দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৫
আফরোজা আশা
পুরো হোটেল ফাঁকা। মাঝ বরাবর একটা টেবিল জুরে দুজন মানুষের অবস্থান। এপাশ-ওপাশ মুখোমুখি হয়ে বসে আছে দিগন্ত তালুকদার আর রহমান পাটোয়ারী। দুজনে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। বেশ অনেকক্ষন পর নিরবতা ভেঙ্গে রহমান বলল,
‘ কি বলতে চাও? ’
শান্ত চাহনিতে একবার রহমানকে দেখল দিগন্ত। পরক্ষণেই স্পষ্ট গলায় বলা শুরু করল,
‘ আমি এতো ঘোরপ্যাঁচ কথা বলতে পারি না। নাইবা আমার এতো ধৈর্য্য আছে। তাই আমার ব্যাপার সরাসরি আমিই বলছি, আপনার মেয়েকে ভালোবাসি। বিয়ে করব ওকে। ’
ভেতরে ভেতরে চমকালো রহমান। কিন্তু মুখভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। দিগন্তের কথার প্রেক্ষিতে হালকা হেসে বলল,
‘ তুমি হয়তো জানো না। আমি বৃষ্টির জন্য পাত্র ঠিক করে রেখেছি। সে আপাতত দেশের কাজে..’
‘ উহুম! বেলা। ’
বেলার নামটা কর্ণকুহুরে পৌঁছাতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রহমান। চোখ-মুখ মাত্রাতিরিক্ত গাম্ভীর্যতায় ছেয়ে গিয়েছে। গমগমে আওয়াজে বলে উঠল,
‘ তোমার সাথে আমি কোনোরূপ রেষারেষি চাই না। তোমার আচার-ব্যবহার আমার কোনোকালেই পছন্দ নয়। এ ধরণের ঠাট্টা-তামাশা আর করবে না। ’
‘ আপনার সাথে আমার ঠাট্টার সম্পর্ক নয়। যেটুকু বলার প্রয়োজন ছিল বলে দিয়েছি। কারণ দিনশেষে আমার জীবনের বড় আমানত আপনার কাছে গুচ্ছিত। ’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রহমান শক্ত গলায় বলল, ‘ তোমার মতো গুন্ডাদের আমি কখনোই পছন্দ করি না। নেহাৎ মিতালীর সাথে তোমার সম্পর্ক রয়েছে। সে খাতিরে দু-একটা ভালোমন্দ কথা বলেছি। সেসবের জন্য আমাকে ভালো ভেবে আমার মেয়ের দিকে নজর দিবে না। মেয়েদের ব্যাপারে কারো সাথে আমার বিন্দুমাত্র আপোষ নেই। ’
দিগন্ত তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে রহমানের দিকে। রহমান যে রেগে আগুন হয়ে গিয়েছে তা ওর চোখের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল দিগন্ত। পরপরই বলল,
‘ আমি আপনার মতামত চাই নি। আমার কথাটুকু জানিয়েছি শুধু। এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই। বসে কথা বলেন। ’
দিগন্তের কথাগুলো শ্রবণ হতেই আরো বিষিয়ে যায় রহমানের মন। রাগে শরীর জ্বলছে রি রি করে। টেবিলের উপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বারি মেরে হিসহিসিয়ে বলে উঠে,
‘ তোমার মতো ম্যানারসল্যাস ছেলে আমি দুচোখে দেখতে পারি না। তুমি আমাকে হুকুম করছো? তোমার এই বুকের পাটা তোমার কাছেই রাখো। আমার মেয়ে অনেক ছোট। তোমার আর তার বয়স পার্থক্য সম্পর্কে আদোতে কোনো আইডিয়া আছে তোমার? ’
‘ বয়স দিয়ে ধুয়ে পানি খাবো? ’
