দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫২

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫২
আফরোজা আশা

প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। আজও সারারাত দু’চোখের পাতা এক হয়নি ফাহাদের। গতকাল থেকে কেবল উঠছে, বসছে আবার রুমজুড়ে পায়চারি করছে সে। ক্ষণে ক্ষণে ভেতরের অস্থিরতা কমার বদলে বাড়ছে যেন। অবশেষে না পেরে সব ইগোতে মাটিচাপা দিয়ে ফোন হাতে নিল।
প্রত্যাশার একটা সিরাপ আনার জন্য নিচে গিয়েছিল দিগন্ত। জেনারেল কেবিনে আছে প্রত্যাশা। শরীরের তাপমাত্রা এখন স্বাভাবিক। ঘুমিয়ে আছে সে। মাইশা আর বেলা ওর দেখ-ভাল করছে। সিরাপ এনে নার্সের হাতের দিয়ে কিছুক্ষন প্রত্যাশার পাশে বসল দিগন্ত। অতঃপর মাইশা আর বেলাকে রেখে মনার কেবিনের দিকে হাঁটা ধরল সে। মাঝপথে পকেটে থাকা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। অনাকাঙ্খিত নাম্বার দেখে ভ্রুঁ গুটিয়ে ফোন রিসিভ করল। অপরপাশ থেকে ফাহাদের ব্যস্ত কণ্ঠস্বর,

‘ বিশ্বাস কর, ওর প্রতি আমার এতো মায়া কাজ করে কেনো আমি নিজেও জানি না। জাস্ট একবার, একপলকের জন্য হলেও দেখতে চাই। জুনায়েদ তালুকদারকে কিছু সময়ের জন্য হাসপাতাল থেকে সরাতে পারবি? আই রিকুয়েষ্ট। ’
ফাহাদের গলায় অস্থিরতা বিদ্যমান। তা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করল দিগন্ত। অন্যসময় হলে নির্ঘাত ত্যাড়ামি করত। আজ আর মন সায় দিল কোনো লড়াই-ঝগড়া করার। ঠান্ডা গলায় কেবল জবাব দিল,
‘ জুনায়েদ তালুকদার বাড়ি গিয়েছে কিছুক্ষন আগে। ’
কথাটা শোনামাত্রই গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ফাহাদ। ফাঁকা রাস্তায় জোরে টান মেরে হাসপাতালের কাছে চলে এলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঘণ্টা তিনেক হলো বাড়ি গিয়েছিল রায়হান। ফ্রেশ হয়ে আবারো এসেছে। রায়হানের বাইক আর ফাহাদের কার দুটোই একসাথে থামল হাসপাতালের সামনে। এসময় ফাহাদকে দেখে অবাক হলো রায়হান। তবে আঁচ করতে পারল মনার জন্যই এসেছে। দুজনে একসাথে এলো মনার কেবিনে।
রায়হানের সাথে ফাহাদকে দেখে চুপচাপ সরে পড়ল মিতালী। ভার্সিটির সবকিছুই তার জানা। ওদের একা ছেড়ে প্রত্যাশার কাছে গেল।
চব্বিশ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও জ্ঞান ফিরেনি মনার। শ্বাস চলছে ধীরভাবে। কাঁচের গ্লাস দিয়ে স্থিরচিত্তে মনাকে দেখল ফাহাদ। সেটুকুতেই ক্ষ্যান্ত হলো না সে। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। দিগন্ত, রায়হান কেউ আটকালো না ওকে।

মনার পাশের চেয়ারে বসে ওর ফ্যাকাসে মুখপানে চেয়ে থাকল ফাহাদ। উজ্জ্বলতা একেবারে মূর্ছা গিয়েছে। কপাল থেকে পুরো মাথায় সাফেদ ব্যান্ডেজ ঘেরা। গাল-মুখের জায়গায় জায়গায় ক্ষতচিহ্ন। মাথার এক্সটার্নাল ব্লিডিং আটকাতে পারলেও, খুব ক্ষীণভাবে ইন্টার্নাল ব্লিডিং হচ্ছেই। অপারেশনের পরেও সেটাকে থামাতে সক্ষম হয়নি ডাক্তারা।

