দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৮

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৮
আফরোজা আশা

‘ আপা, শোনো। ‘
বৃষ্টির কাছ ঘেঁষে বসলো বেলা। নাক টেনে বললো,
‘ আমাকে.. হাঁচিইইই! ’
নাকমুখ কুঁচকে বেলাকের উপর খেঁকিয়ে উঠলো বৃষ্টি,
‘ এই সর! নিজের জ্বালায় বাঁচিনা। তুই এসে হাঁচা-হাঁচি শুরু করলি। এখনি না ভালো মানুষ গেলি। এর মধ্যে ঠান্ডা লাগালি কিভাবে? ’
বৃষ্টির কথায় পাত্তা দিল না বেলা। চুল দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ওর ওড়না টেনে নিয়ে মাথা মুছতে শুরু করলো বেলা। বৃষ্টি সরু চোখে কিছুক্ষন ওকে দেখে থেকে আবারো জানালার বাইরে তাকালো।

‘ এই বারো বেলায় গোসল করলি কেন? ’
বেলা মাথা মুছতে মুছতে বললো,
‘ গরম লাগছিল। গোসল দিলাম এখন ঠান্ডা লেগে গেল। ‘
বৃষ্টি বাহিরের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বললো, ‘ আমি বিয়ে করতে চাই না বেলা। আব্বু বুঝছে না কেনো বল তো। কিভাবে বোঝাবো আমি? ’
বেলা ওর থেকে দ্বিগুণ উদাসীন ভাব নিয়ে বলতে শুরু করলো,‘ তোমার ভাগ্য খুলেছে। বিয়ে দিতে চেয়েছে তাড়াতাড়ি করে নেও। তারপর জামাই নিয়ে ঘুরে বেড়াবা খালি। আমার ভাগ্যে মনে হয় না বিয়ে টিয়ে আছে। বাপ-জামাই এর ঝগড়া দেখেই জীবন কাটিয়ে দিতে হবে। জামাই হবে একটা ব্রিটিশ আর আব্বু তো আব্বুই। মন খারাপ করো না। তারপর.. তারপর আমি কাউকে ফোন দিবো না। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। ’
বৃষ্টি বেলার দিকে অবাক চোখে তাকালো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ কি উল্টাপাল্টা বকছিস। বেলা! কি বলছিস?’
হুট করে কি মনে করে বেলার কপালে হাত রাখলো বৃষ্টি। তাতক্ষনাৎ চমকে উঠলো। বেলার শরীর কিছুটা গরম হয়ে আছে। জ্বর আসছে। অবেলায় গোসল করে জ্বর এনেছে। তাই বেলার উপর চিল্লাতে চিল্লাতে ওকে ওষুধ খাওয়ালো বৃষ্টি। বেলা কাঁদছে আর কিসব বিড়বিড় করছে তাতে কান দিল না সে। ওকে শুইয়ে দিয়ে গায়ে কম্বল মুড়িয়ে দিয়ে নিচে নামলো। আমেনা আর রিনাকে বললো হালকা জ্বর এসেছে বেলার। তারপর আদা দিয়ে গরম চা বানিয়ে নিয়ে আবার উপরে উঠলো।

চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে বেলা। অনেকক্ষন পানিতে ভেজার কারণে হুট করে জ্বর উঠে গিয়েছিল। ওষুধ নেওয়ার কিছুক্ষণ পর শরীর ঘাম ছেড়েছে। এখন তাপমাত্রা স্বাভাবিক। বৃষ্টি চা এনেছে। বেলাকে ডেকে উঠিয়ে গরম চা খেতে দিল। ভালো লাগছে না বেলার। অনেকক্ষন বোনের সাথে থাকলো। জ্বর ছুটেছে আর আসেনি।
সন্ধ্যার পর নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়লো বেলা। আমেনা সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে। ফোন কোথায় পড়ে থাকে না থাকে তার হদিস নেই। বেলা ফোনটা আর রেখে আসেনি। বালিশ থেকে ফোন টেনে এনে দিগন্তের নাম্বারের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তখন ওভাবে ধমকিয়ে তারপর আর ফোন দেইনি দেখে রাগের উপর আরেকদফা রাগ জমা হলো। শেষমেষ দিগন্তের নাম্বার ব্লক করে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। শরীর বেশি ভালো না থাকায় সহজেই ঘুম ধরা দিল চোখে।

