দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৪

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৪
আফরোজা আশা

মাস গড়িয়ে শোকাচ্ছন্ন তালুকদার বাড়িতে এক টুকরো খুশির হাতছানি হলো। নতুন সদস্য আগমনবার্তায় উচ্ছ্বাস যেন ঠিকরে পড়ছে বাড়িতে। দু’মাসের অন্তঃসত্ত্বা বাণী। সকাল সকাল সে খবর সকলের কাছে পৌঁছাতেই হৌ-হুল্লোড়ে মেতেছে প্রত্যেক সদস্য। রহমান পাটোয়ারী আর রাসেল পাটোয়ারী হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টান্ন নিয়ে দুপুরের আগে আগে চলে এসেছে। প্রথম নানাভাই হওয়ার আনন্দ যেন ঠোঁট থেকে সরছে না তাদের।

দুটো ক্লাস শেষ হতেই দিগন্তের মেসেজ পেয়ে কলেজের বাইরে যাচ্ছে বেলা। মেজাজ তার বেজায় খারাপ। আজ কলেজে আসতে চায়নি। দিগন্তের ধমকানি খেয়ে সকাল সকাল আসতে হয়েছে। সাথে রাইমাকেও টেনেটুনে এনেছে। এখন দু’ঘণ্টা না পেরোতেই আবারো ধমকি দিয়ে বাইরে আসতে বলল। হয় লোকটার মাথায় ব্যামো হয়েছে, নয়তো তাকে মিস করছে। তিক্ত মেজাজের মাঝেও মিস করার কথাটা স্মরণে আসতে লাজুক হাসল বেলা। সে হাসির স্থায়ীত্ব ক্ষণকালের। গেটের বাইরে আসতেই চোখমুখ গম্ভীর করে নিল। বাইক নিয়ে রাস্তার অপরপাশে অপেক্ষারত দিগন্তের কাছে এসে শুধাল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ জোর করে পাঠিয়ে আবার এতো জরুরি তলব দিয়ে নিতে আসলেন কেন? ’
-‘ দরকার আছে। উঠেন দ্রুত। ’
-‘ কিন্তু আমি তো আপনার এই বাইকে বসব না। ’
ঘাড় কাত করে প্রশ্ন ছুঁড়ল দিগন্ত, ‘ কি সমস্যা? ’
বেলা গুরুতর ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ সমস্যা বিরাট। বাড়ির পথের পুরোটা আমি হেঁটে যাবো তাও আপনার বাইকে চড়ব না। ’
হাত ঘড়িতে একপলক সময় দেখে নিল দিগন্ত। বেশ দেরী করে ফেলেছে। এর মধ্যে বেলা আরো দেরী করাচ্ছে। বাইক থেকে নেমে বেলার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বলল,
‘ দরকারি কাজ আছে। দেরী হচ্ছে। বাইকে বসবি না কেন? ’
চেহারায় ঘন আঁধার নামল বেলার। আশপাশের ব্যস্ত সড়ক আর হাঁটাচলা করা লোকজনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ভারাক্রান্ত গলায় বলল,

‘ রিজেক্ট করেছিল। ’
বেলার কথা ধরতে পারল না দিগন্ত। ললাটে গাঢ় ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করল, ‘ কে? ’
‘ বাইকের মালিক বাইকে তুলতে রিজেক্ট করেছিল। ’
‘ কবে? ’
‘ চট্টগ্রাম টু ঢাকা ব্যাক করার সময়। ’
সরু চোখে বেলার দিকে তাকালো দিগন্ত। মনে পড়ল সেদিনের কথা। বেলাকে রায়হানের বাইকে দিয়ে মাইশাকে তুলেছিল সে, রায়হানের থেকে মাইশাকে দূরে রাখতে। একপাশ সামলাতে গিয়ে আরেকপাশের তাল বেঁকে গিয়েছে। মুখ থেকে চ বর্গীয় শব্দ তুলে নিরেট স্বরে আওড়ালো,