মনার নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা হাতের ভাজ হাত রাখে ফাহাদ। এই মেয়েটার প্রতি ওর কোনোকালেই বিশেষ কোনো অনুভূতি কাজ করেনি। তবে কখনো ঘৃণাও করতে পারেনি। ওদের একসাথে খোলা পেইজটা আজো আছে। ফাহাদ চাইলেই সেটা কেটে দিতে পারত। কাটেনি বরং হুটহাট লাইভে এসে গান গেয়েছে। চুপিসারে মনার সব গান শোনে সে। হয়তো মনার প্রতি তার এতো মায়া কাজ করার একমাত্র কারণ তার গানের গলা। এই গান দিয়েই পরিচয় হয়েছিল তাদের। তারপর একসাথে গানের ক্যারিয়ার গড়ছিল। হুট করে সব বদলে গেল!
মিনিট পাঁচেক সেভাবেই কাটে। নার্স এসে বাইরে যেতে বলে ফাহাদকে। তা শুনেও নির্নিমেষ মনার দিকে চেয়ে থাকে সে। পুনরায় নার্স তাগদা দিলে উঠে দাঁড়ায় ফাহাদ। ওর হাত থেকে মনার হাত সরিয়ে নেওয়ার সময় অনুভব করে নিস্তেজ হাতখানা কাঁপছে। ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে মনার দিকে তাকায় সে। দেখা মেলে, আধখোলা একজোড়া আঁখির।

নিভু নিভু চোখ ফাহাদকে দেখছে মনা। নিমিষেই সে চোখ গড়িয়ে পড়ল নোনাজল। তা দেখে শরীর হীম হলো ফাহাদের। ওই দুই ফোঁটা অশ্রু কেন যেন হৃদয়ের গহীনে পীড়া দিল তার। কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই আধখোলা চোখজোড়া আস্তে আস্তে বন্ধ হতে লাগল। মুহূর্তেই একটা জোরে ঝাঁকি দিয়ে উঠল মনা। পরপরই ফাহাদের হাত থেকে পড়ে গেল ওর হাতখানা। দূর থেকে ভেসে আসা আজানের ধ্বনি শুরু হতে, মনার দুচোখের পাতাও এক হলো।

নার্সের ডাকে ডাক্তারা ছুটে এলো মনার কেবিনে। দুজন ওয়ার্ডবয় মিলে ফাহাদকে টেনে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। ফাহাদ কেবল হতবুদ্ধির ন্যায় মনার ওই লেগে থাকা চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়ার্ডবয় দুজন খুব সহজেই কেবিন থেকে সরাতে পারছে ওকে। কোনো বল-শক্তি নেই যেন; শরীর কাঁপছে তার, হাঁটু ভেঙে আসতে চাইছে। পলকহীন ভাবে যতক্ষন মনার নিঃপ্রাণ মুখখানা দেখা গেল, ততক্ষণ দেখল। মনার কাছ থেকে সরে আসার সময় তার ওই বরফ ঠান্ডার ন্যায় হাতের ছোঁয়া লেগেছিল ওর হাতে। সেই হীম-শীতল হাতের মানে বুঝতে সময় লাগেনি ফাহাদের।
শক দেওয়া হলো মনাকে। তাতে কোনো কাজ হলো না। হৃদস্পন্দন আজীবনের জন্য থেমে গিয়েছে তার। সেকেন্ড কয়েকের জন্য চোখ খুলেছিল মনা। তারপর ঠিক ফজরের সময় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে সে। নিষ্ঠুর, নির্মম এ দুনিয়া থেকে চিরকালের মতো বিদায় নিয়েছে মোনালিসা মনা।

বাদ যোহর দাফন করা হবে মনাকে। তালুকদার বাড়ির বাইরের ফটকে ওর প্রাণহীন দেহখানা খাঁটিয়ায় শায়িত। আশপাশে কাঁদছে তার গুটি কতক পরিচিত, স্বল্প-পরিচিত মানুষজন।
বেলার ঘাড়ে মাথা ঠেকিয়ে সাদা কাপড়ে মোড়া মনাকে দেখছে প্রত্যাশা। বার কয়েক আম্মু আম্মু করে ডেকেও কোনো সাড়া পায়নি। ওর এক ডাকে ছুটে আসে ওর আম্মু। আজ এতোবার ডাকার পরেও এলো না দেখে অভিমান জমেছে প্রত্যাশার ছোট মনে। দুদিন থেকে অসুস্থ সে, কতবার ছটফট করেছে মায়ের জন্য। অথচ তার পাষাণ মা একবারো এসে তাকে আদর দেয়নি।