ঢাকা চলে এসেছে রায়হান। সারাদিন রাইড করে শরীর ক্লান্ত হয়ে আছে। ঘুমও ধরেছে ভীষণ। মাথা টনটন করছে ব্যাথায়। রাস্তায় যানজোট কম দেখে একটু জোরেই ছেড়েছে বাইক। ঠান্ডা বাতাসে চোখ লেগে আসতে চাইছে। দুসেকেন্ডের জন্য বন্ধ হয়ে এলো চোখ পরপরই ঝট করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই জোরে ব্রেক কোষলো। বাইক এসে লাগলো বয়স্ক এক লোকের হাতে থাকা বাজারের ব্যাগটাতে। রাস্তা ছেড়ে কোণায় চেপে গিয়েছিল রায়হান। ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে বয়স্ক লোক টা হাঁটছিল। একটুর জন্য জানে বেঁচে গেল।

বাইক থামিয়ে তড়িঘড়ি করে লোকটা কাছে আসলো রায়হান। বয়স্ক লোকটা চেঁচিয়ে গালাগালি করছে আর মাটিতে পড়া শাক-সবজি ঝেড়ে ঝেড়ে ব্যাগে তুলছে। রায়হান তার কাছে মাফ চাইতে চাইতে নিচু হলো সাহায্য করার জন্য তখনি আবার চোখ বড় বড় করে জোড়ে গলায় বলে উঠলো,
‘ ওই বুড়া! ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে এখন ঢাকায় এসে হাওয়া খাচ্ছিস। আমার বউ কে? দে! বউয়ের খোঁজ দে। ’
রায়হানের কথা শুনে মাথা তুলে ওর দিকে তাকালো বয়স্ক লোকটা। চেহারা দেখে চমকে উঠলো। একটা ঢোক গিলে রায়হানকে না চেনার ভান করে বললো,

‘ কে তুমি? আদব-কায়দা শিখোনি কিছু? মুরুব্বিদের সাথে এভাবে কথা বলে! ’
রায়হান কাজীর একহাত ধরে টেনে উঠালো। দুহাতে ওর একহাত ঝাপটে ধরে ত্যাদড় গলায় বললো,
‘ আদব-কায়দায় গুষ্টি মারি! বিয়ে করেও বউ নাই আমার কাছে আর আসছে আদব-কায়দা নিয়ে। ওইদিন মাথা খারাপ ছিল বলে বউ হারায় গেছে। চল! তাড়াতাড়ি চল! আমার কাবিননামা কোথায় আছে বল? নাম কি আমার বউয়ের? আজকে আমি বউ না পাইলে কিন্তু তোর বউও আর তোকে পাবে না।’
বয়স্ক কাজী ভয়ে কোঁকড়া লেগে গিয়েছে। রায়হান তার কানের গোড়ায় এসে গলা ফাটিয়ে চিল্লাছে। ভয়ার্ত গলায় কাজী বললো,

‘ তোমার বউ তোমার কাছে থাকবে। আমি কিভাবে বলবো তোমার বউ কোথায়! ’
রায়হান দাঁতে দাঁত পিষে কাজীর হাত ছাড়লো। বড় বড় পা ফেলে বাইক স্টার্ট দিয়ে জোরে গিয়ার চেপে ধরলো। অতঃপর একটানে এসে কাজীর থেকে দুই ইঞ্চি দূরত্বে বাইক থামালো। আরেকটু হলে বাইক কাজীর ছোটখাটো কুঁচকে আসা শরীরটার উপর উঠে যেত। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চার-পাঁচ কদম পিছিয়ে গেল কাজী। রায়হানকে বারবার মানা করছে আর পিছাচ্ছে সে। এদিকে কাজী যতবার পিছাচ্ছে রায়হান বাইক নিয়ে ততোবার তার দিকে ধেয়ে আসছে।
‘ আমাকে ছেড়ে দেও। আমি চিনি না তোমাকে। তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা। ’
রায়হান দাঁতে দাঁত পিষে বললো,