‘ কেউ রিজেক্ট করেনি। দু’লাইন বেশি বুঝিস। ’
-‘ বুঝলে বুঝেছি। কিন্তু সেদিন আমার মন ভেঙ্গেছিল। সে কষ্ট আমি ভুলিনি। ’
-‘ কষ্টটা পরে উজাড় করলে হয় না? এখন জরুরি কাজ আছে। ’
-‘ কোথায় যাবেন নাম বলেন জায়গার। আমি রিকশা করে আসছি। ’
বেলার কথা বিশেষ পছন্দ হলো না দিগন্তের। কিছু একটা ভেবে খুব সিরিয়াস গলায় প্রশ্ন করল,
‘ এই বাইকে বসবেন না? ’
-‘ না। ’
দ্বিতীয় বার কিঞ্চিৎ আশা নিয়ে শুধালো, ‘ কখনোই না? ’
বেলার জবাব তার জায়গায় অনড়, ‘ না। ’
-‘ শিয়র? ’
জেদী কণ্ঠ বেলার, ‘ শতভাগ। ’

সহসা বেলার একহাত চেপে ধরল দিগন্ত। বড় বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। দিগন্তের কদমের সাথে তাল মিলিয়ে একপ্রকার দৌড়াতে হলো বেলাকে। কিছুটা দূরে গিয়ে একটা রিকশায় বসে দুজনে। বেলা হতবুদ্ধির ন্যায় ফ্যাল ফ্যাল করে দিগন্তের দিকে চেয়ে আছে। কিছু একটা স্মরণে আসতেই পেছন ঘাড় বাঁকালো। রিকশার ফাঁক গলিয়ে বাইকের দিকে নজর পড়তেই আঁতকে উঠল সে। ভরা রাস্তার পাশে চাবিসহ বাইক ফাঁকা পড়ে আছে। দিগন্তের বাহু ঝাঁকিয়ে হড়বড়িয়ে বলল,
‘ আরে বাইকের চাবি রেখে এসেছেন। চুরি হয়ে যাবে। নামেন আপনি। ’
দিগন্ত বেলার হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে শক্ত করে বসে রইল। ওর ভাবান্তর না দেখে বেলা আবারো চড়াও হলো,

‘ আশ্চর্য! চাচা রিকশা থামান। ’
রিকশার গতি শ্লথ হতে চাইলে দিগন্ত আটকালো,
‘ থামবে না। আপনি যেতে থাকেন। ’
বেলা হাসফাস করে উঠল। মেইন রোডের পাশে চাবি সমেত ফাঁকা বাইক পেলে কি চোর ছেড়ে দিবে নাকি! ইতঃমধ্যে অনেকটা দূর চলে এসেছে তারা। পুনরায় পেছনে তাকাতেই চোয়াল ঝুলে পড়ল বেলার। ছিঁচকে চোরের মতো একটা চিকনা গোছের লোক বাইকের আশপাশে ঘুরছে। হয়তো নিয়ে পালানোর ধান্দায় আছে।
চোখ বড় বড় করে আর্তনাদ করে উঠল বেলা,