‘ কোনো গুন্ডা-মাস্তান কখনোই আমার মেয়ে-জামাই হতে পারে না। তাই ভালো চাও তো আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকবে। নাহলে সোজা মামলা দিবো তোমার নামে। ’
ওষ্ঠজোড়া হালকা প্রসারিত হলো দিগন্তের। মাথার কুটিল বুদ্ধিগুলো আবারো মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। ঝট করে উঠে রহমান পাটোয়ারীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘ ঠিক আছে। মেনে নিলাম আপনার কথা। দূরে থাকব তবে আপনাকেও আমার একটা কথা মানতে হবে। ’
আগুনের ফুলকির ন্যায় জ্বলজ্বলে তীক্ষ্ণ চোখজোড়ার স্থান দিগন্তের মুখপানে। এতো সহজে আপোষে আস্তে চাইছে ওর সামনে দণ্ডায়মান রগচটা, বদমেজাজি ছেলেটা। মুখ-ভঙ্গিমাও একদম শান্ত,স্বাভাবিক। কোনোরকম হুমকি-ধমকি, কথা-কাটাকাটি ছাড়াই মেনে নিতে চাইছে ওর কথা। মানতে খানিকটা বেগ পেতে হলো রহমানের। তবুও নিজ চেহারার গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে গুরুগম্ভীর গলায় বলল,
‘ যদি তুমি সত্যি বেলার থেকে দূরে থাকো তবে তোমার একটা কথা মানতে আমার কোনো আপত্তি নেই। ’
মনে মনে ভীষণ খুশি হলো দিগন্ত। তার খানিকটা ছাপ পড়ল ওর চোখের ভাজে। ধূর্ত রহমানের নজর এড়ালো না সেটা। মনে মনে দ্বিধায় জোড়ালো সে। মেনে নিয়ে কি বিরাট ভুল করল? একবার কথা দিলে সেটার বরখেলাপ তো সে কোনোদিনও করে না। ছেলেটা যদি ওকে কথার বেড়াজালে ফাঁসিয়ে নিজের কাজ করে নেয়? এ ছেলেকে বাইরে থেকে যতটা সহজ মনে হয়, ও একদম সেরকম সহজ ছেলে নয়। মানুষকে কথার মার-প্যাঁচে আটকে দেয়। দিগন্তকে এতটুকু চেনা আছে রহমানের। নিজের মুখ থেকে বের হওয়া কথাটার জন্য এখন বেজায় আফসোস করছে সে। কিছু না ভেবে, না শুনে হুট করে দিগন্তের কথাটা মেনে নেওয়া উচিত হয় নি তার। রহমানের মুখে অমোঘ চিন্তার ছাপ দেখে আনন্দ পেল দিগন্ত।
‘ আমি যেমন বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছি আপনার কথা পরবর্তীতে আপনাকেও মেনে নিতে হবে। কোনো প্রকার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে আমি আমার লিমিট ক্রস করতে দুবার ভাববো না। আশা করি আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার যথেষ্ট ধারণা আছে। লোকমুখে ছড়াছড়ি রহমান পাটোয়ারী এক কথার মানুষ। আসলেই কি তাই! ’
মাঝ বয়সের হালকা চামড়া কোঁচকানো ভ্রঁদ্বয়ের মাঝে গাঢ় ভাজ পড়ল রহমানের। ভারীক্ষি গলায় বলল,
‘ কি বলতে চাও সোজাসাপটা বলো। এতো কথা শোনার প্রয়োজন নেই আমার। তুমি যে এককথায় বুঝেছো আর আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকতে চেয়েছো একথা ভুলো না আবার। ’
দিগন্তের ওষ্ঠপুটে ক্রুর হাসির উদ্ভব ঘটল। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল,
‘ অবশ্যই! দিগন্ত তালুকদার তার কথায় অটুট থাকে। তবে..’
