তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ২২
নওরিন মুনতাহা হিয়া
ঘড়ির কাটায় রাত প্রায় দুইটা অরণ্য আর ইনায়া একটা বেডের দুই পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। তাদের একে অপরের দুরত্ব প্রায় অনেক। শেষ রাতের দিকে গ্রামে বৃষ্টি হয়েছে যার জন্য আশেপাশ থেকে শীতল বাতাস ভেসে আসছে। ইনায়ার শরীর উষ্ণ হওয়ার জন্য এমন কোনো গরম কিছু পরিধান করে নাই, যার জন্য তার শরীরে বেশ ঠান্ডা অনুভব করছে। গ্রামের শীতের পরিমাণ সবসময় অধিক থাকে, যার জন্য ইনায়ার শরীরে ধীরে ধীরে আরো বেশি ঠান্ডা হয়ে বরফ হয়ে যাচ্ছে।
সময় প্রায় রাত দুইটা যার জন্য অরণ্য ঘুমিয়ে আছে, পাশে থাকা ইনায়ার প্রতি তার বর্তমানে খেয়াল নাই। ইনায়া শরীরে উষ্ণতা অনুভব করার জন্য সে গুটিশুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। অরণ্য অন্য পাশে থেকে যখন ইনায়ার দিকে ফিরে তখন ইনায়ার কাছে যায় অরণ্যর। তীব্র শীতের কারণে ইনায়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অরণ্যকে, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কারণে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা অনুভব করে। ঘুমের মাঝে অরণ্যর শরীরে কোনো নারীর শীতল ছোঁয়া অনুভব করে তার ঘুম ভেঙে যায়, চোখ খুলে তার বাহুতে আবদ্ধ থাকা ইনায়ার দিকে তার চোখ যায়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঘুম ঘুম চোখে অরণ্য ইনায়ার দিকে তাকিয়ে দেখে, নিজের বুকে ইনায়াকে দেখে তার চোখে মুখে প্রশান্তি নেমে আসে। ঘুমন্ত অবস্থায় ইনায়াকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে, যদি ওর রূপের বর্ণনা করতে যায় অরণ্য তাহলে হয়তো এক উপন্যাস লেখা যাবে। অরণ্য ইনায়াকে নিজের বাহুর মধ্যে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়, ইনায়ার ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শরীরে উষ্ণতা দেয়। ইনায়া গরম কিছু অনুভব করে আবার শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে, অরণ্য মুখে হাসি বজায় রেখে আবার ইনায়াকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল প্রায় সাতটা জানালার কাঁচ ভেদ করে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে রুমে, গ্রামে সূর্যের তাপ সবসময় অত্যাধিক প্রখর হয়। সূর্যের এক ঝিলিক এসে পড়ে ইনায়ার চোখে তার চোখ খুলে যায়, ইনায়া পিটপিট করে চোখ খুলে এরপর ঘুমের রেশ কাটিয়ে যখন বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে। তখন সে অনুভব করে তাকে কেউ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, ইনায়া ভালো করে খেয়াল করে দেখে সে অরণ্যর বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। অরণ্য তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে যেনো ছেড়ে দিলে সে পালিয়ে যাবে। কাল রাতে ইনায়া আর অরণ্য যথেষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে ঘুমিয়ে ছিলো তাহলে সকালে কি করে একে অপরের এতো কাছে?