বসা গলায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল প্রত্যাশা। অসুস্থ শরীর নিয়ে ছোটাছুটি করল মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। বেলা জাপটে জড়িয়ে রাখল ওকে। তারপর এক সময় নড়াচড়া বন্ধ করে, শরীর ছেড়ে দিল। কড়া পাওয়ারের ওষুধ খাওয়ার কারণে ঘুমিয়ে গেল সে।
মনার মা মারা গিয়েছে বছর দুয়েক আগে। ওর মৃত্যুর খবর ওর বাপ-ভাইয়ের কাছে গিয়েছে। তারা আসবে না কেউ। তাই তাড়াতাড়ি দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

যোহরের নামাজ শেষে পুরুষলোকেরা একে একে এলো। আপন মানুষদের কাঁধে তালুকদার বাড়ির ফটক ছেড়ে কবরস্থানের রাস্তায় যাত্রা শুরু হলো মনার। পেছনে ফেলে রেখে গেল তার একমাত্র আদরের মেয়েকে।
জুনায়েদ তালুকদার আছে জানা সত্ত্বেও মনার জানাযায় ফাহাদ এসেছে। দিগন্ত রায়হানের পাশে দাঁড়িয়ে কবরস্থ করেছে। চিরনিদ্রায় শায়িত মনাকে তার নিজস্ব ঘরে রেখে বাড়ি ফিরতে হলো সকলকে। এরপর হয়তো ব্যস্ত এ দুনিয়ার বুকে আস্তেধীরে তার নামটুকু মুছে যেতে শুরু করবে।
বাড়ি এসেই দরজায় খিল এটে ঘরে ঢুকেছে জুনায়েদ। কারো সাথে কোনো কথাবার্তা বলেনি। তার মতিগতি বোঝা দায়ের। কেউ চেষ্টাও করেনি বোঝার।
বাণীর কাছে প্রত্যাশাকে রেখে ঘরে এলো বেলা। দিগন্ত পাঞ্জাবি পাল্টে বিছানায় বসেছে। বেলাকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বলল,

‘ মাথা ধরেছে। চুল টেনে দে। ’
দরজা আটকালো বেলা। মাত্রাতিরিক্ত স্বাভাবিক দিগন্ত তালুকদার ভেতরে ভেতরে অশান্তিতে আছে, তা আগে থেকেই জানে সে। প্রশ্ন করে না কোনো; পা মুড়িয়ে বসে দিগন্তকে ইশারা করে ওর কোলে শুতে। বেলার কাজ দেখে ম্লান হাসে দিগন্ত। ওর কোলে মাথা রেখে বলে,
‘ সত্যি মাথা ব্যাথা করছে। ’
দিগন্তের চুলের ভাজে হাত গলিয়ে দেয় বেলা,
‘ হুম, বুঝেছি। ’

তিনদিন পর গরিব-দুঃস্থদের জন্য বেশ বড়সড় আয়োজন করা হয়েছে। তালুকদার বাড়ির বাগানজুরে ত্রিপাল চড়েছে। দিগন্তের দলের ছেলেরা সবার খাওয়া-দাওয়া সামলাচ্ছে। বড় বড় ডেকগুলো খালি হতে বিকাল পেরিয়ে গেল। জুনায়েদ তালুকদারের এসবে কোনো যোগ নেই। সে দিব্য তার মতো অফিস করছে।
জয়নাল তালুকদার আর দিগন্তের উদ্যাগে সব হচ্ছে। সকাল থেকে এ বাড়িতে ছিল রায়হান। দিগন্তের হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে সে। মাইশার সাথে বার কয়েক দেখা হলেও, কোনো কথা হয়নি। মাইশাও আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি।
রান্নাঘরে এসে মায়ের পাশে দাঁড়ালো মাইশা। রেহানা নির্বাক হয়ে হাত চালাচ্ছে রান্নায়। মায়ের হঠাৎ কথা বন্ধ করার কারণ বুঝছে না মাইশা। আজ দুদিন যাবৎ পিছু পিছু ঘুরছে কিন্তু রেহানা তার সাথে টু শব্দটিও উচ্চারণ করছে না। মিতালী পাঠিয়েছে তাকে চা বানানোর জন্য। ড্রয়িংরুমে একজন আধবয়স্ক মহিলা বসেছে। মাইশা চেনে না তাকে। তবে তিনদিন আগেও একবার দেখেছিল এবাড়িতে। তার জন্যই চা-নাস্তা নিতে পাঠিয়েছে মাইশাকে।
চায়ের পাত্রটা চুলোয় দেওয়ার সময় সেটা রেহানা নিয়ে নিল। মাইশার হাতে একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ার ধরিয়ে দিয়ে গমগম গলায় বলল,

