দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২০
আফরোজা আশা
শিষ বাজাতে বাজাতে বাড়িতে ঢুকল দিগন্ত। বাম হাতের আঙুলে বাইকের চাবি গোল গোল ঘুরছে। সাদা শার্টের উপরে তিনটা বোতাম খোলা। ফলে টান টান চাওড়া লোমশ বক্ষের খানিকটা দৃশ্যমান। আরেকহাত দিয়ে চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে লিভিং রুম পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই বিপত্তি ঘটল। পায়ের সাথে কিছু একটা বেঁধে পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে। ঠান্ডা মেজাজ ফড়ফড়িয়ে তুঙ্গে উঠল। পিছু ঘুরে চেঁচানোর জন্য খোলা মুখটা টুপ করে বন্ধ করে নিল। ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে সামনে নিচু হয়ে মাথায় হাত রেখে বসে থাকা বেলাকে দেখে বলল,
‘ তুই এখানে কি করছিস? ’
বাণীর কাছ থেকে দিশার রুমে যাচ্ছিল বেলা। মিতালী ওকে নতুন দুল দিয়েছে সেটা বাণীকে দেখিয়ে দিশার কাছে যাচ্ছিলো। মাঝপথে হাত ফস্কে একটা দুল নিচে পড়ে গিয়েছে। সেটা তোলার জন্য নিচু হতেই বিরাট খাম্বা এসে ধাক্কা খেলো ওর সাথে। মাথায় লেগেছে ভালোই ওর। হাত দিয়ে ডলতে ডলতে দিগন্তের দিকে চেয়ে বলল,
‘ আপনি এখানে কি করছেন? ’
চুউউউ শব্দ তুলল দিগন্ত। এই একটা হাড়ে বজ্জাত মেয়ে। যেটা প্রশ্ন করা হবে সেটাই উল্টে ওকে বলবে। গমগমে গলায় বলে উঠল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ বেয়াদব মেয়ে! আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই বলছিস আমি কি করছি! ’
দুলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো বেলা। দিগন্তের সামনা-সামনি এসে হাত উচিয়ে দুটো আঙুল দেখালো। বুঝল না দিগন্ত। প্রশ্ন করল সহসা, ‘ কি? ’
-‘ এটা আপনার বাড়ি। মানে আপনার সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক মাত্র একটা। ’
সিঁড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দুহাত বুকে বাঁধলো দিগন্ত। শান্ত গলায় বলল,
‘ হু। তারপর ’
বেলার আবার বাড়িয়ে রাখা হাতের দু’আঙুল দিগন্তের মুখের সামনে এনে বলল,
‘ আর এ বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক দুইটা। ’
-‘ আচ্ছা! কিভাবে? ’
-‘ প্রথমত, এটা আমার ফুপির বাড়ি। দ্বিতীয়ত, এটা আমার বোনের শ্বশুড়বাড়ি। ’
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল দিগন্ত। বাঁকা হেসে আস্তে করে বলল,
‘ তিনটা সম্পর্ক করে নে। বোনের শ্বশুড়বাড়ির জায়গায় নিজের শ্বশুড়বাড়ি বলিস। ’
দিগন্তের কথা পুরোপুরি শুনতে পেল না বেলা। ওর দিকে চেয়ে থেকে শুধালো,
‘ কি বললেন? ’
বুক থেকে হাত নামিয়ে বেলার মাথায় হাত রাখল দিগন্ত। কটাক্ষ করে বলল,
‘ বললাম, তোর মাথা ভর্তি গো-বর। ঠিকি বলেছিস! এ বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক একটা কিন্তু তোর সম্পর্ক দুইটা। তোর থাকার কথা বেশি। খানিকের জন্য আমি ভুলে গিয়েছিলাম তুই ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট। ’
কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালো না দিগন্ত। সিঁড়ি ছেড়ে আবার উল্টো হাঁটা ধরল। গন্তব্য এখন রান্নাঘর।
এদিকে বেলা বেক্কলের ন্যায় ড্যাব ড্যাব করে দিগন্তের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। দিগন্ত ওর সুনাম করল নাকি দুর্নাম! মাথার উপর দিয়ে গেল। ঠোঁট উল্টে যে পথে যাচ্ছিলো সেদিকে গেল।
‘ মনিইই! ‘
হাতে নাড়ানো খুন্তিটা থামালো মিতালী। দরজার দিকে ফিরে বলল, ‘ বল। ’
-‘ কখন এসেছে? ’
বুঝেও অবুঝ সাজলো মিতালী। প্রশ্নাত্মক গলায় বলল,
‘ কে? ’
-‘ তোমার ভাতিজী। ’
-‘ সন্ধ্যার পরে। ‘
ফোন স্ক্রল করতে করতে ভ্রুঁ বাঁকিয়ে কিছুটা ভাব নিয়ে দিগন্ত বলল,
‘ বলো নি যে। ’
হাতের খুন্তিটা শব্দ করে রাখল মিতালী। গ্যাসের চাবি ঘুরিয়ে বন্ধ করল সেটা। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দিগন্তের কাছে এসে বলল,
‘ ও এসেছে, এসেছে। তোকে বলার কি আছে। ’
দিগন্ত কিছুটা ভার গলায় বলল,
‘ সকালে তো চলে যাবো। এখন আসলো কেনো? ’
চোখ বাঁকালো মিতালী। গমগমে স্বরে বলল,
‘ চট্টগ্রাম যাবে তাই। ’
মিতালীর কথাটা কর্ণপাত হতেই হাতের ফোনটা হাত ফস্কে পড়তে নিল দিগন্তের। অবাক গলায় বলল,
‘ কিহহহ? ’
‘ কি আবার! কানে শুনিস না? কাল তোদের সাথে যাবে। ’
বিস্ময় ভরা চাহনি নিয়ে দিগন্তে বলে উঠল,
‘ ওর বাপ আসতে দিল? ’
-‘ হু। ’
দু’ঠোঁট চেপে ধরল দিগন্ত। চোখজোড়া চিকচিক করছে। উল্টো ঘুরে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। গেটের বাইরে গিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে আবারো ডাকল,
‘ মনিইই! ‘
-‘ হুম। ’
দুষ্টুমি হাসি দিয়ে দিগন্ত বলল, ‘ দোয়া করো। ’
ভ্রুঁ কুঁঞ্চিত করল মিতালী। চেঁচিয়ে বলল,
‘ গুন্ডা-পান্ডাদের জন্য দোয়া করব কেনো? ওর থেকে দূরে থাকবি দিগু। ’
দিগন্ত শুনেও শুনল না। রুমে যেতে যেতে বলল,
‘ কফি পাঠাও তাড়াতাড়ি। ঘুম হারাম হয়েছে। ’
সূর্য উঠেছে কিয়ৎক্ষন আগে। প্রকৃতিজুরে বিচরণ করছে দিন শুরুর নির্মল আলো। পাখির কিচিরমিচির চলছে আকাশজুরে। বাইক রাইড করবে বলে ভোররাতে বের হতে হয়েছে। কারণ মোজ্জামেল তালুকদার আর মাহফুজ তালুকদারের কড়া আদেশ এতোটা পথ বাইকে গেলে সকালে যান-জোট বাঁধার আগেই পৌঁছাতে হবে। বাড়ির গাড়িও আসছে ওদের পেছনে। সব জিনিসপত্র গাড়িতে কিন্তু মানুষের অভাবে পুরো গাড়ি ফাঁকা। চট্টগ্রামের পথে পর পর তিনটা বাইক চলছে। একটাতে বাণী-দিহান, পরের টাতে রায়হান, সবশেষে দিগন্ত আর বেলা। মন ভীষণ খারাপ রায়হানের। দিশা আসেনি ওদের সাথে। এডমিশন এর পড়াশোনার কারণে এলো না। দিগন্ত বাইক টান মেরে ওর পাশাপাশি এলো।
‘ প্যাঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস কেনো? ’
একটা বড় শ্বাস ফেলে রায়হান বলল, ‘ কত কি পরিকল্পনা করলাম। মেয়েটা এক মূহুর্তে সব ভেস্তে দিল। তোর মতোই বজ্জাত। ’
দিগন্ত পিঞ্চ মেরে বলল, ‘ ও কি আর জানে তোর মতলব!’
