তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ১৭

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ১৭
নওরিন মুনতাহা হিয়া

তালুকদার বাড়ির বিশাল গেইটের সামনে এসে দাঁড়ায় ইনায়া আর অরণ্যর গাড়ি। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে ইনায়া গেইটা পার হয়ে ভিতরে ঢুকে যায়। ইনায়ার নানা প্রায় দশ বছর আগে মারা গেছে আর ওর নানি মৃত্যুর প্রায় অনেক দিন হয়ে গেছে যার জন্য তার আত্মীয় বলতে বাড়িকে কেউ নাই। তবে বাড়িটা যথেষ্ট পরিস্কার সুন্দর করে সাজানো যেনো মনে হচ্ছে কেউ এখনো এই বাড়িতে থাকে।

ইনায়ন কৌতুহল নিয়ে বাড়ির সদর দরজায় নক করে ভিতর থেকে কোনো উত্তর না আসায় সে আবার জোরে শব্দ করে। দরজার কারো শব্দ শুনে ভিতর থেকে দুইজন বৃদ্ধ মহিলা বের হয়ে আসে তাদের পরনে সাদা শাড়ি ছিলো এবং চোখে জুড়া চমশার সাদা ফ্রেম দিয়ে ডাকা ছিলো। ইনায়ার কাছে তারা অপরিচিত কারণ ছোটবেলা কোনো ঘটনা এখন তার স্বরণে নাই। বৃদ্ধ মহিলারা অল্প সময় ইনায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মনে হয় ইনায়ার পরিচয় মনে করার চেষ্টা করছে। অবশেষে তারা ব্যর্থ হয় ইনায়ার চেহারা দেখে তার পরিচয় শনাক্ত করতে তাই বৃদ্ধ মহিলার মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করে –

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‌”- তোমার পরিচয় কি? এই তালুকদার বাড়িতে আসার কারণ কি তোমার? এই বাড়ির কারো সাথে কি তোমার পূর্ব পরিচয় আছে?
বৃদ্ধ মহিলার করা কথা শুনে ইনায়া আর অরণ্য একে অপরের দিকে তাকায়। ইনায়া তাদের কথার জবাবে বলে –
“- আমার নাম ইনায়া। তালুকদার বাড়ির কর্তা শফিক তালুকদারের বড় মেয়ে এনির একমাত্র মেয়ে আমি। অনেক দিন যাবত শহরের থাকার কারণে গ্রামে নানার বাড়িতে কখনো আসা হয় নাই। আজ প্রথম এসেছি “।
ইনায়ার মুখে তার নানা আর মায়ের নাম শুনে বৃদ্ধ মহিলারা একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এর মধ্যে একজন যত দ্রুত সম্ভব ছুটে যায় উপরে সিঁড়ি বেয়ে সে কোথায় যেনো চলে যায়। আর অন্যদিকে অন্য একজন বৃদ্ধ মহিলা তার চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলে এরপর চোখের পানি মুছে স্পষ্ট নয়নে ইনায়ার দিকে দেখে। ইনায়া অবাক করা নয়নে সব কিছু দেখে যাচ্ছে এখানে কি হচ্ছে তার বোধগম্য হচ্ছে না। ইনায়ার কোনো কথা জিজ্ঞেস করার আগে সামনে থাকা বৃদ্ধ মহিলা তার দিকে এগিয়ে আসে। বৃদ্ধ মহিলা ইনায়ার মাথায় হাত রাখে তার চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলে –

“- আজ প্রায় দশ বছর পর তালুকদার বাড়ির বংশধর ফিরে এসেছে। তোমার নানু মারা যাওয়ার আগে তোমার মায়ের কথা সবসময় বলতো অনেক কান্না করেছে নিজের মেয়েকে দেখার জন্য। কিন্তু ওনার সপ্ন পূরণ হয়ে যাওয়ার আগে ওনি মারা যান। আজ যদি তোমার নানু বেঁচে থাকতো তাহলে অনেক খুশি হতো “।
ইনায়া নিজের নানুর বিষয়ে আজ প্রথম শুনছে কারণ ছোটবেলা তার মা নিজের বাবার বাড়ির বিষয় কোনো ঘটনা তাকে বলে নাই। তবে ইনায়া অবাক হয় ওনাকে তার নানুর বিষয়ে কথা বলায় ওনি কি করে তার নানুর কথা যানেন। আর এই তালুকদার বাড়িতে বৃদ্ধ মহিলারা কোথা থেকে এসেছে। ইনায়া জিজ্ঞেস করে –
“- আচ্ছা আপনি কে? তালুকদার বাড়ির প্রতৈকে মারা গেছেন তাহলে আপনাদের কি পরিচয়?
ইনায়ার কথা শুনে তার সামনে থাকা বৃদ্ধ কোনো কথা বলতে যাবে তার আগে পিছন থেকে লাঠির আওয়াজ শুন যায়। ইনায়া সেইদিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে প্রায় একশো বৃদ্ধ মহিলা দাঁড়িয়ে আছে যার জন্য একজন যথেষ্ট শক্ত আর সুন্দরী। ইনায়া এতো বৃদ্ধ মহিলা দেখে অবাক হয় তারা সকলে ইনায়ার দিকে এগিয়ে আসে ইনায়ার আবার তার কথা জিজ্ঞেস করে –

“- আপনাদের পরিচয় কি? তালুকদার বাড়িতে আপনারা কেনো থাকেন?
“- আমরা সকলে অসহায় বৃদ্ধ। তোমার নানু মারা যাওয়ার আগে এই বাড়ি বৃদ্ধা আশ্রমের নামে দান করে দিয়ে গেছে। যার জন্য প্রায় একশোর ও বেশি মানুষ এই বাড়িতে থাকে যারা প্রতৈকে বৃদ্ধ “।
বৃদ্ধা আশ্রম কথাটা শুনে ইনায়া যথেষ্ট অবাক হয় সে খেয়াল করে সামনে থাকা দেয়ালে স্পষ্ট করে লেখা আছে বৃদ্ধা আশ্রম। এই জন্য কি বাড়ির ভিতরে ঢুকার সময় সবকিছু পরিস্কার আর পরিপাটি করে সাজানো লাগ ছিলো তার কাছে। ইনায় নিশ্চয়ই হয় যে তার নানু হয়তো তার পরিচয় তখন যানতেন না যার কারণে এই বৃদ্ধা মানুষদের থাকতে দিয়েছে। ইনায়া বিরক্ত হয় না বরং সে হাসি মুখে এগিয়ে যায় সকলের কাছে। ইনায়া সকল বয়স্ক মহিলার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে এরপর বলে –

“- আমার নানুর বিষয়ে আমার কখনো শুনি নাই। তবে ওনি মারা যাওয়ার আগে এই বাড়ি বৃদ্ধা আশ্রমের নামে দান করে গেছেন। যার মানে ওনি যথেষ্ট ভালো মানুষ ছিলেন আর নানুর সিদ্ধান্তে আমার কোনো অভিযোগ নাই।
অরণ্য এতোখন অনেক সময় ধরে সব কথা শুনে যাচ্ছে তবে ইনায়ার কথায় সে মুগ্ধ হয়। সত্যি বলতে ইনায়া মেয়েটা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি আর দয়ালু মানসিকতার মেয়ে। তালুকদার বাড়ির আয়তন দেখে মনে হচ্ছে যদি ইনায়া এই বাড়ি বিক্রি করে দিতো তাহলে অনেক টাকার মালিক হতে পারতো। কিন্তু ইনায়া তা না করে নিজের নানুর সিদ্ধান্তের সম্মান করেছে। ইনায়ার প্রতিটা আচরণে অরণ্য খুশি হয় আর ওর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়।

