তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩০

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩০
অহনা আক্তার

ফাইজা মুসকানকে রিশাদের সাথে দেখা করাবে করাবে বলেই একমাস চলে গেলো। তারা কোনো ভাবেই বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ টা পাচ্ছে না। তাজমহল কোনো ভাবেই মুসকান কে এই অবস্থায় বাড়ির বাইরে যেতে দিচ্ছে না। সেটা তারা যতই বাহানা দেক না কেন। তাজমহল এখন ফারিশ ছাড়া মুসকানকে একা একা কারো সাথেই বের হতে দেন না। উনার একটাই কথা…

আগে উনার নাতি/নাতনি সুস্থ হয়ে দুনিয়ায় আসুক। আর কয়টা মাস ইতো। এই মাস গুলো চলে গেলে মুসকান যত পারুক ঘোরাঘুরি করুক। এদিক, ওদিক, যেদিক, সেদিক বেড়াতে যাক উনি কিছু বলবেন না। ফাইজাও বাহানা দিয়েছে অনেক, মুসকানকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যাবে। মুসকানের জন্য কেনাকাটা করবে কিন্তু তাজমহলের কড়া জবাব, যা যা খেতে ইচ্ছে করে, যা যা কেনার প্রয়োজন পরে ফারিশ আর তাদের বাবা কে যেন বলে তারাই এনে দিবে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। ফাইজা আর মুসকান তাজমহল কে রাজি করাতে না পেরে হতাশ হয়ে বসে রইলো। মুসকান বুঝে পায় না তার শাশুড়ী হঠাৎ এমন কঠোর হয়ে গেল কেন?
আর ফারিশ! সেতো আরো উপরে,,,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুসকানের মা এসেছিল কিছুদিন আগে প্রথমবারের মতো মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে। এসে দু-তিন দিনের মতো থেকেও গেছে। মুসকানকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এই অবস্থায় মেয়েদের মায়ের সঙ্গ খুব প্রয়োজন। কিন্তু ফারিশ স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তার বউ প্রেগন্যান্সির পুরোটা সময় এই বাড়িতেই থাকবে। গ্রামের যাওয়ার দরকার নেই। গ্রামের চিকিৎসা ততো উন্নত নয়। কোনো ইমারজেন্সি হলে এখান থেকে যত সহজে সব কিছু করতে পারবে গ্রামে গেলে তা পারবে না। রাহিলাকে খুব করে রিকুয়েস্ট করেছে উনিই যেন কয়টা মাস এখানে থেকে যান। কিন্তু রাহিলা তিন দিনের বেশি থাকেনি। বরং ফারিশের সিদ্ধান্তে আরো খুশি হয়েছে। ছেলেটা যে উনার মেয়েটাকে কতোটা ভালোবাসে এও বুঝে গিয়েছে।

রাত বারোটায় ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করছে মুসকান। পেট তার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই ফুলেছে। বেবি একটা থাকলে হয়তো এতোটাও ফুলো দেখাতো না। কিন্তু দুটো হওয়ায় মনে হচ্ছে তার পেটই ফে’টে যাবে।
পেট বড়ো হওয়ায় পুরনো সব জামা ই মুসকানের টাইট হয়ে গেছে এখন। আগের থ্রি পিস গুলাও পড়তে খুব আসুবিধে হয়। তাছাড়া ওই থ্রি পিস গুলা পড়লে তার উদর এতোটা বড় দেখায় যা দেখে মুসকানের নিজেরই ভিষণ লজ্জা লাগে । বেছে বেছে যত টপস আর গোল জামা ছিল ওই গুলোই এখন পড়ে সে। মুসকানের মা রাহিলা ওর জন্য ওদের গ্রাম থেকে বড়সড় ঢুলঢাল কয়েকটা পোশাক বানিয়ে এনেছিল। যেগুলো একেকটা গায়ে দিলে মুসকানের পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত এসে ঠেকে। তাদের গ্রামের মানুষেরা সম্ভবত এই পোশাক গুলোকে মেক্সি বলে। একবার পরে দেখেছিল মুসকান মায়ের আনা ওই পোশাক । আর পরেই নিজেকে আয়নায় দেখে এতো লজ্জা পেয়েছে যে ভুলেও ওইসব আর ছুঁয়ে দেখেনি। এক কোনায় রেখে দিয়েছে। এসব কি জোব্বা এনেছিল তার জন্য আম্মা।