মুখ বাঁকালো রায়হান। দিগন্তের দিকে ফিরে বলল,
‘ এতো আস্তে চালাচ্ছিস কেনো? ভালো লাগছে না। রেস ধর। ’
দিগন্ত চোখের ইশারায় পেছনে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা বেলাকে দেখিকে বলল,
‘ ভয় পাবে। ’
বুঝল রায়হান। ঠোঁট চেপে বলল,
‘ তোরে দিন ভাই। থাক! আমি জোরে ছাড়ছি। ’
কথাটা বলা মাত্র-ই দিহান-বাণীকে ওভারটেক করে জোরে বাইক ছাড়ল রায়হান। রায়হানের দেখা-দেখি দিহানও কিছুটা জোরে চালানো শুরু করল। কিছুক্ষনের মধ্যে ওরা দিগন্তের চোখের আড়াল হয়ে গেল। তা দেখে ঠোঁট বাঁকালো দিগন্ত। আরো কিছুক্ষন বাইক চালানোর পর একটা সবুজে ঘেরা পাহাড়ের সামনে এসে থেমে গেল। বাইক থামানো দেখে পেছন থেকে বেলা বলল,
‘ চলে এসেছি আমরা? ’
-‘ না। ’
-‘ তাহলে থামালেন যে! ’
-‘ বলছি! নাম আগে। ’
দিগন্তের কথামতো বাইক থেকে নামল বেলা। চোখ ঘুরিয়ে আশপাশের পুরো পরিবেশটা অবোলকন করতেই গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ দিগন্ত ভাইইইইইই! ’
বাইক থেকে নামতেই এমন চিৎকার শুনে বেজায় রাগ হলো দিগন্তের। চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘ ওরে বেয়াদব! আর কত জ্বালাবি। দিশাও এতো ভাই ভাই করে গলা ফাটায় না যতটা তুই করিস। অসভ্য! মাথায় তো বেয়াদবি ছাড়া আর কিছুই নেই। ’
কিন্তু বেলার কানে দিগন্তের একটা কথাও গেলে তো! ও তো আটকে গিয়েছে সামনে দন্ডায়মান পাহাড়ের সৌন্দর্য্যে। সকালের শীতল বাতাসের মাঝে মাত্র ওঠা সূর্যটা দেখে খুশিতে আত্মহারা বেলা লাফাতে লাফাতে আবারো চিৎকার ছুড়ল,
‘ দিগন্ত ভাইইইই! কি সুন্দর। ’
চোখ বাঁকালো দিগন্ত। এ মেয়ে শোধরাবার নয়। ভালো লেগেছে সেটা প্রকাশ করলেই হয়। বারবার এভাবে ডাকার কি আছে! সব ওকে জ্বালানোর ধান্দা। না ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বেলার পেছনে এসে দাঁড়ালো। পকেটে দুহাত গুজে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ পছন্দ হয়েছে? ’
-‘ হুমউউ! খুব পছন্দ হয়েছে। সামনা-সামনি পাহাড় দেখতে এতো সুন্দর আগে তো জানতাম না। ’
হালকা হাসতে চেয়েও তা মিলিয়ে গেল। এ জায়গাটা বেলার পছন্দ হবে এটা আগে থেকেই জানত দিগন্ত। বাইক এতো আস্তে চালিয়েছে এ জন্যই। বেলা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে তবেই গ্রামের দিকে যাবে। মাথা নিচু করে নিজের থেকে একগুণ ছোট সাইজের রমণীর দিকে চেয়ে বলল,
‘ এরকম আরো দেখতে চাস? ’
জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল বেলা,
‘ হ্যাঁ চাই। কিন্তু আপারা তো চলে গেল!’
