তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৭

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৭
অহনা আক্তার

বাইরে এসে ফাইজার কাছ থেকে মেয়েটার সম্পর্কে সবই জানতে পারলো মুসকান। হিয়া মেয়েটি একসময় তার স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকা ছিল । তার চেয়েও বড়কথা সে ফারিশদের খুবই ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল। একই সাথে কলেজ লাইফ, ভার্সিটি লাইফ পার করেছে তারা। একসময় মেয়েটা নাকি ফারিশ বলতে পা’গল ছিলো। রমিজ আর নিহানের মতো ফারিশ নিজের বান্ধুবিকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পছন্দ না করলেও হিয়ার পা’গলামোতে করতে বাধ্য হয়। হিয়ার সাথে রিলেশনে যাওয়ার পর হিয়ার স্বভাব দিনদিন পরিবর্তন হতে থাকে। সে ফারিশকে কারো সাথে মিশতে দিত না। কোনো বান্ধুবিদের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে দেখলে রে’গে যেত ।

শ্যামা, টয়া, তন্নি অন্যান্য ফ্রেন্ডদের সাথে সামান্য কথা বলতে দেখলেই ঝ’গড়া শুরু করত। হিয়া চাইত ফারিশ কেবল তার সাথেই মিশবে। তাকে সময় দিবে, তাকে ভালোবাসবে। দিনদিন হিয়ার এই সা’ইকো বিহেভে ফারিশ অতিষ্ঠ হয়ে পরছিল। কিন্তু তবুও সে মেনে নিত। সে ভেবে নিত মেয়েটি তাকে অনেক ভালোবাসে বলেই হয়তো এমন করছে। রিলেশন চলা কালীন হিয়া বহুবার ফারিশদের বাড়িতে এসেছে। সেই হিসেবে ফাইজা আর তাজমহল হিয়া কে ভালো করেই চিনে। ভাইয়ের বউ হিসেবে হিয়াকে একদমই পছন্দ ছিল না ফাইজার। আর না ছিল তাজমহলের ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ। তবুও ছেলের জন্য এই মেয়েকেই বউ করতে রাজি হন তাজমহল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধায় হিয়ার বাবা সাইদ মাহমুদ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তিনি চান ফারিশ যেন উনার মেয়েকে বিয়ে করে উনাদের সাথে অস্ট্রেলিয়া সেটেল্ড হয়ে যায় একেবারের জন্য। এই কথা শুনেতো তাজমহলের মাথায় আকাশ ভে’ঙে পরে। কতোবড় সাহস উনার একমাত্র ছেলেকে তাদের থেকে আলাদা করে দিতে চায়। এই মেয়ে বিয়ের আগেই উনার ছেলেকে নিজের আয়ত্তে করে নিতে চাইছে বিয়ের পরে কি করবে। এর সাথে বিয়ে হলে ছেলেকে চিরতরে হারাতে হবে এটা তাজমহল বুঝে গেছে। যার জন্য তাজমহল কিছুতেই হিয়ার সাথে ফারিশের বিয়েটা হোক এটা চাইতেন না। হিয়া তার বাবার কথায় তাল মিলিয়ে ফারিশকে বিভিন্ন ভাবে কনভিন্স করার চেষ্টা করে। কেঁদেকেটে ফারিশের হাত-পা ধরে ফারিশকে তাদের সাথে অস্ট্রেলিয়া সেটেল্ড হওয়ার জন্য অনুরোধ করে ।

কিন্তু ফারিশ রাজি হয় না। সে নিজের বাবা-মা, পরিবার, বন্ধুবান্ধব রেখে কিছুতেই দূর কান্ট্রিতে যাবে না। ফারিশ হিয়াকে কড়াকড়ি ভাবে জানিয়ে দেয়, সে যদি ফারিশকে বিয়ে করতে চায় তাহলে তার সাথে এদেশেই থাকতে হবে। কিন্তু হিয়ার চোখে তখন পট্টি বাঁধা ছিল। সে তার বাবার কথা মতোই চলে। সে ভাবে ফারিশ তাকে ভালোবেসে তার সাথেই অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে। সেখানে ফারিশ একান্তই তার হবে। না থাকবে কোনো বন্ধুবান্ধব আর না থাকবে কোনো পরিবার। ফারিশের পরিবার শুধুই হিয়া থাকবে। শুধুমাত্র হিয়া।

