দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৩

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৩
আফরোজা আশা

বাটি চামচ সংঘর্ষে আন্দোলিত টুংটাং ধ্বনির সুর জোরালো। জ্বলন্ত গ্যাস স্টোভে জমাট বাঁধা তরকারিতে চামচের বিচরণ চলছে। কিছুটা দূরে একরাশ লজ্জা,অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে মাথা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাইশা। মাথায় চাপানো ওড়নাটা কপালে এসে ঠেকেছে, পারলে হয়তো টেনে বুক পর্যন্ত নামিয়ে নিত। সম্মুখে উদোম গায়ে থাকা পুরুষটার কারণে চক্ষুলজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার। সেই যে দরজার সামনে একপলক দেখেছিল, তারপর আর ভুলেও ঘাড় উঁচিয়ে তাকায়নি। কি এক মহামসিবতে ফেঁসেছে সে! সহজ-সরল,শান্তশিষ্ট জীবনের মোর ঘুরে বারংবার এক জায়গায় আঁটকে যায়। অন্তরকূপ তার আফসোসের সুরে হা-হুতাশ করছে, ভদ্রমহিলার ছেলে ছোট বাচ্চা কিংবা অন্য কেউ হলে কি খুব ক্ষতি হতো? সামনের পুরুষটা যে মোটেও ভদ্র গোছের নয়! চরম নিলজ্জ, বেহায়া, বেহেলাজ। নয়ত একটা মেয়ের সামনে এরকম খোলামেলা কে ঘোরে?

এদিকে শর্টস পরিহিত রায়হান দিব্যি নিজের কাজে মগ্ন। পাশের রমণী যে তার বেশভূষায় লাজে মরছে, তা খোশমনে উপভোগ করছে। দোষ তারও নেই! তপ্ত গরমের দরুন বাড়িতে যেভাবে থাকে সেভাবেই আছে। সচরাচর দলের ছেলেপেলে ছাড়া এবাড়ি মুখী কেউ হয় না। আজ যে বিনা আগমনী বার্তায় তার হারিয়ে যাওয়া বউ, নিজ পায়ে হেঁটে দোরগোড়া অব্দি চলে আসবে, তা ওর অজানা। তালুকদার বাড়ি থেকে ফিরে কোনোমতো গোসল সেরে ঘুমিয়েছিল। বিরক্তিকর কলিংবেলের আওয়াজে অতিষ্ট হয়ে ঘুম ছেড়ে সেভাবেই দরজা খুলেছে৷ ভেবেছিল দলের কোনো ছেলে এসেছে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত রমণীকে দেখে বৃহৎ আকৃতির চমক পেয়েছে সে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অসময়ে মাইশাকে দেখে বাকরুদ্ধ রায়হান চটজলদি দিগন্তকে ফোন দিয়ে সব শুনে নেয়। ব্যস, তারপর থেকে ইচ্ছাকৃত মাইশার ওপর জুলুম চালাচ্ছে। মেরে-ধরে বা জবানীতে নয়, আকারে-ইঙ্গিতে সূক্ষ্মভাবে লজ্জার সাগরে চুবিয়ে মারছে। এই যে মাইশা লজ্জায় কাঁচুমাচু হয়ে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। ওর ওই লাজুকরাঙা মুখাবয়ব দেখে ভেতরে ভেতরে কি ভীষণ পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে রায়হান। আল্লাহর দুনিয়ায় এহেন সুখের তুলনা নেই যেন। বউ থাকতেও এতোগুলো দিন কিনা এই আনন্দ অনুভূতি থেকে বঞ্চিত ছিল সে। ভেতরটা হাহাকারে জর্জরিত হলো।
গরম করা তরকারি বাটিতে ঢেলে নিতে নিতে মাইশার দিকে তাকাল রায়হান। অসন্তোষ চিত্ত্বে বলল,

‘ কি আশ্চর্য! চোখমুখ বিকৃত করার মানে কি? দেখে লাগছে, আমি জোরপূর্বক এখানে তুলে এনেছি। ’
রাগে চিরচিরিয়ে উঠল মাইশা। এ নিয়ে প্রত্যেক লাইনে লাইনে রায়হান ওকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে। লোকটা অবশ্যই শুনেছে মাইশাকে পাঠানো হয়েছে। ইচ্ছে করে আসেনি সে। মাইশা নিজেও বার কয়েক বলেছে। কিন্তু অসভ্য লোক সে কথাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ঘুরেফিরে এটাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, মাইশা যেচে পড়ে নিজ থেকে ওর কাছে এসেছে।
মাইশাকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে রায়হান পুনরায় আওড়ালো,

