দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪
আফরোজা আশা

টেবিলে সব সাজানো আছে। কিন্তু বেলা কি করবে, না করবে বুঝতে পারছে না। দিগন্ত চেয়ার টেনে বসল। উল্টিয়ে রাখা প্লেটটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। ডাইনিং এ রাখা সব খাবারগুলোতে চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে বেলার। কি দিয়ে শুরু করবে, কিভাবে দিবে ভাবলেই কান্না আসছে ওর। যেই গুন্ডা লোক ওকে মেরেছে, ওর প্রেমে বাম হাত ঢুকিয়েছে, সেই লোককেই কিনা আদর-আপ্যায়ন করে খাওয়াতে হবে ওকে।

‘ কার খেয়ালে ডুব দিলি? ’
দিগন্তের কথায় দুদিকে মাথা নাড়ালো বেলা। ধীর আওয়াজে বলল, ‘ কিছু না। ’
তারপর একে একে দিগন্তের প্লেটে খাবার তুলে দিল। খাওয়া শুরু না করে দিগন্ত বলে উঠল,
-‘ পাশে বস। ’
-‘ কেনো? ’
-‘ আমার সাথে খাবি। ’
-‘ আমি খেয়েছি। ’
-‘ আবার খাবি। ’
-‘ নাহ।’
গরম চোখে তাকালো দিগন্ত। নিভে গেল বেলা। মিনমিন করে অবুঝ গলায় বলল, ‘ আপনি আমাকে মেরেছেন। ভালো লাগছে না আপনার পাশে থাকতে। রাগ লাগছে খুব। ’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-‘ তুই রাগও করতে পারিস!’
-‘ আলবাত পারি। ’
– ‘ প্রেম করার বয়স হয়েছে? ’
হকচকালো বেলা। দিগন্তের মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, ‘ হ..হ্যাঁ.. না। ’
– ‘ সঠিক উত্তর নেই। অথচ প্রেম করতে গিয়েছিস নিজের থেকে দ্বিগুন বয়সি ছেলের সাথে। জানাবো বাড়িতে এসব? ’

– ‘ নাহ। মেরেছেন তো! প্রেমও হতে দেননি। আবার বাড়িতে এসব জানাবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন কেনো? ’
কথা বলল না দিগন্ত। ভ্রু নেড়ে ইশারা করল পাশে বসতে। থ্রেট যেহেতু দিয়েছে তাই রিস্ক নিবে না বেলা। যদি সত্যি সত্যি বাড়িতে বলে দেয় তাহলে কি করবে ও। দুনিয়া-দারি ভুলে নাচতে নাচতে গিয়ে দিগন্তের সামনেই রায়হানকে বলে দিল মনের কথা। তখন ওর ছোট মাথায় এতো প্যাঁচ এসেছে নাকি! দিগন্ত নামক গুন্ডা যে ওর সদ্য হওয়া প্রেমে আগুন দিবে তা বেলা নামক ষোড়শী বুঝতে পারেনি। এখন গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদে মরলেও এ প্রেম আর হওয়ার নয়। কিন্তু তাই বলে কি বাড়িতে এসব কথা জানা-জানি হয়ে মান খোয়াবে বেলা। কখনো না! মনে দুরুদুরু ভয় নিয়ে দিগন্তের পাশে চেয়ার টেনে বসল। বেলার সামনে প্লেটটা উল্টিয়ে নিজের দিকে নিল দিগন্ত আর ওর প্লেটটা বেলার দিকে ঠেলে দিল।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল বেলার। অবাক হয়ে বলে,

‘ এটা আমাকে দিলেন কেনো? এতো খাবার আমি কিভাবে খাবো? ’
– ‘ যেভাবে সবাই খায় সেভাবে। ’
-‘ আমাকে কি আপনার মতো এতো বড় মানুষ মনে করেছেন। আমি ছোট মানুষ, পেটটাও ছোট, খাইও সে পরিমাণ। ’
বেলার মুখ থেকে এতো বড় মানুষ কথাটা শুনতে মন জ্বলে উঠল দিগন্তের। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ জ্ঞান চেয়েছি তোর কাছে! বেয়াদপ মেয়ে, এতো বড় বড় বলে কি বুঝাতে চাইছিস আমি বুড়ো? ’
জিভ কাটল বেলা। দুপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ বুড়ো কেনো হবেন? আপনি দেখতে মাশআল্লাহ তবে ব্যবহার আস্তাগফিরুল্লাহ। এতো খাটাশ মানুষ হয়! ’

