তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৪৭+৪৮

তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৪৭+৪৮
শান্তনা আক্তার

‘তুই যা করবি ফাস্ট কর স্রুতি। নইলে তোর জন্য আমিও ফেঁসে যেতে পারি। ধুর আমার তোর কথায় রাজী হওয়াই উচিত হয়নি।’
জ্ঞানহীন রিমির অসাড় শরীরের পাশ দিয়ে বসে আছে স্রুতি। এক ধ্যানে অনেকক্ষণ যাবৎ সে রিমিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে অনবরত। আচমকাই সে আঙুল দিয়ে আস্তে আস্তে রিমির মুখে স্লাইড করতে করতে বলল, ‘দাঁড়া না তোহা। শত্রুকে কি এত সহজে মেরে ফেললে শরীরের ক্ষোভ যায়? আই মিন, শত্রুর সহজ মৃত্যু তৃপ্তির বিশাল চূড়ায় নিয়ে যায় না। এর জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও ধৈর্য লাগে।
‘তুই পরিকল্পনা কর, আমি পালাই। আমি স্পষ্ট বুঝে গিয়েছি। তুই মরবি সিওর, তবে আমাকে নিয়ে। মাফ চাই তোর কাছে। আমাকে প্রাণে বাঁচতে দে।’

‘তোকে নিয়ে আর পারলাম না! ঠিক আছে তাড়াতাড়ি করছি। কিন্তু কিভাবে মারি বলতো আমার সতীন টাকে? কিভাবে মারলে ও একটু একটু করে কষ্ট পেয়ে মরবে?’
‘আমি তো বললামই শরীর থেকে গলা আলাদা করে ফেল। এটাই সহজ ও ভয়ংকর মৃত্যু।’
‘তোহা! তুই কি পাগল নাকি? এভাবে আমাদের ধরা পড়ার চান্স থাকবে। কারণ রিমির লাশ নিয়ে বাহিরে বের হওয়া যাবে না কোনভাবেই। এমন কিছু করতে হবে যাতে রিমির লাশ কেউ কখনো খুঁজেই না পায়।’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমরা তো ম্যাজিক জানি তাইনা? যেভাবে বলছিস ম্যাজিক করে যেন রিমির শরীর ইনভিসিবল করে ফেলব। হোয়াট এ ফানি জোক! হাস্যকর।’
তোহা রীতিমতো রাগে ফোঁসফোঁস করছে।
‘ম্যাজিক জানি না, তবে একটা কাজ করা যায়।’
‘কি? যা করার খুব তাড়াতাড়ি কর।’ তোহা বলল।
‘আগে তুই বেলকনিতে গিয়ে দেখ নিচে কি কি দেখা যাচ্ছে।’
‘তুই যদি এখানকার সৌন্দর্যই দেখতে আসিস, তাহলে রিমিকে খামখা কিডন্যাপ কেন করলি?’
স্রুতি গাঢ় গলায় বলল,

‘যা বলেছি তাই কর।’
তোহা বেলকনিতে গিয়ে নিচের দিকে চোখ বুলিয়ে আবারও আগের জায়গায় ফিরে আসে। তারপর বলে, ‘কিছু লোকজন আছে।’ কিন্তু কেন?’
‘তোকে দিয়ে কিছুই হবে না। আমিই দেখছি। বলে স্রুতিও দেখতে গেল। সাথে আরেকটা বেলকনিও দেখে নিল। এরপর ফিরে এসে বলল, ‘নাহ! সামনের টা দিয়ে হবে না। পেছনের বেলকনিটা কাজে লাগবে যদি আমার পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে চাই তাহলে।’

