তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৮
নওরিন মুনতাহা হিয়া
রাত প্রায় দশটা। চারদিকে রাতে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে। হাসপাতালে এক করিডোরে একজন মানুষের আত্মানাথ শুনা যাচ্ছে। একজন মা তার ছেলে হারানোর বেদনায় কান্না করছে, পৃথিবীর সকল মায়া, ভালোবাসা আবেগ তার কাছে এখন তুচ্ছ মরীচিকা। মৃত্যু কথাটা এই দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর আর সত্যি। পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার কতো প্রয়াস, সৌন্দর্য, রূপ আর অহংকারের মিথ্যা মায়ায় তারা বন্ধি। কিন্তু সকল মায়া, মোহ, সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে একদিন মানুষ মৃত্যুর মুখে পতিত হবে। বহমান জীবন আর
স্বার্থপর পৃথিবী ছেড়ে অজানা গন্তব্যর উদ্দেশ্য রওনা দিবে।
হাসপাতালে করিডোরে কান্না করা এক মায়ের নাম রেহানা বেগম। যার সন্তানের মৃত্যুর খবর ওনি শুনেছেন, সমস্ত হাসপাতাল জুড়ে এখন তার কান্নার আত্মনাথ শুনা যাচ্ছে। মায়ের ভালোবাসা কি অদ্ভুত তাই না! যে সন্তানের সাথে গত দশ বছর যাবত ওনি কথা বলেন নি, যার মুখ দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নাই। আজ তার মৃত্যুর সংবাদ শুনে ওনি পাগলের মতো কান্না করে যাচ্ছেন। মানুষ বেঁচে থাকলে তার প্রতি সকলের কতো অভিযোগ, নিরপরাধ হয়ে ও ঘৃণার পাএ হয়। কিন্তু মার যাওয়ার পর তার চরম শএু ও তার জন্য কান্না করে, সমাজের মানুষ তাকে ভালো লোক ছিলো বলে সমম্বধোন করে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ডক্টর অরণ্যর মৃত্যুর কথা বলে চলে যায়, রেহানা বেগম কান্না করছেন। অরুণা বেগম তাকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ডক্টরের কথা শুনে ইনায়া পাথরের ন্যায় শান্ত আর পাষাণ হৃদয়ের মানুষের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখ পানির বিন্দুর ফোঁটা দেখতে পাওয়া গেলো না। ডক্টরের বলা কথা ইনায়ার কানে পৌঁছায়, কিন্তু তবুও সে নিরব। ডক্টরের বলা কথাটা আবার নিজের মনে আওড়াতে থাকে, তার অরণ্য কি সত্যি মৃত? ইনায়ার মনের মধ্যে থাকা কথার কোনো উত্তর জানা নেই তার। কিন্তু তার হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে, প্রচুর ব্যাথা করছে। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি তার এখন নেই।
ডক্টরের কথা শুনে মিলন সাহবে মাথায় হাত দিয়ে সিটে বসে পড়ে, অন্যদিকে ইভান ইনায়ার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইনায়ার মনের অবস্থা ইভান বুঝতে পারে, ইনায়া তার পাশে থাকা দেয়ালে হাত রাখে। দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি তার শরীরে এখন নাই, শরীর ঠান্ডা হয়ে অবশ হয়ে যাচ্ছে। ইনায়া চোখের সামনে অন্ধকার দেখছে, অরণ্যর হাস্যকর মুগ্ধতায় ভরা চেহারা বার বার ভেসে উঠছে। ইনায়ার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়, সে পড়ে যাবে তার আগেই ইভান ছুটে আসে তার কাছে। ইভান তখন ইনায়াকে ধরতে যাবে, তার আগেই ইনায়া প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠে –
“- ছুঁয়েন না আমায় ইভান ভাই। আমার স্বামী জীবিত থাকুক বা মৃত, শুধু সে ছাড়া আমার শরীর টার্চ করার অনুমতি অন্য কোনো পুরুষকে আমি দিব না। দূরে সরে যান “।