বেলার সরল সোজা কথায় রাগ বাড়ার কথা থাকলেও দমে গেল দিগন্ত। নিজের মতো খাবার বেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করল। তার আগে গমগম গলার আদেশ ছুড়ে দিল বেলার কাছে।
‘ ভালো চাস তো প্লেটের সবটুকু আমার সাথে সাথে শেষ কর। নাহলে যে কীর্তি করে বেড়াস সেসব তুলে দিবো তোর নীতিবান বাপের কাছে। ’
অসহায় চোখে একবার নিজের ছোট পেটটা দেখল, তারপর প্লেটের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টালো। অনেকক্ষন আগে খেয়েছে। এখন খিদে পেয়েছে বেশ খেতে পারবে ও কিন্তু দিগন্তের পাশে খেতে কেমন লাগছে। আয়েস করে না খেলে বেলার গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না। কি আর করার নিজেকে ঠেলে কোনো মতে খাওয়া শুরু করল, সাথে মনে মনে কান ধরল এখন থেকে যেখানে দিগন্ত তালুকদার নামক বজ্জাত লোক থাকবে সেখানে বেলা ছায়াও মারাবে না।
মাথা নিচু করে খেতে খেতে ঠোঁট এলিয়ে হালকা হাসল দিগন্ত। তা বেলার চোক্ষু আড়ালেই রয়ে গেল।

মাঝে কেটে গিয়েছে চারটা দিন। আজ বেলার স্কুল জীবনের শেষদিন। মন খারাপ নিয়ে তৈরি হচ্ছে স্কুলের জন্য। রেডি হয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিচে আসল। রহমান সাহেব নাস্তা করছে। বেলাকে দেখে আময়িক হেসে ডাকলেন নিজের কাছে। মনমরা হয়ে হেলেদুলে বাবার কাছ ঘেষে বসল বেলা। রহমান মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,
‘ ছোটাআম্মুর মন খারাপ দেখছি যে। স্কুল শেষ এজন্য বুঝি? ’
সায় দিল বেলা। মুখ লটকিয়ে রেখেই বলল,

‘ ভালো লাগছে না আব্বু। এখন থেকে আর স্কুলে যেতে হবে না ভাবলেই কষ্ট লাগছে। ’
হালকা হাসল রহমান সাহেব। নিজের প্লেট থেকে রুটি ছিঁড়ে মেয়েকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠছো। মন খারাপ করে না বাচ্চা। নতুন কলেজে যাবে, নতুন ফ্রেন্ডস হবে, দেখবে স্কুলের মতো সবকিছু সেখানেও একি থাকবে। এখন শুধু মন লাগিয়ে পড়াশোনা করো আর তোমার বেস্টটা দিয়ে পরীক্ষা দেও কেমন।’

বাবার কথা বুঝল বেলা। টুকটুক করে আব্বুর হাতে খেয়ে দেয় স্কুলের উদ্দেশ্যে ছুট লাগাল।
দুইপাশের দুটো বিনুনি হাত দিয়ে টেনে ধরে গুনগুন করে গান গাইছে আর রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে বেলা। স্কুলের একটু আগেই নামিয়ে দিয়ে গেছে রহমান পাটোয়ারী। বাকি রাস্তা বেলা ওর প্রাণপ্রিয়া সখীর সাথে হেঁটে যাবে। একটু হেঁটে একটা মোরের কাছে দাঁড়ালো বেলা। মিনিট খানেক বাদে ওর বয়সী দুপাশে দু’ঝুটি ওয়ালা একটা চঞ্চল বালিকা দৌড়ে এলো ওর দিকে। কাছে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ সরি সরি পার্টনার। আজ বাড়িতে পূজো রেখেছে তাই দেরী হয়ে গেল। ’
দাঁতকপাটি বের করে হাসল বেলা। রাইমা বসাক নামক পার্টনার এর ঘাড়ে হাত রেখে বলল,
‘ দেরী হলেও সমস্যা নেই বুঝলি। আজ আমরা স্কুলে যাচ্ছি না। ’
চোখজোড়া চিকচিক করে উঠল রাইমা’র। বিগলিত গলায় বলল,

‘ কিন্তু আজ যে শেষ দিন বেলা। মিস দিবি, সত্যি? ’
মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় ভান ধরে বেলা বলল,
‘ শেষদিন দেখেই তো যাবো না। জানিস সকাল থেকে মন খারাপ ছিল। আব্বুর কথা শুনে এখন একটু ভালো হয়েছে। আজ স্কুলে গেলে আবার মন খারাপ হয়ে যাবে তার থেকে বরং স্কুলের আশপাশে ঘুরে বাড়ি ফিরব। ’
ঠাসস করে একটা থাবা পড়ল বেলার মাথায়। চোখ-মুখ কুঁচকে নিল ও। রাইমার গজগজিয়ে বলল,

