দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৬
আফরোজা আশা
এক হাত গলায় ঝুলিয়ে আরেকহাত দিয়ে আয়েস করে পা নাচিয়ে নাচিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে পাটোয়ারী বাড়ির ছোট কন্যা বেলা পাটোয়ারী। পাশে দুই হাত বুকে চেপে সরু চোখে তাকিয়ে আছে দিগন্ত। হাতে অনেকটাই লেগেছে। কয়েকদিন নড়াচড়া করতে বারণ করেছে ডাক্তার। আর্ম স্লিং দিয়ে হাত ঝুলিয়ে দিয়েছে। আপাতত বেলা চেটেপুটে আইস্ক্রিম খেতে ব্যস্ত। দিগন্তের সম্পূর্ণ নজর ওর বাচ্চাদের ন্যায় খাওয়ার দিকে। আইস্ক্রিম গলে কুনুই গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। গালে-মুখেও ছড়িয়ে আছে। কিন্তু আইস্ক্রিম পাগল বেলার সেসবে হুশ নেই।
দিগন্ত হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
‘ বড় হবি না তুই? ’
খাওয়া থামে বেলার। ডাগর ডাগর নেত্রপল্লব ঝাপটে দিগন্তের মুখপানে চেয়ে বলে,
‘ আপনি সবসময় এভাবে বলেন কেনো? ’
ভ্রুঁ গুটালো দিগন্ত। পূর্বের গম্ভীরতা নিয়েই বলে,
‘ কিহ? ’
‘ সবসময় বড় হবি না, কবে বড় হবি এসব বলেন কেনো? ’
‘ কেনো বলি এটা যেদিন বুঝতে পারবি সেদিন সত্যিই বড় হবি। ’
‘ মানে? ’
‘ বড় হো, মানে এমনিই বুঝবি। ’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মুখ বেঁকালো বেলা। দিগন্তকে আরো কিছু বলার জন্য বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই পাশে রাখে স্কুল ব্যাগটা ধুপ করে পরে গেল। চেইন খোলা থাকায় ব্যাগ থেকে কিছু কিছু জিনিস পরে গেল। মুখ দিয়ে চুউউউ শব্দ বের করে হাঁটু গেড়ে বসল দিগন্ত। এক এক করে সব কিছু ব্যাগে উঠিয়ে রাখার ফাঁকে একটা পরীক্ষার খাতায় চোখ আটকে গেল। ব্যাগটা বেলার পাশে রেখে খাতাটা গভীর মনযোগ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখা শুরু করল। এদিকে বেলা অসহায় মুখে একের পর এক শুকনো ঢক গিলে চলেছে। বেশ খানিক সময় পর দিগন্ত অবাক চোখে বেলার দিকে তাকালো। খাতার উপরে দুইটা বড় সাইজের গোল্লা। ভেতরে পুরো খাতা ফাঁকা, শুধু প্রথম পৃষ্ঠায় একটু দাগ কেটে লিখেছে। সেই লেখাকে আর লাল কালি দিয়ে ইচ্ছে মতো কেটেছে টিচার। পুরো খাতায় একটাই প্রশ্নের উত্তর লিখেছে বেলা পাটোয়ারী। তাও আবার মেঘনাদবধ কাব্যের লেখক মাইকেল চৌধুরি।
দিগন্ত দাঁত দিয়ে এক ঠোঁট কামড়ে ধরল। মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা গলায় বলে উঠল,
‘যে মেয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত কে মাইকেল চৌধুরি বানায় সে মেয়ে নাকি আর্মি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। হাউ ফানি!
আচ্ছা, দেশের শান্তিরক্ষা কিভাবে করবি? যেখানে তুই কবির পরিচয়ে টান মেরে কবির আত্মায় অশান্তি লাগিয়ে দিয়েছিস, সেখানে তোর মতো বেয়াদপ দেশে শান্তি আনবে কিভাবে? বুঝা!’