‘ তবে কি? ’
‘ আপনার মেয়ে আমার কাছে আসলে আমি তাকে ফেরাবো না।’
দিগন্তের কথায় ভয় পেয়ে চমকানোর কথা থাকলেও রহমান এক চুল পরিমানও বিচলিত হলো না। বরং ওষ্ঠজুড়ে ছেয়ে গেল এক বিস্তর হাসির রেখা। কণ্ঠে কিছুটা অহমিকা নিয়েই বলল,
‘ সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত থাকো। আমি থাকতে আমার মেয়ের এরকম মতিভ্রম কখনোই হবে না। ’
‘ অহংকারের পতন আছে পাটোয়ারী সাহেব। মেয়েদের নিয়ে একটু বেশিই অহংকার নয় কি আপনার? ’
‘ কিছু অহংকারের পতন নেই। আমার মেয়েরা আমার অহংকার, আমার গর্বের কারণ। তারা পথভ্রষ্ট হলেও সঠিক পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য আমি আছি। তুমি শুধু খেয়াল রেখো তোমার কথার যেন হেড়ফের না হয়। ’
বলেই আর দাঁড়ালো না রহমান। যেভাবেই তাড়া নিয়ে এসেছিল। সেভাবেই হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
রহমানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল দিগন্ত। রায়হান এসে দাঁড়ালো ওর পাশে। অবাক গলায় বলল,
‘ মেনে নিলি যে! কি হলো ব্যাপারটা? এটা সত্যি তুই বলছিস? লোকটার এককথায় বেলার থেকে দূরে সরে আসবি। হাউ! ’
দিগন্ত রায়হানের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ যখন কাছে থেকে কাজ হয় না তখন দূরে সরে যাবি। দেখবি কাজ অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। ’
‘ মানে? ’
‘ সময় হলে বুঝবি। ’
বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। এই বারিধারার মাঝে হুড়মিড়িয়ে বাড়িতে এলো দিগন্ত। রাত অনেক হয়েছে। পুরো বাড়ি অন্ধকার। পরিবেশ থমথমে। অন্ধকারে মোড়া পুরো বাড়ির মধ্যে শুধু ডাইনিং এর হালকা আলোটুকু নিঃশব্দে জ্বলছে।
পুরো শরীরের অনেকাংশে ভিজে গিয়েছে দিগন্তের। ভেজা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে থামল। মিতালী ঘুমে টুপছে আর কাঁচা শাক বেছে রাখছে। তা দেখে ভারী গলায় দিগন্ত বলল,
‘ রাত এতো হয়ে গেল ঘুমাও নি কেনো? ’
টুপে পড়ছিল মিতালী। দিগন্তের আওয়াজ পেয়ে ঘুম ধরা চোখগুলো ফিরিয়ে ওর দিকে তাকালো। একটা বিরাট হাই তুলে বলল,
‘ তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার গরম করছি। ’
দিগন্তের কপালে ভাজ পড়ল। ওর জন্য অপেক্ষা করতে বারণ করে প্রতিদিন কিন্তু মিতালী সে কথা কানে তুললে তো। সারাদিন খেটেখুটে সেই আবার রাত জেগে বসে থাকবে ওর জন্য। দিগন্ত চাইলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারে না। এতো রাত অব্ধি জাগার কোনো মানেই নেই। গমগমে গলায় বলল,
‘ তোমার কি নিজের শরীর নিয়ে একটুও ভাবনা নেই? আর কত বার বলব রাত জেগো না। ’
মিতালী বাঁকা গলায় বলল, ‘ তুই রাতে তাড়াতাড়ি ফিরলেই তো পারিস। ’
-‘ আমার কাজ থাকে। ’
-‘ অকাজ সব। এমন তো না সরকারি চাকরি করছিস তাই সরকার তোকে বেঁধে রেখে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। সেই তো দাদাগিরি করে বেড়াস। ’
-‘ তোমার আর তোমার ভাইয়ের কথার ধরণ একি! সুযোগ পেলেই আমাকে ঠেস মেরে কথা বলতে ছাড়ো না। ’
ভাইয়ের কথা আসতেই কৌতুহলি একটা ভাব চলে এলো মিতালীর মাঝে। বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ ভাইয়ের কথা বললি যে? দেখা হয়েছিল নাকি! ’
দিগন্ত সায় জানিয়ে বলল, ‘ হ্যাঁ। সন্ধ্যার পরে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছি দুজনে। ’