‘তুই কি আমাকে পরিষ্কার করে বলবি না স্রুতি? যদি না বলিস তাহলে থ্যাংকস। আমি গেলাম।’
‘তুই গেলে কিভাবে হবে? আমি একা রিমিকে উঁচু করতে পারবো না।’
‘রিমিকে উঁচু করে কি হবে?’ বেশ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করে ফেলল তোহা।
‘ওকে ফেলে দেব বেলকনি দিয়ে। পেছনে ঢাল আছে। সেখান থেকে গড়াগড়ি খেতে খেতে একেবারে পাহাড়ের নিচে। তারপর শেষ আমার পথের কাটা।’ বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে স্রুতি।
তোহা ঢোক গিলে বলে, ‘আমার ভয় করছে রে। আমি নাই খুনখারাবির মধ্যে।’

‘তুই নেই মানে! নগদ দু লক্ষ্য টাকা ক্যাশ দিয়েছি তোকে। এখন পালাতে চাচ্ছিস? আমার টাকা ফেরত দে তুই।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আছি তোর সাথে।’
স্রুতি প্রথমে রিমির দুহাত ধরে ফেলে। তারপর তোহা গিয়ে কাঁপা হাতে রিমির দুই পা শক্তপোক্ত ভাবে ধরে। তারপর অসহায় ভঙ্গিতে বলে, ‘তোর কি একটুও মায়া হচ্ছে না স্রুতি? মানুষ হয়ে আরেকটা মানুষকে মেরে ফেলব আমরা?’

স্রুতি হিংস্র জানোয়ারদের ন্যায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সাথে হুংকার দিয়ে বলে,
‘না মায়া হচ্ছে না আমার। একটুও মায়া হচ্ছে না আমার। কার জন্য হবে? এই মেয়েটার জন্য? যে কিনা আমার এতদিনের গড়া ভালবাসাকে একদিনের সাইক্লোন হয়ে নিজের দখলে নিয়ে নিল? আমি তো ভালো একটা মেয়েই ছিলাম। কখনো আমাকে খারাপ কিছুতে জড়াতে দেখেছিস কি তুই? আমি তো তোর মতো ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়ে পার্টি করি না।

আমি তো কোনো ছেলের সাথে খারাপ সম্পর্কে জড়াইনি। এমনকি কখনো কারো ক্ষতি হোক এমন কিছুই করিনি। আমার সবটা জুড়ে তো আহসান ছিল এবং আছে, থাকবেও। কথা হচ্ছে, আমি ভালো হয়ে তো ওকে পাইনি! তাহলে ভালো থেকে লাভ কি হয়েছে আমার? আমি আজ খারাপ হয়েছি। তুই শুনে রাখ, এই পৃথিবীতে যতরকম খারাপ কাজ আছে আমি করবো। শুধুমাত্র আমার ভালবাসাকে পাওয়ার জন্য। আমি পাগল বুঝলি? আর আমার পাগলামি ততদিন পর্যন্ত থাকবে, যতদিন আমি আমার আহসানকে না পাই। ওকে পেলে আমি সেই আগের ভালো আমিটা হয়ে যাব। সত্যি বলছি। আমি সেই শান্তশিষ্ট মেয়ে হয়ে যাব।’

তোহা চুপচাপ স্রুতির কথাগুলো শুনে গেল। কোনো প্রকার বাঁধা দিল না। এরপর ওরা যখন রিমিকে তোলার প্রচেষ্টা করতে শুরু করে, ঠিক তখনই আহসান রুমের ভেতর ঢুকে গেল। আহসানকে দেখে স্রুতি আর তোহা দুজনেরই শ্বাস নেওয়া মুশকিল হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওরা রিমিকে বিছানায় ফেলেই পালাতে নিল, কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশদের ভীড়ে আটকে পড়ে। এদিকে আহসান আর তিয়াসা রিমিকে দেখে জীবন ফিরে ফেল যেন। আহসান রিমির নার্ভস চেক করে বুঝলো রিমি জীবিত আছে। সাথে সাথে রিমিকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে দিল আহসান।

মেইন পুলিশ অফিসার আহসানকে উদ্দেশ্যে করে বলল, ‘স্যার মহিলাদের বিরুদ্ধে আপনাকে থানায় ডাইরি করতে হবে। সাথে,,,
তাকে থামিয়ে আহসান বলল, ‘আমি সব করছি তবে তার আগে ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে।’ আহসান স্রুতির মুখোমুখি হল। আহসানের চাহনি বলে দিচ্ছে ও কতটা ক্ষিপ্ত। এতটাই ক্ষিপ্ত যে আহসানের সারা শরীর কাঁপছে।

