দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৭
আফরোজা আশা
রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে মাত্র। ভোরের স্নিগ্ধতা প্রকৃতি জুড়ে বিচরণ করছে। হালকা শীতল বাতাসে একটা সুন্দর শীত শীত ভাব। আকাশের বুকে একফালি সূর্য মিষ্টি আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ভোর সকালে তালুকদার বাড়িতে বড় বড় পা ফেলে আগমন ঘটল বাড়ির বড় ছেলের। সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভিতর পা রাখা মাত্রই নিশ্চুপ ঠান্ডা পরিবেশটা ঝংকার তুলল একজনের গলার আওয়াজে। থেমে গেল দিগন্তের চলমান পা- দ্বয়। দিগন্তের বেশ ভালো করে জানা এখন ওর সাথে কি ঘটতে চলেছে। তাই আলগোছে পকেটে দু হাত ঢুকিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সেখানেই।
ডাইনিং টেবিলে ফ্রুটসগুলো ঠিকভাবে রেখে ধুপধাপ পা ফেলে দিগন্তের সামনে এসে দাঁড়ালো মিতালী। চোখ-মুখ অসন্তুষে জর্জরিত। দিগন্তের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ ফোন কোথায় তোর? কোন সুরঙ্গে লুকিয়ে রাখিস? ’
‘ ভুলে সুইচ অফ হয়ে গিয়েছিল। ’
মিতালী তাতক্ষনাৎ একহাত দিগন্তের সামনে বাড়িয়ে দিল। দুবার হাত নাচিয়ে গমগমে গলায় বলল,
‘ দে ফোন। যে ফোন কাজের সময় সুইচ অফ থাকে সে ফোনের দরকার নাই। ’
-‘ ফোনে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল আছে। দেওয়া যাবে না। ’
-‘ তোর ফাইলের গুষ্টি মারি! কত বার ফোন দিয়েছিলাম জানিস? চিন্তায় আমার হাত-পা জমে গিয়েছিল আর তুই ঠোঁটে সিগারেট টেনে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছিলি! ’
-‘ হু। তারপর ’
-‘ পরে কল ঢুকেছিল। ধরিস নি কেনো? ’
-‘ ব্যস্ত ছিলাম। ’
-‘ তোকে না পেয়ে রায়হানকে ফোন দিলাম। এমনিই মন-মেজাজ খারাপ আর ও কি বলল? ’
-‘ আই লাভ ইউ বলেছে। ’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দিগন্তের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো মিতালী। মিতালী চাহনি দেখে দিগন্ত ঠান্ডা স্বরে বলল,
‘ চোখ পাকানোর কিছু নেই। অন্য কাউকে বলেছে, তোমাকে না।’
-‘ ওকে তো ভালো ছেলে ভাবতাম। তোর সাথে থেকে থেকে তোর মতোই ম্যানারলেস হয়ে গিয়েছে। ফোন তুলে সালাম-কালাম নেই সোজা আই লাভ ইউ! অপরপাশের ব্যক্তি কে সেটা যাচাই করবে না। ’
-‘ ওটা একটা গাধা। তারপর, বলো! ’
মিতালী প্রশ্নাত্মক গলায় বলল, ‘ কাকে বলেছিল? ’
দিগন্ত ঠোঁট কামড়ে ধরে দু’সেকেন্ডের মাঝে ঝড়ের গতিতে বলল, ‘ তোমার ভাইয়ের বজ্জাত মায়ের পেটের গুণবতী মেয়ের দুই মাত্র ছেলের একমাত্র বোন কে। ’
ভ্রুঁ কুঁচকে নিল মিতালী। পুরো কথা মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। ফের জিজ্ঞেস করল,
‘ কি বললি? সোজাসাপটা বল তো বাপু। ’
-‘ বলব? ’
-‘ হুম ’
-‘ আমার ঘুম পেয়েছে। ’
দিগন্তের এরূপ হেয়ালিপনায় বিরক্ত হলো মিতালী। ধমকের সুরে বলে উঠল,
‘ এই তুই বলবি? ’
তারপর দিগন্ত দিকে ভালো করে তাকাতেই খেয়াল হলো দিগন্ত সেই তখন থেকে পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন যেন সন্দেহ হলো মিতালী। ওর আর দিগন্তের মাঝের দূরত্বটুকু কাটিয়ে দিগন্তের কাছে গিয়ে বলল,
‘ কি ব্যাপার? হাত বের করছিস না কেনো? দেখি হাত দেখা তো?’
