তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৬
অহনা আক্তার
চলে গেছে ফারিশের বন্ধুরা। মুসকান আর লজ্জায় তাদের সামনে আসেনি। বিকেলের দিকে ফারিশকে ইমারজেন্সি ফোন দিয়ে বাড়িতে আনেন তাজমহল। ফারিশ নিজের কাজে বেড়িয়ে গিয়েছিল বন্ধুদের বিধায় দিয়েই। কিন্তু মায়ের ফোন কলে আবার ফিরে আসতে হলো। বাড়িতে ঢুকতেই ফারিশ মুসকান আর ফাইজা কে রেডি হয়ে সোফায় বসে থাকতে দেখে। তাজমহল আর ফাইজা মিলে জোর করে মুসকান কে রেডি করেছে। ফারিশকে দেখেই তাজমহল তার দিকে এগিয়ে আসে। মায়ের দিকে তাকিয়ে রাশভারী স্বরে বলে ফারিশ,
— কি হয়েছে মা? এভাবে কেন ডেকে আনিয়েছো আমায়? জানো আমি কাজে গেলে খুব ব্যস্ত থাকি। এর পরেও এভাবে ইমারজেন্সি তলব করার কোনো মানে হয়?
তাজমহল ছেলের কথায় খুবই বিরক্ত হলেন,
— দরকার না হলে তো তোমায় এভাবে ডেকে আনতাম না আমি। বারবার বলেছিলাম বিকেলের মধ্যে চলে এসো মুসকান কে নিয়ে শপিং এ যেতে হবে। অথচ সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তুমি আসছই না। মেয়েটা বাড়ির নতুন বউ কিন্তু তার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো শপিংই করা হলো না। একটাও শাড়ি কেনা হলো না। কয়েকদিন বাদেই তোমার নানিজান মুসকানকে দেখতে আসবে। তুমিতো জানো তোমার নানিজান কি রকম মানুষ? পুরনো নিয়মকানুনে আবদ্ধ তিনি। নাতবউ কে শাড়িতে না দেখে কে জানে কতো বারোহাজারি শুরু করবেন আম্মাজান। তাছাড়া মুসকানের কতো যাবতীয় জিনিস ওতো কেনা বাকি….
— তো এতো দরকার যখন তোমরাই চলে যেতে ওকে নিয়ে শপিং এ। আমার সাথে যাওয়ার কি দরকার? তাছাড়া আমার এইসব মেয়েদের জিনিস সম্মন্ধে কোনো আইডিয়া নেই।
— তোমার আইডিয়া থাকতে তো বলিনি আমি । মুসকান আর ফাইজা কে নিয়ে গেলেই চলবে। মুসকানের যা যা লাগবে সে নিজে পছন্দ করে নিবে। আর না পারলে ফাইজাতো আছেই সেই সিলেক্ট করে দিবে। তুমিতো জানো তোমার বোন কেনাকাটায় কতটা এক্সপার্ট।
ফারিশ তিক্ত কণ্ঠে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— এরজন্য তুমি আমার কাজ রেখে এভাবে…
ফারিশের বাক্য শেষ না হতেই তাজমহলের কর্কশ সুর ভেসে উঠে,
— কি এমন কাজ কাজ কর সারাদিন ? বিয়ে করেছো বউয়ের খেয়াল রাখতে শিখো! ওকে সময় দাও!