‘তুই এত বড় সাহস কিভাবে পেলি বল? কি করে সাহস হলো আমার রিমির ক্ষতি করার?’
স্রুতি হাতের হ্যান্ডকাফ খোলার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘ক্ষতি আর করলাম কই? জানে মারতে চেয়েছিলাম রিমিকে। আর কয়েক মিনিট পরে আসলে ফেলেই দিতাম বেলকনি দিয়ে। তারপর ওর চিহ্নটুকুও পেতি না তুই।’

আহসান মুষ্টিবদ্ধ করে স্রুতির দিকে এগিয়ে গেলে ওকে একজন পুলিশ থামিয়ে দিল।
আহসান প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বলল, ‘তোকে আমি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছাড়বো দেখিস। এর জন্য যা যা করতে হয় তাই করবো আমি। দরকার পড়লে আত্মীয়তা ভুলে যাব,তাও তোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছাড়বো।’

‘যা করার করিস। কিন্তু আমি এত সহজে মরবো না। তোকে না পেয়ে আমি মরবো না। মরলে তোকে নিয়েই মরবো। তাহলে আর আক্ষেপ থাকবে না আমার। মনে রাখিস আমার কথাটা।
বারাবাড়ি হয়ে যাচ্ছিলো বলে স্রুতি ও তোহাকে নিয়ে যাওয়া হলো সেখান থেকে। সাথে ছদ্মবেশী ওয়েটারসহ যে যে স্রুতির সাথে জড়িত ছিল তাদের সকলকেই আটক করা হলো।

আহসান যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করে রিমির কাছে গেল। গিয়ে দেখল রিমি চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। আহসানকে দেখেই উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো রিমি। আহসান রিমির কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘আমি আছি তো। আমি থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ না।’

মধ্যরাত তাও যেন রিমির কান্নার বেগ কমছে না। এখনো ভয় পাচ্ছে সে। বারবার মনে হচ্ছে আজ সে তার বাবা-মা,বোন, আহসানকে হারিয়ে ফেলতে বসেছিল। এই ভাবনাটাই রিমিকে কোনো ভাবে শান্তি দিচ্ছে না। আহসান বেশ শক্ত করে রিমিকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
‘আর ভয় নেই। স্রুতি আর কোনদিনও আমাদের মাঝে আসবে না। ওকে পর্যাপ্ত শাস্তি দেওয়া হবে। আমি সেই ব্যবস্থাই করবো। ভয় পেওনা লক্ষীটি।’

‘আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না ঘটনাটা। আমার হাত পায়ে শক্তি পাচ্ছি না। আমি মনে জোর পাচ্ছি না। আমাকে বাঁচাও। আমি বাঁচতে চাই। তোমার সাথে জীবন কাটাতে চাই।’
‘বাঁচবে তো। আমি আছি তো। আমরা একসাথে পথ চলবো ইনশাআল্লাহ।’ বলে রিমির এলোমেলো চুলগুলো কানের কাছে গুজে দিল।

‘আবারও যদি স্রুতি চলে আসে আমাদের মাঝে? আমার ভয় কাটছে না কেন? আমি ঘুমোতে পারছি না কেন? আমি একটু শান্তি চাই। আমাকে একটু স্বস্তি এনে দাও দয়া করে।’
‘আমার দিকে তাকাও রিমি। দেখো আমার দিকে। দেখো বলছি।’