‘ গরম করেছি। প্লেটে বেড়ে নিয়ে আমার ঘরে এসো। ’
অবাক, হতবাক মাইশা সে কথা শুনে তড়িৎ রায়হানের দিকে চাইল। পরপরই চোখ খিঁচিয়ে নিয়ে অপরপাশে ঘাড় বাঁকালো। বাবা নেই ওর। সারাজীবন কাটল মায়ের আঁচল ধরে। কখনো কোনো পুরুষকে এতোটা খোলামেলা অবস্থায় দেখেনি। এই মুহূর্তে রাজ্যের অস্বস্তিতে ছেঁয়ে আছে সমস্ত কায়া। অথচ যার জন্য তার এই দূর্দশা, তার মাঝে বিন্দু পরিমাণও শরম নেই।
ফোঁস করে দম ছাড়ে মাইশা। থমথমে গম্ভীর গলায় শুধায়,

‘ আপনার জামা-কাপড় নেই? ’
ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল রায়হান,
‘ না, নেই। ’
ডাহা মিথ্যাটা কি অবলীলায় বলল রায়হান! মাইশা চোখ কুঁচকে নিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ প্লিজ, আগে নিজেকে ঢাকেন, নয়তো আমাকে যেতে দেন। ’
-‘ আমার আরামের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে স্বেচ্ছায় আমার বাড়িতে এসেছো। ঘুমে ছিলাম বলে খিদের জ্বালা টের পাইনি। ঘুম ভাঙিয়ে, ক্ষুধা উপলব্ধি করিয়ে, যাই যাই করলেই হবে? আমার পেট শান্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো ছাড় নেই। ’

-‘ পুরো ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার আপনার জন্যই পাঠিয়েছে। সদর দরজা আনলক করে, পেট পুরে খান। আমি মানা করেছি নাকি!’
তাতক্ষনাৎ মেকি রাগের রেশ ধরে গর্জে উঠল রায়হান,
‘ খাবো মানে? সারাদিন না খেয়ে ক্লান্ত শরীর আমার। দূর্বলতায় হাত-পা কাঁপছে। এ হাত দিয়ে খাবার তুলতে পারবো? কেমন থরথরিয়ে কাঁপছে! মুখের সামনে আনতেই তো সব পড়ে যাবে। ’
ললাটে ভাজ পড়ল মাইশার। কি বোঝাতে চাইল! সে কিভাবে খাবে, না খাবে তাতে মাইশার কি? অবুঝ গলায় বলল,
‘ হাতে খেতে পারবেন না চামচে খাবেন। দয়া করে আমাকে যেতে দেন। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছে। ’
মাইশার কথা স্পষ্ট শুনতে পেল রায়হান। কিন্তু মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখায় মেজাজ তেতে উঠল। ক্ষিপ্ত গলায় চাপা আক্রোশ নিয়ে বলল,

‘ তোমার হাত থাকতে চামচে খাবো কেনো? ধরা খেয়ে কি চামচকে বিয়ে করেছিলাম? জল-জ্যান্ত বউ আমার উভে এসেছে খাবার নিয়ে। সেসব খাবার চেটেপুটে ওর হাতেই খাবো। অত্যাধিক বেশি সুস্বাদু হলে ওকেও খেয়ে ফেলব। তাও চামচে খাবো না। ’
রায়হানের পাগলের প্রলাপ শুনে তব্দা খেলো মাইশা। অমিমাংসীত এক সম্পর্কের জের ধরে, বুক ফুলিয়ে অনবরত অধিকারবোধ নিয়ে বলা কথাগুলো শুনে মেজাজ অচিরেই বিগড়ে গেল তার। নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই।
রাগ-ক্ষোভ মিশ্রিত অতিষ্ট কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,