বিছানায় আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছিল ফারিশ। দীর্ঘ সময় ধরে মুসকান কে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল,
— আজ কি আর ঘুমাবে না? প্রতিদিন কি এত দেখো আয়নায়?
মুসকান মুচকি হেসে উত্তর দিল,
— মাতৃত্বের রূপ দেখি।
ফারিশ মুগ্ধ হলো। চট করে বিছানা থেকে নেমে এসে মুসকানের পিঠ ঘেঁষে দাঁড়াল। আলতোভাবে মুসকানকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বলল,
— খুব আদুরে লাগে তোমায় এখন। ইচ্ছে করে সারাক্ষণ কোলে বসিয়ে আদর করি। চু*মু খাই, বুকের ভিতর ঢুকিয়ে ফেলি। বলতে বলতেই মুসকানের গালে শব্দ করে চু’মু খেল ফারিশ।
মুসকান লজ্জা পেল। মাথা নুইয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল,

— একটা কথা ছিলো।
মুসকানের ঘাড়ে ছোটছোট স্পর্শ দিয়ে জিজ্ঞেস করল ফারিশ,
— কি কথা বলো না?
আয়নায় ফারিশের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলল মুসকান,
— আমি কাল ফাইজার সাথে মার্কেটে যেতে চাই। আমায় যেতে দিবেন?
ফারিশের রোমান্টিক মুড অটোমেটিক চে ঞ্জ হয়ে গেলো। মুসকানকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে সটান হয়ে বসে বলল,
— কোনো প্রয়োজন নেই। কি আনতে হবে বলো আমি নিয়ে আসবো।
মুসকান এগিয়ে এসে ফারিশের সামনে দাঁড়াল। অনুরোধের সুরে বলল,

— যাই না। আপনি এখন আর আমাকে বাইরে যেতে দেন না কেন? আমার কিছু হবে না বিশ্বাস করেন। শুধু যাব আর আসবো। গাড়িতে করেই যাব। আমার খুব দরকারি কতগুলো ড্রেস কেনার আছে ওগুলো কিনেই এসে পড়বো।
— একবার বললে শুনো না? কতোবার বলতে হবে?যেতে বারণ করেছি মানে যাবে না। কি রকম ড্রেস আনতে হবে আমাকে বলো আমি কালকের মধ্যেই এনে দিবো।
মুসকান হঠাৎ চটে গেল,

— কেন আমার কি পারসোনাল কোনো কিছু কেনার থাকতে পারে না? আমি কি এখন নিজে পছন্দ করে কোনো ড্রেসও কিনতে পারবো না? আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেছেন আপনি? আমি কতটা মোটা হয়েছি! প্রতিটা জামা পড়তে কতোটা অসুবিধা হয় এখন। যেটাই পড়ি পেটের দিকে এসে আটকে যায়..
এতোটুকু বলে নাক টেনে ফুপাতে শুরু করলো মুসকান। ইদানীং তার অল্পতেই মোড চেঞ্জ হয়ে যায়। এই খিটখিটিয়ে উঠে তো এই আবার প্রফুল্ল। শুধু শুধুই কেঁদে ভাসিয়ে দিবে আবার নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে। ডক্টর বলেছে এই অবস্থায় মেয়েদের মেজাজ কিছুটা এইরকমই থাকে, শুধু শুধু কান্না করবে, রাগ করবে, জেদ ধরবে, হাসবে, যার জন্য বেশি মাথা ঘামালো না ফারিশ। চুপচাপ বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে দু’হাত ছড়িয়ে মুসকানকে কাছে ডাকল,

— ঘুমাবে আসো রাত হয়েছে অনেক। তোমার জন্য এতো রাত জাগা মোটেও ঠিক না।
মুসকান ফুঁসে উঠে বলল,
— আপনি আমার কথা ইগনোর করছেন?
— কোথায় ইগনোর করছি? তোমার আর আমার মধ্যে পারসোনাল বলতে কি আছে? যত ড্রেস কিনতে চাও কাল অনলাইন থেকে নিজেই চুজ করে অর্ডার করো। এখন আসো ঘুমাবো।
মুসকান সশব্দে চেঁচাল,
— অনলাইন থেকে ড্রেস কিনবো না আমি। আ বা য়া বানাবো নিজে ডিজাইন দিয়ে টেইলার্স থেকে। আমি না গেলে কি করে হবে?
— ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব কাল।
— না আমি আপনার সাথে যাব না। ফাইজার সাথে যাবো। আপনার সময় থাকে না। আসার জন্য তাড়াদেন বেশি।
ফারিশ উঠে বসল। বিরক্তি নিয়ে বলল,