‘ গেল গেল। চুরি হয়ে গেল। এই ঢ্যামনা লোক নড়ছে না তাও। ’
দিগন্ত বেলার ঘাড়ের পেছনে হাত ঘুবিয়ে ঘাড় সোজা করে দিল। রাশভারি গলায় আওড়াল,
‘ চুরি হওয়ার জন্যই ছেড়েছি। পুড়িয়ে ফেললে নষ্ট হতো। তার চেয়ে চোরের একমাসের পেটের খাবার জুটে যাবে। ’
হা করে দিগন্তের মুখপানে চাইল বেলা। এতোক্ষনে যে বাইক আর বাইকের জায়গায় নেই তা বেশ টের পাচ্ছে। চুরি যাওয়ার দুঃখে ওর বুক পুড়ছে অথচ পাশের লোকটা কি নির্বিকার। কিঞ্চিৎ কষ্টের ছাপও যেন তাকে ছোঁয়নি। রাগে ফেটে পড়ল বেলা। দিগন্তের পায়ের দিকে খামচি দিয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে দিল। তা দেখেও দেখল না দিগন্ত।
আপনমনে কিছুক্ষন অশ্রু ঝরিয়ে বিশেষ লাভ হলো না বেলার। দিগন্তের স্থিরদৃষ্টি রাস্তার দিকে। পাশে যে কেউ কাঁদছে তা যেন সে টের পায়নি। বাইকের শোকে কাতর বেলা দাঁত কিড়মিড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমি উঠব না বলে বাইক হারিয়ে আমাকে দোষী বানালেন। ওটা কিনতে টাকা লাগেনি মনে হয়। টাকা কি গাছে ফলে? ’
-‘ হুম ’
ক্ষীণ স্বরে গর্জে উঠল বেলা, ‘ কি হুম? ’
-‘ জানি না। ’
-‘ কেমন ঝামেলার লোক! যাচ্ছি কোথায়? ’
এবার নড়েচড়ে বসল দিগন্ত। জবাব দিল,
‘ শপিংমল। ‘
এ সময় শপিংমল! আকাশ থেকে ধুপ করে জমিনে আছাড় খেলো বেলা। শপিংমল যাওয়ার জন্য এই ভর দুপুরে এতো তাড়া! বিস্মিত গলায় শুধাল, ‘ কেনো? ’

এতোক্ষন এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল দিগন্ত। বেলার দিকে পূর্ণদৃষ্টি মেলে চাইল। ঠান্ডা স্বরে বলল,
‘ আমার ছোট ভাই বাপ হচ্ছে। আমার আগে ছক্কা মেরেছে। ভারী গিফট অবশ্যই ডিজার্ভ করে। ’
‘ আচ্ছা। ’ সাময়িকভাবে কথাটা বললেও দিগন্তের পুরো লাইনটার সমীকরণ মেলাতে কিছু সেকেন্ড লাগল বেলার। অতঃপর দিগন্তের বাহু ঘেঁষে শরীর কিছুটা দুলিয়ে তড়াক করে চেঁচিয়ে উঠল,
‘ এ্যাহ! আমি খালামণি হচ্ছি? সত্যি? ’
ত্যাদড় গলায় জবাব দিল দিগন্ত,
‘ না। বড়আম্মু হবি। ’
কথাটা একদম বেকার মনে হলো বেলার। মুখ বেঁকিয়ে বলল,‘ ফাতড়ামি করবেন না তো৷ ’
চোখ ছোট ছোট করে শক্ত চোয়ালে বেলার দিকে তাকিয়ে থাকল দিগন্ত। বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘ অভদ্র, বেয়াদব মেয়ে মানুষ। ’

একপশলা মিলনমেলা বসেছে তাকুলদার বাড়িতে। দুপরের পরপর ওবাড়ি থেকে সকলে চলে এসেছে। এদিকে যাদের জন্য খুশির আমেজে মেতেছে সবাই তাদের মাঝেই নিরব যুদ্ধ চলছে। দিহান বারবার বাণীকে ইশারা করছে একটু ঘরে আসার জন্য। কিন্তু এতো মানুষের সামনে তা দেখেও অগ্রাহ্য করছে বাণী। বাড়িভর্তি মানুষজনের সামনে কি সে নির্লজ্জের মতো ঘরে গিয়ে ঢুকে থাকবে!
দিহান মিনিট পাঁচেক পর পর ওর পাশে এসে ইশারা দিচ্ছে। শান্ত মেজাজে চুপ থাকলেও এবার বেশ রেগে গেল বাণী। শরীর তার মোটেও ভালো নেই। সকাল থেকেই না খাওয়া তার। যা একটু মুখে তুলেছিল সেটুকুও বের হয়ে গিয়েছে। একপাশে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মূহুর্ত চলছে, আরেকপাশে শরীর খারাপ। এর মধ্যে দিহানের কাজ কারবারে মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে আসছে।