রিমি আহসানের দিকে তাকাতেই আহসান আলতো করে রিমির ওষ্ঠদ্বয় নিজের দখলে নিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর রিমি শান্ত হয়ে গিয়ে আহসানের সাথে সায় মেলায়। রিমি তার সমস্ত ভয় কাটিয়ে হারিয়ে যায় প্রিয় মানুষের ভালবাসার আশ্রয়ে। বেঁচে থাকার অদৃশ্য সার্থকতায়। খুঁজে নেয় স্বস্তির নিঃশ্বাস।
একমাত্র ভালবাসাই পারে ভয়কে জয়ে রুপান্তর করতে। সাহায্য করে নতুন ভাবে বাঁচতে। আর! অফুরন্ত মনোবল জোগাতে।

গত রাতের ঘটনা নিয়ে সবাই অত্যন্ত নিরাশ। ভ্রমণের সেই উৎসাহটা আর নেই কারো ভেতর। সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামীকালই ফেরত যাবে সবাই। আহসান থানায় গিয়ে সব ফর্মালিটি পূরণ করে এসেছে। সঙ্গে জিসানও ছিল। জিসান স্রুতিকে ভালো-মন্দ যতটা পেরেছে শুনিয়েছে। যদিও সে স্রুতির থেকে ছোট, তবু্ও দোষীকে ছাড় দিতে সায় দিল না তার মন। ফলে বোন বলেও পরিচয় দিতে মানে লেগেছে তার। এইজন্য কিছু কড়া কথা বলতে বাধ্য হয়েছিল সে।

মুখ ভাড় হয়ে আছে সবার। আহসান রিমির দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে। তাকাতে যেন বাধ্য হচ্ছে। কারণ ধীর-স্থীর রিমিকে দেখতে মোটেও ভাল লাগছে না তার। কারোরই মন বসছে না কিছুতেই। কিভাবে বসবে? দমকা হাওয়ার মতো কি এক মারাত্মক ঘটনাই না ঘটে গেল। একে ঘটনা না বলে অঘটন বললে উপযুক্ত উপমা হবে।

আহসান ধীর গতিতে রিমির কাছে উপস্থিত হলো। রিমির বাহুদ্বয়ে হাত রেখে বলল, ‘মন খারাপ করে কিছুই হবে না। মন খারাপ মানে শুধু শুধু ডিপ্রেশনকে আলিঙ্গণ করা ছাড়া কিছুই নয়। আমার ভালো লাগছে না সকলের এই নিস্তব্ধতা। বিশেষ করে তোমার।’

রিমি মলিন কন্ঠে বলল, ‘কিছু কিছু ঘটনা ভোলা ভারী দুষ্কর। আশ্চর্যজনক তাজাখবর কিছুদিন ভার্চুয়াল কিংবা স্বাভাবিক দুনিয়া হোক, দুই স্থানেই তোলপাড় শুরু করে দেয় কিছু সংখ্যক মানুষদের মাঝে। আর এসব ঘটনা নিস্তেজ হতে সময় নেয়। তাই আমার সাথে ঘটা অঘটনের অবসানের জন্যও সময় লাগবে। আমি পারবো না সহজেই সব ভুলে যেতে। চাইলেও না।’

‘কথা ঠিক। তবে আমার যে এই রিমিকে ভালো লাগে না! আমাকে জ্বালাতন করা, অবাধ্য, বদরাগী মেয়েটা তো এই নিশ্চুপ মেয়েটি নয়। আমি যে আগের চঞ্চল রিমিকে দেখতে চাই।’
‘আমিও চাই। কিন্তু কিভাবে? আমার যে কিছুই ভালো লাগছে না। এখনকার চারিদিকে চোখ বুলালেই কেমন একটা অদেখা ভয় আমাকে গ্রাস করে। আমি থাকবো না এখানে। বাড়ি ফিরে চলো আজই।’
‘অস্থির হয়ো না তুমি। আমি কথা দিলাম আগামীকাল আমরা ফেরত যাচ্ছি। তবে হাসিমুখে যাব। সব প্রকার বিষাদ ফেলে ভালো মুহুর্তটুকু হাসির রেশের সঙ্গে নিয়ে যাব। পারবে না?’

