তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৪১

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৪১
নওরিন মুনতাহা হিয়া

রাত প্রায় সাতটা গাড়ি করে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে ইনায়া। মনটা তার আজ ভীষণ বিষন্ন, অরুণা বেগমের অসুস্থতা আর শায়েলা বেগমের এমন কড়া কথা শুনে তার খারাপ লাগছে। যদিও ইনায়ার মনে থাকা কষ্ট শেয়ার করার জন্য এখন কেউ নেই। বড্ড একা লাগে নিজেকে, সমস্ত দায়িত্ব, মিথ্যা নাটক আর ভালো থাকার অভিনয় করে এখন সে টার্য়াড। গাড়িতে যখন ইনায়া উদাসীন হয়ে বসে ছিলো তখন হঠাৎ তার ফোনে কল আসে। হাসপাতালে থাকা ডক্টর তাকে কল করেছে, যা দেখে ইনায়া ভয় পেয়ে যায়। ডক্টর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তাকে কল দেয় না, তবে কি অরণ্যর। ইনায়া আর ভাবতে পারে না, সে তাড়াতাড়ি করে ফোন রিসিভ করে ভায়ার্ত কণ্ঠে বলে –

“- ডক্টর আপনি হঠাৎ কল করলেন? অরণ্যর কি কিছু হয়েছে ডক্টর?
“- ইনায়া ম্যাম ওই অরণ্য স্যার “।
“- অরণ্যর কি হয়েছে ডক্টর? আপনি অপেক্ষা করুন আমি হাসপাতালে আসছি এখুনি।
“- ম্যাম অরণ্যর স্যারের জ্ঞান ফিরেছে, ওনি কোমা থেকে বের হয়ে এসেছে।
“- হোয়াট “।
ডক্টরের বলা কথাটা ইনায়ার বিশ্বাস হয় না, প্রায় দুইবছর পর অরণ্য কোমায় থেকে বের হয়ে এসেছে। এরপর ডক্টর বলেছে ইনায়া তা শুনতে পাই না, তার কানে শুধু অরণ্যর নাম ভেসে আসছে। তার অরণ্য ফিরে এসেছে, এই কথাটা ভেবেই ইনায়ার মনে থাকা সমস্ত কষ্ট, দুঃখ, বিষন্নতা, দূরে হয়ে যায়। তার উদাসীন মনে আবার সুঃখের আগমন হয়, অশ্রুঝরা দুই আঁখিতে এখন শুধু অরণ্যকে দেখার অপেক্ষা করছে। ডক্টর অল্প সময় কথা বলে ফোন রেখে দেয়, ইনায়া বুঝি ডক্টরের সব কথা শুনতে পাই নাই। ইনায়া ফোন কানে ধরা অবস্থায় গাড়ির ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“- ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়া ও, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। কাম ওন ফাস্ট “।
ড্রাইভার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়, ইনায়া তাকে সর্বচ্চ দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানোর কথা বলে। গাড়ি এখন অনেক দ্রুত চলছে, হাসপাতাল থেকে প্রায় তিরিশ মিনিটের দূরে তারা রয়েছে। তবুও ইনায়ার শান্তি লাগছে না, তার অপেক্ষার প্রহর যেনো শেষ হচ্ছে না। ভালোবাসার মানুষকে একবার জড়িয়ে ধরার জন্য, তাকে এক নজর চোখে দেখার জন্য যে মন কতটা ছটফট করে তা ইনায়া বুঝতে পারছে। ইনায়া ফোন বের করে ইভানকে কল দেয়, ইভান এখনো কম্পিউটারে বসে কাজ করে যাচ্ছে।
ফোন অনারবত বেজে যাচ্ছে, ইভান বিরক্ত হয়ে পাশে থাকা ফোন হাতে নেয়। ফোনের স্কিনে ইনায়ার নাম্বার দেখে অল্প সময়ের জন্য অবাক হয়ে যায়, কারণ প্রায় পনেরো মিনিট আগেই ইনায়ার সাথে তার কথা হয়েছে। এখন আবার ইনায়া ফোন করছে, ইভান ফোন রিসিভ করে বলে –

