দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৯

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৯
আফরোজা আশা

টানা একমাস গাধার খাটুনি খেটে আজ ইতি হলো বেলার মাধ্যমিক জীবনের। শরীর, মন এখন পুরোপুরি চাঙ্গা। মনের ভয়-ভীতি কবেই হাওয়া হয়ে গিয়েছে টেরও পায় নি। পাবেই বা কিভাবে ওকে কেউ আগের কোনো কিছু মনে করার ফুরসত দেয় নি। কিছুক্ষন আগে পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হল ছেড়ে বেরিয়েই রাইমা আর ও রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। পরীক্ষার কেন্দ্র প্রায় খালি হয়ে গেল কিন্তু ওদের কথা ফুরালো না। গেটের কাছে বেলার জন্য অপেক্ষা করছে দিহান আর বাণী। এতো দিন রহমান পাটোয়ারী বেলাকে নিয়ে যাওয়া-আসা করেছে। আজ বাণী আর দিহান পাটোয়ারী বাড়ি যাবে। তাই রহমান পাটোয়ারীকে আসতে বারণ করেছে।

গেটের সামনে আধ-ঘণ্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে ওরা। অথচ বেলার বের হবার নাম নেই। একের পর এক সব বের হয়ে এতোক্ষণে হয়তো বাড়ি চলে গিয়েছে। বেজায় চটে গেল বাণী। দিহানের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলে দিহান আঙুল উঠিয়ে গেটের দিকে দেখিয়ে বলল,
‘ ওই তো বেলা আসছে। ’
চুপ হলো বাণী। বেলা ওর কাছাকাছি আসতেই চোখ রাঙিয়ে বলে উঠল,
‘ এতোক্ষন লাগে তোর বের হতে। পরীক্ষা শেষ হয়েছে সেই কখন আর তুই আসছিস এখন। আমরা যে এই কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি সে খেয়াল নেই। ’
বোনের রাগের কারণ বুঝল বেলা। আসলেই বাইরে অনেক রোদ। এ রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কারোর-ই মাথা গরম হয়ে যাবে। তাই মিনমিনে গলায় বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ রাইমার সাথে একটু কথা বলতে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। ’
বাণী আর কিছু বলল না। বেলার হাত থেকে ফাইলটা নিজের হাতে নিয়ে ওর কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে নরম গলায় বলল,
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। পরীক্ষা কেমন হয়েছে? ’
-‘ ভালো ’
পাশ থেকে দিহান বলল, ‘ বেলা, চল তাহলে এই খুশিতে আইসক্রিম খাই। ’
আইসক্রিমের কথা শুনতেই চোখজোড়া চকচক করে উঠল বেলা। বাণীকে পাশ কাটিয়ে দিহানের কাছে এসে গদগদ স্বরে বলল,

‘ দিহান ভাই সত্যি খাওয়াবে? ’
মন ক্ষুন্ন হলো দিহানের। মুখ ভার করে বলল,
‘ আমি না এখন তোর বোন-জামাই। দিহান ভাই আবার কি? ভাইয়া বল। তোর বড় দুলাভাই হই। দাম দিবি না একটু। ’
ভাবুক হলো বেলা। কিছুটা চিন্তিত গলায় বলল,
‘ দিগন্ত ভাইকে ভাইয়া ডাকলে ক্ষেপে যায়। এদিকে আবার তোমাকে ভাইয়া না ডাকলে দাম পাও না। তাহলে বেলা ডাকবে টা কি? ’
পেছন থেকে বেলার মাথায় টাক মারল বাণী। ওর হাত ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ পরীক্ষার পড়া পড়তে পড়তে তোর মাথা খারাপ হয়েছে। এজন্য উল্টাপাল্টা বকছিস। চল, আগে আইসক্রিম খাবি। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় যা ভাবার ভাবিস। ’
বেলার আর কিসের ভাবনা-চিন্তা। ওর তো এখন আরামের দিন। আহহ! পরীক্ষা শেষ। এখন শুধু ঘুরবে-ফিরবে, খাবে-দাবে আর ঘুমাবে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে পাটোয়ারী বাড়ির দিকে দিহানের গাড়ি ছুটল।

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। পাটোয়ারী বাড়ির লিভিংরুমে মেয়ে-জামাইয়ের সাথে খোশগল্পে মেতে আছে রহমান আর রাসেল। আর কিছুক্ষন পর ওরা তালুকদার বাড়ি ফিরে যাবে। রহমান চাইলে জোর করতে পারল না মেয়েকে আজ রাতটা এখানে থাকতে বলার। কারণ কাল সকালে ওরা চট্টগ্রাম যাবে। দিহানের দাদা-দাদি দিলদার তালুকদার আর রকেয়া তালুকদার চট্টগ্রামে তাদের গ্রামের বাড়িতে-ই থাকেন। শহরের কোলাহল, যানজোট এর বিরক্তিকর ধ্বনি পছন্দ না ওদের। তাই দুই-ছেলে এতো বলার পরও তাদের সাথে থাকতে নারাজ তারা। গ্রামের শান্ত, নির্মল পরিবেশ ছেড়ে কিছুতেই এখানে থাকবে না।
বাণী আর দিহানের বিয়ের এতোদিন হলো ওরা এখনো গ্রামে যায়নি। কাল যাবে তবে যাওয়ার আগে বাবার বাড়ির সবার সাথে দেখা করার জন্য এসেছে আজ। গল্পের ফাঁকে হঠাৎ দিহান বলে উঠল,