‘কিভাবে পারবো? ইতোমধ্যে বাড়ির সবাই জেনে গিয়েছে স্রুতির কীর্তিকলাপের কথা। আমরা কি জবাব দেব সবাইকে?’
‘সেটা আমি বুঝে নেব। কারো কথা শুনবো না আমি। স্রুতিকে কঠিন শাস্তি না দিয়েই জামিন করালে ও পরবর্তীতে আরও খারাপ কিছুর জন্য সাহস পেয়ে যাবে। রাগের মাথায় বলেছি ফাঁসিতে ঝোলাবো, যাতে ও কিছুটা ভয় পায়। আর ভয় পেয়ে নিজেকে শুধরে নেয়। মিনিমাম ১ বছরের জন্য হলেও ওকে জেলে থাকতে হবে। শুধুমাত্র কুকর্মের প্রায়শ্চিত্তের জন্য। বুঝলে?’

‘১ বছর! বেশি হয়ে গেল না?’
‘না। আমি সকলের থেকে পারমিশন নিয়েই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছি। সবাই চায় স্রুতির একটু ভোগান্তি প্রয়োজন।’

‘আমি কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছি না জানো? আমি স্রুতির মতো এমন পাগল মেয়ে একটাও দেখিনি। ভালবাসা পাওয়ার জন্য মানুষ কতটা নিচে নামতে পারে,স্রুতি তারই বাস্তব প্রমাণ। তবে আমি যদি ওর জায়গায় থাকতাম, তাহলে প্রিয় মানুষটার সুখের জন্য সব ত্যাগ করে নতুন ভাবে বাঁচতাম। জীবন অতি মূল্যবান। এই মূল্যবান জীবনটা অযথা এক তরফা ভালবাসার জন্য বিলিয়ে দেওয়ার মতো বোকামি করতাম না। এটা সরাসরি নির্বোধরাই পারে।’

আহসান রিমির গালে হাত ছুঁইয়ে বলে, ‘ঠিক। আমিও হয়তো তাই করতাম। তবে বোঝে কয়জন বলো?’
‘ঠিক, বোঝে কয়জন? এই না বোঝার ভুলের জন্যই ভুলের মাশুল গুনতে হয় জীবনভর। আমি মানি, কেউ যদি নিজ ইচ্ছেতে আমার কাছে না আসে, তার হাতে পায়ে কেন ধরবো আমি? এতে আমি নিচে নেমে যাচ্ছি। পক্ষান্তরে নিজেকে অপমান করছি। একইভাবে পিছিয়ে যাচ্ছি বাকী প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায়। আমাদের উচিত যেকোনো পরিস্থিতি মেনে খাপ খাইয়ে চলা।’

‘তুমি ঠিক বলেছো রিমি। কিন্তু কিছুই করার নেই! সবার মন-মানসিকতা এক ধাঁচের নয়। যাই হোক, তুমি আর আমি দুজনেই এখন বড়। আর বড় হয়ে ভেঙে পড়লে ছোটরা কি শিখবে আমাদের থেকে? আমরা চেষ্টা করবো হাসির আড়ালে সকলকে ভালো রাখার। ওইযে বললে খাপ খাইয়ে চলার কথা! সেটা করে দেখাও। তাহলে মানবো তুমি বুদ্ধিমতী।’

‘তাইতো? আমি নিজেই নিজের কথার কাছে হেরে কেন যাচ্ছি? না, আমি এসব নিয়ে আর ভাববো না।’
‘দ্যাট’স লাইক অ্যা গুড ওয়াইফ। তো এখন বলো কি করলে তুমি খুশি হবে। আমি তাই করবো। আফটার অল, আমি তোমার আনন্দ দেখতে চাই। অ্যাট এনি কস্ট।’
‘তো চলো যাই কংলাক ঝর্ণা দেখতে।’
‘অফকোর্স, এক্ষুনি বের হবো আমরা।’