‘ বউ বউ বউ! কিসের বউ? অভিভাবকহীন, মতামত বিহীন ধরে-বেঁধে কবুল বললেই বিয়ে হয় না,কোনো স্বীকৃতি নেই। কাগজ-কলমের আরেকটা সই দিলেই কাহিনী খতম। আর আমার মতো গরিব, চরিত্রহীন, ধর্ষিতা আপনার মতো সুপুরুষের যোগ্যও না। সেদিনের ওই বিকৃত পশুগুলোর যোগ্য। বউ শব্দটা একদম বেমানান, খুব বিষাক্ত ঠেকছে। ’

রায়হানের স্থিরদৃষ্টি ক্রোধের অনলে কাঁপতে থাকা মেয়েটার পানে। তার বলা দু-চার লাইনের বাক্যগুলো মেয়েটাকে এতো আঘাত দিয়েছে ভাবতেই ব্যাথাতুর আঁচর কাটে হৃদগহীনে। নিরুপায়, পরাজিত সৈনিকের ন্যায় হার মানতে চেয়েও, পারে না। তনু-মনে অসীম জোশ সঞ্চার করে ক্ষিপ্র বেগে মাইশার অতি নিকটে চলে আসে। দুহাত পেছনে মুরে ধরে শক্তবেষ্টনীতে আবদ্ধ করে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। আচানাক আক্রমণে অপর পাশে ফিরে থাকা মাইশা হকচকিত বড় নেত্রমেলে রায়হানের মুখপানে তাকায়। সুঠামদেহী পুরুষটা দানবের ন্যায় থাবা মেরে তার বিশাল বক্ষের মাঝে পিষে ধরেছে ওকে। পেছনে ধরে রাখা হাতজোড়া ছাড়ানোর উপায় নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ হলো মাইশার। কিন্তু চোখমুখের ক্ষুব্ধতা কমলো না। কঠোর দৃষ্টিতে গমগমে স্বরে বলল,
‘ ছাড়েন। ’

রায়হানও অত্যন্ত ভদ্রলোকের ন্যায় মাইশার কথার ঠিক বিপরীত কাজ করল। কিঞ্চিৎ যে দূরত্বটুকু আছে সেটুকু ঘুঁচিয়ে কপালে কপাল ঠেকালো। অতঃপর থমথমে মুখে আক্ষেপ জড়িত গলায় বলতে লাগল,
‘ আগে যা বলে ফেলেছি এখন এসে তা ফিরিয়ে নেওয়ার সাধ্য নেই। কিন্তু ভুলটুকু শুধরে নিয়ে, প্রায়শ্চিত্ত করার উপায় আছে। জ্ঞানশূন্য অবস্থায় যে অসম্মান করেছি, তার থেকে শতগুণ বেশি সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে। আমি অন্যায় করেছি, সেটা কোনো বাক-বিতর্ক ছাড়াই নতশিরে মেনে নিয়েছি। আসলেই আমি অপরাধী। কিন্তু অপরাধ তোমারো কম নয়। এক অভিমানের রেশ ধরে, আমাকে রাগ দেখাতে গিয়ে বারবার নিজেকে কটুক্তি করছো। নিজের প্রতি জুলুম করছো, সঙ্গে আমাকেও অনুশোচনার যাতাকলে পিষছো, পিষছো আর পিষছোই। নিকৃষ্ট আসামীকেও একবার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে আমাকে কেনো দেওয়া হচ্ছে না? একটা সুযোগ অবশ্যই আমার প্রাপ্য। কসম, আদর্শ স্বামী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করব। ’

রায়হানের শেষোক্ত কথাটা বেজায় করুণ ঠেকলো মাইশার নিকট। নিরুত্তর হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল রায়হানের আকুতিময় চোখাজোড়ার দিকে। প্রশ্নবিদ্ধ করল নিজেকে। মন বলছে সুযোগ দিতে আবার মস্তিষ্ক বাঁধা দিচ্ছে। মন-মস্তিষ্কের যুদ্ধকে থামিয়ে জবাবটা নিজেই বাছাই করল। কঠোর মনে রায়হানের কথাগুলো বিঁধেছে অনেকাংশে। একটু একটু করে জমানো রাগ-অভিমান, দুঃখ-বিষাদের শক্ত পাহাড়টা নরম হলো কিছুটা।টলমলে সিক্ত চোখে শুষ্ক অধর ভিজিয়ে ছোট্ট করে বলে উঠল,
‘ দিলাম। ’
প্রশন্নচিত্ত্বে হাসল রায়হান। আলতোভাবে ডেকে উঠল,
‘ আমার বউ। ’
ফের বউ বলায় কপাট রাগ দেখাল মাইশা। তা দেখে রায়হান দুপাশে না বোধক মাথা নাড়িয়ে গদগদ ভাবে আওড়ালো,