-‘ সরবে তুমি। এক বেয়াদব পয়দা করেছে তোমার ভাই। ওর জন্য সারারাত ঘুম হলো না। এখন তুমি কি শুরু করেছো এসব!’
চোখে রাঙালো মিতালী। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ ভালোয় ভালোয় হাত দেখা দিগু। নাহলে তোর বাপের সাথে আজ তোর যুদ্ধ লাগাবো আমি। ’
চুউউউ শব্দ করল দিগন্ত। এখনি আরেক ঝামেলা বাঁধাবে মিতালী। রয়ে সয়ে হাত বের করল পকেট থেকে।
ব্যস মিতালীকে আর পায় কে। শুরু করল চিৎকার চেঁচামেচি। করবে না-ই বা কেনো! দিগন্তের দুহাতে রক্ত জমাট বেঁধে কালসীটে দাগ পড়েছে। সাথে ফুলেও গিয়েছে হাত।
‘ এইইই! কার সাথে মারপিট করেছিস আবার? হাতের এতো বাজে অবস্থা কেনো? এইগুলা দেখার জন্য দিন-রাত খেঁটে মরি আমি। বাইরে গিয়ে পালোয়ান সাজো তুমি? একবার নাক ফাটিয়ে আসবা, আরেকবার হাত থেতলিয়ে আসবা। কাকে মেরে এসেছিস? ’
‘ পুলিশ কমিশনারের বড় ছেলে ফাহিম দেওয়ান। ’
কথাটুকু বলে আস্তে করে মিতালীর পাশ কাটিয়ে ছুট লাগালো দিগন্ত। যে টেপ রেকর্ডার অন হয়েছে এটা এখন ওর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করবে।
‘ কমিশনারের ছেলে ’ কথাটা শুনতেই মাথায় হাত পড়ল মিতালীর। দিগন্তের যাওয়ার দিকে অগ্নিদৃষ্টি ফেলে গলা ফাটিয়ে চেঁচালো,
‘ আজ তোর বাপ-চাচা তোর বিচার না করলে তোদের বাড়িতে তোরা থাকিস। গুন্ডা-পান্ডাদের সাথে আমি থাকব না। গায়ে-গোতরে খেঁটে মুখে খাবার তুলে দিবো আর তার তেজ বাহিরে গিয়ে বের করবি তোরা। কমিশনারের ছেলেকে তুই মেরেছিস! কমিশনার তোকে ছেড়ে দেবে? জাহান্নামে যা সব। কিচ্ছু বলব আর আমি। ’
দিগন্ত রুমে এসে ঠাস করে শব্দ তুলে আটকে দিল দরজা। মিতালী এখনো বকছেই। এটা এখন চলবে সারাদিন। রুম সাউন্ড প্রুফ হওয়ায় শান্তি পেল দিগন্তের কান। শরীর মেজমেজ করছে, সাথে মাথাও ভার হয়ে আছে। সবকিছু বিরক্ত লাগছে দিগন্তের। পরণের শার্ট খুলে ছুড়ে ফেলল মেঝেতে। লোমশে আবৃত চাওড়া প্রসস্থ বুক্ষ উন্মুক্ত হলো। টেনে-হিঁচড়ে শরীরটাকে নিয়ে গেল ওয়াশরুমে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে পানি ছেড়ে দিল। ঝরঝর করে পানিগুলো দিগন্তের সিল্কিচুলোগুলো ভিজিয়ে শরীর বেয়ে পড়তে শুরু করল। হাতদুটোতে পানির স্পর্শ পেতেই চিনচিন করে জ্বালা-পোড়া শুরু হলো। কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো ভাবাবেগ নেই দিগন্তের মাঝে। কপালের কাছে লেপ্টে যাওয়া চুলোগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঠান্ডা পানির আরামটা গায়ে টেনে নিতে লাগল। বুকের লোমগুলোর মাঝে একপাশে জ্বলজ্বল করছে সেই ছোট্ট লেখাটা ‘ বিন্দুচারিণী ’।
শাওয়ার শেষে কোমড়ে টাওয়াল পেঁচিয়ে বের মাত্র হয়েছে দিগন্ত। ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে হালকা ভেজা চাপ দাঁড়িগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে ফোনটা হাতে নিল। রায়হানের নাম্বারে ফোন দিয়ে দরকারি কিছু কথা সেরে ফোনটা রাখতে নিলে হাত লেগে তার নিচের নাম্বারে কল চলে গেল। মহাবিরক্ত নিয়ে ফোনটা কেটে দিতে চেয়েও আটকে গেল। ততোক্ষনে অপরপাশের বান্দা ফোন পিক করেছে। কি বলবে দিগন্ত! চুপ করে রইল। ফোন একহাতে কানে চেপে ধরে আরেক হাতে সিগারেট নিয়ে মুখ ধরল। তারপর লাইটার সামনে এনে আগুন দিল সিগারেটের মাথায়। মুখে কোনো কথা নেই। ফোন কানে নিয়ে ফসফস করে সিগারেটে টান দিতে লাগল। এভাবে কাটল কয়েক মিনিট।
এদিকে পুরো সাফেদে মোড়ানো একটা আলিশান রুমে কোমড় সমান চাদর টেনে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে ফাহাদ। মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। চাওড়া হলদে ফর্সা পিঠটা খোলা। জীম করা মাংসল পেশিগুলো ফুলে আছে। একহাত মাথার কাছে বালিশ জড়িয়ে রেখেছে, আরেকহাত কানে ফোন ধরে রেখেছে। অপরপাশ থেকে এতোক্ষনেও কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হালকা করে মাথা উচিয়ে ঘুমে ভরে থাকা লাল চোখজোড়া টেনে খুলল। দিগন্তকে এখনো লাইনে দেখে আবারো শুয়ে পড়ল। একপাশ থেকে আরেকপাশে ফোন ধরে বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ আমি কি তোর প্রেমিকা লাগি? ফোন দিয়ে চুপচাপ আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনে ভেতরের ফিলিংস জাগাচ্ছিস! ’
একই বিদ্রুপের স্বরে ভেসে এলো অপরপাশ থেকে,
‘ তুই নিজেকে আমার নায়িকা ভাবছিস নাকি? ’
-‘ শালা হিজরা! ’
-‘ আহহ! দেখেছিলি বুঝি? ’
-‘ নট ইন্টারেস্টেড। ’
-‘ সমস্যা আছে তোর? হারবাল খাস ’
চোখ খুলে বেডসাইডে হেলান দিয়ে বসল ফাহাদ। ফোনটা লাউডে দিয়ে পাশ থেকে বিয়ারের ক্যানটা হাতে নিল। তাতে সিপ দিতে দিতে বলল,
‘ হারবাল বিষয়ে ভালোই অভিজ্ঞতা দেখছি। কাজে লাগাস বুঝি! যাক, অনেক উপকার করলি! ’
ঠোঁট কামড়ে ধরল দিগন্ত। বাঁকা গলায় বলল,
‘কাল বেলার খোঁজ দিয়েছিলি তাই একটা ছোট হেল্প করে শোধ-বোধ করে দিলাম। ’
ক্যানে শেষ চুমুক দিয়ে দিগন্তকে কটাক্ষ করে বলল ফাহাদ,
‘ শালা ইতর! ইতরামি করার জায়গা পাস না? এসব করার জন্য ফোন দিয়েছিস? ’
-‘ কল লিস্টে সামনে ছিলি। হাত লেগে চলে গিয়েছে। ’
-‘ যাক জীবনে দুবার ফোনে কথা হয়েছে সেটা আমি দিয়েছিলাম। ভুল করে হলেও তৃতীয় ফোন তুই দিয়েছিস। ’
-‘ কারেক্ট! ভুল করেই। সজ্ঞানে কোনোদিনও দিগন্ত তালুকদারের প্রয়োজন পরে না কাউকে ফোন দেওয়ার। ’
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল ফাহাদ। গমগমে স্বরে আওড়ালো,
‘ এতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে ঘুরিস! টেক মাই চ্যালেঞ্জ। চতুর্থবারের ফোনটা তোর কাছ থেকেই আসবে। ’
সিগারেটের অবশিষ্ট টা এ্যাশ ট্রে-তে ফেলে দিগন্ত বলল,
‘ স্বপ্ন-ই দেখতে থাক শালা। ’
বলে-ই লাইন কেটে দিল। ফোনটা পাশের কাউচে ছুড়ে দিয়ে টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। একটু না ঘুমালে শান্তি পাবে না।
টুট-টুট শব্দ তুলে লাইন বিচ্ছিন্ন হতেই উরুর উপরে রাখা ফোনের স্ক্রিনে আলোকপাত করল ফাহাদ। মাথার ব্যাথা তো আগে থেকেই ছিল। এখন কাঁচা ঘুম ভাঙার কারণে ঘাড়ের শিরা-উপশিরায় দপদপ করে যন্ত্রনা শুরু হয়েছে। দু’আঙুল উঠিয়ে ঘাড়ে স্লাইড করতে করতে বিড়বিড়ালো,
‘ হারাম’জাদা! সারাজীবন জ্বালালো। ’
বেলা গড়িয়েছে। সকালের মিষ্টি পরিবেশটা এখন প্রখর রোদে উত্তপ্ত আবহাওয়ায় রূপ নিয়েছে। পাটোয়ারী বাড়ির সবাই হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। থাকবে নাই বা কেনো! বাড়ির তিনটা মানুষ তিনদিকে এডমিট। বেলার দাদির অবস্থা আগের থেকে এখন ভালো তার দেখভালের জন্য রিনা রয়েছে সেখানে। আমেনা অসুস্থ শরীর নিয়ে দুই মেয়ের কাছে ছুটাছুটি করছে। বেলাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তাই এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বৃষ্টির অবস্থা বেশ নাজুক ছিল। এতোক্ষন অবজারভেশন এ রেখেছিল। খানিক আগে কেবিনে শিফট করা হয়েছে। এখন আশংকামুক্ত। পাতার প্রায় সবগুলো ওষুধ খেয়ে নিয়েছিল। বেশি দেরি হয় নি বলে জোর বাঁচা বেঁচে গিয়েছে। ওয়াশ করার সময় ডাক্তাররা ভরসা দিতে পারছিল না কোনো। ভাগ্যের জোরে বেঁচে ফিরেছে।
কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে বৃষ্টির। এখনো পরিবারের কেউ আসেনি ওর কাছে। কেবিন পুরো ফাঁকা। জ্ঞান ফিরে পাশে কাউকে পায় নি। নিজের উপরে তাচ্ছিল্য হাসল। তখনি দরজা ঠেলে প্রবেশ করল রহমান। ভেতরে ঢুকে একবারো তাকালো না বৃষ্টির দিকে। দরজা ভেতর থেকে লক করে দিয়ে বৃষ্টির পাশে চেয়ার টেনে বসল। কেবিনেট থেকে একটা কমলা নিয়ে খোসা ছাড়ালো। বৃষ্টির মুখের সামনে এক অংশ ধরল। বাবার দিকে নিরবে চেয়ে আছে বৃষ্টি। মুখের সামনে খাবার ধরাতে চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। রহমান এখনো তাকায় নি ওর দিকে। বৃষ্টি তাকে ডাকতে চাইছে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে পারছে না। খুব কষ্টে আটকে আটকে ডেকে উঠল,
‘ অ..আব্বু। ’
শুনল রহমান। জবাব দিল কিন্তু তবুও চাইল না ওর দিকে।
‘ বলো ’
-‘ মারবে ন..না? ’
-‘ না ’
-‘ ব..বকবে না? ’
-‘ না ’
-‘ আমার তো ম.. মরে যাওয়া উচিত ছিল। ’
-‘ ভালো। আমি কি আর বেঁধে রেখেছি তোমাকে? ’
বৃষ্টি আরো কিছু বলতে চাইলো কিন্তু আটকে দিল রহমান। ফলের টুকরো টা বৃষ্টি মুখে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আগে খাওয়া শেষ করো। এরপর বেলাকে খাওয়াতে হবে। ’