‘ আবার! আবার মিথ্যা বলছিস। বুইড়া ব্যাটা! যখন ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়েছিল তখন না খুব দাপট দেখালি। এখন আর আমাকে চিনতে পারছিস না তাই না। আমার বউয়ের নাম বল নাহলে দিলাম তোর উপর গাড়ি উঠায়। ‘
বলে আবারো একটানে কাজীর পায়ের কাছাকাছি এসে বাইক থামালো রায়হান। ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপছে কাজীর হাঁটুজোড়া। কপাল বেয়ে টুপটুপ করে ঘাম ঝড়ছে। এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো সে। বউ না পেয়ে ছেলের মাথা পুরা খারাপ হয়ে গিয়েছে। কেমন ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো ফোঁস ফোঁস করছে।

‘ এখনো চুপ করে আছিস। তোর বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই বুঝেছি। ইসস! তখনি তোর উপর উঠিয়ে দিতো হতো বাইক। বুইড়া খাটাশ! থাক তোকে আর নাম বলতে হবে না। আমি তোর ওপর গাড়ি উঠাচ্ছি। থাম! ’
বলেই রায়হান কোষে গাড়ির গিয়ার চেপে ধরলো। জোরে শব্দ হচ্ছে বাইক। ভয়ে কাঁদো কাঁদো অবস্থা কাজীর। রায়হানের মায়া হলো না তাতে। বাইক ছেড়ে দিল। নিজের দিকে বাইক তেড়ে আসতে দেখে বয়স্ক লোকটা জান-প্রাণ ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ ও আল্লাহ গো! বলছি বলছি। ’
কাজীর ঠিক সামনে থেকে বাইক ঘুরিয়ে বাম পাশে নিল রায়হান। রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
‘ বল। তাড়াতাড়ি নাম বল। ’
থরথরিয়ে পুরো শরীর কাঁপছে কাজীর। গলা শুকিয়ে গিয়েছে। বহু কষ্টে শুকনো ঢোক চেপে বললো, ‘ মা..মা..মা..’
আবারো চেঁচিয়ে উঠলো রায়হান, ‘ মামা করে তোতলাইস না। এতো ধৈর্য্য নাই আমার। নাম বল, নাম! ’
ধমক খেয়ে কাজী ফট করে বলে উঠলো, ‘ মাইশা আঞ্জুমান ’
চোখ বন্ধ করে একটা বড় শ্বাস টানলো রায়হান। বুকের কোথায় যেন শান্তি পেল। আবার চোখ খুলে কাজীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,

‘ এহহ বুড়া ব্যাটা! পুরা নাম মনে রাখছে। আবার নাটক মারায় আমার সাথে! এই! তুই না আমাকে চিনিস না? তাহলে আমার বউয়ের নাম কিভাবে মনে থাকে? ফাইজলামি মারাও আমার সাথে, হ্যাঁ?
সত্যি করে বল তো কাজীর বাচ্চা! দিগন্ত তোকে টাকা খাইয়ে ঢাকা এনেছিল তাই না? ভাবছো আমি বলদ, কিছু বুঝি না? একবার খালি বউ তুলে আনি তারপর তোদের সবগুলারে সাইজ করবো দেখিস।’
কাজী কি বলবে। ভয় মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না তার। রায়হান বাঁকা চোখে কাজীর দিকে চেয়ে বললো,
‘ বাইকের পেছনে উঠ, বুড়া। মাথা-টাথা আজও খারাপ আছে। সম্মান পরে বউসহ এসে দিয়ে যাবো। বস তাড়াতাড়ি। ঠিকানা বল তোর। ‘

