তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২২
অহনা আক্তার
“ফুপিমণি” জিন্নাত কে দেখে ফুপিমণি বলে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল মুসকান। তৎক্ষনাৎ ড্রাইভার কে বলে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত নেমে পরলো। মুসকানের সাথে সাথে নেমে পরলো জহিরও। কারণ সেও জিন্নাতকে দেখেছে। ফাইজা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— কি বলছো ভাবি? ফুপিমণি এখানে কি করে আসবে?
মুসকান ফাইজার কোনো কথার জবাব না দিয়ে ছুটে জিন্নাতের কাছে চলে গেলো। এতোক্ষণে ফাইজাও দেখেছে তার ফুপিমণিকে। রাস্তার একপাশে কালো বোরখা পরে মাথায় কাপড় টেনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশাওয়ালা রাগান্বিত হয়ে আঙুল তুলে তুলে কি যেন বলছে! জিন্নাত মাথা নুয়ে বারবার চোখের পানি মুছছে। ফাইজাও এবার ছুটে সেখানে গেল।
মুসকান জিন্নাতের কাছে গিয়ে তাকে জপটে ধরে বলতে লাগলো,
— তুমি এখানে কি করছো ফুপিমণি? তোমার কি হয়েছে?
জিন্নাতকে কোনো কথা বলতে না দেখে জহির বিচলিত কণ্ঠে শুধালো,
— কি হলো কথা বলছিস না কেন? তুই একা একা ঢাকায় কি করছিস ?
জিন্নাত বারবার নিজের মুখ আড়াল করতে চাইছে। কান্না লুকাতে চাইছে। এর মাঝে রিকশাওয়ালা লোকটি বলে,
— ওনি মনে হইতাছে আফনাদের পরিছিত লোক ?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জহির মাথা নাড়ায়। রিকশাওয়ালা যেন জানে বাঁচল। ত্বরিত গতিতে বলতে লাগল,
— ভাই,,, ভালো হইছে ভাই,, আফনাদের পাইছি !! এই আফা তিন’ডা ঘন্টা ধইরা আমার রিক্সায় ঘুইরা বেড়াইতাছে। এতোক্ষানি রাইত হইয়া গেছে নামবার খবর নাই। কই যাইবো হেইডাও কয় না! আমি যদি জিগাই তাইলে উত্তরও দেয় না হুদাই কান্দে। আমার ভাড়ার টেকাডা ও দেয় নাই। কইতাছে যে উনার কাছে নাকি কোনো টেকা নাই! এমন কইলে হইবো কন ভাই? টেকা না থাকলে আমার রিক্সায় উঠছে কেন? আমরা দিন আনি দিন খাই। টেকা না পাইলে খামু কি?
মুসকানের চোখে পানি। সে তার ফুপিমণির দিকে তাকিয়ে মায়াভরা কণ্ঠে বলে,
— কি হয়েছে ফুপিমণি বলো না? তোমার ঠোঁটের কোনায় র’ক্ত কেন ?
জিন্নাত জোরপূর্বক হাসে। মুসকানের গালে হাত রেখে বলে,
— কিছুনা..তো! ক..কই? কিছু হয়নি আমার! (কাপড় দিয়ে মুখ ডাকার চেষ্টা করে)
মুসকান এবার ফুপিয়ে উঠলো। নাক টানতে টানতে বলল,
— বললেই হলো! আমি স্পষ্ট দেখেছি তোমার গালে থা’প্পড়ের দাগ,, ঠোঁটে র’ক্ত।
জহির অবাক হয়ে জিন্নাতের দিকে তাকায়। রিকশাওয়ালাকে টাকা দিয়ে বিধায় করে ভরাট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— তুই কাঁদছিস কেন এইভাবে? কে মে’রেছে তোকে? এই শহরে তোর ভাইয়ের এতো বড় বাড়ি থাকতে তুই কিনা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস !!
ভাইয়ের কথা শুনে চোখ উপচে আরো বেশি করে পানি পড়তে লাগলো জিন্নাতের। আর না পেরে ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে দিল। জহির যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার আদরের বোনটার এতো ক’ষ্ট আছে অথচ সে বড় ভাই হয়ে কিছুই জানে না। বোনের পিঠে হাত রেখে চোয়াল শক্ত করে বলে জহির,
— তোর স্বামী আর ছেলে কোথায়? ওই জা’নো’য়া’র গুলো কি তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে? একবার বল শুধু ওদেরকে ওদের বাড়িতে ফেলেই কু’বিয়ে আসবো !!