— বিয়ে আমি করিনি তোমারা জোর করে করিয়েছো ভুলে যাও কেন বারবার।
মুসকানের নিজেকে নিয়ে তাদের মা ছেলের মধ্যে কথা-কাটাকাটি দেখতে আর ভালো লাগছে না। তাই সে ধীর আওয়াজে বলল,
— থাকনা বড়চাচি আমার শপিং এরতো কোনো প্রয়োজন নেই।
মুসকানের গলা শুনে ফারিশ শান্ত চোখে একবার তার দিকে তাকালো। নীল গাউনে মাথায় ঘুমটা টেনে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। শরীরের সাথে জামার কালারটা পুরো ফুটে উঠেছে। কী সুন্দর দেখতে লাগছে। ফারিশ আর কথা বাড়ায় না। তাজমহল কে উদ্দেশ্য করে বলে,
— আমি বাইরে আছি ওদের আসতে বলো। এই বলে সে গটগট পায়ে বাহিরের দিকে চলে যায়।
তাজমহল মুসকানের কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে মুচকি হেসে বলেন,
— যাও। ফারিশ বাইরে ওয়েট করছে। বরের পকেট খালাস করে ফিরবে আজ। যা ইচ্ছে হয় যেটা ভালো লাগে সেটাই কিনবে। কোনো দ্বিধা করবে না। আর সব সময় ফাইজা আর ফারিশের পাশাপাশি থাকবে কেমন। মুসকান মাথা নাড়ায়।
তাজমহল ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলেন,
— ওকে সবসময় তোমাদের সাথে সাথে রাখবে। একা ছাড়বে না। মেয়েটা শহরে নতুন। এসব বড়বড় শপিং মল সম্পর্কে ওর তেমন ধারণা নেই।
ফাইজা দ্রুত উত্তর দেয়,
— আরে রাখবো রাখবো। তোমার পুত্রবধূর হাত দরকার পড়লে শিকল দিয়ে সাথে বেধে রাখব। এখন আসি ভাইয়া বাইরে ওয়েট করছে কখন থেকে। লেট করলে আবার ধমকানো শুরু করবে। এই বলে ফাইজা মুসকানের হাত ধরে টেনে বাইরের দিকে ছোট লাগালো। তাজমহল উচ্চস্বরে বলছে, ‘সাবধানে’!
গাড়ির সামনে এসে ফাইজা মুসকানকে সমানে ঠেলে যাচ্ছে ফারিশের পাশে বসার জন্য। কিন্তু মুসকান কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। তার এই গাড়িতে যেতেই ইচ্ছে করছে। গাড়ির গন্ধে কেমন মাথা ঘোরে, ব’মি পায়। ফারিশ ড্রাইভিং সিটে বসে তটস্থ ভঙ্গিতে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে ঘোর বিরাগ।
ফাইজার ঠেলাঠেলিতে মুসকান তার দিকে অসহায় চোখে তাকালো। থেমে থেমে বলল,
— আমি গাড়িতে যাব না ফাইজা।
ফারিশ আর ধৈর্য্য ধরে বসে থাকতে পারলো না। অধৈর্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পরলো। মুসকানের সামনে এসে একপ্রকার ধমকিয়ে বলল,
— এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার? গাড়িতে যাবেনা তো কি উড়ে যাবে? কখন থেকে দেখছি তামাশা করে যাচ্ছ! আমাকে তোমার শ্বশুরের মতো অবলা ভাববে না যে তোমার জন্য ঢ্যাংঢ্যাং করে রিকশায় চরে বেড়াবো। তোমার বর নিজের গাড়ি ছাড়া চলতে পারেনা। আর এখন থেকে তোমাকেও গাড়িতে চরার অভ্যাস করে নিতে হবে। ‘এখন, কোনোরকম ‘পে’…’পো’ করা ছাড়া চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসো!
ফারিশের ধমক খেয়ে মুসকানের জান যায় যায় অবস্থা। তার ছোট খাটো কলিজা কি এতো বড় পুরুষের ধমক নিতে পারে। তার উপর আবার বলছে সে নাকি পে’পো করে। আচ্ছা এইলোক টা এমন কেন? ভয়ে মুসকান দ্রুত গাড়িতে উঠে বসল।
ফাইজাকে নিজেদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারিশ তাকেও ধমক দিল,,
— তোকে কি এবার ইনভাইটেশন দিয়ে গাড়িতে ওঠাতে হবে।
ফাইজা ভয়ে ভয়ে বলল,
— ও..ওঠছি তো।
সেও দ্রুত গাড়িতে ওঠে বসে। ফারিশ গাড়িতে বসা মাত্রই গাড়ির ওইনডো বন্ধ করে এসিটা ছেড়ে দিল। এই ঠান্ডার মঝেও ঘেমে গেছে সে। একেতো গাড়ির গন্ধ তার উপর জানালাও বন্ধ। এখন আবার ছেড়েছে এসি। এসির গন্ধে মুসকানের নাড়িভুড়ি সব উল্টে আসার উপক্রম। সে দ্রুত ওড়না দিয়ে নাক-মুখ চেপে ধরে বসে রইল। ব’মি করে দিলে পরবে আরেক ফ্যাসাদে…
শপিং মলে এসে মুসকানের চোখ পুরো কপালে। সে ফাইজার হাত চেপে চারপাশটা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। তাদের গ্রামের হাটেতো কখনো এতো আলোকরশ্মির মেলা দেখেনি সে। সেখানের স্টল গুলোও খুব ছোট ছোট। আর এখানে….