‘ বেলার তো পরীক্ষা শেষ। ও আমাদের সাথে যাক। ’
রহমান পাটোয়ারী চুপ করে গেল। কিছুক্ষন ভেবে পাশে বসা বেলার দিকে ফিরে বলল, ‘ তুমি যেতে চাও? ’
বেলা এতোক্ষন উসখুস করছিল। রহমান পাটোয়ারী জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ বেগে উপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ হুম আব্বু। চট্টগ্রামের পাহাড়-সমুদ্র দেখার ইচ্ছা অনেক। যেতে দিবে? বড় আপা তো আছে। ’
বাণী চুপচাপ বসে ছিল এতোক্ষন। বেলার কথা শেষ হতেই রহমানহ এর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল তার সামনে। শান্ত গলায় বলল,

‘ তুমি যদি মনে করো আমি বেলাকে সামলে রাখতে পারব তাহলে যেতে দেও ওকে। এমনি-ই বেশ ধকল গিয়েছে ওর উপরে। একটু ঘুরে এলে ভালো লাগত। ’
রহমান মুচকি হেসে বাণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘ যেখানে বেলার বড় আপা আছে সেখানে ওকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই। নিয়ে যাও তবে ওর সাথে সাথে নিজেদেরও খেয়াল রেখো আম্মা। ’
বাবার কথা শুনে বিস্তর হাসল বাণী। এদিকে বেলাকে আর পায় কে! সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে লাফাতে লাফাতে নিজের রুমে গিয়ে ধুমধাম প্রয়োজনীয় সব জিনিস ক্যারি ব্যাগ এ ভরে দশমিনিটের মাঝে রেডি হয়ে নিল। আবার সবকিছু নিয়ে একই ভাবে লাফাতে লাফাতে হাজির হলো আগের জায়গায়। ওর কাজ দেখে হাসল সবাই। ঘুরা-ফিরায় নাম শুনলে বাড়ির ছোটকন্যার লাফ-ঝাঁপ আগের থেকেও বেড়ে যায়।
অতঃপর বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেলাকে নিয়ে তালুকদার বাড়ির দিকে গেল বাণীরা। যাওয়ার আগে আমেনা আর রিনা বেলার হাতে ধরিয়ে দিল বড় বড় টিফিন ভর্তি পিঠা-পুলি। এই কাজগুলো যেন বেলার জন্যই সীল-মোহর দিয়ে বাঁধাই করা।

রাত হয়েছে বেশ। এতোক্ষন টং ঘরে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছে দিগন্ত। এখন বাড়ি ফিরবে। সবাইকে বিদায় দিয়ে বাইকের কাছে আসতেই পেছন থেকে ছুটে এলো ওর কাছে রায়হান।
রায়হান কে দেখেও না দেখার ভান করল দিগন্ত। কিন্তু রায়হান নাছোড়বান্দা ন্যায় বলে উঠল,
‘ দোস্ত নে না তোর সাথে। দেখ, কাল কত সকালে বের হবি। এতো সকালে উঠে আবার তোদের বাড়ি যাওয়া অনেক কষ্টকর। এখনি নিয়ে চল না। ’
বাইকে বসে জবাব দিল দিগন্ত, ‘ না ’
-‘ আমি ভুলভাল কিছু বলব না সত্যি। ’
-‘ যা বাড়ি যা। সকালে সময় মতো চলে আসবি। ’
দিগন্ত কথা বলে শেষ করার আগেই ওর বাইকের পেছনে ঝাঁপিয়ে উঠে বসল রায়হান। বাইক স্টার্ট দিতে গিয়েও থেমে গেল দিগন্ত। গম্ভীর গলায় বলল,

‘ নামবি নাকি লাথি খাবি। ’
রায়হান জেদিভাবে বলল, ‘ তোর সাথে যাবো। ’
-‘ নাম শালা। তোর নজর ভালো না। বাড়িতে আমার যুবতী বোন আছে। নিয়ে যাবো না তোকে। ’
-‘ হ্যাঁ হ্যাঁ! তোর ওই যুবতি বোন-ই আমার বউ হবে। ’
-‘ আমার বোন, ছোট। ’
-‘ বেলা-ও ছোট। ’
ব্যস রায়হানের বলতে দেরি হলো কিনা, দিগন্তের পা উচিয়ে লাথি মারতে দেরি হলো না। এক লাথে বাইক থেকে ছিটকে দূরে সরে পড়ল রায়হান। দিগন্ত আর তাকালো না ওর দিকে। বাইক ছেড়ে দিল। পেছনে থেকে রায়হানের হুংকার ভেসে এলো,