— আশ্চর্য তো !! বেবিরা আসার পর কি এসব করতে পারবে না তুমি? এখনই কেন?
— বেবিরা পেটে আছে বলেইতো ওইরকম ড্রেস বানাতে চাইছি। আর তাছাড়া আপনারা যে এতো বলেন বেবিরা আসার পর আমাকে সব করতে,,,
~ ওরা আসার সময়ই যদি আমি মা’রা যাই তখন?
” মুসকাননন ”
ঘর কাঁপিয়ে গর্জে উঠলো ফারিশ। আচমকা গর্জনে মুসকান দু’পা পিছিয়ে গেল। ভয়ে তার বুকের ভিতর ধারাম ধারাম শব্দ হচ্ছে। হাওয়ার বেগে ফারিশ খাট থেকে নেমে এসে মুসকানের দুই বাহু খাবলে ধরল।
হিংস্র চোখে তাকিয়ে অত্যন্ত খেপা স্বরে বলতে লাগলো,
— তোমার সব ছেলে মানুষী কথা মেনে নেই বলে ভাববে না এটাও মেনে নিব। ম’রার কথা আসে কি করে মুখ দিয়ে? কোন জিনিসের কমতি রেখেছি তোমায়? ভালোবাসার কমতি রেখেছি কোথাও ? বলো??
মুসকান ঠকঠক করে কাঁপছে। তার একটা কথায় যে ফারিশ এমন ভয়ংকর ক্ষেপে যাবে ভুলেও ভাবতে পারেনি। সে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে ভয়ে ভয়ে বলল,

— আমিতো এ..এমনি ব..বলে ছিলাম।
— এমনি কেন বলবে ?? (উচ্চস্বরে)
মুসকান আরো ভয় পেল। ভেজা কণ্ঠে বলল,
— মুখ দিয়ে হ..হঠাৎ এসে পরেছে। বুঝতে পারিনি আপনি এমন রেগে যাবেন! আ..আর বলবো না।
— তোমার এই অন্যায় করে করে বারবার সরি, করবো না, বলবো না বলায় আমার বুকের ভিতরের দ হ ন বন্ধ হয়ে যাবে না! ক্ষণেক্ষণে হার্ট অ্যা’টাকের মতো যন্ত্রণা দাও তুমি আমায়। প্রতিনিয়ত তোমার চিন্তায় পা’গল হয়ে যাচ্ছি আমি। কি করে দু, দুটো বেবির মা হবে! কি করে ওদের দুনিয়াতে আনবে! তোমার আর বেবিদের কিছু হবে না তো! তোমরা ঠিক থাকবে তো! কতোটা রিস্ক নিতে হবে তোমাকে! এসব ভেবে মাথা কাজ করে না আমার। আর তুমি আমাকে ম’রে যাওয়ার ভয় দেখাও !! আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার এতো ইচ্ছে থাকলে এলে কেন?

— আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি কথাটায় আপনি এতোটা হার্ট হবেন! আমি আর আপনার বেবিরা কখনোই আপনাকে রেখে কোথাও যাব না। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে ফারিশ কে কথা গুলো বলছে মুসকান।
মুসকানের কান্না দেখে ফারিশ কিছুটা শান্ত হলো। ফুস করে শ্বাস ছেড়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
— কান্না বন্ধ করো।
মুসকান কেঁদেই যাচ্ছে,,,
— কি হলো? কান্না বন্ধ করতে বললাম তো!
মুসকান তাও কাঁদছে….
ফারিশ ধমকে উঠল,
—” স্টপ ক্রাইং ”
সাথে সাথে মুসকান কান্না বন্ধ করে দিল। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে গোল গোল চোখ করে ফারিশের দিকে তাকাল। ফারিশ মুসকানের চোখের পানি মুছে দিল। আদুরে ভাবে বুকে টেনে শীতল স্বরে বলল,