বেলা সরল গলায় জবাব দিল, ‘ আমি জানতাম ওটা মাইকেল মধুসূদন দত্ত হবে। ‘
‘ তাহলে, এটা কি লিখেছিস? ফাইলামো করছিস আমার সাথে? ’
‘ না। ও সময় আমার খুব আলসামো লাগছিল। লিখতে ইচ্ছে করছিল না। দেখুন, নামটা কতটা বড়। তাই আমি ছোট করে মাইকেল লিখে চৌধুরি লাগিয়ে দিয়েছি। ’
তব্দা খেলো দিগন্ত। হতবাক আওয়াজে দুহাতে তালি মেরে বলল,
‘ বাহহ! কেয়া বাত। এটা না হলো প্রকৃত স্টুডেন্ট। তুই তো একটা হিরা রে। তোকে তো মিউজিয়ামে রাখা উচিত। ’
দিগন্ত যে ওকে কটাক্ষ করে কথাগুলো বলল সেসব বুঝল না ছোট বেলা। গদগদ ভাব নিয়ে বলল,
‘ আপনি আমার তারিফ করছেন দিগন্ত ভাই। আমার না বিশ্বাস হতে চাইছে না। ’
দাঁতে দাঁত চাপল দিগন্ত। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ বেয়াদপ! মাথায় ভর্তি গোবর নিয়ে চলিস। মুখপুরি! তোকে নিয়ে আমি মনির কাছে এতো বড় বড় কথা বলি আর এদিকে তুই পরীক্ষার খাতায় বড় বড় গোল্লা নিয়ে ঘুরিস। তোর সুশীল বাপ এসব চেক করে না? ’
মাথা নাড়িয়ে না বলল বেলা। হতাশার শ্বাস ফেলল দিগন্ত।
‘ তোর মতো মেয়েকে নিয়ে দেশের কী হবে। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে ‘মাইকেল চৌধুরি’ বানায়, তাও আবার অলসতা আর নাম বড় তাই লিখতে ইচ্ছা হয় না? এই অজুহাত! বোর্ড পরীক্ষায় কি করবি? ’
তারপর হঠাৎ পকেট থেকে ফোন বের করে ছবি তুলতে লাগল খাতার।
‘ কি করছেন আপনি?’ চোখ বড় করে জিজ্ঞাসা করল বেলা।
‘ তোর গাধামির স্মৃতি রাখছি। ভবিষ্যৎ এ তোর বাচ্চা-কাচ্চাকে দেখাবো। তারাও জানবে তাদের অভাগী মা কত ভালো পড়াশোনা করেছে। সাথে তোর বাংলা টিচারকে একটা লাল সালাম দিয়ে আসা প্রয়োজন। ছাত্রী পরীক্ষার খাতায় মাইকেল চৌধুরি লিখেছে। ব্যাপারটা কি দারুন! বাংলা সাহিত্য তো পারলে খুশিতে আত্মহত্যা করবে। ’
ঠোঁট উল্টায় বেলা। জোর গলায় বলে,
‘ আপনার জানা উচিত। এটা সৃজনশীলতার যুগ। নাম ছোট করলে মনে রাখা সহজ হয়। এই তো! Efficiency.’