‘ শালা সব শোধ নিব দেখে নিস। আমাকে আমার প্রেমিকার কাছে যেতে দিস না এই জন্যই তোর কপাল খুলে না। এখনো জানাতেই পারলাম না আমি ভালোবাসি ওকে। ওর জায়গায় ওর মা-কে বলে দিলাম। সব তোর দোষ। শালা দেখিস, বিয়ের পর তোর বোনের উপরেই এর শোধ তুলব। ’
কিছুটা দূরে গিয়ে-ও থেমে গেল দিগন্ত। পেছনের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে ঠাট্টা করে বলে উঠল,
‘ বাবু-রে! বিয়ের পর তোর বউকে তুই কি করবি সেটা আমাকে বলে লাভ! ছিহ শালা! বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুদ্ধিও হাঁটুতে গেছে তোর। যাহ ভাগ! শালা। ’
বলে বাইকের ধুলা উড়িয়ে চলে গেল দিগন্ত। এদিকে রাগে ফোঁস ফোঁস করছে রায়হান।

নিরিবিলি পরিবেশ। চারপাশে শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে। মাথার উপরে আকাশের তারা ঝিকিমিকি করছে। চাঁদ অর্ধেক উঁকি দিচ্ছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে। নিস্তব্ধ এই হালকা শীতল আবহাওয়ার মাঝে ছাদের রেলিং এর উপর বসে আছে ফাহাদ। পাশে চার-পাঁচটা খালি বিয়ারের ক্যান। মন ভালো নেই। কিছুই ভালো লাগছে না। সন্ধ্যা পর থেকে বাইরে যায় নি। আড্ডাখানায়-ও যাওয়া হয় নি। হুট করে বিরক্ত লাগছে আশপাশের সবকিছু। তাই এতো রাতের একা একা ছাদে বসে আছে। ঝরঝরে হালকা ব্রাউন কালারের চুলগুলো বাতাসের বেগে এলোমেলো হয়ে আছে। ফর্সা মুখে গাঢ় কালো ভ্রু-যুগলের সাথে খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি হয়েছে।

পরণে ওভারসাইজ টি-শার্ট। কোলের উপর একটা গিটার পড়ে আছে। একহাত দিয়ে গিটার চেপে রেখেছে আরেক হাত দিয়ে একের পর এক ক্যান খালি করছে। দৃষ্টি দূর আকাশ-পানে। ক্যানে চুমুক দিয়ে শব্দ করে পাশে রাখল। তারপর হাত দিয়ে কপালে এলোমেলো হওয়া চুলগুলো পেছনের দিকে ঠেকে দিয়ে গিটারটা ভালোভাবে ধরল। টুং টাং আওয়াজ তুলল পরক্ষণে তা তাল হারালো। কয়েকবার চেষ্টা করল কিন্তু হচ্ছে না। যেখানে মন নেই সেখানে সুর আসবে কিভাবে! বিরক্ত হয়ে গিটার পাশে ছুড়ে ফেলতে গিয়েও আটকে গেল। একটা লম্বা শ্বাস টেনে আবারো ধরল। কিছু একটা মনে করে ধীর স্থির ভাবে সুর তুলল পুনরায়। গিটারের সুর ঠিক করে এই নিরব পরিবেশে গলা ছেড়ে গাইল,

ভালোবাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
আমার মনের ঘরে চাঁদের আলো চুইয়া চুইয়া পড়ে
পুষে রাখবো রাখবো রে বন্ধু তোমায় যতনে
সুরেলা একটা আওয়াজে ছাদের পরিবেশ মুখরিত হলো। গানের মাঝে এসে আলতোভাবে চোখ বুজল ফাহাদ। জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল সেদিন পার্কে কান্নারত এক ষোড়শী কন্যার প্রতিচ্ছবি। ঘন পাপড়ির মাঝে অশ্রুবিন্দুর ফোঁটা, ভয়ার্ত মুখাবয়ব, ফোলা ফোলা ফর্সা গাল, গোলাপি অধরজোড়া, দুপাশে বিনুনি করা কালো কেশ। সবকিছু স্মৃতিচারণ হতেই চোখ বন্ধ রেখে মুচকি হাসল ফাহাদ। অতঃপর আবারো সুর ধরল,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৮

দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন যে আর মানে না…..
কাছে আইসো আইসো রে বন্ধু প্রেমের কারণে
ভালোবাইসো বাইসো রে বন্ধু আমায় যতনে

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২০