কথাটা বলতে বলতে দিগন্তের দিকে পেছন ফিরতে চাইলে একটা পাথরের খণ্ডের সাথে পা বেঁধে উল্টে পড়ে যেতে নিল বেলা। তাতক্ষনাৎ দুহাত বাড়িয়ে বেলাকে পড়া থেকে বাঁচাতে আগলে ধরল দিগন্ত।
চমকে উঠল বেলা। শিরশির করে উঠল সর্বাঙ্গ। দিগন্তের দুহাত শক্ত করে আকড়ে ধরেছে ওর কোমড়। অনাকাঙ্ক্ষিত এই ছোঁয়া হুট করেই তোলপাড় তুলল ওর মনে। কেমন যেন একটা মিশ্র অনুভূতিতে ছেঁয়ে গেল সমস্ত কায়া। কি হলো হঠাৎ! কেন এমন হলো বুঝল না বোকা বেলা।
এদিকে ভেসে এলো দিগন্তের অস্থির গলার স্বর,
‘ ঠিক আছিস? লেগেছে কোথাও? ’
কি জবাব দেবে বেলা! ও তো নিজেকেই সামলাতে পারছে না। দিগন্তের হাত এখনো ওর কোমড়ের বাঁকে। গলা দিয়ে টেনেও আওয়াজ বের হতে চাইছে না। একটা শুকনো ঢক চেপে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,
‘ ক…কেমন জ..জানি লাগছে! আপনি এ..একটু সরে দাঁড়ান। ’
ভ্রুঁ কুঞ্চিত হলো দিগন্তের। প্রশ্ন করল,
‘ কিহ! কি বললি? ’
বেলা আবারো বলল,
‘ আপনার হাত সরান। আমার কেমন যেন লাগছে। ’
সহসা দিগন্তের কোঁচকানো ভ্রুঁজোড়া শিথীল হলো। বোকারাণী বেলা ছোট হলেও দিগন্ত তো আর ছোট নয়। চতুর মস্তিষ্ক যা বুঝার তা ঠিকি বুঝল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। হাত সরাতে চাইলেও মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেল। সেভাবে থেকেই প্রশ্ন ছুড়ল বেলার উদ্দেশ্যে,
‘ কেমন লাগছে? ’
-‘ জানি না তো। ’
-‘ আগে বল তারপরে ছাড়া পাবি। ’
চোখের চাহনি আসহায় হলো বেলার। ও তো নিজেই জানে না ওর কেমন লাগছে। অজানা এ অনুভূতির সাথে তো পূর্ব পরিচিত নয় বেলা। দিগন্তকে কি বলবে! এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ধীর স্বরে বলল,
‘ সরে দাঁড়ান না দিগন্ত ভাই। ’
দিগন্তের একই কথা, ‘ আগে বল ‘
ঠোঁট উল্টালো বেলা। মিনমিনে গলায় বলল,
‘ আমি তো জানি না কেমন লাগছে। আপনাকে কিভাবে বলব? ’
বেলার ঠোঁট উল্টানো দেখে একটা বড় শ্বাস টেনে আলগোছে নিজের হাত সরিয়ে নিল দিগন্ত। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘ পায়ে লেগেছে কি? ’
-‘ না ’
অনেকটা দূর চলে এসেছে দিহান আত রায়হান। একটা হোটেলের সামনে বাইকের উপর হেলান দিয়ে চা খাচ্ছে রায়হান। দিগন্তের জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আসার কোনো নাম-নিশানা নেই। দিহানরা এতোক্ষন ওর সাথেই দাঁড়িয়ে ছিল। কয়েকমিনিট আগে আবারো চলা শুরু করেছে। কারণ নতুন বউকে সকাল আটটার মধ্যে উপস্থিত চায় রকেয়া তালুকদার। তাই আর দেরী করতে পারল না ওরা। রায়হানও ওদের চলে যেতে বলে দিগন্তের জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকক্ষন হয়ে গেল। এরমধ্যে দু’কাপ চা শেষ রায়হানের। আর দাঁড়িয়ে থাকার ধৈর্য্য ধরছে না। ফোন বের করে দিগন্তের নাম্বারে ফোন লাগালো। অনেকক্ষন পর ফোন উঠাল দিগন্ত। ওকে পেতেই রায়হান বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলে উঠল,
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ১৯
‘ কোথায় তুই? মাঝরাস্তায় অপেক্ষা করছি কতক্ষন থেকে? এতো সকালে মানুষজনও নেই আশেপাশে। নিজেকে কেমন এতিম এতিম লাগছে।’
অপরপাশ থেকে দিগন্ত বলল, ‘ চলে যা। আমার যেতে দেরী হবে। সময় মতো চলে যাবো। ’
দিগন্তের কথা বুঝল রায়হান। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘ আমার পুরো জার্নিটা তোর বোন মাটি করল। ধ্যাত! ঘুর তুই শালা। ’
বলেই ফোন কেটে দিল। তারপর ফুল স্পিডে বাইক ছাড়ল। এ ছাড়া আর কি-ই বা করবে ও।