দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৩

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৩
আফরোজা আশা

সকাল সকাল উঠে পড়েছে সবাই। বাণী,দিহান, রায়হান,বেলা,দিগন্ত সবাই ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে সকালের গ্রামীণ পরিবেশটা ঘুরে দেখার জন্য। বৃষ্টি হয়েছে রাতে তাই মাটির কাঁচা রাস্তাটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। সকলের সামনে হেলেদুলে হাঁটতে থাকা বেলা হুট করে থেমে যায়। ওর দেখাদেখি বাকিরাও থামে। বেলার নজর একদিকেই নিবদ্ধ। ওর নজর খেয়াল করে বাকি সবাই সেদিকে তাকালো।
বেলা কোমড়ে হাত রেখে একদৃষ্টে চেয়ে আছে একটা কাঁচা আমের থোকার দিকে। একটু উঁচুতে আছে ওটা। কিন্তু একসাথে তিনটা বড় বড় কাঁচা আম ঝুলছে। দিহান আমের দিক থেকে নজর সরিয়ে বেলাকে বলে,

‘ দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? এখান থেকে বিলে যেতে আরো দশ মিনিটের মতো পথ হাঁটতে হবে। ’
বেলা আমগুলোর দিকে আঙুল তাক করে বায়না ধরে ও এগুলো খাবে। দিহান মানা করছে ওকে। এ গাছের মালিক অনেক ত্যাড়া আর খিটখিটে। আম চাইতে গেলে তো দিবেই না। চুরি করে ধরা পড়লে খবর করে ছাড়বে। পুরো গ্রাম হাঁক-ডাক করে এক করবে। ওই বুড়োর ক্যাচাল এর ভয়ে কেউ ওর গাছের ধারের কাছেও ঘেঁষে না। বিলের পাড়ে ওদের আম গাছ আছে সেখান থেকে কাঁচা আম পেড়ে দিবে কিন্তু বেলা তাও ওর কথা শুনছে না। দিহানের এতো বুঝ বেলা কানে তুলতে নারাজ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

দিগন্ত ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ফোন ঘটছে আর শালি-দুলাভাইয়ের কাহিনী দেখছে। বাণী, রায়হানও বুঝালো বেলাকে কিন্তু ওর ওই আমগুলো চাই মানে চাই। লম্বা বড় বড় সবুজ রাঙা আমগুলোতে মন বসে গিয়েছে বেলার।
দিগন্ত হাতের ফোনটা পকেটে ঢুকালো। পাশ থেকে দেখে দেখে চারটা বড় ইটের টুকরো হাতে তুলে নিল। দুইটা রায়হানের হাতে দিল আর দুইটা ওর কাছে রাখল। রায়হানকে ইশারা করল ঢিল মারার জন্য। অতঃপর দুজনে একসাথে নিশানা বরাবর মারা শুরু করল। এক এক করে চারটা ঢিল লাগল ঝুলতে থাকা আমগুলোতে। কাঁচা আম তিনটি সেই ঢিলের বেগেই শব্দতুলে মাটিতে আছড়ে পড়ল। বেলা খুশিতে লাফাতে লাফাতে গিয়ে তিনটা আম-ই হাতে নিল। কিন্তু আমগুলোর চেহারা দেখার আর সময় পেল না। ইতিমধ্যে দিগন্তদের কাহিনী দেখে বাণীকে নিয়ে বিলের রাস্তায় ছুট লাগিয়েছে দিহান। ঢিল ছুড়ার পর রায়হানও ভোঁ দৌড় দিয়েছে ওদের পিছে পিছে।
বাড়ির ভেতর থেকে একটা বুড়া গলা ছেড়ে হুংকার ছুড়ছে,

‘ কে রেএএ? থাম! ওখানেই থাম! আমার গাছের আম চুরি করা বের করছি। থাম! ’
দিগন্ত বেলার একহাত ধরে বড় বড় পা ফেলে ওকে টেনে-ছিঁচড়ে নিয়ে যেতে শুরু করল। দিগন্ত জোরে হাঁটছে কিন্তু বেলা ওর পাশে দৌড়াচ্ছে। দিগন্তের সাথে তাল মেলাতে পারছে না বেলা। হাতের আমগুলো উপচে পড়ে যেতে চাইছে। প্রায় কিছুক্ষন এভাব হাঁটার পর বেলা বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ আস্তে হাঁটেন না। আমি পড়ে যাবো তো। ’
দিগন্ত বেলার হাত থেকে দুইটা আম নিজের হাতে নিয়ে কড়া গলায় বলল,
‘ চুরি করেছিস বেয়াদব। চুরি করলে সেটা নিয়ে ওই এলাকা থেকে হাওয়া হয়ে যেতে হয় এটাও শেখায় নি তোর বাপ।’
দিগন্তের সাথে তাল মিলাতে মিলাতে বেলা সোজা বলল,