বৃদ্ধ আশ্রমে থাকা বৃদ্ধরা ইনায়ার কথা শুনে অবাক হয় কারণ তারা মনে কর ছিলো ইনায়া হয়তো তাদের এখানে থাকা পছন্দ করবে না। কিন্তু ইনায়া মুখে এমন কথা শুনে তারা খুশি হয় বৃদ্ধ মহিলা বলে –
“- এখন মনে হচ্ছে তুমি এই তালুকদার বাড়ির বংশধর। তোমার নানু মারা গেছেন তো কি হয়েছে আমরা সবাই তোমার নানু। এই বাড়িতে তুমি যতদিন থাকবে সব ধরনের আদর যত্ন করব আমরা “।
“- ধন্যবাদ আপনাদের। সত্যি বলতে আপনাদের দেখে আমার অনেক ভালো লাগছে “।
“- কিন্তু ইনায়া তোমার পাশে এই লোক কে?
“- ওনি অরণ্য আমার স্বামী।

বিবাহিত জীবনে প্রথম ইনায়া অরণ্যকে স্বামী হিসাবে সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। অরণ্য ইনায়ার দিকে তাকিয়ে দেখে ইনায়া হাসি মুখে কথাটা বলে। ইনায়ার বলা কথা শুনে অরণ্যর মন প্রশান্তিতে ভরে যায় তাহলে কি ইনায়া তাকে স্বামী হিসাবে মেনে নিয়েছে? ইনায়া অরণ্যকে ইশারা করে সবার সাথে ভালো করে কথা বলার জন্য অরণ্য মুখে মুচকি হাসি বজায় রেখে বিনয়ের সাথে বলে –

“- আসসালামু আলাইকুম আমি অরণ্য। ইনায়ার স্বামী আর এই তালুকদার বাড়ির নাতিন জামাই “।
অরণ্য মুখে নাতিন জামাই কথা শুনে সব বৃদ্ধ খুশি হয়ে যায় তার দিকে এগিয়ে আসে। অরণ্যকে রুমে নিয়ে যায় ইনায়ার নানু মারা যাওয়ার আগে যে রুমে থাকতো তাদের সেই রুমে থাকতে দেওয়া হয়। অরণ্য আর ইনায়া যথেষ্ট খুশি ইনায়া রুমে প্রবেশ করে ঘরের প্রতিটা জায়গায় ইনায়া দেখতে থাকে। ইনায়ার চোখ যায় সামনে থাকা দেয়ালে সেখানে তার মা আর নানুর ছবি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রায় পনেরো বছর পর নিজের মায়ের ছবি দেখছে ইনায়া তার চোখ পানি দিয়ে ভিজে যায়। আর তার নানুকে হয়তো সে জীবনের প্রথম দেখছে।
ইনায়ার দেখার মাঝে অরণ্য বলে –

“- ইনায়া ফ্রেশ হবেন না? অনেক সময় ধরে জার্নি করে এসেছেন যার ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসেন “।
অরণ্যর কথা শুনে ইনায়া ছবি থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় আর অরণ্য বিছানায় শুয়ে একটু রেস্ট নিতে থাকে। অন্যদিকে ইভান অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসে আজকে তার মন বড্ড বেশ খারাপ। বুকের ভিতরে কেমন যানি ছটফট করছে যেনো সে তার খুব আপন একজন মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে। ইভান নিজেকে শান্ত করতে পারছে না যার জন্য সে বাসায় ফিরে আসে।
বাসায় ফিরে এসে দেখে অরুণা বেগম রান্না ঘরে বসে কাটাকুটি করছেন ইভান তাকে দেখে কোনো কথা না বলে চলে যায়। কিন্তু সিঁড়ির কাছে গিয়ে তার পা থেমে যায় সে আবার ফিরে আসে তার মায়ের কাছে। অরুণা বেগম খেয়াল করে ইভান তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছে কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না। অরুণা বেগম বলে –