এতোবড় শপিং মলে ফাইজা আর ফারিশ কোন দিকে ঢুকে কোন দিক দিয়ে চলে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না মুসকান। সে কেবল তাদের দুই ভাইবোনের পিছু পিছু বোকার মতো হেটে যাচ্ছে। এখানে তাকে ফেলে গেলে হয়তো কাশ্মিন কালেও বাড়ি ফিরতে পারবে না মুসকান । বাড়িতো দূর এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তাই খোঁজে পাবেনা সে। চলন্ত লিফটের কাছে আসতেই ফাইজার হাত শক্ত করে চেপে ধরল মুসকান। ভয়ে সামনে পা বাড়াতে চাইছে না কোনোভাবেই। ফাইজা আশ্বাস দিয়ে বলছে কিছু হবেনা, এটাতে ভয়ের কিছুই নেই, একবার উঠলেই ভয় কেটে যাবে। কিন্তু মুসকান সাহস পাচ্ছে না। এক পা বাড়াতে নিলেই আবার পিছিয়ে ফেলছে। সেইদিকে তাকিয়ে ফারিশ নিজেই এসে মুসকানের হাত আঁকড়ে ধরল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কেঁপে উঠলো মুসকান। ফারিশের কোনো ভাবাবেগ হলো না। সে নিজের মতো করে ফাইজাকে বলছে,
— তুই যাহ আমি দেখছি।
ভাইয়ের কথায় সেকেন্ডের মধ্যে লিফট বেয়ে উপরে উঠে পড়ল ফাইজা। ফারিশ এবার মুসকানের অনেকটা কাছে এসে গম্ভীর স্বরে বলল,
— ‘তুমি কি যেতে পারবে নাকি কোলে করে নিয়ে যাব!’
ফারিশের গম্ভীর গলায় অস্বাভাবিক কথা শুনে মুসকানের পেট মুচড়ে উঠলো। লজ্জায় কান দুটো গরম হয়ে গেল সাথে সাথে। চোখ খিঁচে বিসমিল্লাহ বলে কোনোরকমে সিঁড়িতে পা রাখল সে। ভয়ে চিল্লিয়ে ফারিশের হাতসহ টিশার্ট খামচে ধরল। সব রকম দোয়া দরুদ পরে ফেলছে ইতি মধ্যে। ঠোঁটে দাঁত চেপে মৃদু হাসলো ফারিশ। খুব সাবধানে মুসকানকে নিজের দিকে আগলে নিল। ফাইজার হাসির শব্দে চোখ খুলল মুসকান। চারপাশে তাকিয়ে চুপসে যাওয়া ভয়েসে বলল,
— এসে পরেছি?
ফাইজা হেসে মুসকানের গাল টেনে দিয়ে বলল,
— ইউ আর সো কিউট ভাবি!