“- হ্যালো ইনায়া কি হয়েছে?
‘- ইভান ভাই অরণ্য কোমা থেকে ফিরে এসেছে। ওর হুঁশ ফিরেছে আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনি ও আসেন ‘।
ইনায়া এতো তাড়াতাড়ি করে কথাটা বলেছে যে ইভানের বুঝতে অল্প সময় লাগে, এরপর যখন সে বুঝে যে অরণ্যর জ্ঞান ফিরে এসেছে তখন সে খুশি হয়ে যায়। ইভান তার কাজ রেখে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিচে আসে, এরপর গাড়ি করে হাসপাতালের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায় পড়ে। ইভান তাড়াহুড়ো করে বের হয়, যার জন্য বাড়ির অন্য সদস্যকে যানাতে পারে না। প্রায় তিরিশ মিনিট পর ইনায়ার গাড়ি হাসপাতালে এসে পৌঁছায়, ইনায়া গাড়ি থেকে নেমে প্রায় দৌড়ে হাসপাতালের ভিতরে চলে যায়।

হাসপাতালে কেবিনের সামনে এসে উপস্থিত হয় ইনায়া, আজ প্রায় দুইবছর পর তার স্বামীকে সে সুস্থ অবস্থায় দেখবে। অন্যদিকে অরণ্য কোমায় থেকে জ্ঞান ফিরে আসার পর শুধু ইনায়ার নাম বলে যাচ্ছে। ডক্টর যার অন্য অতিষ্ঠ হয়ে ইনায়াকে ফোন করেছে, তাকে অরণ্যর পাগলামি করার কথা বলেছে। কেবিনের দরজার জোরে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে যায় ইনায়া, এরপর ছুটে যায় অরণ্যর কাছে। অরণ্য ইনায়াকে দুইবছর পর দেখছে, সেই এক্সিডেন্টের সময় শুধু ইনায়ার চেহারা দেখেছে সে।

অরণ্য ইনায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, সেটা অনুসরণ করে ইনায়া শক্ত করে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ইনায়ার মাথাটা অরণ্য তার বুকে শক্ত করে চেপে ধরে। অঝরে কান্না করে যাচ্ছে ইনায়া, তবে সেটা দুঃখের না বরং সুখের কান্না। ইনায়া কান্না করতে থাকে, আর বলে –
‘- অরণ্য আমি আপনাকে অনেক মিস করেছি। এতোদিন আপনাকে ছাড়া আমি ভালো ছিলাম না। যায় হয়ে যাক না কেনো কখনো ছেড়ে যাবেন না আমার, কথা দিন আমাকে ‘।

ইনায়ার কণ্ঠে এমন আবেগময় কথা শুনে অরণ্যর মন হৃদয় প্রশান্তিে ভরে যায়। সে তার জীবনে যোগ্য একজন সঙ্গিনী পেয়েছে, যদি সে তার থেকে দীর্ঘসময় ও দূরে থাকে তবুও তাকে ভুলে যাবে না। শুধু দুইবছর না সারাজীবন তার অপেক্ষা করবে, শুধু তাকেই ভালোবেসে যাবে। অরণ্যর বুকে কান্না করা মেয়েটা তার বউ, যাকে সে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। অরণ্যর বুক থেকে মুখ তুলে ইনায়া, তারপর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। কতো রাত হাসপাতালে এই নিথর দেহের দিকে ইনায়া নির্বিকার তাকিয়ে থেকেছে, তার কণ্ঠে নিজের নাম শুনার জন্য আত্মানাথ করেছে অপেক্ষা করেছে।

হয়তো অভাগী ইনায়ার কথা উপর ওয়ালা শুনেছে এইবার, যার জন্য তার জীবনে থাকা সামান্য পরিমাণ সুখ কেঁড়ে নেয় নাই। অরণ্য ও ইনায়ার চোহারা ভালো করে লক্ষ্য করে, দুইবছর আগের ইনায়া আর এখনকার ইনায়ার মধ্যে কতো পার্থক্য। তার চোখে মুখে কালো দাগ, মুখটা ফেকাসে,নরম শরীরটা রোগা হয়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে বিছানায় এতোদিন সে শুয়ে ছিলো না ইনায়া তা অরণ্য বুঝতে পারে না। তবে ইনায়ার প্রতি তার বড্ড মায়া হয়, মেয়েটাকে সে অতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে ফেলছে।