রহমানের কথা কানে পৌঁক্সহাতেই বৃষ্টির শান্ত চাহনি হিংসাতে ভরে উঠল। শক্ত আওয়াজে বলল,
‘ অসুস্থ আমি। তাও ছোট মেয়েকে নিয়ে বেশি চিন্তা তোমার। ’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রহমান। বৃষ্টির ধারণা বেলাকে সবাই ওর থেকে বেশি ভালোবাসে। বেলা হওয়ার কারণে বৃষ্টিকে ওর দাদির হাতে তুলে দিয়েছে। ওর জন্যই বৃষ্টির আদর-ভালোবাসা কমে গিয়েছে। এই অবাস্তব ধারণাগুলো মনে পুষে রেখে বেলার প্রতি দিনকে দিন প্রচন্ড রূপে হিংসাত্মক হয়ে উঠছে বৃষ্টি।
রহমান আরেক টুকরো কমলা মেয়ের মুখের সামনে নিয়ে এতোক্ষন পর তার মুখের দিকে তাকায়। মাত্র কয়েক ঘন্টায় শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে গিয়েছে। ফুলো গালগুলো ঝরে গিয়েছে। মেয়ের এহেন অবস্থা বুকে আঘাত হানে রহমানের। হাতের ফলটা আবারো বৃষ্টির মুখে দিয়ে ওর একহাত টেনে নিজের দুহাতের মাঝে নেয়। হাতের উল্টো পিঠে স্ব-স্নেহে পরশ বুলিয়ে গালে সাথে ধরে। আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলে উঠে,
‘ এই হাতগুলো এতো ছোট ছোট ছিল। এই হাত আব্বুর হাত ধরে আস্তে ধীরে বড় হলো। এখন এ হাতের মালিকের আর দরকার নেই আব্বুর। নিজের জীবনের সব ডিসিশন নিজেই নিতে পারে। আব্বুকে আপরাধী করে দুনিয়া ছাড়ার পরিকল্পনাও বানাতে পারে।’
ফুপিয়ে উঠে বৃষ্টি। একরাশ অভিমান জড়ানো মন নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
‘ আমি অনেক খারাপ। কেউ ভালোবাসে না আমাকে। ’
হাত উঠিয়ে বৃষ্টির চুলে বিলি কাটে রহমান। বাবার আদরে আরো বেশি আহ্লাদ পায় বৃষ্টি। আবারো বলে,
‘ আমি মরে গেলে তোমরা শান্তি পেতে। বোঝা কমে যেতো। ’
-‘ সন্তানরা বাবার বোঝা হয় না আম্মা। ’
-‘ বানী, বেলার মতো ভালো মেয়েরা হয় না। বৃষ্টির মতো খারাপ মেয়ের সবার বোঝা হয় আব্বু। ’
-‘ আমি তোমাকে তোমার পছন্দের মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে দেয় নি বলে একথা মনে হলো তোমার? কি চাও তুমি? সব জেনে-শুনেও মেয়েকে দু’বিয়ে করা একটা চরিত্রহীন লাফাঙ্গা ছেলের হাতে তুলে দিবো? কারণ মেয়ে তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসলেই সুখ পাওয়া যায়? যদি তাই হয়! যদি তুমি আমাকে ফুল সিওরিটি দিতে পারো ওরকম ছেলেকে বিয়ে করার পর তুমি সুখী থাকতে পারবে তবে আমি মেনে নিবো। কিন্তু আদোও বিয়ে করবে তো? তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে ছেলেটা তোমাকে বাজে অফার করে নি! ’
ছোট হয়ে এলো বৃষ্টির মুখ। ভেসে এলো বৃষ্টির ধীর কণ্ঠ,
‘ তুমি ভুল বুঝছো। আমি এখন আর সেসব চাই না। ’
-‘ তাহলে বেলাকে কোথায় পাঠিয়েছিলে? ’