জিন্নাত আবারো কাঁদে। করুন সুরে বলে,
— না ভাইজান। ওরা কেউ আমাকে বাড়ি থেকে বের করেনি। আমি নিজে চলে এসেছি। ওই অ’মানুষের সাথে আমি আর থাকতে পারবো না! আমাকে আপনার বাড়ি নিয়ে চলুন ভাইজান। খুব ক্ষুধা লেগেছে। কাল রাত থেকে কিছু খাইনি।
এবার জহিরও কেঁদে দেন। বোনের ক’ষ্ট আর নিতে পারছে না। আদরের বোনটা এমন খিদে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। ভাগ্যক্রমে আজ যদি তাদের সামনে না পরত তাহলে কি হতো। ভাবতেই বুকে ব্যথা করছে জহিরের। সে আর দেরি না করে বোন আর মেয়েদের নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। যা করার পরে করবে।
ছেলেকে কে আর্জেন্ট ফোন করে বাড়ি এনেছে জহির। রাগে মাথা জ্বলজ্বল করছে উনার। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যে সামনে আসবে তাকেই গু*লি করে মে’রে ফেলবে। বাড়িতে এসে জিন্নাতের অবস্থা দেখে ফারিশ নিজেও স্তব্ধ হয়ে গেল। তাজমহল আর মুসকান মিলে জিন্নাতের মা*রের জায়গা গুলোতে মলম লাগাচ্ছে।
ফারিশ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল,
— ফুপিমণি আমাদের এখানে !! এ-ই অবস্থা কেন ?
বলেই দ্রুত গিয়ে জিন্নাতের পাশে বসলো। তার ফুপিমণির মুখটা দু’হাতে আগলে ধরে বলল,
— ফুপা কি তোমার গায়ে হাত তুলেছে?
জিন্নাত কাঁদতে কাঁদতে মাথা দুলালো। ফারিশের চোখের কার্নিশ লাল হয়ে গেল মুহূর্তেই। গলার স্বর অত্যন্ত গম্ভীর করে বলল,
— কেন?
জিন্নাত চোয়াল শক্ত করে বসল। আজ সব বলবে সে। মোকলেসের অত্যাচার সে আর নিতে পারছে না। ঘরের সকলে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে জিন্নাতের কথা শোনার জন্য। জিন্নাত চোখের পানি মুছে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো,
— বিয়ের পর থেকে মোকলেস আমাকে এক বিন্দু পরিমাণও শান্তি দেয়নি। সব সময় টাকা, টাকা, টাকা, করেছে। টাকা ছাড়া আর কিছু বুঝে না লোকটা। বিয়েতে আব্বাজানের কাছ থেকে এতো এতো যৌতুক নিয়েও তার তৃপ্তি মেটেনি। আমাকে নানাভাবে ব্ল্যাকমেল করে আব্বাজান আর জাহিদের থেকে টাকা নিয়েছে। আমি টাকা আনতে না চাইলে আমার গায়ে হাত তুলেছে। রিশাদ হয়ে যাওয়ায় ওই জা’হান্নাম থেকে বের হতে পারিনি আমি। মুখ থুবড়ে পড়ে ওই অ’মানুষ টার সংসারই করে গেছি। কিন্তু যেই ছেলের জন্য এতো কিছু সেই ছেলেই বড় হয়ে আমাকে বুঝলো না। তার বাবার দেখানো পথেই চলতে লাগল। তার বাবার আশকারায় আর শাসনের অভাবে একটা ল’ম্পটে পরিণত হলো। ম*দ, নাইট ক্লাব, সারারাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা মাস্তি এসব করে জীবনটাকে একদম শেষ করে দিচ্ছে। মুসকান কে না পাওয়ার জন্য প্রতিটা দিন আমার সাথে গলা উঁচিয়ে চেচামেচি করে…
— মুসকানকে না পাওয়ার জন্য মানেহহহ !!
বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল ফারিশ। মুসকানের দিকে তাকালে সে মাথা নুইয়ে ফেলে।
জিন্নাত চোখের জল মুছে বলে,
— হ্যা। রিশাদ মুসকানকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করে। তাকে বিয়ে করার জন্য আমাকে নানাভাবে ফৌর্স করে। আব্বাজানকে রাজি করাতে বলে। মুসকানকে পেলে নাকি সে সব ছেড়ে দিবে। একদম ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। যেখানে আমার জীবনটাই ওরা ক’য়লা বানিয়ে দিয়েছে সেখানে আমার ভাতিজির জীবনটা কি করবে এর ধারণা আমার আছে। আব্বাজান মুসকানের সাথে তোর বিয়েটা হোট করেই দিয়ে দেন। রিশাদ যখন জেনেছে তখন তোদের বিয়ে হয়ে গেছে। আর এরজন্য আমার নিজের পে*টের ছেলে আমাকে দেখতে পারে না। তার সামনে মোকলেস আমাকে গা’লা’গা’লি করে, গায়ে হাত তুলতে আসে কিন্তু সে কোনো প্রতিবাদ করে না। উল্টো বলে আমি নাকি তার ‘মা’ না। মা হলে নাকি নিজের ছেলে ইচ্ছের প্রাধান্য দিতাম। সে যা চায় তা এনে দিতাম। অবশ্য সে তখন মা’তাল ছিলো। কিন্তু তাও ছেলের এমন আচরণ আমি স’হ্য করতে পারিনা।
কথাগুলো বলে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে জিন্নাত। তাজমহল একগ্লাস পানি এগিয়ে দিল জিন্নাতের দিকে। মুসকান হেঁচকি তুলে কাঁদছে। তার জন্য তার ফুপিমণি কতো কিছু সহ্য করছে। জহির নিজের চুল নিজে শক্ত করে টেনে ধরেছে। রাগে কি করবে বুঝতে পারছে না। জিন্নাত পানিটুকু খায়। খেয়ে গলা ভেজায়। ফারিশের চোখ রক্তলাল। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
—‘ তারপর?’
তারপর এভাবেই চলতে থাকে। রোজ রাতে ম*দ খেয়ে বাড়িতে এসে একটা কথাই বলে, ‘তার মুসকান লাগবে! মুসকানকে এনে দিতে!’ যতদিন পর্যন্ত মুসকান না আসবে ততদিন পর্যন্ত সে এভাবেই চলবে। কাল রাতেও এমনই হলো। নে*শায় বোধ হয়ে বাড়িতে এসে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। আমাকে বলে,
–‘ তুই মা না? তুই একটা স্বার্থপর মহিলা! তোর চোখে তোর ছেলের কষ্ট ধরা পরে না! মানুষের টা পরে! তোকে আমি ঘে*ন্না করি! তোর মতো মা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো! ‘
আমি আর সহ্য করতে পারিনি। রাগে,জিদ্দে প্রথমবারের মতো ছেলেকে থা’প্পড় মা’রি। আর এটাই মেনে নিতে পারেনি ওর বাবা। ছেলেকে মা’রার অপরাধে মোকলেস আমাকেও ক’ষিয়ে থ*প্পড়ের উপর থা’প্পড় মা’রে। ওর একেকটা থা’প্পড়ে আমার আত্মা বেড়িয়ে আসার উপক্রম। মেয়ে রিতা ছাড়া আর একটা মানুষও এগিয়ে এসে মোকলেসের থেকে আমাকে ছুটানোর সাহস করেনি। আমি আর না পেরে কাঁদতে কাঁদতে এক পোশাকে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। রাতটা ওদের ওখানেই একজন পরিচিত মহিলার বাসায় কাটিয়ে উনার বোরখা নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পরি।
আব্বাজানের কাছে যেতে পারিনি আমার গায়ে আ’ঘাতের দাগ দেখে কষ্ট পাবেন। তোদের বাসায়ও আসতে চাইনি। একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতাম। কিন্তু রাস্তায় ভাইজানকে দেখে আর মনের কষ্ট ধরে রাখতে পারিনি। এখানে এসে তোকে দেখেতো আরো পারিনি। সব ভিতর থেকে বেড়িয়ে গেছে। আমি আর ওই কা*রাগারে যেতে চাই না বাবা। তুই আমাকে বাঁচা। ওরা আমার খোঁজ নিয়ে কালই এখানে চলে আসবে। আমাকে ওদের থেকে রক্ষা কর। ‘ এসব বলে বলে অঝোরে কাঁদছে জিন্নাত।
ফারিশ তার ফুপিমণির মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। চোখ থেকে যেন আ’গুন বের হচ্ছে। গলার রগ ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২১
রুমের প্রতিটি মানুষ স্তব্ধ। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে তাদেরও। জহির ছোটে নিজের রুমে গেলো। নিজের লাইসেন্স করা ব’ন্দুক টা হতে নিয়ে বের হতেই তাজমহল বাঁধা দিল। জহির ক্রুধে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
–” সামনে থেকে সরবে নাকি তোমাকেও গু’লি মে’রে উড়িয়ে দিব…..!! ”