কিন্তু হিয়া কোনোভাবে ফারিশকে রাজি করাতে না পারায় সে ফারিশের সাথে প্রচুর কথা কা’টাকা’টি করে। রাগের মাথায় ফারিশের চরিত্র ফারিশের বাবা-মায়ের চরিত্র তুলে কথা বলে। তাদের গা’লি দেয়। যা ফারিশ মেনে নিতে পারেনি। নিজেকে নিয়ে সব স’হ্য করবে ফারিশ কিন্তু নিজের বাবা-মাকে নিয়ে না। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় হিয়ার বাবা সাইদ মাহমুদ । সে নিজের মেয়েকে বিভিন্ন ভাবে বুঝায় যে ফারিশ তাকে ভালোবাসেনা। ভালোবাসলে সব ছেড়ে তার সাথে যেতে অবশ্যই রাজি হতো। হিয়া নিজের বাবার কথা বিশ্বাস করে। ফারিশের সাথে ব্রেকআপ করে চলে যায় অস্ট্রেলিয়া। সাইদ চৌধুরীর ঠোঁটে তখন বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে। তিনি চাইছিল নিজের বন্ধুর ছেলের সাথে হিয়াকে বিয়ে দিতে। অস্ট্রেলিয়াতে তার বন্ধুর পুরো পরিবার থাকে । তিনিও মেয়েকে নিয়ে সেখানেই থাকতে চান….

ফাইজার কাছ থেকে সব জানতে পেরে মুসকানের মন খারাপ হয়ে যায়। তার স্বামী অন্য একটা মেয়েকে ভালোবাসত এটা তার শুনতে ভালো লাগছে না। বাড়িতে এসে মুসকান কারো সাথে কোনো কথা না বলে ফারিশের রুমে ঢুকে যায় । তাজমহল মুসকানের মুড অফ দেখে ফাইজাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? ফাইজা শপিং মলে হয়ে যাওয়া সব ঘটনা তার মাকে খোলে বলে। সব শুনে তাজমহল চিন্তায় পরে যায়। এই মেয়ে এখনো তার ছেলের পিছে পরে আছে…

নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে খুব রোডলি কথা বলছে ফারিশ। মুসকান ঘুমিয়ে ছিল। ফারিশের চিল্লানোতে লাফিয়ে ওঠে। ঘরে বসে থেকেও ফারিশের চিল্লাচিল্লি স্পষ্ট শুনতে পারছে সে। কাউকে অসম্ভব রেগে ধমকাচ্ছে,
— হিয়া দেশে এসেছে আমাকে জানাসনি কেন?
অপরপাশ থেকে কি বলছে মুসকান কিছুই বুঝতে পারছে না। সে কেবল ফারিশের কথা গুলোই শুনছে…

— আরে ইয়ার পা’গল করে ফেলছে ওহ আমাকে কল দিয়ে দিয়ে! আমার বিয়ে হয়েগেছে বিলিভই করছে না। ব্লক করলে অন্য নাম্বার থেকে ঘুমের টেবলেটের পিক সেন্ড করছে। ব্লক ছুটাতে বলছে। নাহলে নাকি নিজের ক্ষতি করবে। সমানে কান্নাকাটি করছে ইয়ার। বারবার দেখা করতে বলছে। যাবনা বলায় হাতে না’ইফ নিয়ে ফটো সেন্ড করছে। রগ কে’টে ফেলবে বলছে। এটাকে থামা নয়তো আমি নিজেই এর গলা কে’টে দেব। অ’সহ্য মেয়ে মানুষ…
মুসকান ভয়ে বারবার ঢুক গিলছে। কত সাঙ্ঘাতিক এই লোক। প্রাক্তনের গলা কে’টে দিবে বলছে।
বন্ধুদের সাথে চিল্লাচিল্লি করে ঘরে এসে হাতের ফোন বিছানায় ছুড়ে মারল ফারিশ। এটা দেখে মুসকান আরেকটু গুটিয়ে বসল। ফারিশ বিছানায় বসে কপালের দিকের চুল টেনে চোখ বুঝে আছে। বেশ কিছুক্ষণ চলে যাওয়ার পর মুসকান ভীত আওয়াজে বলল,