রহমানের প্রশ্নে দৃষ্টি এলোমেলো হয় বৃষ্টির। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘ এটাও বলে দিয়েছে! আ..আমার এক বন্ধুর কাছে ..।’
-‘ মিথ্যা বলার প্রয়োজন নেই। তোমার অজানায় অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে। ’
প্রশ্নাত্মক চাহনিতে রহমানের দিকে চাইল বৃষ্টি। বাবার শক্ত দৃঢ় দৃষ্টি দেখে মাথা নিচু করে ফেলল।
‘ সেদিন যখন তুমি আমাকে বুঝিয়েছিলে তখনি ফাহিমের সাথে আমি সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। কিন্তু তাও ও মানুষ লাগিয়ে আমার রুমের দিকে ইটের টুকরো ছুড়ত, আমাকে নানাভাবে ডিস্টার্ব করছিল। তাই একটা কাগজে আমি আমার সব কথা লিখে সবার আড়ালে বেলার হাতে পাঠিয়েছিলাম। আর তোমাদের থেকে আমি নামক বোঝাটা সরিয়ে ফেলতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলাম। ’
-‘ তোমার মনে হয় নি বেলার বিপদ হতে পারে? যাদের কাছে পাঠিয়েছিলে তারা কি ভালো মানুষ ছিল? ’
চমকে তাকালো বৃষ্টি। নিজের জীবনের টান-পোড়ের মাঝে অন্য কিছুর খেয়াল আসে নি ওর। থেমে থেমে বলল,
‘ বেলা তো ছোট মানুষ। ’
-‘ শকুনদের নজরে ছোট-বড় থাকে না আম্মা। নিয়ে গিয়েছিল বেলাকে।’
কথাটা শুনতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল বৃষ্টি। কিছু বলতে চাইছে কিন্তু পারছে না। রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে মেয়ের মাথা বুকে আগলে নিল। আদরমিশ্রিত গলায় বলল,
‘ বড় হয়েছেন আম্মা। এখনো ছোটদের মতো মনোভাব কেনো? আপনি আমাদের বোঝা না। সন্তান ভালো হোক, খারাপ হোক কখনো বাবা-মা এর বোঝা হয় না। আপনি আমার বাচ্চা।হাজারো ভুল করতে পারেন সেগুলো শুধরে দেওয়ার জন্য তো আব্বু আছে। ছেলেগুলো আপনাকে ডিস্টার্ব করছিল বলেন নি তো কাউকে। আব্বুর কাছে মনের সব কথা বলবেন। আব্বুকে বলতে না পারলে আম্মুকে বলবেন। আম্মুকে না বললে বড় আপাকে বলবেন, ছোট আব্বুকে বলবেন, ছোট আম্মুকে বলবেন। এতো মানুষ পাশে থাকতেও আপনি বোকার মতো মানসিক চাপ নিয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিলেন। এটা কি অন্যায় নয়? ’
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৬
সব কথা শুনল বৃষ্টি। বাবার বুকে পড়ে অঝোর ধারায় কাঁদল। কেনো কাঁদল নিজেও জানে না। বুকের মাঝে যে দমবন্ধকর অবস্থাটা ছিল সেটা নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল কিভাবে যেন! কি বুঝল কে জানে। কাঁদতে ভালো লাগছে তাই কাঁদছেই। এতোদিনে মনে পুষে রাখা রাগ, জেদ, অভিমানে পানি পড়েছে হয়তো। হালকা লাগছে নিজেকে। রহমান নিরবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কান্না থামানোর চেষ্টা করছে না। কিছু কান্না ঝরা মন্দ নয়। যদি মনে শান্তি আসে তাহলে কাঁদুক।