠে __ __
“- আদ্রিয়ান কাম অন তুমি এতো রাগ করছ কেনো? আমরা তো একে অপরের বন্ধু তাই না? বন্ধুকে জড়িয়ে ধর্ অপরাধের কিছু নয়? আমেরিয়ায় এইটা নরমাল বিষয়?
আদ্রিয়ানের রাগটা দিগুণ বেড়ে যায় জিয়ার কথা শুনে। আদ্রিয়ান বলে __
“- আমেরিকায় বিষয়টা নরমাল হলে, আমার কাছে নরমাল নয়। আমরা বন্ধু কিন্তু বন্ধু হলেই, যে সবসময় জড়িয়ে ধরতে হবে এইটা কোথায় লিখা আছে? আর আমি মাএ অপারেশন শেষ করে এসেছি, এখন আমার শরীরে কত জীবাণু – ব্যাকটেরিয়া রয়েছে। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরার কারণে যদি, তোমার ইনফেকশন হয় তখন কি হবে?
আদ্রিয়ানের কথা শুনে জিয়া বেহায়ার মতো বলে উঠে __
“- তোমার কি আমাকে নিয়ে টেনশন হচ্ছে আদ্রিয়ান?
“- যাস্ট শ্যাট আপ জিয়া। ডক্টর হয় আমি, সকলের শরীল স্বাস্থ্যর বিষয়ে খেয়াল রাখতে হয় আমার। আজ তুমি ছাড়া যদি অন্য কোনো মানুষ, আমার কাছে আসত তাকে ও এই কথাই বলতাম __.
আদ্রিয়ানের এমন স্পষ্ট জবাব শুনে জিয়া মুখ চুপসে যায়। জিয়া কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে বলে __
“- আদ্রিয়ান তুমি রাগ করছ কেনো? আচ্ছা এইসব বাদ দাও, চলো নিচে কেন্টিনে যায়। ভীষণ খুদা লাগছে আমার। একসাথে খাবার খেয়ে আসি ___.
জিয়ার কথার উত্তর আদ্রিয়ান ছোট করে জবাব দেয় __
“- আমার খুদা লাগছে না জিয়া,আর এখন বিকাল, বিকালে কিছু অভ্যাস আমার নাই। তোমার খুদা লাগলে, একা গিয়ে খেয়ে আসো __.
জিয়াকে আর কথা বলার সুযোগ দেয় না আদ্রিয়ান। টেবিলের উপর থেকে এফর্রন নিয়ে, বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে যায়। জিয়া রাগে দাঁত কটমট করে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে।
বিকাল পাঁচটায় রিসোর্টের বরাদ্দকৃত এক রুমে বসে আছে মেঘ। সারাদিন জার্নি করার পর তার শরীর ভীষণ ছিল, যার সে এতোখন ঘুমিয়ে ছিল। তবে খুব বেশি ঘুম হয়নি, এই এক থেকে দেড় ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। মেঘ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ওয়াশরুম থেকে সামান্য ফ্রেশ হয়ে বাহিরে বের হয়ে আসে। আবিহার শশুড় বাড়ির কারো সাথে তার পরিচয় বা দেখা হয়নি, তারা যেহেতু একই রিসেন্ট থাকবে তাহলে দেখা অবশ্যই হবে। মেঘ রুমে বসে বোর হচ্ছিল যার জন্য সে, রুম থেকে বের হয়ে বাহিরে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ড্রয়িং রুমের কাছে যায়, সেখানে আবিহার শাশুড়ী [ আদ্রিয়ানের মামী ] ফারহানা বেগম বসে আছেন। তার সাথে রয়েছে, তার কয়েকজন আত্মাীয়। যাদের দেখে মনে হলো, তারা আমেরিকান।
ফারহানা বেগম সিঁড়ি দিয়ে মেঘকে, নিচে নামতে দেখে। ওনি কথা বলা বন্ধ থামিয়ে দেন, এরপর হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকে। মেঘ এগিয়ে যায়, তার কাছে ফারহানা বেগম বলে __
“- তুমি মেঘ তাই না? আবিহার বন্ধু, বাংলাদেশ থেকে এখানে পড়াশোনা করতে এসেছ?