‘ আচ্ছা আর ডাকব না। ’
পরপরই ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে আবদারমাখা চটপটে গলায় বলল,
‘ সুইটহার্ট এখন তাহলে একটা চুমু খাই? ’
ক্ষনে ক্ষনে ভোল পাল্টানো পুরুষটার দিকে বেক্কলের মতো চেয়ে আছে মাইশা। গিরগিটির চেয়েও কি দ্রুত রঙ পাল্টায়! দিশার কথানুযায়ী, পুরুষ মানুষ অভিনয়ে সেরা। বাস্তব প্রমাণ পাচ্ছে মাইশা।
এদিকে তিরতির করে কম্পনরত মাইশার গোলাপি অধরের দিকে চেয়ে ফাঁকা ঢোক গিলল রায়হান। একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য অস্থির হলো মন-মস্তিষ্ক তীব্র যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। বউ হয় ওর, অবশ্যই ছুঁবে। বেশি না হলেও অল্পতে পুষিয়ে নিবে। শয়তান মনের উস্কানিতে আর তর সইল না রায়হানের৷ একরাশ তাড়া নিয়ে হড়বড়িয়ে বলল,
-‘ নাহ! খিদের চোটে শরীরে একদম জোর নেই। একটা চুমু আমি খাবোই, এনার্জির জন্য। তোমার স্বামী খুব ক্ষুধার্ত মেয়ে। ’

নাকোচ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ দিল না মাইশাকে৷ নিজ কর্মে মনোনিবেশ করল। এদিকে দম আটকে চোখ মারবেল আকৃতির হলো মাইশার। রায়হানের আদর মিশ্রিত স্পর্শে কাঁটা দিয়ে উঠল সর্বাঙ্গ। নিরবে, নিভৃতে চুপটি করে রইল পুরো সময়টা। রায়হান সরে যেতেই প্রবল জড়তা আষ্টেপৃষ্টে ধরল ওকে। মুখ লুকানোর জায়গা না পেয়ে প্রশস্থ বুকেই মাথা ঠেকিয়ে দিল।

উড়নচণ্ডী, চঞ্চল, ফ্লার্টবাজ মেয়েটা হঠাৎ মূর্ছা গিয়েছে। নিকষ কালো আঁধারের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে দুঃখবিলাস করছে একাকী। মন ভালো নেই তার। অন্ধকার বেলকনির মেঝেতে পা মুড়িয়ে বসে আকাশের জ্বলজ্বলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে দিশা। ঘরে এসে দোর আঁটকে সেই তখন থেকে এভাবেই বসে আছে৷ হুট করে মনগহীনে কঠিন অভিমান জমেছে। অথচ এটা নিছক একটা কারণমাত্র! সে কারণটাই মানতে চাইছে না ওর মন।
প্রথম দিকে স্বভাব জোরে মজা লুটলেও। দিন দিন সত্যিই ছেলেটার উপর দূর্বল হয়েছে ওর দস্যি মন। একটা ছেলের সাথে এতো মেয়ের কানেকশন কেনো থাকতে হবে? বেলার বিষয়টা টেনেটুনে মেনে নিলেও, মনার বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারছে না দিশা। মনা ফাহাদের জন্য পাগল ছিল, কথাটা মনে পড়লেই অন্তর জ্বলছে ওর। যে মানুষটা দুনিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছে, তার ওপর ইর্ষা করা একদম শোভা পায়না!

দিশা নিজের উপরেই বিরক্ত হলো। ফাহাদ ওকে চেনেও না, জানেও না। নিজে যেচে পড়ে গায়ে পড়া মেয়ের মতো ফেইক আইডি দিয়ে চিপকে আছে। আত্মসম্মান পরপর করে মাথা চাড়া দিল। নিজের ওপর, নিজের অযাচিত স্বভাবের ওপর বিতৃষ্ণা জন্মালো দিশার। কোলের মাঝে অবহেলায় পড়ে থাকা স্ক্রিন চূর্ণ ফোনটা তুলে ফাহাদকে দেওয়া এ যাবৎ সব মেসেজগুলো একে একে মুছে ফেলল। সেই সাথে আইডিটাও কেটে দিল। আধভাঙা ফোনটাকে পুনরায় আছড়ে ফেলে দাঁত কিড়মিড়ালো সে। অশ্রুসিক্ত চোখের কার্নিশ বেয়ে টুপ টুপ করে পানি ঝড়তে লাগল।

ঘরে এসে হাত-পা মেলে শুয়ে পড়েছে বেলা। গরমে জান যায় যায় অবস্থা। ফ্যানের তীব্র বাতাস গায়ে লাগিয়েও শান্তি মিলছে না। চিৎপাটাং হয়ে শুয়ে একশো গালি ছুঁড়ছে দোহাতি ভারী সুতি ওড়নাটার ওপর। ওটার জন্য একটুও বাতাস পায়নি এতোক্ষন। ঘেমেনেয়ে একাকার। দৌড়ঝাঁপ করে দু-একটা কাজ করতেই গরমে নাজেহাল হয়ে গিয়েছে। ঘরে এসেই ওড়না কোথায় ছুঁড়ে ফেলেছে তার ইয়াত্তা নেই। অনেকটা সময় পেরিয়ে হিম বাতাসটা আস্তে আস্তে শরীরে লাগতে শুরু করল। আরামে দুচোখের পাতা লেগে এলো বেলার। ঠিক তখনি বিরাট এক পাথর কোথা থেকে যেন ছুটে এসে আছড়ে পড়ল ওর উপর। তন্দ্রাচ্ছন্ন বেলা গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। আঁখিজোড়া খুলতেই তাজ্জব বনে গেল। কিসের পাথর! এ তো সাক্ষাৎ পাথররূপী মানব, বেলার ছোট্ট শরীরটার ওপর নিজের বিশালদেহী শরীরটা ছেড়ে চ্যাপ্টা করার প্র‍য়াস চালাচ্ছে।

-‘ আমাকে রাগাতে খুব ভালো লাগে, তাই না? ’
প্রশ্ন করে বেলার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে থাকল দিগন্ত। বসার ঘরে বেলার করা ত্যাড়ামির প্রতিশোধ এখন পঁই পঁই করে তুলবে সে। এদিকে অন্তর-আত্মা শুকিয়ে এলো বেলার। লোকটা এখন কি করবে ওর সাথে! ভালো কিছু আপাতত কপালে নেই তা বেশ টের পেয়েছে। বাঁচার তাগিদে মোচড় দিয়ে উঠল। হাত-পা নাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে ভীতু স্বরে আওড়াল,
‘ আপনি রাগবেন এমন কোনো কাজ করিনি। অযথা দোষারোপ করছেন। ’
থমথমে গলায় শুধালো দিগন্ত,
‘ একটু রোমান্টিক মুডে থাকলে তোর যত বেয়াদবি শুরু হয়। তখন ঘরভর্তি মানুষের সামনে হাতে হাত ছোঁয়ালাম। লজ্জায় লাল,নীল হওয়ার জায়গায় শক্ত হয়ে খিঁচিয়ে গেলি কেন? ’
অবাকের ভান ধরে বেলা মিনমিনে স্বরে বলল,

‘ কখন? আমি টের পাইনি। ’
ফুঁসে উঠল দিগন্ত,
‘ আমার সাথে চালাকি করতে চাইছিস! এখন টের পাবি সবকিছু। ’
বলতে দেরী হলো না, দিগন্তের খন্ড ওষ্ঠছোঁয়া বেলার গলদেশে বর্ষণের ফোঁটার ন্যায় এলোপাথাড়ি ছুঁয়ে দিতে শুরু করল। ছটফটিয়ে উঠল বেলা। দিগন্তের বুকের একপাশ খামচে ধরে চোখজোড়া আলগোছে বুজে নিল। কিয়ৎকাল পর বেলার কানে বেজে উঠল ফিসফিসিয়ে বলা কথা,
‘ পাকামি করে লাভ কি হলো? সেই তো এখন কান গরম হয়ে গিয়েছে। ’