— আর একটুও কাঁদবা না ওকে।
মুসকান ফারিশের বুকেই মাথা দোলাল। নাক টেনে বলল,
— আমার আর কোনো ড্রেসের প্রয়োজন নেই। আর কোথাও যাব না আমি। বেবিরা আসার পর সব করবো।
মুসকানের বাচ্চামো কথায় হেসে দিল ফারিশ। এই মেয়েটার সাথে রাগ করে থাকতেই পারে না সে। মুসকান মুখ তুলে ফারিশকে দেখলো। একটু কাঁদলেই তার নাক চোখ লাল হয়ে যায় । ফারিশ সেদিকে তাকিয়ে মুসকানের টকটকে লাল হয়ে যাওয়া নাকে ছোট্ট করে কা’মড় বসালো। তাকে আলতো করে ধরে খাটে বসিয়ে পানি খেতে দিল। মুসকান পানি খেয়ে কিছু বলার আগেই ফারিশ রুমের লাইট বন্ধ করে ড্রিম লাইট চালু করে দিল। হালকা টিমটিমে আলোয় বিছানায় শুয়ে মুসকানকেও টেনে নিলো নিজের বুকের উপর। শরীরের সাথে চেপে ধরে মোলায়েম ভয়েসে বলল,

— চুপচাপ ঘুমাও এখন। কাল ড্রাইভার চাচাকে বলে দিবো তোমাকে আর ফাইজা কে মার্কেটে নিয়ে যেতে।
— না যাব না আমি।
— উমমম কথা বলতে নিষেধ করছি না ঘুমাও।
মুসকান চুপ হয়ে গেল। রিশাদের সাথে দেখা করার জন্য সে আর ফাইজা খুব চেষ্টা করছে কিন্তু বাড়ি থেকেই বের হতে পারছে না। ফারিশ নিষেধ করায় তাজমহলও তাকে কোথাও যেতে দিচ্ছে না। যার জন্য ভেবে রেখেছে আজ যে করেই হোক ফারিশকে রাজি করাবে সে। ড্রেস বানানো তো বাহানা মাত্র। আসল কারণ হচ্ছে রিশাদের সাথে দেখা করা। কিন্তু ফারিশ নরমাল কারণেই যে হারে রেগে যাচ্ছে। ভুলক্রমেও যদি আসল কারণ টা জানতে পারে তখন কি হবে! আতঙ্কে এখনই হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে মুসকানের। না যাওয়াটাই এখন ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে…

ঝলমলে বিকেল। মৃদু মন্দ বাতাস চারদিকে। সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে ফাইজার পাশেই অস্থির হয়ে বসে আছে মুসকান। আসতে চাইছিলো না কিছুতেই। কিন্তু ফারিশ নিজেই তাকে জোর করে পাঠিয়েছে ফাইজার সাথে। সে যে রকম ড্রেস পড়তে চায় নিজে পছন্দ করে একদম সেই রকম ড্রেসই যেন বানাতে দিয়ে আসে এই বলে হাতে টাকাও গুঁজে দিয়েছে। মুসকান লাগবে না প্রয়োজন নেই বলেছে অনেকবার। কিন্তু ফারিশ শুনেনি। সে ভেবেছে মুসকান হয়তো অভিমান করে এমন টা বলছে। তাই সেই জোর দিয়ে পাঠালো। ব্যস্ততার জন্য মুসকানের সাথে যেতে চেয়েও যায়নি ফারিশ। ড্রাইভার কে কড়াকড়ি বলে দিয়েছে তাদের যেন সাবধানে নিয়ে যায় আর শপিং শেষ হলে সাবধানে বাড়ি নিয়ে আসে।

মার্কেটে গিয়ে চটপট বেশ কয়েকটা কাপড় কিনে টেইলার্সে বানাতে দিয়ে মার্কেটের পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে ফাইজা আর মুসকান। সুযোগ যখন পেয়েছে একবার রিশাদের সাথে দেখাটা নাহয় করেই যাক। ফাইজা আগেভাগেই রিশাদ কে ফোন দিয়ে বলেছিল এই জায়গায় আসতে। রিশাদ এসে তাদের জন্য কখন থেকেই ওয়েট করছিল। মুসকান অস্থির হয়ে বারবার আশেপাশে তাকাচ্ছে। ফারিশ রিশাদের নামই সহ্য করতে পারে না। সেই জায়গায় তার প্রিয় বোন আর বউ দু’জনেই লুকিয়ে রিশাদের সাথে দেখা করতে রেস্টুরেন্টে এসেছে। যদি জেনে যায় তাহলে কি ভয়ংকর কান্ড ঘটাবে এটা ভেবেই মুসকানের রুহ কাঁপছে। মনে মনে অনবরত দোয়া দুরুদ পড়ে যাচ্ছে দুজনেই। মুসকানের ভয়টা যেন ফাইজার থেকেও বেশি। কারণ ফারিশের ভয়ংকর রাগের সাক্ষি সে একবার নয় বারবার হয়েছে। মনে মনে বলছে,,