‘ Efficiency, তাই না? তাহলে এটাও বল, গুলশান সোসাইটিতে বুলডোজার দিয়ে বিল্ডিং না ভেঙে, বিল্ডিংয়ে বোমা মারলে সময় বাঁচবে। It’s Efficient. ’
বেলা ভাবুক গলায় দিগন্তকে শুধালো, ‘ এটাও ঠিক কিন্তু এতে কি মানুষের ক্ষতি হবে, দিগন্ত ভাই? ’
বিরক্তকর চাহনিতে কিছুক্ষন বেলার দিকে চেয়ে রইল দিগন্ত। উত্তর করল না ওর প্রশ্নের। উত্তরের আশায় এখনো দিগন্তের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দিগন্ত। অনেকক্ষন পর দিগন্ত ভারী আওয়াজে বলে,
‘ মাথায় গোবর নিয় ঘুরিস তুই। চল, সময় নেই আমার। তোকে নামিয়ে দিয়ে আসব। বেয়াদপ মেয়ে, সামনে পরীক্ষা পড়াশোনা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। আর কিছুই বলব না তোকে। তোর বাপ ধরব। ’
চমকে উঠে বেলা। মিনমিন গলায় বলে, ‘ বাড়িতে বলবেন না দিগন্ত ভাই। আম্মু মারবে আর দাদী অনেক পঁচা কথা শোনাবে। ’
বেলার একহাত ধরে বাড়ির জন্য পা বাড়াতে বাড়াতে ঘাড় বাঁকিয়ে দিগন্ত বলে, ‘ তোর দাদীর এক পা মাটিতে তাও মুখের ধার কমে না কেনো? বুড়িটাই তোর বাপের মাথার নষ্ট করে। ’
তারপর আস্তে করে বিড়বিড়িয়ে বলল,‘ সাথে একটা নাতিন লেলিয়ে দিয়েছে। মনে ধরেছে ছোটজনকে, বেক্কল বুড়ি লেলিয়ে দিয়েছে মেঝোজনকে। আমার জীবনের চিরদুশমন এরা। ’
বেলার এখন চরম সময় কাটছে। দিনরাত টেবিলে বসে বইয়ের পাতায় মুখ গুজে রয়েছে। চেয়ারে বসে দুপা ছড়িয়ে দিয়ে গা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে পড়ছে বেলা। পুরো রুমে গুনগুন পড়ার আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে। দুধের গ্লাস হাতে রুমে আসল বাণী। বেলার সামনে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ ঝটপট খেয়ে নে। ’
পড়া থামিয়ে ভার মুখে তাকাল বেলা। কোনো বাক্য ব্যয় না করে বাণীর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে একঢোকে সম্পূর্ণ দুধটুকু খেয়ে নিল। আচানাক বেলার এতো পরিবর্তনে অবাক হলো বাণী। মুখ ফস্কে বলে ফেলল,
‘ এ কিরে! তুই কোনো গাঁইগুঁই ছাড়া দুধ খেয়ে নিলি আজ। ’
তারপর আবার বেলার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অস্থির গলায় বলল, ‘বেলা, বোন তোর শরীর ঠিক আছে? বেশি চাপ নিয়ে পড়তে হবে না। হয়েছে, অনেক পড়েছিস। চল এখন আমার সাথে একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি। ’
বেলা হাতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে বাণীর কোমড় পেঁচিয়ে ধরল। কান্নারত গলায় বলল, ‘ আর মাত্র তিনদিন। তারপর তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে। তোমাকে ছাড়া কিভাবে থাকব আপা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ’
দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫
এতোক্ষনে বুঝল বাণী। বেলাকে ভালোভাবে জড়িয়ে ধরে মাথায় একটা স্নেহের চুমু একেঁ দিল। নরম গলায় বলল,
‘ বোকা মেয়ে! এগুলো ভেবে মন খারাপ করে বসে আছিস। দু-একদিন পরপরই আমি টুক করে চলে আসব। আর তোর মন খারাপ লাগলে, আমার কথা মনে পড়লে চলে যাবি ওবাড়ি। আপা কি তোকে একা ছাড়ছে নাকি! ’
যতো যাই বলুক বেলার মন এখন ভীষণ খারাপ। বাণীকে জড়িয়ে রেখেই চোখের পানি বিসর্জন দিচ্ছে। বাণী মুচকি হেসে বড় আপা পাগল বোনটাকে আদর দিতে শুরু করল। বেশ খানিক সময় নিয়ে বেলাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সক্ষম হলো। তারপর দুবোন খুঁনশুটি করতে করতে ছাদের দিকে হাঁটা ধরল।