ফারহানা বেগম কথা শুনে, মেঘ প্রথমে তাকে সালাম দেয়। এরপর বিনয়ের সাথে বলে __
“- জী আন্টি আমিই মেঘ। আবিহার বন্ধু __.
ফারহানা বেগম সালামের উত্তর নেয়, ফারহানা বেগম তার মুখে মিষ্টি হাসি বজায় রেখে বলে __
আবিহা তোমার কথা বলেছিল কাল। তুমি বাংলাদেশে থেকে এসেছ, তার মানে তুমি আমার দেশের লোক৷ তুমি অতিথি হও এই বাড়ির। আর তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেনো, ছোফায় বসো __.
মেঘ অন্য সব আত্মীয়দের সাথে ছোফায় বসে। ফারহানা বেগম সকলের সাথে, মেঘের পরিচয় করিয়ে দেয়। মেঘ সত্যি ফারহানা বেগমের ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়, কতো সুন্দর করে মিষ্টি করে কথা বলেন ওনি। আর ভীষণ হাসি – খুশি মেজাজের মানুষ, কারান মনে হয় এই স্বাভাব তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। যেকোন কথা বলার সময়, মুখে ভুবন ভুলানো হাসি বজায় রাখা। মেঘ কিছু সময় সকলের সাথে আড্ডা দেয়। সকলের সাথে কথা বলার মধ্যে, ফারহানা বেগমের মনে পড়ে ওনি ফ্রিজে কেক আর মিষ্টি জাতীয় কিছু খাবার রেখেছিলেন। আত্মীয় সহ বন্ধুদের খাওয়ানের জন্য, আশেপাশে কোনো কাজের লোক নাই যাকে বলবে ফ্রিজ থেকে কেক নিয়ে আসতে। ফারহানা বেগমের মেঘের কথা মনে পড়ে, ফারহানা বেগম বলে __
“- মেঘ তুমি যদি কিছু মনে না করো, তবে রান্না ঘরে ফ্রিজে কিছু কেক আর মিষ্টি রয়েছে। তা নিয়ে আসবে __.
“- আন্টি এখানে মনে করার কি আছে, আমি এখুনি নিয়ে আসছি।
মেঘ ছোফায় থেকে উঠে রান্না ঘরে ফ্রিজের কাছে যায়। অন্যদিকে আদ্রিয়ান তখনই বাড়িতে ফিরে আসে। ড্রয়িং রুমে ফারহানা বেগম আর আত্মীয়দের দেখে, দাঁড়িয়ে যায়। ফারহানা বেগম আদ্রিয়ানকে দেখে বলে __
“- আদ্রিয়ান তুমি কোথায় গিয়েছিলে? কারান বলল তুমি না কি হাসপাতালে অপারেশন করতে গিয়েছ? তোমাকে না বলেছি, যতদিন বিয়ে শেষ হবে ততদিন ছুটি নিতে?
ফারহানা বেগমের কথা শুনে আদ্রিয়ান বলে উঠে ___
“- সরি মামি, কিন্তু অপারেশনটা খুব জরুরি ছিল। বাট এখন আর এই ভুল হবে না, কারানের বিয়ের শেষ না হওয়া অবধি আমি আর কোথাও যাব না __.
“- হুম মনে থাকে যেনো। আচ্ছা এখন রুমে যাও, সারাদিন হাসপাতালে থেকে শরীর ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই। আমি কাজের লোক দিয়ে, তোমার রুমে খাবার পাঠিয়ে দিব।
“- না মামী এখন আর কিছু খাব না। ভীষণ ঘুম পেয়েছে ঘুমাতে আমি __.
“- আচ্ছা ঠিক আছে। রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। কিন্তু ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে, বসে যেও না আবার।
“- হুম অবশ্যই। বাই __.