নিশ্চুপ বেলা। দিগন্তের বুকে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষন পর কানের লতিতে চিনচিনে ব্যাথার আভাস পেয়ে রাগী চোখে দিগন্তের মুখপানে চাইল। দিগন্ত বেলার অতি নিকটে এসে রাশভারি স্বরে আওড়ালো,
‘ পরেরবার এরকম করলে আজকের আদরগুলো কামড়ে চলে যাবে পাটোয়ারীর মেয়ে। ’
তেতে উঠল বেলা। এক কান জ্বলছে তার। মুখ বেঁকিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
‘ কান জ্বলছে। এতোজোরে কেউ কামড়ায়! লাগবে না আপনার আদর-ভালোবাসা। ’
রাগের দরুন বেলার ফোলা নাকের আগ্রভাগ টেপুস হয়ে ফুলে উঠেছে। ফর্সা কপোলে লাজুকতার ছড়াছড়ি। বেলার এহেন রূপ মুগ্ধ হলো দিগন্ত। ভাবগাম্ভীর্য ভরা মুখে হুট করে এক চিলতে হাসির দেখা মিলল। পুনরায় বেলাকে বিরক্ত করার প্রবল ইচ্ছে মাথা চাড়া দিল। ব্যস,সময়ব্যয় না করে ওর নাকের ফুলো জায়গায় দাঁত বসিয়ে দিল। সহসা আর্তনাদ করে উঠল বেলা। তা শুনে শব্দহীন হাসল দিগন্ত।

এদিকে চেঁচামেচি থামিয়ে নাকে হাত চেপে গোল গোল চোখে হাস্যজ্জল দিগন্তকে দেখছে বেলা। এতো সুন্দর হাসি কোনো মানুষের হতে পারে! পাগল পাগল লাগল বেলার। বুক ধরফরিয়ে উঠল, দুনিয়া দুলতে শুরু করল। নিমিষেই হাত-পা ছেড়ে দেয় বেলা। দিগন্তের ঠোঁটের কোণের হাসি বিলীন হয়। ওর একগালে হাত রেখে অস্থির চিত্তে শুধায়,
‘ বেলা! খারাপ লাগছে? ঘামছিস কেনো? এই মেয়ে! ’
মিনিটখানেক সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল বেলা। নরম হাত বাড়িয়ে দিগন্তের মুখ চেপে ধরে বড় বড় দম টেনে হড়বড়িয়ে বলল,
‘ আপনার হাসি মারাত্মক রকমের ভয়ংকর! কেমন পাগল বানিয়ে দেয় আমাকে। হাসবেন না আর মাথাটাথা সব ঘুরে যায়। কি সাংঘাতিক! ’

বেলার কথা কর্ণকুহুরে ঢুকতেই আকস্মাৎ ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল দিগন্ত। তা দেখে হায় হায় করে চেঁচিয়ে উঠল বেলা। দিগন্তের বুকে দুমদাম কিল-ঘুষি দিয়ে ওকে সরাতে চেষ্টা করল। কিন্তু বেলার শক্তি দাবাং দিগন্তের নিকট নিছকই তুচ্ছ। শেষেমেষ না পেরে বেলা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল,
‘ আচ্ছা একটা কথা বলেন, হৃদয় তো ছেলের নাম হয়। তাই না? ’
-‘ হুম। ’
-‘ হৃদয়ের ভেতরে থাকা খন্ডগুলোকে অলিন্দ, নিলয় বলে। এ দুটোও ছেলের নাম, তাই না? ’
-‘ হুম। ’
ঠোঁট উল্টে চাপা স্বরে খেঁকিয়ে উঠল বেলা,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫২

‘ তাহলে তিনটে ছেলেসহ, আমার নিজস্ব শক্তি মিলিয়েও আপনাকে আমার উপর থেকে সরাতে পারছি না কেনো? ভারি লোক! হাঁড়গোড় সব ভেঙ্গে দিল। ’
বেলার অদ্ভুদ চিন্তাধারা দেখে থমকালো দিগন্ত। ওর অসংলগ্ন লজিকহীন বার্তা শুনে অচিরেই কিছু বলার ভাষা হারালো। হতম্ভবের ন্যায় উঠে বসে অসন্তোষের সহিত ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইল সম্মুখের নাদানের পানে।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here