“- কি হয়েছে ইভান? তুমি কি কোন কথা বলতে চাও আমাকে?
“- ওহ আসলে ইনায়া কোথায় এখন? মানে ইনায়ার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা ছিলো যার জন্য জিজ্ঞেস করছি?
অরুণা বেগম অবাক হয় হঠাৎ করে ইভানের মুখে ইনায়ার নাম শুনে কিন্তু সে ভাবে হয়তো বিজনেসের কোনো কাজ আছে। ইভান যেহেতু নতুন করে অফিসে জয়েন করেছে তার হয়তো কোনো ফাইলের বিষয়ে ইনায়ার থেকে তথ্য যানতে হতে পারে। অরুণা বেগম বলে –

“- ইনায়া আর কোথায় থাকবে ওর শশুড় বাড়িতে। তবে বিয়ের পর ইনায়া আর অরণ্য কোথাও ঘুরতে যায় নাই যার জন্য তারা হানিমুনে গেছে। কোন দেশে ঘুরতে গেছে যানি না.
অরুণা বেগমের মুখে ইনায়ার হানিমুনে যাওয়ার কথা শুনে ইভান এক পা পিছিয়ে যায়। তাহলে কি ইনায়া অরণ্যকে নিজের স্বামী হিসাবে মেনে নিয়েছে তারা কি একসাথে সময় কাটানোর জন্য হানিমুনে গেছে। ইনায়া কি সত্যি অরণ্যকে ভালোবেসে ফেলেছে? ইভান আর কোনো জবাব দেয় না সে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে নিজের রুমে চলে যায়। ইভান রুমে প্রবেশ কর দরজা বন্ধ করে দেয় এরপর ফোন বেডে রেখে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
ওয়াশরুমের পানি গড়িয়ে পড়ছে ইভানের সমস্ত শরীরে পানি বেয়ে যাচ্ছে কিন্তু তার চোখের পানি ও হয়তো সেই পানির সাথে মিশ যাচ্ছে। ইভানের এখন নিজের উপর রাগ হচ্ছে সে তার নিজের ভুলের কারণে ইনায়াক৷ হারিয়ে ফেলেছে। তার বউকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে দিয়েছে? এর থেকে কি বড়েন পাপ হতে পারে? কিন্তু ইভান হঠাৎ করে ইনায়ার জন্য কষ্ট লাগছে কেনো সে কি তবে ইনায়াকে ভালোবেসে ফেলেছে?

অন্যদিকে ইনায়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসে ইনায়ার চুল গড়িয়ে পানি পড়ছে যদিও সে বিষয়ে তার কেনো খেয়াল নাই। ইনায়া জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা তার মনে পড়ে যায় তার চোখ শুধু তার মায়ের ছবির দিকে সীমাবদ্ধ থাকে। ইনায়া এগিয়ে আসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অরণ্য এতোখন ইনায়ার বিষয়ে খেয়াল করে। অরণ্য বেড থেকে উঠে আয়নার সামনে আসে এরপর ইনায়ার হাত থেকে টাওয়াল নিয়ে নেয়। অরণ্য টাওয়াল দিয়ে অরণ্যর মাথা মুছে দিতে থাকে।
ইনায়ার হুঁশ ফিরে আসে সে অরণ্যর দূরে সরে যেতে চাই তখন অরণ্য বলে –

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ১৬

“- ভিজা চুলে দাঁড়িয়ে থাকলে জ্বর এসে যাবে।
ইনায়া তাকিয়ে থাকে অরণ্যর দিকে অরণ্যর কেয়ার ভালোবাসা সব ইনায়ার ভালো লাগে এখন। অরণ্য মানুষটা সত্যি অনেক ভালো জীবনে আজ অবধি তার খেয়াল অন্য কেউ রাখে নাই। ইনায়া মনে মনে বলে –
“- অরণ্য ভাগ্য ক্রমে পাওয়া আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে অমূল্য উপহার। খুব যত্ন করে আগলে রাখতে চাই যাতে জীবন থেকে কখনো হারিয়ে না যান “।
নারীর শুধু যত্নে আর ভালোবাসায় আটকে। অতীতকে ভুলে যাওয়া যায় যদি তোমার জীবনে যোগ্য আর যত্নবান কোনো মানুষ আসে “।

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ১৮