ইনায়ার মুখের উপর পড়া চুল অরণ্য সুন্দর করে কানের পিছনে গুঁজে দেয়। আজ তার বড্ড লোভ হচ্ছে ইনায়ার এমন বিষন্ন মুখটা একবার তার ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দিতে। অরণ্য ইনায়ার গাল দুইটা হাত দিয়ে আলতো করে ধরে, এরপর তার ঠোঁট দিয়ে ইনায়ার, চোখে, গালে, নাকে সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে ভালোবাসার পরশ দেয়। স্বামীর আদুরে স্পর্শে ইনায়া চোখে বন্ধ করে নেয়, অল্প সময় পর একে অপরকে আবার জড়িয়ে ধরে।

ইনায়া আর অরণ্যর রোমান্টিক খুনসুটির মধ্যে ইভান কেবিনে আসে। যেহেতু কেবিনের দরজা খোলা, তাই ইভান নক না করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। অরণ্য আর ইনায়াকে জড়িয়ে ধরা দেখে, ইভান এক পা পিছিয়ে যায় এরপর নিজের উপস্থিতি বোঝাতে দরজায় নক করে। দরজায় নক করার শব্দ শুনে ইনায়া অরণ্যর বুক থেকে উঠে পড়ে, অরণ্য কোনো নার্স এসেছে ভেবে বিরক্ত হয়। এতোদিন পর তার বউকে কাছে পেয়েছে, কিন্তু তাতে ও শান্তি নেই।
অরণ্য বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে, সামনে থাকা মানুষটা দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে যায়। তার বিশ্বাস হচ্ছে না ইভান চৌধুরী তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ইনায়া ইভানকে দেখে অরণ্যর থেকে দূরে সরে যায়। যতই হোক ইভান তার ভাসুর হয়, তার সামনে এমন করে জড়িয়ে ধরা ঠিক নয়। ইভান হাসি মুখ নিয়ে এগিয়ে আসে অরণ্যর কাছে এরপর বলে –

“- কেমন আছো অরণ্য? তোমার শরীর ঠিক আছে এখন? ডক্টর কি বলেছে?
অরণ্য কি উত্তর দিবে সে শুধু অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মানে ইভান চৌধুরী তার চিরশত্রু, তার সতিন, তাকে দেখার জন্য হাসপাতালে এসেছে। বিষয়টা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে অরণ্যর, সে কিছুটা সময় ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ এতোটা সময় হয়তো ইনায়াকে ও দেখে নাই, যতটা সে ইভানকে দেখে যাচ্ছে। এরপর অরণ্য শান্ত হয়ে বলে –

“- হুম আই এম অল রাইট। কিন্তু ইভান চৌধুরী হঠাৎ আমাকে দেখতে কেনো এসেছে? আর আমার সুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইছে কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না “।
অরণ্যর কথা শুনে ইভান কিছু বলতে যাবে, এর আগেই ইনায়া ধমকের সুরে অরণ্যকে বলে –
“- অরণ্য ইভান ভাই আপনার বড় ভাই হয়। আপনি এতোদিন অসুস্থ ছিলেন, এখন সুস্থ হয়েছেন যার জন্য ওনি আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে । এখানে বিশ্বাস না করার কি আছে?
ইনায়ার ধমক শুনে ইভান বলে –

“- আরে ইনায়া অরণ্যকে কেনো এমন করে বলছ? ওর কোনো দোষ নেই, আসলে আমার আব্বু অরণ্য বা তার পরিবারের সাথে যা করেছে তা অন্যায়। আর দুইবছরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে, যা অরণ্যর অজানা “।
ইভান ইনায়ার কথা শুনে অরণ্যর বিশ্বাস হচ্ছে না,তারা একে অপরের সাথে এতো সুন্দর করে কথা বলছে। প্রায় পাঁচ মিনিট ইভান অরণ্য আর ইনায়ার সাথে কথা বলে। এরপর কেবিন থেকে বের হয়ে যায়, অরণ্য মনে মনে বলে –

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৪০

‘- হুম এইটা ভাই না সতিন। এতোদিন পর বউকে একটু আদর করছিলাম সেটার বারোটা বাজিয়ে দিলো। তবে সব প্রতিশোধ এখন আমি নিব, শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর তোকে যদি আমি আমার দশ বাচ্চার মামা না বানায় তবে আমার নাম অরণ্য রাজ চৌধুরী না। আমার দশটা বাচ্চা তোকে দিনে চব্বিশ ঘণ্টা তোকে মামা মামা বলে ডাকবে তখন গিয়ে প্রতিশোধ পূরণ হবে।

তোমার নামে লেখা চিঠি পর্ব ৪২

1 COMMENT

Comments are closed.