মিতালী অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘ বলে দিয়েছিস সব? ’
‘ হু ’
‘ তারপর ; কি বলল? ’
দিগন্ত একটা চেয়ার টেনে বসল। মিতালীর শাড়ির আঁচল টেনে মাথা মুছতে মুছতে রহমানকে ভেঙিয়ে বলল,
‘ সেই একই বাণী, আমার মেয়ে অনেক ছোট। দূরে থাকবে ওর থেকে। তোমার মতো গুন্ডা-লাফাঙ্গা ছেলেকে আমি কখনোই মানব না। আমার মেয়ের সাথে কিছু করার চেষ্টা করলে মামলা দিবো তোমার নামে। ’
-‘ তুই কি বললি? ’
দিগন্ত গম্ভীর গলায় বলল, ‘ মেনে নিয়েছি। ’
চরম বিস্ময় নিয়ে মিতালী বলল, ‘ কি বলছিস? বেলাকে ছাড়া থাকতে পারবি? ’
দিগন্ত ম্লান হেসে বলল, ‘ ওকে ছাড়াই তো আছি। ’
মিতালী দিগন্তের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ সব ঠিক আছে? তোর চোখ-মুখ এতো শুকনো লাগছে কেনো রে? ’
‘ ঠিক আছি আমি। খিদে নেই। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। ’
‘ বড়ভাই কি আর কিছু বলেছে? ’
‘ বলেছে অনেক কিছুই। আমিও মেনে নিয়েছি। দূরে থাকব তার মেয়ের থেকে কিন্তু.. ’
‘ কিন্তু কি? ’
দিগন্ত মিতালীর দিকে তাকালো। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
‘ তার মেয়ে আমার কাছে আসলে আমি মানা করব না। মন বড় তো! ’
‘ ও এসবের কি বুঝে? আর তোর কাছেই বা আসবে কেনো বাপু?’
দিগন্ত মুচকি হেসে ডাকল, ‘ মনি! ’
‘ বল ’
‘ তোমার ভাতিজী মনে হয় বড় হয়ে গিয়েছে। ’
‘ হুম হয়েছে তো। বিকেলে ফোন দিয়েছিল। কি ভাব নিয়ে বলল! আমি এখন কলেজের ছাত্রী। ছোট নেই আর। ’
‘ জানো? ’
‘ কি? ’
‘ বেয়াদবটা হিংসে করছে? ’
‘ সে কি! কাকে? ’
‘ মাইশাকে ’
ভীষণ কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করল মিতালী, ‘ কি করে বুঝলি? ’
দিগন্ত ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, ‘ ওর চোখের চাহনি-ই সব বলে দেয় আমাকে। না বললেও ওর মনে কখন কি চলে তা আমার নখদর্পণে। ’
এক টুকরো হাসল মিতালী। পরক্ষনেই বলল,
‘ কিন্তু মাইশাকে হিংসে করবে কেনো? ’
‘ হয়তো গ্রামে কিছু শুনেছে। যাই হোক! ওর হিংসের কারণে আমার বেশ সুবিধা হয়েছে। ওর সাথে ওর বাপকেও সোজা করব এবার। কিন্তু একটা কারণে মার খেয়েছে বেয়াদবটা। ’
বাঁকা গলায় মিতালী শুধালো, ‘ তুই মেরেছিস? ’
‘ হু ’
‘ কেনো? এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তুলবি কেনো? ’
দিগন্ত একটু ফুঁসে উঠে বলল,‘ ও বারবার আমার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলছিল। আবার মাইশাকে আমার সাথে জড়িয়ে উল্টাপাল্টা বলছিল। এতোবার প্রশ্ন করলাম একবারো আমাকে কিছু বলে নি। ও জানতে চাইলেই তো সব বলে দিতাম। তা না করে নিজে নিজেই কত কিছু ভেবে নিয়েছে। বেয়াদব একটা! রাগ উঠেছিল খুব। সামলাতে পারি নি নিজেকে তাই দিয়েছি থাপ্পড়। অসভ্য মেয়ে! একে তো কিছু শোনেনি আমার কাছে তারউপর আবার ত্যাড়ামি করছিল। ’
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ২৪
গভীর রাত। শুনশান পরিবেশ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম নেই শুধু রায়হানের চোখে। বিছানা জুড়ে নড়াচড়া করছে। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বিশাল চিন্তার ভার। আর না পেরে উঠে বসল। একটা সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণের মাঝে শেষ করল সেটা। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না। বৃষ্টি থেমেছে। এই কাঁদাজলের মাঝে নিস্তব্ধতা ভেদ করে বাইক নিয়ে ছুটল এক জায়গায়।