গালে হাত রেখে অবাক হয়ে ফাইজার কান্ড দেখে যাচ্ছে মুসকান। একের পর এক জিনিস সে কিনে যাচ্ছে মুসকানের জন্য। যেটাই ভালো লাগছে সেটাই ফারিশকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে ভাইয়া এটা নেই। ফারিশও কি সুন্দর মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে দিচ্ছে। মুসকান বারবার ফাইজাকে বারণ করছে এতো কিছু না নিতে তার এতো জিনিসের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু ফাইজা কথাই শুনছে না। তার শাশুড়ী বলে দিয়েছে সে যেন আজ বরের পকেট খালাস করে ফিরে। সে কি খালাস করবে তার বরতো নিজেই নিজের পকেট খালাস করে ফেলছে শপিং করে করে। এতো দামিদামি জিনিস নেওয়ার কোনো মানে হয়।
ফোনে কল আসায় মুসকানদের রেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ফারিশ। দূর থেকে এক নজরে তাকিয়ে আছে মুসকান ফারিশের দিকে। না চাইতেও চোখ চলে যাচ্ছে বারবার। লোকটা সুদর্শন। অতিব সুদর্শন। কথা বলার স্টাইল টাও সুন্দর। এইযে খানিকক্ষণ বাদে বাদে হাত দিয়ে চুল গুলো উঁচু করে ধরছে, টুকরো আওয়াজে কথা বলছে, কথার ফাঁকে ফাঁকে মৃদু হাসছে এই স্টাইল গুলোও চমৎকার। কালো টিশার্ট টা গায়ের সাথে মিশে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে লোকটাকে। এমন নয় যে মুসকান ফারিশকে আগে কখনো দেখেনি। সে দেখেছে। ফারিশের বহু ছবি দেখিয়েছে রাতুল তাকে। তখন ছবি গুলো দেখে তার মনে ভালোলাগা বা অন্য কিছুই সৃষ্টি হয়নি যেটা এখন হচ্ছে। হয়তো স্বামী বলে। মুসকানের তাকানোর মাঝেই হঠাৎ কোথ থেকে যেন একটা মেয়ে এসে ফারিশকে জড়িয়ে ধরলো। আচমকা কেউ জাপটে ধরায় ফারিশ চমকে ওঠলো। মেয়েটাকে নিজের থেকে ছুটিয়ে ধমক দিতে যাবে তার আগেই মেয়েটার চেহারা দেখে থমকে গেল,,,
— হিয়া তুইইই !!!
হিয়া কাঁদতে কাঁদতে ফারিশকে আবারও জড়িয়ে ধরলো। ফারিশ ছুটাতে চাইছে কিন্তু হিয়া ছাড়ছে না। সে শক্ত করে ফারিশকে জাপটে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। মুসকান দূর থেকে খেয়াল করছে মেয়েটাকে। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরা মেয়েটি দেখতে যতটা সুন্দর ততটাই স্মার্ট। কিন্তু নিজের স্বামী কে এভাবে জড়িয়ে ধরায় মোটেও ভালো লাগছে মুসকানের। শপিং মলের মতো এমন একটা জনমানব সমূহ স্থানে বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটূ। ফারিশ মুসকানদের দিকে তাকালে দেখতে পায় ফাইজা আর মুসকান তাদের দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শুধু ফাইজা আর মুসকান না আশেপাশের অনেকেই তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ফাইজা বিড়বিড়িয়ে বলছে,,
— এ আবার এতোদিন বাদে কোথ থেকে উদয় হলো!
ফারিশ শরীরের বেগে হিয়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে জোরে ধমক দিল,
— এসব কি অসভ্যতা শুরু করেছিস পাবলিক প্লেসে?
এটা তোর অস্ট্রেলিয়ার রাস্তা পেয়েছিস যে যখন যেভাবে ইচ্ছে যাকে তাকে এসে জড়িয়ে ধরবি?’
হিয়া অবাক হয়ে বলল,
— তুই এভাবে কথা বলছিস কেন আমার সাথে? দু’টো বছর পর আমাদের দেখা হয়েছে আর সেখানে তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস?
— আর কিভাবে কথা বলব তোর সাথে? চলে গিয়েছিলি না! আবার এসেছিস কেন ? খবরদার আমার সাথে জাপটাজাপটি করতে এসেছিস তো! আমার সাইডে ফাইডেও যেন তোর ছায়া না দেখি !! ফাইজার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বলে,
— তোদের হয়েছে নাকি আরো বাকি আছে?
ফাইজা তুতলিয়ে বলল,
— জি…জ্বি ভাইয়া হ..হয়েছে!
ফারিশ চড়া গলায় বলল,
তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৫
— চুপচাপ মুসকানকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসবি। আমি বিল প্রে করে আসছি।
ফাইজা আচ্ছা বলে মুসকানের হাত ধরে গাড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো। মুসকান যেতে যেতে বারবার পিছন ঘুরে মেয়েটাকে দেখছে। তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ”মেয়েটি কে?”