‘ গাধা! আগে বলবি না। টাকা নিয়ে আসতাম। এখন এতো টাকা আছে নাকি। ’
বেলা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘ টাকা দিয়ে কি করবি! আমরা তো রাস্তায় রাস্তায় ভেটকায় বেড়াবো। ’
– ‘ তা বেড়াবো। আচ্ছা চল! কিন্তু কেউ দেখলে? ’
– ‘ কে দেখবে? সবাই ব্যস্ত! আর আমরাও কিছুক্ষন ঘুরে বাড়ি ফিরব। এর মধ্যে কেউ দেখবে বলে মনে হয় না। ’
দুই বান্ধবী নিজেদের মধ্যে আরো কিছুক্ষন ষোলা পরামর্শ করে হাতে হাত ধরে হাঁটা লাগালো। আপাতত যেখানে দুচোখ যাবে সেখানেই যাবে ওরা। তবুও স্কুলে গিয়ে মুডের বারোটা বাজাতে রাজি নয়।

ও সখা গো ….
প্রেমে মোরে দিয়োনা ধরা,
ধরা দিলে তোমার মন ভাইঙ্গা হবে গুড়া গুড়া
রাইমার মুখ দুহাতে চেপে ধরল বেলা। রাগে কটমটিয়ে বলল,
‘ ছাগলের মতো গান ধরেছিস কেনো? ’
মুখ থেকে বেলার হাত সরিয়ে খিলখিল করে হাসি ধরল রাইমা। বিরক্ত হলো বেলা। রাইমা হাসতে হাসতে ওর গায়ের উপর উল্টে পড়ে বলল,
‘ দিগন্ত ভাইয়ের হাতে একটা চড় খেয়েই তোর ভালোবাসা উড়ে গেল। এই ছিল তোর মনে বেলা! এই তুই প্রেমে পড়েছিলি রায়হান ভাইয়ের। ভালোবাসার মান-সম্মান ডুবালিরে তুই। ’
কথা শেষ করে রাইমা আবারো সুর টানল,

ও সখা গো ….
প্রেমে মোরে দিয়োনা ধরা,
ধরা দিলে তোমার মন ভাইঙ্গা হবে গুড়া গুড়া
-‘ ধ্যাত! চুপ কর তো। এসব গান গাইবি না আমার সামনে। ’
– ‘ তুই চুপ কর। আমার এখনো একটা কথা মনে পড়লে হাসি পাচ্ছে জানিস।’
ভ্রুঁ নাচালো বেলা। জানে না ও। রাইমা ঠোঁট চেপে হাসি কন্ট্রোল করে বলল,
‘ সেদিন দিগন্ত ভাইয়ের হাতে চটকানা খেয়ে তুই কেমন কানা হয়ে গিয়েছিল। আগ-পাছ কোনো কিছু না দেখে, একটা মার খেয়েই বোতলের মতো কাঁদতে কাঁদত চলে গেলি। ’

চোখ-মুখ বিকৃত করে নিল বেলা। হাত উঠিয়ে রাইমার গালে জোরসে একটা চড় মেরে বলে,
‘ আমার হাত নরম তাই বেশি লাগল না, বুঝলি। দিগন্ত ভাই এর হাতের বড়ি খেলে বুঝতি কেনো বোতলের মতো কেঁদেছি। গালের হাড্ডি নড়ে গিয়েছিল মনে হয়। এখনো ব্যাথা আছে। ’
গালে হাত দিয়ে বেক্কলের মতো বেলার কথা শুনল রাইমা। বেশ লেগেছে ওর গালে। ঝিনঝিন করছে হালকা হালকা।
– ‘ এটা তো মুখে বললেও বুঝতাম। মারলি কেন? ’
– ‘ সেদিন রায়হান ভাইকে প্রপোজ এর জন্য এগিয়ে দিলি আমায়, পরে আমার বিপদে কোথায় ছিলি? এটা তার শোধ তুলেছি। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৩

বেলার উপর চড়াও হয়ে রাইমা কিছু বলতে নিবে কিন্তু হুট করে পার্কের ভিতরটা কেমন গন্ডগোল লেগে গেল। স্কুল ফাঁকি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা পার্কের শেষ কিনারে এসে বসে গল্প করছিল। শেষে বসে থাকায় দুজনেই বুঝতে পারছে না এতো কোলাহল কিসের? এই দিকটায় তেমন মানুষজন নেই। দুই বান্ধবী একে অপরের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