‘ আমি তো চুরি করি নি,দিগন্ত ভাই। ’
‘ কে করেছে? ’
‘ আপনি। ’
সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল দিগন্ত। বেলার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ আর কোনোদিনও বলিস কিছু তারপর সেটার বদলে শুধু থাপ্পড় জুটবে তোর কপালে। ’
পাশ থেকে ভেসে এলো রায়হানের কটাক্ষ মিশ্রিত গলা,
‘ দেখলি! যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর। ’
বেশ অনেকটা দূরেই চলে এসেছে ওরা। তাই বেলার হাত ছেড়ে দিল দিগন্ত। রায়হানের সাথে আবার ধীরেসুস্থে সামনের দিকে এগোতে লাগল। বেলার হাতে এখনো একটা আম আছে। বেলার নজর সেই আমে। রাস্তার দিকে খেয়াল নেই ওর। হাতের বড় সাইজের আমটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আর হাঁটছে। কাঁচা আমটা খাওয়ার জন্য জিভ নিসপিস করছে ওর।

হঠাৎ একটা জায়গায় ধুপ করে পা পিছলে পড়ে গেল ও। পায়ে ব্যাথা পেল প্রচণ্ড। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বের করল না। লজ্জা লাগছিল ওর। এতো বড় মেয়ে পিছলা খেয়ে পড়েছে আবার সামনে দুইটা দামড়া দামড়া ভাইকে ডেকে কাঁদবে।
তার কোনো সাড়াশব্দ না বের করেই পায়ে হাত রেখে সেখানেই ঠোঁট উল্টে কাঁদা শুরু করল বেলা। কাঁদছে কিন্তু কোনো শব্দ নেই। আর নাই-বা আছে আশেপাশে কোনো মানুষজন। থাকবেও বা কিভাবে এই রাস্তায় শুধু ধান ক্ষেত আর পুকুর এর সমাহার। মাঝে মধ্যে এক-দুইটা বাড়ি চোখে পড়ছে। যা এক-দুটো মানুষ থাকত বৃষ্টির কারণে কেউ এখনো বের হয় নি হয়তো।

বাণী দিহান একসাথে সামনে হাঁটছে। ওদের পিছে দিগন্ত আর রায়হান গল্প করছে নিজ মনে। সাথে যে বেলা নেই সেটা এখনো খেয়াল করে নি কেউ।
রায়হানের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে হুট করে দিগন্তের হাঁটা থেমে যায়। আশপাশ চোখ ঘুরিয়ে খুঁজে একজনকে। পায় না। বাণী দিহান অনেকটা দূরে চলে গিয়েছে। ওদের সাথে থাকার কথা না।
দিগন্তের গতি থেমে যাওয়া দেখে রায়হান বলল,

‘ কি হলো? ’
‘ বেলা কোথায়? ’
‘ আমাদের সাথে-ই তো হাঁটছিল। ’
উদ্বিগ্ন হলো দিগন্ত। রায়হানকে সেখানে রেখেই ফেলে আসা পথটুকু আবার হাঁটা শুরু করল। কিছুটা গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। কাদামাটির পানিতে ভেজা একটা রাস্তায় পায়ে হাত দিয়ে বসে আছে বেলা। জামা-কাপড় সব কাঁদাতে মাখামাখি হয়েছে। চুলেও কিছুটা লেগেছে। দিগন্তকে দেখতে পেয়েই এতোক্ষন নিরব কাঁদতে থাকা বেলা এবার আর থাকতে পারল না। ভ্যাঁএ! করে কেঁদে উঠল।
দিগন্ত তড়িৎ গতিতে ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। কিছুটা অস্থির গলায় বলে,