ইনায়া তার কণ্ঠ দিয়ে অন্য কোনো শব্দ উচ্চারণ করার শক্তি হয় নাই, সে অজ্ঞান হয়ে যায়, তবে তার জ্ঞান থাকা অবধি অরণ্যর নাম শুধু তার কণ্ঠ ধ্বনিতে উচ্চারিণত হয়েছে। পাশে থাকা চেয়ারে ইনায়ার নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ল, আজ যদি অরণ্য থাকত তবে তাকে ধরত। ইনায়ার সব বিপদে তার স্বামী পাশে থেকেছে, ইনায়া মনে হয় আজ ও তার প্রতাশ্যা করছে। ইভান নিজের হাত গুটিয়ে নেয়, সামনে থাকা নারীকে আজ তার অন্য কারো স্ত্রী মনে হচ্ছে। অন্য পুরুষের সম্পত্তির উপর ইভান হক জমাতে চাই নাই, তাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা তার মন থেকে লোভ পেয়েছে। ইভান ইনায়ার নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে থাকল, এরপর দূরে থাকা নাতাশার নাম ধরে ডাক দেয়।
সকলের থেকে দূরে নাতাশা আর অরুণা বেগম রয়েছে, রেহানা বেগম কান্না করছে। মূলত অরুণা বেগম আর নাতাশা তাকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছে, ভাইয়ের ডাক শুনে নাতাশা কার কাছে আসে। ইভান বলে –
“- নাতাশা তুমি ইনায়াকে অন্য কোনো কেবিনে নিয়ে যাও। ইনায়া অজ্ঞান হয়ে গেছে “।
” লাশঘর ” দেয়ালে স্পষ্ট খোদায় করে লেখা রয়েছে কথাটা। লাশঘরের চারপাশে এক অদ্ভুত নিরবতা কাজ করছে। কি থমথমে পরিবেশ আর অদ্ভুত ভয়ংকর সব আওয়াজ তার কানে ভেসে আসছে। “ লাশঘরের“ সামনে একজন দারোয়ান বসে রয়েছে, তার হাতে একটা লাঠি। দারোয়ান কম তাকে দেখে কোনো ভয়ংকর পিশাচ মনে হচ্ছে। দারোয়ান সামনে থাকা দুইজন পুরুষ আর একজন নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করে। এরপর গম্ভীর স্বরে বলে –
“- কে আপনরা? কোনো মানুষ মারা গেছে আপনাদের? লাশ লাগবো?
দারোয়ানের গম্ভীর ভাষায় বলা কথা শুনে ইভান সামান্য ভয় পায়। জীবনে তার অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে, বহু দেশ, শহর, ভ্রমণ করেছে। কিন্তু আজ প্রথম লাশঘর নামে এক অদ্ভুত জায়গায় তাকে আসতে হয়েছে, তার পাশে রয়েছে মিলন সাহেব আর নাতাশা। হাসপাতালে এক ফাঁকা রুমে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইনায়া শুয়ে রয়েছে, তার শরীর দুবর্ল ডক্টর তাকে ভিটামিন জাতীয় ইনজেকশন দিয়েছে। আর রেহানা বেগম এখনো কান্না করে যাচ্ছেন, অরুণা বেগম তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। হাসপাতালে থাকা এক ওয়ার্বয় বলেছে, মৃত বক্তির লাশ মর্গে রাখা হয়। যার জন্য ইভান চৌধুরী আর মিলন সাহেব এখানে এসেছে, অরণ্যর পরিবারে কোনো পুরুষ সদস্য নাই। নাতাশা তাদের সাথে এসেছে, যদি কোনো খারাপ সংবাদ হয় তাহলে তার বাবাকে সামলাতে হবে।
ইনায়ার অজ্ঞান ফিরতে এখনো সময় রয়েছে, ডক্টর যা ইনজেকশন দিয়েছে প্রায় দুই ঘণ্টার পর তার অজ্ঞান আসবে। দারোয়ানের কথার জবাব মিলন সাহেব দেয় –
“- প্রায় দুই ঘণ্টা আগে অরণ্য রাজ চৌধুরী নামে, একজন মানুষ এক্সিডেন্ট মারা গেছে। তার পরিবারের সদস্য আমরা, তার মৃতদেহ কোথায়?
দারোয়ান মিলন চৌধুরীর কথা শুনে বলেন –
“- এই জায়গায় হাজার হাজার মানুষের লাশ আসে প্রতিদিন, একটু আগে একটা মানুষ মারা গেছে তার দেহ এখানে নিয়ে এসেছে। যান দেখুন ওনি আমার আত্মীয় কি না?