— আল্লাহ উনি যেন কোনোভাবেই এই কথা না জানে আল্লাহ! আমিন, আমিন, আমিন, ছুম্মা আমিন!
— তোরা দুটো ফারিশকে এতো ভয় পাস কেন বলতো? সে কি বাঘ যে তোদের খেয়ে ফেলবে..?
মুসকান আর ফাইজা কে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলল রিশাদ।
ফাইজা মুখ বেঁকিয়ে বলল,
— ভাইয়ার হাতে ঘু’ষি খেয়ে তো নিজেই চিৎপটাং হয়ে গিয়েছিলে আবার আমাদের বলছো?
— তুমি চুপ করো। মুসকান, আমিতো ভেবেছিলাম তুই অন্তত এই ভীতু টার মতো ফারিশ কে ভয় পাবি না।
— কি বললে তুমি আমি ভীতু ??
রিশাদ চোখ পাকিয়ে তাকায়,
— কথা বলছিতো ওর সাথে?
ফাইজা থেমে গেল। ভাব নিয়ে চুপচাপ কোল্ড কফি খেতে লাগলো।
মুসকান রয়েসয়ে বলল,
— উনার যা রাগ। ভয় না পেয়ে উপায় আছে…
রিশাদ মুচকি হাসলো,

— বেবিরা আসার পর আর এমন থাকবে না।
মুসকান অবাক হলো। এটা কি আসোলেও রিশাদ ভাইয়া। এতো নমনীয় ব্যবহার তাদের রিশাদ ভাইয়া করছে। হঠাৎই ফাইজা কেশে উঠলো। কফি খেতে নিয়ে ভিষম খেয়েছে সে। কাশতে কাশতে তার অবস্থা খারাপ। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। রিশাদকে বড্ড উত্তেজিৎ দেখালো। ফাইজার মাথায় হাত চেপে হালকা চাপড় দিতে লাগল। চোখ গরম করে সমানে শাসাতে লাগল,
— এতো কেয়ারলেস কেন তুমি? সামান্য কফিও খেতে পাড়ো না! নাকে, মুখে, মাথার তালুতে উঠিয়ে কেন খেতে হবে?

ফাইজার কাশি বন্ধ হয়নি। সে এখনো কেশেই যাচ্ছে। রিশাদ চিন্তিত হয়ে দ্রুত ফাইজাকে পানি খাওয়াতে লাগল। পিঠে হাত ভুলিয়ে চুল ঠিক করে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল, ‘ আস্তে, আস্তে খাও ‘
সময় নিয়ে শান্ত হলো ফাইজা। রিশাদ নরম স্বরে বলল,
— ঠিক আছো?
ফাইজা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল।
মুসকান এতোক্ষন ধরে অবাক হয়ে কেবল ফাইজা আর রিশাদকেই দেখে গেলো। এতো পরিবর্তন কি আসোলেও কেউ হয়! মনটা হঠাৎই আনন্দে ফুরফুরে হয়ে গেলো মুসকানের। তাদের দুজনকে একসাথে দেখতেও তার বেশ লাগছে।
ফাইজা ক্ষীণ স্বরে বলল,

— আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি। জামায় কফি পরেছে। পরিষ্কার করতে হবে।
— আমি কি আসবো সাথে?
— না না ভাবি কি একা বসে থাকবে নাকি। তোমরা দু’জনে কথা বলো। আমি এক্ষুনি চলে আসব।
ফাইজা চলে গেল। রিশাদ মুসকানের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে বসলো।
— তুই নাকি আমার সাথে কথা বলতে চাইছিলি? তা কি কথা বল?
আড়চোখে রিশাদের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল মুসকান। এক হাত দিয়ে অপর হাতের তালু কচলাতে কচলাতে বলল,

— তুমি কি আসোলেই ফাইজা কে ভালোবাসো নাকি ওকে ঠকাতে চাচ্ছ রিশাদ ভাইয়া?
রিশাদের নির্বিকার কণ্ঠ ,
— তোর কি মনে হয়?
— আমি তোমার পরিবর্তন হজম করতে পারছি না।
— কেনো? তোর পিছনে পরে থাকলে হজম করতি বুঝি?
মুসকান সাথে সাথে চোখ তুলে তাকাল,
— এসব কি বলছো?
রিশাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
— ভুল কি বলেছি? একসময় তোর পিছনে যেভাবে পড়েছিলাম সেখান থেকে এসব ভাবা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
মুসকান অস্বস্তিতে পরে গেল। শুষ্ক ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করল,
— আমার কথার স্পষ্ট উত্তর দিচ্ছ না কেন? ফাইজা কে কি সত্যিই ভালোবাসো?
শার্টের কলার টেনেটুনে উঁচু করে জবাব দিল রিশাদ,
— এনি ডাউট?
মুসকান কিছু বলতে নিবে তার আগেই রিশাদ আবার বলল,