আদ্রিয়ান কথাটা বলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যায়। ড্রয়িং রুম থেকে রান্নাঘরের দুরত্ব বেশ অনেকটা, তাই মেঘ আর আদ্রিয়ানের কথা শুনতে পায় না। ফ্রিজের থেকে কেক আর মিষ্টি বের করে নিয়ে আসে মেঘ৷ এরপর সকলের মিলে একসাথে আড্ডা দেয়, বিদেশে মানুষদের সাথে কথা বলতে মেঘ বোর ফিল করে না। বরং সে নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে, তার ভালোই লাগে।
রাত প্রায় নয়টা আবিহা তার রুমে বসে, বিয়ের সমস্ত জিনিসপএ আলমারিতে গুছিয়ে রাখছে। কালকে তার আর কারানের মেহেদী অনুষ্ঠান। আবিহার কাজ করার মধ্যে, হঠাৎ করে তার কাজিনের দল রুমের ভিতর প্রবেশ করে। আবিহা সকলকে একসাথে তার রুমে আসতে দেখে, অবাক হয়ে বলে __ __
“- কি ব্যাপার? তোরা সকলে একসাথে হঠাৎ আমার রুমে কেনো এসেছিস?
কাজিনরা সকলের বায়না সুরে বলে উঠে __
“- আপু কাল কি তোমার আর কারান ভাইয়ের এনগেজমেন্ট হবে না? শুধু কি মেহেদী অনুষ্ঠান হবে?
কাল কারান আর আবিহার মেহেদী অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফারহানা বেগম নিষেধ করে দেন, কারণ কারানের বাবা নির্ঝর সাহেব ব্যবসার কাজে কয়েকদিনের মধ্যেই বিদেশে চলো যাবেন। কাজটা খুব জরুরি। তাই বিয়ে অনুষ্ঠান সব তাড়াতাড়ি শেষ করতে চান ওনি। আর আবিহাকে যখন তারা পাএী দেখতে গিয়েছিল, তখন ফারহানা বেগম আবিহার আঙ্গুলে আংটি পড়িয়ে দেন। তাই এখন আর নতুন করে এনগেজমেন্ট করার, প্রয়োজন নাই।
আবিহা বলে _
“- না কাল এনগেজমেন্ট হবে না। শুধু মেহেদী অনুষ্ঠান হবে না। তাছাড়া মা আমাকে পাএী দেখার দিন, আংটি পড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন আবার এনগেজমেন্ট করার কি দরকার?
কাজিনরা সকলে জবাব দেয় _
“- কিন্তু আপু সেটা তো ফারহানা আন্টি, আংটি পড়িয়ে দিয়েছে তোমাকে? কারান ভাইয়া তো দেয় নি? আমরা চাই কারান ভাই, তোমাকে প্রপোজ করুক। তোমার হাতে ভালোবেসে আংটি পড়াক __.
“- না এখন এইটা সম্ভব নয়। মা যখন নিষেধ করেছে, এখন আর এইটা সম্ভব নয়?
আবিহার কোনো কথা তার কাজিনরা শুনে না, তারা তাকে জোর করতে থাকে। যেনো কারান আর তার এনগেজমেন্ট হয়, কারান যেনো তাকে আংটি পড়িয়ে দিয়ে ভালো বাসার কথা বলে। প্রায় এক ঘণ্টা পর আবিহা রাজি হয়, কাজিনরা সকলে মিলে একটা পরিকল্পনা করে। আবিহা প্রথমে রাজি হয় না, পরে সকলে তাকে বাধ্য করে।
আবিহার কাছে সকলের পরিকল্পনা খারাপ মনে হয় না। পরিকল্পনা অনুসারে আবিহা কারানের ফোনে একটা মেসেজ দেয়। মেঘ তার রুমে বসে পড়াশোনা করছিল, কালকে থেকে যেহেতু আবিহার বিয়ে তাই সে পড়তে পারবে না। মেঘ যখন পড়াশোনা করছিল, তখন তার রুমের দরজায় নাড়ে কারান। মেঘ টেবিল থেকে উঠে, দরজার কাছে যায়। দরজার বাহিরে কারানকে দেখে মেঘ বলে __
কারান ভাই আপনি এখানে? কিছু বলবেন?