‘ মিতালী ভাবির সাথে যে আপা বসে আছে, এটা তার কাছে যাবে। ’
-‘ চা নিয়ে যাই। ’
-‘ আমি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি যাও। ’
অগ্যত মাইশা ড্রয়িংরুমে আসে। মিতালীর পাশে বসা ভদ্রমহিলার দিকে ক্যারিয়ারটা বাড়িয়ে দিয়ে ধীর গলায় বলে,
‘ মা পাঠালো। ’
মাইশার দিকে চেয়ে ভদ্রমহিলা মুচকি হাসলো। তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ছোট প্যাড বের করে তাতে কিছু লিখলো। অতঃপর সেটা মাইশার হাতে দিয়ে বলল,
‘ আমি আজ এ বাড়িতেই থাকছি। খাবারগুলো একটু বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসো মা। রিকশা দিয়ে গেলে মিনিট দশেকের রাস্তা। কাগজে ঠিকানা লেখা আছে। ’

অপ্রস্তুত হলো মাইশা। মিতালীর দিকে তাকাতেই সেও যেতে বলল।
ব্যস, বেকায়দায় পড়ল মাইশা। মন-মেজাজ তার অকারণের খিটখিটে হয়ে আছে। এ সমস্ত কাজ-কারবারে ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলো। দিশাকে ডাকতে গিয়ে মেজাজ যেন আরো তিক্ত হলো তার। ওকে দেখলেই দিশা কেমন গাঁইগুঁই করে পালাতে চাইছে। কোনো কথাও বলছে না ঠিকভাবে। বেলা আর বাণী প্রত্যাশার সাথে খেলছে, ওকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছে। কাউকে না পেয়ে শেষমেষ একাই বের হলো সে। মাথায় ভালোভাবে ওড়না চেপে রিকশা নিয়ে ঠিকানা অনুযায়ী চলে এলো।

ইতঃমধ্যে ভদ্রমহিলাটাকে বেশ অহংকারী হিসেবে ধরে নিয়েছে মাইশা। তালুকদার বাড়ির একজন সামান্য বুয়ার মেয়ে সে। ভদ্রমহিলা হয়তো ওকে-ও কাজের মেয়ের চোখেই দেখেছে। নয়তো চেনা নেই, জানা নেই হুট করে এভাবে ফরমায়েশ করতে পারে কেউ! নিজের প্রতি হীনমন্যতায় ভুগতে লাগল সে।
দুদিন থেকে রায়হান ইগনোর করছে, এটা যেন খুব করে অশান্তিতে ফেলেছে ওকে। আজ এতোবার দেখা হলো, দেখেও ওর সাথে কথা বলল না রায়হান। মাইশা তাই চায়, রায়হানের থেকে দূরত্ব মনে-প্রাণে চায় সে। অথচ রায়হান কথা বলেনি কেনো সেটা নিয়েও তার সমস্যা। এহেন দ্বি-মুখী চিন্তা ভাবনার জন্য নিজের উপরে বেজায় রাগ হলো মাইশার। শান্ত মেয়েটা ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ল।
ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছালো ভদ্রমহিলার বাড়িতে। ভাড়া মিটিয়ে আকাশের দিকে তাকায় মাইশা। সূর্য ঢলে পড়ছে, অন্ধকার হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরবে। দরজায় এসে বেল দিল। কতগুলো মিনিট পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কারা দেখা নেই। অধৈর্য্য হয়ে পরপর চার-পাঁচবার বেল বাজালো এবার। কিছুক্ষন পর দরজা খুলল কেউ একজন। সম্মুখের ব্যক্তিকে দেখে ভয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল সে।