— এটা ঠিক যে তোকে আমি পছন্দ করতাম। হয়তো এখনও ভালো লাগে । তোর জন্য আমার মনের এক কোনায় একটু হলেও দুর্বলতা আছে। সেটা আমি অস্বীকার করতে পারিনা। কিন্তু তাই বলে আমি ফাইজার ভালোবাসাকেও দূরে ঠেলে দিতে পারিনা। যে মেয়েটা আমার মতো পা’থরের বুকে ফুল ফুটিয়েছে। আমাকে অ*মানুষ থেকে মানুষ হতে সাহায্য করেছে। আমার ভালো মুখোশ টা ভিতর থেকে টেনে সামনে এনেছে। আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে তাকে না ভালোবেসে যাব কোথায়? আমার নিজেকে জোর করে হলেও ফাইজা কে ভালোবাসতে হবে। তোর সাথে আমি অনেক খারাপ আচরণ করেছি যেটার জন্য আমি অনুতপ্ত। মাফ করে দে আমায়।

আমি ফাইজাতে সন্তুষ্ট থাকতে চাই। ওর সাথে ঘর বাঁধতে চাই। ফাইজাই একমাত্র মেয়ে যে আমার অনুভূতি গুলো বুঝে। আমার কষ্ট বুঝে। আমার দুঃখে দুঃখী হয়। আমার হাসিতে হাসে। এমন একটা মেয়েকে আমি কখনোই পায়ে ঠেলে দূরে সরাতে পারবো না। সেটা তোর জামাই, শ্বশুর না মানলেও না। আশা করি তুই তোর উত্তর পেয়ে গেছিস?
মুসকানের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখে চিন্তার রেখা। নিরব দর্শকের মতো কেবল শুনেই গেল রিশাদের কথা গুলো। রিশাদের কথা শুনে যতটুকু বুঝেছে রিশাদ কখনো ফাইজাকে ছাড়বে না। আর ফারিশকে যতটুকু চেনে সে ভুলেও নিজের বোনকে রিশাদের হাতে তুলে দিবে না। ওহ গড কি যে হবে..

— ভাবিইইই…
ফাইজার ডাকে ধ্যান ভাঙে মুসকানের। ফাইজা দ্রুত এসে মুসকানের সামনে ফোন তাক করে বলে,
— ভাইয়া কন্টিনিউয়াস কল করে যাচ্ছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ওইয়ার টু লেট ভাবি। এখনি বাসায় যেতে হবে। জলদি উঠো।
মুসকান চিন্তিত স্বরে বলল,
— আমার ফোন কোথায়? নিশ্চয়ই আমাকে কল দিয়ে না পেয়ে তোমাকে কল করছে!
— তোমার ফোন তো গাড়িতে ব্যাগের ভেতর।
— কি বলো? এখন কি হবে?
— যা হবে পরে দেখা যাবে ভাবি। এখন জলদি চলো ভাইয়া নাহলে এখানেই এসে যাবে।
মুসকান আর ফাইজা হন্তদন্ত হয়ে চলে যেতে নিলে রিশাদ পিছু ডাকে,,

— তোরা দুটো আবার ওই হি’টলারের ভয়ে পালাচ্ছিস? এমন ভাবে যাচ্ছিস মনে হয় আ’জরাইল আসছে এখনি জান কবজ করবে। আরে আমি অধমের দিকে ওতো একটু খেয়াল কর।
— তুমি আবার আমার ভাইয়াকে হি’টলার বললে (রেগে)
রিশাদ ফাইজার কথায় পাত্তা দিল না। মুসকানের সামনে এসে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ২৯

— বাড়ি গিয়ে স্বামীর মাথায় ভালো করে তেল মালিশ করিস। কিছুদিনের মধ্যে খুব বড়সড় শক খেতে যাচ্ছে,,,আগে থেকে মাথাটা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। আর পারলে আমার কিছু গুণগানও করিস। যেন তোর জামাই কে পটাতে একটু সুবিধা হয়। ব্যাটা তো সহজে পটবে বলে মনে হচ্ছে না…

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৩১