ইনায়ার মনে পড়ে মাঝ রাতে তার শরীরে বেশ ঠান্ডা অনুভব কর ছিলো যার জন্য সে শক্ত একটা বালিশ জড়িয়ে ধরে। কোথাও বালিশ মনে করে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে নাই তো সে? ইনায়া নিজের করা কাজে নিজেই ফেঁসে গেছে। ইনায়ার এখন লজ্জায় মাটিতে লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে, তবে অরণ্য যেহেতু ঘুমিয়ে আছে তার মানে কালকে রাতের ঘটনা সে কিছুই যানে না। ইনায়া তাড়াতাড়ি করে অরণ্যর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়, এরপর বিছানা থেকে ধীরে ধীরে নেমে যায় এক দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
প্রায় পনেরো মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হয় ইনায়া, রুমে এসে দেখে অরণ্য এখনো ঘুমিয়ে আছে। ইনায়া অরণ্যকে ডাক বা বিরক্ত না করে আয়নার সামনে চলে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হ্রেয়ারড্রয়ার দিয়ে চুল শুকাতে থাকে, ইনায়ার ভিজা চুলের পানি এসে পড়ে অরণ্যর মুখে। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে চোখে পানি এসে পড়ার কারণে তার ঘুম ভেঙে যায়, বিরক্তি নিয়ে ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে যা দেখে তা দেখে সে অবাক।
সদ্য গোসল শেষ করে আসা ইনায়ার চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, তার পরনে লাল শাড়ি হাতে থাকা লাল রঙের চুড়ি আর চুল বেড়ে সারা শরীরে পানি পড়া। সব মিলিয়ে ইনায়াকে অনেক সুন্দর লাগছে, অরণ্যর বিরক্ত হয়ে যাওয়া মুগ সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধতায় ভরে যায়। অরণ্য নিজের হাত মাথার পিছু রাখে এরপর এক দৃষ্টিতে ইনায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইনায়াকে এই অবস্থায় ঠিক কতটা মোহনীয় লাগছে তা হয়তো সে নিজে ও যানে না, অন্যদিকে অরণ্যর মনে নিষিদ্ধ বাসনা জেগে উঠে তার নিজের মনকে শান্ত রাখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
অরণ্য ইনায়ার দিকে দেখে হালকা শুকনো ঢুক গিলে, তার এখন নিজের মনের চাওয়ার কথা ভেবে ইচ্ছা করছে ইনায়াকে ছুঁয়ে দিতে। তাকে গভীর থেকে গভীর ভাবে ভালোবাসতে কিন্তু সে তা পারবে না, ইনায়ার অনিচ্ছায় সে তাকে ছুয়েঁ দিতে পারবে না। নিজের চাহিদার জন্য কাপুরুষের মতো বউয়ের উপর জোর খাটাতে পারবে না, অরণ্য এতো নিচুঁ মন-মানসিকতার কাজ করতে পারবে না। অরণ্য নিজের মন আর বিবেকের যুদ্ধে তার বিবেক জয় লাভ করে, সে ইনায়ার উপর থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নেয়।
অরণ্যর চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগেই ইনায়ার চোখ যায় বিছানায় শুয়ে থাকা অরণ্যর দিকে, কালকে রাতে ঘটনার জন্য অরণ্যর দিকে তাকিয়ে থাকতে ইনায়ার ভীষণ লজ্জা করছে। তবুও ইনায়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলে –
“- অরণ্য আপনি ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন? যান ফ্রেশ হয়ে আসুন? আমি আপনার জন্য কফি নিয়ে আসি নিচ থেকে?
ইনায়ার কণ্ঠে অরণ্যর হুঁশ ফিরে আসে এতোখন ইনায়ার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, তা ভেবে তার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। ইনায়া যখন তার সামনে আসে তখন অরণ্যর সবকিছু এলেমেলো হয়ে যায়, মনের মধ্যে থাকা সুপ্ত অনূভুতি বার বার তাকে ইনায়ার প্রতি আকৃষ্ট করে। পুরুষ মানুষের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক কতটা কঠিন তা হয়তো অরণ্য উপলব্ধি করতে পারে, তবে যতোই কষ্ট হোক না কেনো ইনায়া যতদিন না অরণ্যকে ভালোবাসবে ততদিন অরণ্য তার সীমা অতিক্রম করবে না। ইনায়া কথার উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে –
“- অরণ্য কথার উত্তর দেন না কেনো? কোন ভাবনার জগৎতে হারিয়ে গেলেন আপনি? যান ফ্রেশ হয়ে আসুন “।
ইনায়া আয়নার সামনে থেকে সরে অরণ্যর কাছে যায়, বিছানার কাছে ঝুঁকে অরণ্য কি ভাবছে তা বুঝার চেষ্টা করে। হঠাৎ করে অরণ্য তার হাত ধরে এক টান দিয়ে নিজের উপর ফেলে দেয়, ইনায়া এসে পড়ে অরণ্যর বুকে। ইনায়া অরণ্যর এমন কাজে হঠাৎ করে থতমত খেয়ে যায় সে উঠতে যাবে, এমন সময় অরণ্য তার হাত ধরে ফেলে। অরণ্য ইনায়ার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ নয়নে বলে –
“- এই সুন্দরী আমাকে পা*গল করার জন্য কি এমন মহোনীয় রূপ নিয়ে আমার আসবে আসো। এতো পাষাণ হওয়া কিন্তু ঠিক না, নিজের বরকে এমন অসহ্য জ্বালিয়ে কি শান্তি পাও?
ইনায়া অরণ্যর কথার মানে বুঝতে পারে না তবে অরণ্যর এতো কাছে এসেছে বলে তার কেমন যানি লজ্জা লাগছে, ইনায়ার গাল রক্ত জবার মতো লাল হয়ে গেছে। অরণ্যর এমন ঘোর লাগা দৃষ্টি সব মিলিয়ে ইনায়া লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। তবে ইনায়া সব লজ্জা আর ভালো লাগা দূরে সরিয়ে অরণ্যের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া চেষ্টা করতে থাকে, অরণ্য আরো শক্ত করে ইনায়াকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। ইনায়া শান্ত গলায় বলে –
“- অরণ্য কি করছেন আপনি? ছাড়ুন?