‘ পড়লি কিভাবে? ’
বেলা কান্নারত গলায় বলে, ‘ পড়ে গিয়েছি। ’
‘ লেগেছে? ’
‘ হ্যাঁ ’
‘ কোথায়? ’
বেলা পায়ের একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, ‘ এখানে। ব্যাথা করছে। উঠে দাঁড়াতে পারছি না। ’
দিগন্ত জায়গাটা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল,‘ কখন পড়েছিস? ’
বেলা সরলভাবে উত্তর দিল, ‘ ঘড়ি নেই তো কাছে। সময় দেখি নি। ’
তীর্যক চাহনিতে বেলার মুখের দিকে চাইল দিগন্ত। গমগমে গলায় বলল,
‘ তুই একটা দেশী মেয়ে কিন্তু চাল-চলন এরকম হাইব্রিডের মতো কেনো? ’
‘ মা…’ মুখের কথা মুখেই রইল বেলার। চোখজোড়া বড় বড় করে দিল এক চিৎকার। দিগন্ত ওর পা ধরে মোচড় দিয়েছে। কি যে ব্যাথাটা পেয়েছে বেলা! দিগন্তের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ ভেঙে দিলেন আমার পা টা? শেষ, সব শেষ। এখন কি হবে আমার? ’
দিগন্তও চেহারায় বিস্ময় ভাব এনে বলল,

‘ ভাঙা পা নিয়ে কি করবি এখন? কোলে উঠবি। আয় কোলে আয়। এমনিই তুই বাচ্চা মানুষ। ’
বেলা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ আমি কলেজে উঠা এতো বড় মেয়েটা আপনার কোলে চাপবো কেনো? ’
‘ তুই নিজেকে বড় ভাবছিস? ’
‘ ভাবার কি আছে? আর কদিন পর আমি সতেরো বছরে পা দিবো। ’
‘ আঠারো হলে বেশি ভালো হতো। ’
‘ কেনো? ’
জবাব দিল না দিগন্ত। বেলাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,
‘ হাঁটতে পারছিস কিনা দেখ এখন ’
বেলা আস্তেধীরে উঠে দাঁড়ালো। আগে মতো ঠিকভাবে হাঁটতে না পারলেও ব্যাথাটা কমেছে অনেক। পা ফেলাতে পারছে। দিগন্ত ওর সামনে একহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ হাত ধরে হাঁট। ’

বেলা দিগন্তের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরল। পাশ ফিরিয়ে দৃষ্টি স্থাপন করল দিগন্তের মুখের দিকে। লম্বা দিগন্তের বুকে পর্যন্ত উঠতে পেরেছে ও। ঘুম থেকে উঠার কারণে চুলগুলো এলোমেলো অনেকটা। অগোছালো চুল, চাপ দাঁড়ি,সিগারেট পোড়া দু’ঠোঁট আর লম্বাটে নাকের আদোলে গড়া ফর্সা চেহারাটা দেখতে সুন্দর লাগছে বেলার।
দিগন্তের হাত ধরে হাঁটতেও ভালো লাগছে ওর। ও ব্যাথা পেলে দিগন্ত যেভাবে ওকে নিয়ে ভাবে সেটাও খুব ভালো লাগে বেলার। এতো ভালো লাগার নিয়ে ভাবতে গিয়ে পিচ্ছিল একটা জায়গায় এসে আবারো পিছলা খেলো বেলা। দিগন্ত বেলার হাত ধরে নিজের মতো হাঁটছিল। বেলা পড়ে যেতে নিলে ওর ধরে রাখা হাতটা আরো শক্ত করে ধরল।
কাঁত হয়ে কিছুটা হেলে গিয়েছে বেলা। দিগন্ত এবার একটু ফাঁক রেখে ওকে দুহাতের মাঝে আস্তে করে ধরে বলল,
‘ চোখ দিয়ে দেখে হাঁটিস না কেন? আরেকবার পড়লে অকালেই কোমড় হারাবি। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২২

বেলা একটু ভয় পেয়েছিল ঠিক কিন্তু মনের মাঝে কেনো যেন একটা বিশ্বাস চলে এসেছে দিগন্ত ওকে আঘাত পেতে দিবে না। দিগন্তের কথা শুনে পুরো মাথাটা ঘুরিয়ে ওর দিকে চাইল। তাতক্ষনাৎ চোখে পড়ল দিগন্তের গলার মাঝে উঠানামা করার একটু ফুলো অংশ। একটা শুকনো ঢোক চাপলো বেলা। মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
‘ আপনি দেখতে অনেক সুন্দর, দিগন্ত ভাই। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৪