ষোলা পরামর্শে বসেছে একদল। প্রত্যেকের হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপ। জয়নাল তালুকদার, দিহান, মিতালী, রকেয়া তালুকদার, দিলদার তালুকদার আর রেহানা মিলে রাজিয়া শিকদারের সাথে গভীর আলোচনা সারছে। মাইশা-রায়হানের কাহিনী এখন সবার জানা। বাইরের কাজ শেষে দিগন্তও যোগ দেয় তাদের সাথে। তাকে দেখে এককাপ চা এগিয়ে দিল বেলা। কাপটা নেওয়ার সময় ইচ্ছাকৃত বেলার হাতে ছোঁয়া লাগালো দিগন্ত। তাতে বেলার মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা পেল না, নাইবা চোখমুখে ফুটল কোনো লাজুকতা। ওর এহেন নির্জীবতা দেখে ক্রোধে ফেটে পড়ল দিগন্ত। আক্রশ মেটালো সবার উপরে। বিরক্তিমাখা গলায় বলল,
‘ আশ্চর্য! তোমরা এতো তোড়জোর করছো কেনো? ওদের নিজেদের বোঝা-পোড়া করতে দেও। ’
সহসা খেঁকিয়ে উঠল মিতালী, ‘ তুই চুপ কর। নাটের গুরু! এতোবড় ঘটনা ঘটেছে কাউকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিস নি। ’

এতো মানুষের সামনে ঝারি খেয়ে দিগন্তের সব রাগ পড়ল বেলার উপরে। রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে গরম চায়ে চুমুক বসালো। এদিকে দিগন্তের খেয়ে ফেলা নজর দেখে সেখান থেকে সুর সুর করে কেটে পড়ল বেলা। সোজা এসে থামল রান্নাঘরের সামনে। ইচ্ছে করে দিগন্তকে পাত্তা দেয়নি সে। এই যে পাত্তা না পেয়ে রেগে গেল; লোকটাকে রাগিয়ে মজা পাচ্ছে।

একটা ট্রেতে ভাজাপোড়া রেখে গিয়েছে রেহানা। সেটা হাতে নিল বেলা। এসব ড্রয়িংরুমে রেখে ঘরে পালিয়ে যাবে। এমনিতেই এ কদিন বিরাট বিরাট সত্য জেনেছে। আজ আবার রায়হান-মাইশার ধরা খেয়ে বিয়ে করা শুনে হাত-পা কাঁপছে তার। ভয়ে নয়, উচ্ছ্বাসে। বিয়ের পরেও মাইশাকে দেখে ওর হিংসা কাজ করত। এখন জ্বলন্ত মনে ঠান্ডা পানি পড়েছে। কিন্তু রায়হানের কথা ভাবলে ক্ষণে ক্ষণে অবাক হচ্ছে সে!
ডায়রিতে পড়ল রায়হান দিশাকে ভালোবাসে অথচ বিয়ে করল মাইশাকে। এদিকে মনা ভালোবাসত ফাহাদকে, সে ফাহাদ দেওয়ান আবার ওকে বিয়ে করার জন্য কি জোরাজুরিটাই না করল!
এতোশত হিসেব মেলাতে মেলাতে, রান্নাঘর পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই হাত নড়বড়ে হলো বেলার। কাঁচের ট্রেটা উপচে পড়তে চাইলে সেটা ধরে ফেলে দিশা।

-‘ আরে তুই এমন টলছিস কেন? সোজা হয়ে দাঁড়া। ‘
-‘ আমার মাথা ঘুরছে গো। ’
ট্রে থেকে একটা পাকোড়া তুলে মুখে পুড়ল দিশা। চিবোতে চিবোতে বলল, ‘ এ কথা ভুলেও বড়দের সামনে বলিস না। বিয়ের সপ্তাহ না পেরোতেই মৌখিক পোয়াতি বানিয়ে দিবে। ’
তা শুনে হাসল বেলা। হুট করে চোখ গেল দিশার ফোনের দিকে। গোল গোল চোখে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে রইল সে। বেলার দৃষ্টি খেয়াল করে চট করে ফোন নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল দিশা। তড়িঘড়ি করে বেলাকে ধরতে গিয়ে ফোন বন্ধ করার কথা ভুলে বসেছে। বেলা অবাক গলায় শুধালো,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫১

‘ ফাহাদ দেওয়ানকে স্টক করছো? ’
ফিসফিসিয়ে জবাব দিল দিশা,
‘ কাউকে বলবি না। ছেলেটাকে তুই ছ্যাঁকা দিয়েছিস, আমি মলম লাগিয়ে ধুমছে প্রেম করব। ’
-‘ তুমিও আর মানুষ পেলে না। অতীতে মনা আন্টি ফাহাদ দেওয়ানের জন্য পাগল ছিল, এখন আবার তুমি। ’
বলতে বলতে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালো বেলা। এদিকে ওর কথা শুনে মুহূর্তেই মুখের হাসি বিলীন হলো দিশার। হাতের ফোনখানা মেঝেতে আছড়ে পড়ল।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here