কাজী গাঁইগুঁই করে মানা করলো। যাবে না সে রায়হানের সাথে। পরপরই বিশাল ধমক দিল রায়হান। ঠেলা পেয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বাইকে উঠে বসলো কাজী। অতঃপর তার বলা জায়গায় এসে থামলো রায়হান। কাজী নেমে রায়হানকে বললো বাড়িতে আসতে। রায়হান আবারো খেঁকিয়ে উঠে বললো,
‘ আসবো না আবার! আমার কাবিননামা তৈরি রাখ। কাল এসে যদি ঠিকঠাক না পাইছি তাহলে এইবার আর মুখে বলবো না সোজা তোর থুরথুরা বুড়া শরীরের উপর চড়িয়ে দিবো বাইক। যা দৌড় লাগা, কাজ শুরু কর। ‘
রায়হানের তাড়ায় পড়নের সাদা লুঙ্গি তুলে বাড়ির দিকে ছুটলো কাজী। রায়হান সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বাইক সোজা টান মারলো।

বাড়ি ফিরে আগে ফ্রেশ হয়েছে রায়হান। মাথা ব্যাথায় ফেটে পড়ছে। তাড়াহুড়া করে শাওয়ার নিয়ে,ওষুধ খেয়ে সেভাবেই কার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো আবার। পেছন থেকে ওর মা কয়েকবার ডাকলো ওকে সেসব শোনার সময় নেই ওর।
রাত হয়েছে অনেকটাই। তালুকদার বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালো রায়হান। ওকে দেখে দারোয়ান চুপচাপ গেট খুলে দিয়েছে। গাড়ি থেকে বের হয়ে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো রায়হান। ভাগ্যক্রমে কেউ দেখেনি ওকে। মিতালী আর বাণী রান্না করতে ব্যস্ত। বাকিরা হয়তো যে যার রুমে আছে। তবে রায়হান জানে এই সময় দিগন্ত বাড়িতে থাকবে না।তাই গটগট পায়ে হেঁটে একেবারে মাইশার রুমের দিকে চলে এলো।

মাইশার রুমের দরজা চাপানো। ওষুধ নিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে ও। পায়ের ফ্রাকচারের কারণে সারাদিন শুয়ে আছে। সাথে কোমড়ের ব্যাথাটাও একবার কমছে একবার বাড়ছে।
এতোক্ষন দিশা ছিল মাইশার সাথে। মাইশা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর কিছু দরকারি কাজে নিজের রুমে চলে গিয়েছে ও।
রায়হান সোজা এসে থামলো মাইশার কাছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে ও। রায়হান ঝটকা মেরে মাইশাকে এক টানে উঠিয়ে বসিয়ে দিল। ঘুমন্ত মাইশার ঘুম ছুটে গেল তাতক্ষনাৎ। ব্যাথায় কোমড় মট মট করে উঠলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দাবাং হাতের এক ভারী থাপ্পড় পড়লো ওর নরম গালে। দুনিয়ে ঘুরে গেল ওর। গালে হাত দিয়ে বোকার মতো সামনের দিকে তাকালো। মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে আছে। কি থেকে কি হলো বুঝতে পারছে না মাইশা। একদিকে কোমড়ের অসহ্য যন্ত্রনা অন্যদিকে গাল দাউদাউ করে জ্বলছে। চিৎকার করার ফুরসত টুকুও পেল না। তার আগেই ওর দিকে তেড়ে এলো রায়হান।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৭

মাইশার মুখ শক্ত করে চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
‘ আমি তোকে দেখিনি। তুই তো দেখেছিলি আমাকে। এতোদিন ধরে সামনে ঘুরছিস,একবারো কিছু বলার প্রয়োজন মনে হয়নি না? এদিকে,তোকে কোথায় খুঁজে পাবো না পাবো সে চিন্তায় পাগল আমি। আর তুই বিন্দাস জীবন কাটাচ্ছিস। হ্যাঁ? সিরিয়াল এটা? তোর সো কলড ভাই আর তুই সিরিয়াল পেয়েছিস? আমি রাগের মাথায় কি উল্টাপাল্টা বলেছি সেটা নিয়ে পড়ে থাকবি? ইডিয়েট! জাস্ট থাপ্রাইতে ইচ্ছা করতেছে। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩৮ (২)