দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৭

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৭
আফরোজা আশা

পাটোয়ারী বাড়িতে বৃষ্টি আর বেলার বিদায় একসাথে হয়েছে। বেশি দেরী হতে দেয়নি। রাতের প্রহর শুরু হওয়ার আগেই রহমান পাটোয়ারী দুই মেয়েকে দুই জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। তারপর গুটি কতক মিনিটের ব্যবধানে তার ভরা বাড়ি ফাঁকা, শূন্যে রূপ নিল। একদিকে, বৃষ্টিকে নিয়ে দেওয়ান’রা নিজ গন্তব্যে চলে গেল। অপরদিকে, বাণী আর বেলাকে নিয়ে তালকুদার’রা রওনা হলো তাদের নীড়ে।

রহমান শুধু নিষ্পলক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখলো ওদের যাওয়া। যতদূর পর্যন্ত দেখা গেল, দেখতেই থাকলো। দুচোখ ভরে দেখলো তিন কন্যার সাথে তৈরি হওয়া তার সামাজিক দূরত্বটুকু। ভালোবাসা, আদর-আহ্লাদের কোনো পরিবর্তন না ঘটলেও, মেয়েদের প্রতি তার দৈনিক শাসনের রুটিনে বিস্তর পরিবর্তন ঠিকি ঘটল। বিদায়ের আগ মূহুর্ত পর্যন্তও যতটা জোশ ছিল তার মনে, বিদায়ের ঠিক পরপর সব উবে গিয়েছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

গেটের সামনে ধ্যান মেরে অনেকটা সময় পার করল রহমান। অতঃপর, নিরবে পা বাড়ালো ভেতরের দিকে। শরীর-মন কোনোটাতেই আর বিন্দু পরিমাণ জোর নেই। এতোক্ষন দাপটের সহিত একহাতে সব কাজ সমলানো রহমান পাটোয়ারী হুট করে কেমন যেন নেতিয়ে পড়লো। কারো সাথে কথা বলার শক্তিটুকুই অবশিষ্ট নেই তার মধ্যে।
অবশ পাজোড়া টেনে কোনোমতে রুমে চলে গেল। দরজা এঁটে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে থম মেরে শুয়ে রইলো। বর্তমানে তার বুক ফাঁকা, বাড়ি ফাঁকা। কানের পাশে ভেসে বেড়ানো মেয়েদের আব্বু ডাক নিরবতায় রূপ পাল্টেছে।
ভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝেছে রাসেল। বাড়িতে যেকজন আত্মীয়-স্বজন আছে তাদের দেখভালের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিল। অন্যদিকে, মেয়েদের রুমের মেঝেতে বসে শব্দ করে কাঁদছে আমেনা। রিনা আর দু’একজন মহিলা সদস্য তাকে সামলাচ্ছে। একইরুমের বিছানায় আধশোয়া রূপজান বেগম মেঝোনাতনীর জন্য বিলাপ বকছে। শ্যাযাগত বয়স্ক নারীর দূর্বলতা যেন ওই বৃষ্টি। বেশিই ভালোবাসে ওকে। হয়তো, নিজ হাতে গড়েছে বলে টান অনেক বেশি। সেটা একগুঁয়েভাবে প্রখর রূপ নিয়েছে তার বয়স্ক মস্কিষ্ক।

অন্ধকার রজনী। মাথার ওপরে চাঁদ তার ম্লান আলো চারপাশে ছড়িয়ে রেখেছে। নিভু আলোয় জ্বলতে থাকা তারার দল পুরো আকাশের বুকে আধিপত্য খাটাচ্ছে। নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়া পৃথিবীতে, ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম ডাক নিস্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে ভেসে বেড়াচ্ছে। জ্বলজ্বলে আলোকিত রুমের বিছানা দখল করে ঝিমাচ্ছে এক লালবধূ। ক্লান্ত শরীর; ঘুম যেন চোখ ছাপিয়ে এসেছে।

ঝিমোতে ঝিমোতে টের পেল বেলা, বিছানায় এককভাবে বসে থাকার দরুন কোমড় লেগে এসেছে। তালুকদার বাড়িতে আসার পর কিছুক্ষন ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রাখা হয়েছিল ওকে। তারপর দিশা আর মাইশা মিলে দিগন্তের ঘরে নিয়ে এসেছে। বিছানার মাঝবরাবর বসিয়ে ওর লেপ্টে যাওয়া চোখমুখ, শাড়ি সব ঠিকঠাক গুছিয়ে দিয়ে সেই যে চলে গেল আর কারো আসার নাম-নিশানা নেই। প্রায় এক ঘণ্টা হয়ে এসেছে এঘরে বেলা একা বসে আছে।
চোখ আর মানছে না বেলার। বিয়ে থেকে শরু করে বিদায়ের শেষ পর্যন্ত প্রচুর কেঁদেছে। ফলস্বরূপ চোখ জ্বলছে ভীষণ, মাথা ব্যাথা করছে। আসার সময় রকেয়া তালুকদার গাড়িতে অনেককিছু বলেছে ওকে।
সব ঠিকঠাক না বুঝলেও এটুকু বুঝেছে আজ দিগন্তের সব কথা মানতে বলেছে। সাথে আরো কিছু নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানিয়েছে। আগাগোড়া কিছু না বুঝলেও কথাগুলো মাথায় গেঁথে রেখেছে ও। আগে ভাগে ঘুমানো যাবে না। সবকিছু স্মরণে রেখে জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো বেলা। কিন্তু হুট করে কখন যেন শুয়ে পড়লো। তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

অপরদিকে, ড্রয়িংরুমে প্রত্যাশাকে কোলে নিয়ে কঠোর চোখে জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে আছে দিগন্ত। চোখমুখে রাগে রেশ স্পষ্ট। সবাই চুপচুপ দেখছে ওদের দুজনের যুদ্ধ।
মিতালী দিগন্তের কাছে যেতে চাইলে সোফায় বসে থাকা রকেয়া তালুকদার ইশারায় মানা করলো ওকে। বাড়ানো পা আটকে ফেললো মিতালী। কিছুক্ষন আগের হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকা পরিবেশ হুট করে শান্ত রূপ নিয়েছে। জুনায়েদও শক্ত চোখে চেয়ে আছে দিগন্তের দিকে।
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালো দিগন্ত। জোরে শ্বাস টেনে একপলক প্রত্যাশার দিকে দেখলো। পুনরায় জুনায়েদের মুখোমুখি হয়েয়ে গম্ভীরমুখে বলল,

‘ আপনি আর আপনার স্ত্রী বিষাক্ত, নিকৃষ্টতম ব্যক্তি তা জানা পরেও আমি আপনাদের ফসলকে এবাড়িতে এনেছি। কেনো জানেন? এ বাড়িতে ওর অধিকার বঞ্চিত করার কারণে ভবিষ্যতে কোনো একসময় অপরাধীর কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হতো আমাকে। তাই নিজ থেকে ওকে এবাড়িতে আসার সুযোগ করে দিয়েছি। তারমানে এই না ওই মহিলাকেও আমি এবাড়িতে ঢুকতে দিবো। আমার মায়ের হাতে গোড়া এ বাড়ির পবিত্রতায় কোনো নর্দমার ঠাঁই হবে না। কথাটা ভালোভাবে মাথায় গেড়ে নেন। ’

কথাগুলো বলে প্রত্যাশাকে কোল থেকে নামিয়ে জুনায়েদের সামনে ছেড়ে দিল দিগন্ত। তারপর হনহনিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। পেছন থেকে জুনায়েদ জোরালো আওয়াজে হুংকার ছুড়ল,
‘ তুমি কি নিজেকে এবাড়ির কর্তার আসনে বসিয়েছো? তোমার কথায় চলতে হবে সবাইকে। বিয়ে করে ফেলেছো। প্রয়োজন পড়লে বউ, বাচ্চা নিয়ে তুমি আলাদা সংসার করবে। আমি মনাকে এবাড়িতে আনবো। দেখি কে আটকাতে পারে আমাকে।’

চলন্ত পদযুগল থেমে গেল দিগন্তের। ঘাড় বাঁকিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো জুনায়েদের দিকে। পরপরই সোফায় আয়েসী ভঙ্গিতে আসন গেড়ে বসা দিলদার তালুকদারের দিকে চেয়ে রাশভারী স্বরে বলে উঠল,
‘ দাদাজান ; তোমার বংশে কুলাঙ্গার এই একটাই নাকি আরো ছিল? ’
দিলদার ক্ষুব্ধ নয়নে জুনায়েদকে দেখলো। ঘৃণিত চোখমুখে বলল,
‘ ছেলের সাথে লড়াই করছে দ্বিতীয় স্ত্রীর জন্য। ছিহ! মিনিমাম লজ্জা তো নেই, আত্মসম্মানটাও গুলে খেয়েছে। ছোট বাচ্চাকাচ্চা সবার সামনে আবার বড় গলায় কথা বলছে। আমি একটা অজাতের জন্ম দিয়েছি। ’

বাবার থেকে তাচ্ছিল্যতা পেয়ে দমে গেল জুনায়েদ। প্রত্যাশাকে নিয়ে আর দাঁড়ালো না সেখানে। অপমানে মুখ থমথমে রূপ নিয়েছে। চটজলদি বেরিয়ে পড়ল। বড় ভাইয়ের কাজে লজ্জিত জয়নাল। বউ-বাচ্চার চোখে চোখ রাখতে পারল না। ভারী শ্বাস ফেলল। জুনায়েদের গাড়ির চাবি ওর কাছে সেটা দিতে সেও বাইরের দিকে গেল।
রুমে পা রাখতেই থমকালো দিগন্ত। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে ওর বধূ।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৬

পরনের লাল শাড়িটা এলোমেলো হয়ে আছে। ভারী শাড়ি-গহনা নিয়ে সেভাবেই ঘুমিয়েছে। সেসব গায়ে বিঁধছে হয়তো। ঘুমের মাঝেই বারবার এপাশ ওপাশ করছে বেলা। চোখের রঙিন প্রসাধনী ঘুমের রেশে হাত দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। গালমুখে লেগেছে সেগুলো। অগোছালো বেলাকে দেখে কিঞ্চিৎ হাসলো দিগন্ত। দরজা চাপিয়ে দিয়ে বেলার পাশে এসে বসলো।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৪৭ (২)