কংলাক ঝর্ণার উদ্দেশ্যে সবুজ ঘনঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে হাঁটছে সকলে। বর্তমানে সকলে এমন একটা জায়গার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যেখানে আশেপাশে,সামনে-পেছনে যেদিকেই নজর যাবে শুধু সবুজের সমাহারেই হারাবে। অনিন্দ্য সৌন্দর্যের মধ্যে কংলাক ঝর্ণা আরেকটি অন্যতম নিদর্শন। উঁচু নিঁচু পথ হওয়ায় লাঠিতে ভর করে এগোচ্ছে সবাই। এভাবেই ট্র‍্যাকিং করতে করতে সবাই পৌঁছে গেল কংলাক ঝর্ণার কাছে। সবাই বলতে আহসান,রিমি,জিসান,জান্নাত ও তিয়াসা। রেজওয়ান আসেনি। তার কারণ কদিন রিসোর্টের কাজে মন না দেওয়ায় তাকে কড়া কথা শুনতে হয়েছে রিসোর্টের মালিকের কাছে। তার উপর রাতের ঘটনাটা তো আছেই।

সবাই আবার প্রাণ ফিরে পেল পাহাড়ের গা ঘেঁষে পরন্ত পানির প্রবাহমানের অবিরত খেলা দেখে। একমাত্র জিসান ছাড়া। সে এখনো লজ্জিতবোধ করছে স্রুতির ভয়াবহ কাজটির জন্য। শত হোক স্রুতি তারই রক্তের বোন। এই পর্যন্ত জিসান হিসাব ছাড়া স্যরি উপহার দিয়ে ফেলেছে রিমিকে। ঝর্ণার কাছে গিয়ে আবারও বলল, ‘স্যরি ভাবি। আমি যত ক্ষমা চাইবো কম পড়বে।’
রিমি কানে হাত ঠেসে তিক্ত ভঙ্গিমায় বলল,

‘ভাই তুমি দূর হও আমার থেকে। আমি তো তোমার উপর রেগে নেই যে মাফ করবো! তুমি তো কিছু করোনি। আর এত স্যরি কেন বলছো বলোতো? ভালো লাগছে না শুনতে। আমি সব ভুলে যেতে চাই আর তুমি কিনা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছো আমায়!’
জিসান অপরাধীর ন্যায় হাতজোড় করে বলল, ‘তবুও আমার ভালো লাগছে না। মন থেকে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতে পারছি না।’

‘উফ! সব কিছুর জন্য আমি সাফার করলাম।সেখানে আমি ভুলে যেতে পারলে তুমি কেন নয়?’
‘জানি না ভাবি। কিন্তু,,,
‘একটা থাপ্পড় দিয়ে তোমার ৩২টা দাঁত ফেলে দেব এখন। ওই দেখো সবাই আমাদের রেখে ঝর্ণার পানি ছুঁয়েও ফেলেছে। তোমার জন্য পেছনে পড়ে গেলাম ধ্যাত!’

বলেই হনহনিয়ে চলে গেল রিমি। ঝর্ণার ঝমঝম শব্দে গুনগুনিয়ে উঠেছে চারিধার। আহসান দুষ্টুমি করে রিমির গায়ে কয়েক ফোঁটা পানি ছিটিয়ে দিল। রিমি চকিত হয়ে রাগান্বিত দৃষ্টি তাক করে আহসানের দিকে। পরমুহূর্তে নিজেই দুষ্টমি শুরু করে দেয়। জান্নাত আহসান ও রিমির ভালবাসাময় খুনসুটি মজা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে হাতের মুঠে পানি নিয়ে জিসানের গায়ে ছুড়ে মারে। জান্নাতের এরুপ কার্যকলাপে চোখ বড় হয়ে গেল জিসানের। জিসান আশা করেনি জান্নাত এমন দুঃসাহসিক কাজ করে দেখাবে। কি মনে জিসানও জান্নাতের সাথে মত্ত হয়ে গেল ছোট-খাটো আনন্দ-উল্লাসে। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেল অতীতকে। মেনে নিল বর্তমানের ভালো থাকার এই মুহুর্তগুলোকে।

অপরদিকে তিয়াসা স্থীর হলো জান্নাত ও জিসানের জুটির তালে। চোখ আটকালো ওদের দিকে। সহসাই এক ফোঁটা পানির অস্তিত্ব খুঁজে পেল চোখের কোণে। ভাবলো, পাহাড়ি ঝর্ণার অবাধ্য পানি এসে চোখ দখল করেছে। কিন্তু আসলে কি তাই? তিয়াসা হাসির আড়ালে অজানা খারাপ লগাটা আড়াল করে নিল। তার সাথে জিসান ও জান্নাতের থেকে জোরপূর্বক চোখ সরিয়ে অন্যত্র রাখলো। যাতে চোখের নোনা জল অস্বাভাবিকভাবে ভারী না হয়ে পড়ে।তবুও কি সে বাঁধ মানবে?

সেখান থেকে পাড়ি জমালো আলুটিলা গুহার দিকে। মশাল হাতে গুহার ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছে সবাই। গুহার ভেতর অন্ধকার আর অন্ধকার! মশালের হলুদ কিরণে পরিবেশে অপূর্ব এক স্নিগ্ধ আভা ফুটে উঠেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ দেখে রিমি ভয়ে আহসানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে। তবে পা চলছে তার। আচমকাই অদ্ভুত এক শব্দে গলা শুকিয়ে এলো তিয়াসার। আহসান আর রিমি অনেকটা সামনের দিকে। আহসান সাথে থাকায় তেমন উত্তেজনা নেই রিমির মধ্যে।

তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৪৫+৪৬

তবে তিয়াসার মধ্যে উত্তেজনার হাওয়া তীব্র গতিতে বইছে যেন। কারণ সে একাই হাঁটছে। বারবার ভয়ংকর সেই শব্দটা কানে ভেসে যেতেই কয়েক কদম পিছিয়ে গেল তিয়াসা। পরবর্তীতে আবার একই শব্দ শুনে কোনো দিশা না পেয়ে পেছনে গিয়ে জিসানের হাত চেপে ধরে শক্তপোক্তভাবে। ঘটনাটা আকস্মিক। সেই মুহুর্তে জিসান জান্নাতের দিকে তাকালো। দেখলো জান্নাত তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে জিসান তার অন্যহাত দিয়ে জান্নাতের হাত ধরে ফেলায় থেমে গেল জান্নাত। সেই মুহুর্তে ওদের পাশ দিয়েই একটা বাচ্চা ছেলে যাচ্ছিলো। সে তার ফোনের ভয়ানক মিউজিক বন্ধ করে হাসতে হাসতে বলল, ‘বড় মানুষ কি বড় ভীতু রে বাবা! এনারা সব আসে কোথ থেকে কি জানি? ভীতুর ডিম কোথাকার।’

এই বলে হাসতে হাসতে সামনের দিকে চলে গেল বাচ্চাটা। এদিকে তিয়াসা বেকুবের মতো মুখ করে স্যরি বলল জিসানকে। জিসান কিছু না বলে ডোন্ট কেয়ার ভাব করে তিয়াসার থেকে হাত ছাড়িয়ে জান্নাতকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তিয়াসা কিছুক্ষণ থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কি জানি কি ভেবে পুনরায় হাঁটা ধরল।

এরপর আসলো লুসাইদের বাঁশ নৃত্য। সকলেই মেতে ওঠে সেই নৃত্যের সঙ্গে। একইসাথে ঝাড়ভোজ পিকনিক স্পট, খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালা হয়ে যাওয়ার পথে দীঘিনালা ঝুলন্ত ব্রিজ এবং দীঘিনালা বন বিহার দেখা। সব মিলিয়ে পুরো দিনটা খুব আনন্দের সাথে কাটে সবার। আগামীকাল চলে যাবে বলে খুব আক্ষেপও প্রকাশ করে সকলে। সেই সাথে সাজেকের সাথে জড়িত স্মৃতিগুলো মনের খাঁচায় বন্দী করে প্রশান্তির একরাশ শ্বাস ও পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে ফিরে আসে রিসোর্টে।

তোলপাড় সিজন ২ পর্ব ৪৯+৫০