— আপনার কী মাথা ব্যাথা করছে? ঔষধ লাগিয়ে দিবো?
ফারিশ চোখ লাল করে তাকায় মুসকানের দিকে। রাগী কণ্ঠে বলে,
— তোমাকে কনসার্ন দেখাতে বলেছি আমি?
মুসকান নিচু স্বরে বলল,
— না আ..পনাকে দেখে মনে হলো আপনার মাথা ব্যাথা করছে!
— তো, তাতে তোমার কী?
মুসকান মিনমিনিয়ে বলল,
— আপনি অন্যের রাগ আমার উপর ঝাড়ছেন কেন?
রেগে এক ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল ফারিশ। ঠিকই তো। হিয়ার রাগ সে এই মেয়েটার উপর কেন ঝাড়ছে ! গলার স্বর স্থির করে শান্ত ভাবেই বলল ফারিশ,

— ইয়াহ মাথায় প্রচন্ড পে’ইন হচ্ছে। একটু টিপে দিলে ভালো হতো।
মুসকান খুশি হয়ে পা দুটো আসন বেঁধে বসে। ফারিশকে ডেকে বলে,
— আসুন এখানে শুয়ে পরুন আমি খুব সুন্দর করে আপনার মাথা টিপে দিব। দেখবেন আপনার মাথা ব্যা’থা একদম গায়েব হয়ে যাবে।
ফারিশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়,
— এখানে?

— হ্যা এখানেই তো শুবেন। কোলে না শুলে মাথা টিপবো কি করে? আব্বা ওতো আমার কোলেই মাথা রেখে শুতো আর আমি খুব যত্ন করে আব্বার মাথা টিপে দিতাম। আব্বা কি বলতো জানেন? আমার হাতে নাকি যাদু আছে। আমি মাথা টিপে দিলে নাকি ওনার ঘুম চলে আসে। বাবার কথা মনে পরতেই মুসকানের চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। এই কেঁদে দিবে এইরকম। ফারিশ মুসকানের চোখে পানি দেখে বুঝতে পারে মেয়েটার তার বাবার কথা মনে পরে গেছে। যার জন্য সে দ্রুতই উত্তর দেয়,
— আচ্ছা আচ্ছা এখানেই শুচ্ছি আমি। টিপে দাও।
মুসকানের কোলে মাথা রেখে চোখ বুঝে নেয় ফারিশ। মা ছাড়া এই প্রথম কারো কোলে শুয়েছে সে। একটু অন্যরকম লাগছে কিন্তু ভালো লাগছে।
মুসকানের বুকের ভিতর ধকধক করছে। তার হার্টবিট বেড়ে গেছে। সে নিজের হাত জোড়া অবিলম্বে ফারিশের মাথায় রাখল। আস্তে করে টিপে দিতে লাগল। ধীরে ধীরে ফারিশের চুলেও হাত বুলাতে লাগল। হালকা করে টেনে দিতে লাগল। মনে মনে বলছে, ‘ওনার চুল গুলোও কতো সফট’।

মুসকানের হাতের ছুঁয়ায় ঘুম চলে এসেছে ফারিশের। আর এদিকে মুসকানের হাতসহ পা ও ঝিমঝিম করছে। প্রায় তিন ঘন্টা ধরে এভাবেই বসে সে। কিছুক্ষণ পর ভোর হয়ে যাবে। অথচ লোকটা না উঠছে আর না তাকে ছাড়তে বলছে। কখন থেকে ফারিশের ফোনও বেজে যাচ্ছে। মুসকান ফারিশকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। সে নিজেই হাত বাড়িয়ে ফারিশের ফোনটা হাতে নিল। স্কিনে তাকিয়ে দেখে হিয়া ফোন করছে তাও আবার ভিডিও কল। বারান্দায় হিয়াকে নিয়ে বলা ফারিশের প্রতিটি কথাই শুনেছে মুসকান। মাথার ঘুমটাটা একটু টেনে টুনে ঠিক করে সে নিজেই কল রিসিভ করল। ফোনের অপর পাশ থেকে হিয়াকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । চুলটুলের অবস্থা জ’ঘন্য। গায়ে ওড়না নেই। হাতে ছু*রি নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভেবেছিলো ফারিশ কল রিসিভ করেছে। কিন্তু অপর পাশে একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে গর্জিয়ে উঠল,,

— এইই মেয়ে তুমি কে ? ফারিশের কল তুমি রিসিভ করেছো কেন? ফারিশ কোথায় ??
মুসকান নরম আওয়াজে বলল,
— আপনি রাতবিরেতে আমার স্বামীকে কল দিয়ে ডিস্টার্ব কেন করছেন আন্টি?
— হোয়াট আন্টি !! হু দ্যা হ্যাল আর ইউ বি*চ? তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে আন্টি ডাকার?
মুসকানের চোখ বড়সড় হয়ে যায়। তাকে গালি দিচ্ছে তাকে !! এই মেয়েকেতো সে একদমই রফাদফা করে ফেলতো যদি সে তার স্বামীর প্রাক্তন প্রেমিকা না হতো। অন্যের স্বামীকে ওড়না ছাড়া ভিডিও কল দেওয়া হচ্ছে নি’র্লজ্জ মেয়ে কোথাকার! ইচ্ছে করছে তাদের স্কুলের প’চা নর্দমাটায় নিয়ে গিয়ে একে চুবিয়ে আনতে। সে গলাটা ঝেড়ে রয়েসয়ে বলল,

— আপনাকে দেখে আমার আন্টির সমান মনে হলে আমি কি করব?
হিয়া তেতে উঠে বলল,
— ওহহ জাস্ট স্টপ ইট! ফারিশ কোথায়? ওকে ফোন দাও আমি কথা বলব ওর সাথে।
— আপনি যাকে খোঁজছেন সে এখন তার বউয়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে ব্যস্ত। দয়াকরে আমার স্বামীকে ডি’স্টার্ব করা বন্ধ করে দিন।
হিয়া চিল্লিয়ে বলল,
— এই মেয়ে কে তোমার স্বামী? ফারিশ শুধু আমার। আমি বিশ্বাস করিনা ফারিশ আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে।
মুসকান মুখটাকে অসহায় বানিয়ে বলল,

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৬

— আপনি বিশ্বাস না করলে আমার কি করার আছে আন্টি ? তিনি সত্যিই এখন আমার কোলে ঘুমাচ্ছে! এই দেখুন। মুসকান ক্যামেরাটা ঘুরিয়ে ফারিশের দিকে ধরল। সাথে সে ফারিশের চুলেও হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যা দেখে হিয়া জোরে ফোন আ’ছার মা’রে। চিৎকার করে রুমের সমস্ত জিনিসপত্র ভা’ঙতে শুরু করে,
— নো নো নো ফারিশ কিছুতেই অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারেনা কিছুতেই না।
মুসকান কল রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফারিশ ভাইয়া প্রেম করার জন্য আর কোনো মেয়ে পেল না। এই মে’ন্টালকেই কেন….

তোমার মুগ্ধতায় পর্ব ৮