কারান বিচলিত কণ্ঠে বলে __
“- মেঘ তুমি আবিহাকে দেখছ? ও কোথায় যানো?
“- না আবিহাকে দেখি নি আমি। ও কোথায় মানে? আবিহা ওর রুমে নাই?
“- না আবিহাকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?
__ কিহ?
“- একটু আগে আবিহা আমায় মেসেজ দিয়েছিল, ও না কি আমার উপর রাগ করছে। তাই রিসোর্ট ছেড়ে চলে গেছে ,এখন যদি ওকে খুঁজে বের করে ওর রাগ না ভাঙায়। ও না কি বিয়ে করবে না আমায়?
কারানের কথা শুনে মেঘ অবাক হয়ে যায়। হঠাৎ করে আবিহার এমন করার কারণ বুঝতে পারে না সে। মেঘ বলে _
“- কারান ভাইয়া টেনশন করবেন না আপনি? আবিহা হয়ত কোনো বিষয়ে, আপনার সাথে রাগ করেছে। রিসাের্টের আশেপাশে কোথায় গিয়েছি হয়ত,আমি খুঁজে দেখছি.
কারানের কথা শুনে মেঘ আবিহাকে খুঁজতে বের হয় । কারান আদ্রিয়ানকে বলে, আবিহার রাগ করার বিষয়টা। কারান আর আদ্রিয়ান এখন একসাথে, আবিহাকে খুঁজছে। কিন্তু অনেক সময় ধরে খুঁজে না পাওয়া পর আদ্রিয়ান বলে _
“- কারান তুই বরং রিসাের্টের বাম পাশের দিকে খোঁজ, আর আমি ডান পাশে যায়।
“- ওকে __.
আদ্রিয়ান আর কারান আলাদা হয়ে আবিহাকে খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে মেঘ ও রিসোর্টের সব জায়গায় আবিহাকে খুঁজে যাচ্ছে, কিন্তু কোথাও পাই নি। তাই রিসোর্ট থেকে বের হয়ে বাহিরে খুঁজতে থাকে। প্রায় বিশ মিনিট পর আদ্রিয়ান একটা জায়গায় এসে পৌঁছায়, মেঘ ও ওই সেইম জায়গায় আসে। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না, তবে হঠাৎ আদ্রিয়ান দেখতে পায়। সামনে অন্ধকারে এক মেয়ের ছায়া দেখা যাচ্ছে, ও মনে করে এইটা আবিহা। মেঘ ও দেখে অপর পাশে এক ছেলেকে দেখা যাচ্ছে, মনে হয় এইটা কারান ভাই। আবিহাকে খুঁজতে এসেছে, মেঘ এইটা মনে করে এগিয়ে যায় তার কাছে।
মেঘ ও অন্ধকারে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, সামনে থাকা আদ্রিয়ান তার কাছে আসছে। মেঘ আর আদ্রিয়ান কিছু সময়ের মধ্যে একে অপরের সামনে চলে আসে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, একে অপরের মুখটা অবধি না। মেঘ সামনে থাকা মানুষটাকে কারান মনে করে, কিছু বলতে যাবে। তার আগেই সে অনুভব করে, তার পায়ের নিচে কিছু একটা রয়েছে। যেনো একটা সুইচের মতো, মেঘ কিছু বুঝতর আগেই হঠাৎ করে চারপাশ আলোয় ঝলমল করে উঠে।
তোমার নামে নীলচে তারা পর্ব ৪
মেঘের চারপাশে ঝলমল করছে, লাল, নীল বাতি আর আলোক সজ্জা যা দেখে সে অবাক হয়ে যায়। আদ্রিযান ও হঠাৎ করে এমন হওয়ার কারণে অবাক হয়ে যায়। মেঘ চারপাশে দেখে, সে কিছু বুঝে উঠার আগেই। অন্ধকারে আলোর ঝলমলে, তার সামনে থাকা মানুষটার উপর চোখ যায়। মেঘ সাথে সাথেই চমকে যায়, তার চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। মেঘ শুধু তার অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠে __
“- আ — আ — আদ্রিয়ান রেদোয়ান __.