“- যে বুকে শুয়ে কাল সারারাত পার করে দিলেন। আজ সেখানে থেকে ছাড়া পাওয়ার এতো তাড়া কেনো আপনার?
অরণ্যর মুখে কাল রাতের কথা শুনে ইনায়া টনক নড়ে তার মানে অরণ্য রাতে জড়িয়ে ধরার কথা সব জানে, ইনায়াকে আরো অধিক লজ্জা ঘিরে ধরে। ইনায়া মৃদু স্বরে বলে –
‘- কালকে রাতের ঘটনার জন্য সরি। না মানে অতিরিক্ত শীতের কারণে বাধ্য হয়ে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছি। এই ভুল হবে না আর কখনো?
“- সরি বলার দরকার নাই। স্বামী হয় আপনার জড়িয়ে ধরার অধিকার রয়েছে আপনার। আর আমি চাই আপনি এই ভুল সারাজীবন করে যান, প্রতি রাতে আপনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চাই আমি “।
ইনায়ার আরো অল্প সময় অরণ্যর বুকে অবস্থান করে এরপর তার কি যেনো মনে পড়ে, যার কারণে ইনায়া অরণ্যকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। ইনায়া এমন কাণ্ডে অরণ্য বিরক্ত হয়ে বলে –
“- কি হয়েছে এমন করছেন কেনো?
“- অরণ্য ছাড়ুন আমাকে। আর আপনি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়? আমাদের রেডি হয়ে বের হতে হবে?
ইনায়ার মুখে বের হতে হবে শুনে অরণ্য বলে –
‘- এতো সকালে কোথায় যাবো আমরা?
“- আপনার শশুড় বাড়িতে?
শশুড় বাড়ি কথাটা শুনে অরণ্য ইনায়ার মুখে অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে বলে –
“- ছিঃ ছিঃ ইনায়া আপনি কেমন বউ বলুন? বিয়ের কয়েকদিন পর স্বামীর বিয়ে দিতে চান? চার বিয়ে করা জায়েজ আছে বলে কি আপনি আমার সাথে এমন জোর করবেন?
“- হুম করব। অরণ্য উঠুন না ফ্রেশ হন “।
‘- ইনায়া আপনার মনে কি একটু দয়া মায়া নাই এমন অসহায়, বেচারা মানুষকে চার বিয়ে করাতে চান? চার বউকে সয্য করার ক্ষমতা কি আমার আছে, শএু হলে এতো বড়ো ক্ষতি আমার করবেন না।
ইনায়া অরণ্যর কথায় বিরক্ত হয়ে বলে –
“- হুম শএু কখনো উপকার করে না। এখন যান রেডি হন “।
ইনায়া এই বলে অরণ্যর বুক থেকে উঠার চেষ্টা করে তখন অরণ্য আবার হাত ধরে বলে –
“- সত্যি করে বলুন কোথায় যাবো আমরা?
“- থানায় যেতে হবে। শাফায়াত মামার কেসের ডিটেইলস জানতে, ওনার মৃত্যুর আসল রহস্য জানার জন্য থানায় যেতে হবে “।
থানায় যাওয়ার কথা শুনে অরণ্য ইনায়ার হাত ছেড়ে দেয়, ইনায়া বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। এরপর অরণ্যকে ফ্রেশ হতে বলে সে চলে যায় নিচে।অন্যদিকে অরণ্যর মুখ গম্ভীর হয়ে যায় সে পাশে থাকা তার ফোন বের করে, একজন অপরিচিত লোককে কল করে অরণ্য বলে –
“- সানি রূপনগর থানায় শাফায়াত হত্যার আসল খুনের ফাইল সরিয়ে ফেল, আগুন জ্বালিয়ে দে সেটাই। যাতে ইনায়া আসল সত্যির বিষয়ে কখনো যানতে না পারে।
“- ওকে “.
তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ২১
অরণ্য কথাটা বলে ফোন রেখে দেয় দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দেয়। ভবিষ্যতে ইনায়া যখন যানতে পারবে আসল ঘটনার অপরাধী কে, তখন কি হবে, অরণ্য কি সয্য করতে পারবে ইনায়ার চোখে তার জন্য ঘৃণা? যদি নিজের অতীত আর পাপ লুকিয়ে রাখতে ইনায়াকে তার খুন করতে হয়, সে কি পারবে নিজ হাতে ইনায়াকে খুন করতে? কিন্তু পরিস্থিতি যা হচ্ছে একদিন সত্যি ইনায়ার মৃত্যু অরণ্যর হাতে লেখা আছে?