ইভান আর মিলন সাহেব দারোয়ানের সাথে ভিতরে ঢুকে যায়, নাতাশা তাদের সাথে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু ইভান তাকে নিষেধ করে দেয়, নাতাশা বাচ্চা, ও ভয় পাবে। লাশঘরের ভিতরে ইভান শুকনো ঢুক গিলে, সারা রুম বরফ ন্যায় শীতল। শরীরের হাড্ডি মাংস জমে যাওয়ার উপক্রম। মগ্নের মধ্যে প্রায় শত খানিক লাশ রয়েছে, সবার শরীর সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো রয়েছে। মিলন সাহেব আর ইভান এগিয়ে যায়। দারোয়ান তাদের একটা লাশের কাছে নিয়ে যায়, যার সমস্ত শরীর সাদা কাফনের কাপড় দিয়ে আবৃত। সদ্য মারা যাওয়ার কারণে রক্তের লাল বিন্দু বিন্দু সাদা কাপড়ে উপর রয়েছে। মৃতদেহের কাছে গিয়ে ইভানের শরীর ভয় বা কষ্টে ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়।
মিলন চৌধুরী খুব শান্ত, কিন্তু সেটা শুধু তার বাহিরে। মৃতদেহর দিকে এক দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখেন ওনি। আজ থেকে প্রায় সতেরো বছর আগে, ঠিক এমন এক এক্সিডেন্ট তার ছোট ভাই মারা গেছে। অরণ্যর বাবা নিলয় চৌধুরী আর রেহানা বেগমের যখন বিয়ে হয়, তখন মিলন চৌধুরী তা মেনে নেন নাই। কারণ রেহানা বেগম গরীব ঘরের সন্তান ছিলেন, আর নীলয় মিলন সাহেব না জানিয়ে বিয়ে করে ছিলেন। যার জন্য রাগে অভিমানে নীলয় চৌধুরী আর রেহানা বেগমকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। কিন্তু মিলন সাহেব তার ভাইকে অনেক ভালোবাসত। শুধু তার অভিমান আর বংশের মর্যাদার রক্ষার জন্য ওনি এমন করেছেন।
চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর নিলয় চৌধুরী আর রেহানা বেগম বস্তির এক বাসায় ঠাঁই নেয়। যা মিলন সাহেব তার গোপন সূএের মাধ্যমে যানতে পারে। নীলয় সাহেব তখন বেকার ছিলেন কোনো চাকরি না করার কারণে তার সংসার অভাব দেখা দেয়। মিলন সাহেব গোপনে তার বন্ধুর এক কোম্পানিতে চাকরি করার সুযোগ করে দেয়। যদিও নীলয় সাহেব বা রেহানা বেগম এর বিষয়ে কিছুই যানত না। তাদের সংসার সুখে শান্তিতে চলতে থাকে। কয়েক বছর পর তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় অরণ্য আর সায়মা।
অরণ্যর যখন দশ বছর বয়স তখন নীলয় সাহেব এক্সিডেন্ট মারা যান। মিলন চৌধুরী ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে বস্তিতে ছুটে আসে। কিন্তু তখন অরণ্য আর রেহানা বেগম মিলন সাহেবকে তার বাবার হত্যাকারী মনে করত। সম্পত্তির লোভে মিলন সাহেব তার আপন ভাইকে হত্যা করেছে এই কথা তাদের মনের মধ্যে গেঁথে যায়। এরপর মিলন সাহেব তাদের সামনে আসে নাই, তার ভাইয়ের মৃত্যুর জানাযা ওনি পড়েছেন কিন্তু সেটা অরণ্যর চোখের অগোচরে। সকলে যখন নীলয় সাহেবের কবর দিয়ে চলে যান। তখন মিলন সাহেব তার ভাইয়ের কববের কাছে যায়। মৃত ভাইয়ের কবরের মাটি আঁকড়ে ধরে কান্না করে।
স্বামীর মৃত্যুর পর আবার রেহানা বেগমের সংসারে অভাব ঘনিয়ে আসে। অরণ্য বয়স তখন মাএ দশ বছর আর সায়মার ছয় বছর। যুবতী বিধবা রেহানা বেগম শিক্ষিত ছিলেন যার জন্য ওনি চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। মিলন সাহেব তখন রেহানা বেগমকে একটা স্কুলে চাকরি দেয়। তাদের বিভিন্ন ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে যার বিষয়ে তারা কিছু যানত না। অরণ্য যখন ভার্সিটতে পড়ে তখন সে নতুন বিজনেস শুরু করার চেষ্টা করে। মিলন চৌধুরী সবসময় অরণ্যর প্রতিটা কার্যকলাপে নজর রাখে। অরণ্যর ব্যবসায় তাকে সাহায্য করে।
অতীতের কথা মনে হতেই মিলন চৌধুরীর চোখে জল চলে আসে। ওনি লাশের উপর থেকে কাঁপা কাঁপা হাতে সাদা কাপড় সরান। এরপর যা দেখে তাতে ওনি অবাক হয়ে যান।
নাতাশা অনেক সময় ধরে তার বাবা আর ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তারা বাহির হচ্ছে না তার মনে ভয় করছে। প্রায় পাঁচমিনিট পর মিলন সাহেব আর ইভান বেরিয়ে আসে। দরজার কাছে আসতেই নাতাশা উৎসুক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে –
“- আব্বু কি দেখলে তোমরা? যে লোক মারা গেছে ওনি অরণ্য ভাইয়া? না কি অন্য কেউ?
নাতাশার কথা শুনে মিলন সাহেব ওর মাথায় হাত রেখে বলে –
তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৩৭
“- ওই মৃতদেহ অরণ্যর না “।
মিলন সাহেবের কথা শুনে নাতাশা দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। এরপর দৌড়ে যায় রেহানা বেগম আর অরুণা বেগমকে এই খবর দিতে।