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকলে স্ত্রীর ইশারায় রহমান পাটোয়ারী মিতালী আর জয়নাল তালুকদারের কাছে কথা পাড়ল বাণীকে কিছুদিনের জন্য ওবাড়িতে রাখবে। অসুস্থতায় চোখমুখ বশে গিয়েছে। মিতালী মানা করল না। রাজী হলো সে। সংসারের কাজের ফাঁকে বাণীর কতটুকু খেয়াল রাখতে পারবে তার ঠিক নেই। মা-চাচীর কাছে যত্নে থাকবে, এ সময়টা কড়া যত্নের প্রয়োজন বাণীর।

দিহান অসহায় চোখে বাণীর দিকে চেয়ে আছে। পারছে না তো হুমড়ি খেয়ে পড়ে বাণীর সাথে সেও যেতে চায়। কিন্তু তার প্রয়োজন পড়ল না। রহমান পাটোয়ারী হাসিমুখে দিহানকে তাদের সাথে যেতে বলল। দুটো দিন সেখান থেকে অফিস করলে খুব একটা ক্ষতি হবে। নিভু চোখজোড়া চকচক করে উঠল দিহানের। বাণী আড়চোখে ওর ভাবগতি দেখছে। কিছুটা ইচ্ছে করেই দিহানের কথা শুনছে না সে। বেলার বিয়ের আগে ওকে বাপের বাড়ি ফেলে এসেছিল। এই সুযোগ, নাকে দড়ি দিয়ে একটু না ঘুরালেই নয়!
এদিকে চঞ্চল বেলার মন আঁকুপাঁকু করছে, সেও যাবে ওবাড়ি। কতদিন হলো নিজের রুমটাতে থাকা হয় না তার। বুকটা খাঁক হয়ে আছে। পাশে বসা দিগন্তের টি-শার্টে কোণা চেপে ধরল। রাসেল পাটোয়ারীর সাথে কথা বলছিল দিগন্ত। বেলার দিকে ফিরে ভ্রু নাচাল। বেলা ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ আমিও যাবো ওবাড়ি। ’
-‘ তোরো বাচ্চা হবে? ’
অহেতুক প্রশ্নে হকচকাল বেলা। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ বাচ্চা হলেই যদি যাওয়া যাবে তবে হবে। ’
ঠোঁট কামড়ে ধরল দিগন্ত। শ্লেষাত্মক স্বরে বলল,
‘ তাই! কোথায় অর্ডার করলি? ’
বেলা মুখ ভার করে জবাব দিল,
‘ দিগন্ত তালুকদার হোম ডেলিভারি। ডেলিভারি চার্জ পাটোয়ারী বাড়িতে। ’
গম্ভীর গলায় আওড়ালো দিগন্ত, ‘ ডেলিভারি ক্যান্সল। ’
বেলার আর কিছু বলল না। বোঝা হয়েছে যেতে দেবে না।

সবার জীবন টুকটাক এগিয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় থমকে আছে শুধু দিশার জীবন। কদিন আগেও বাঁচাল, উৎফুল্ল মেয়েটা বেছে বেছে কথা বলছে আজ। তার হুট করে নরম কাটা দেখে বার কয়েক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে সকলের কাছে। পড়াশোনার চাপের অযুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। হয়তো মাইশা থাকলে কথাবার্তার মধ্য ওকে সামলাতো। কিন্তু সেদিন রায়হানের বাড়ি থেকে আসার পর, তার পরবর্তী সকালে রেহানা তাকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে গিয়েছে। মায়ের আচানাক সিদ্ধান্তে স্তম্ভিত হয়ে তার সাথে ফিরতে বাধ্য হয়েছিল মাইশা। অবাক করা বিষয় হলো, এবাড়ির কেউ আটকায়নি তাদের। মাইশা খুব করে চেয়েছিল যেন তাকে আটকায়। ভার্সিটির ক্লাসের কথা বলেও থাকতে চেয়েছিল কিন্তু সফল হয়নি। রেহানা মেয়েকে নিয়ে চলে গিয়েছে।

সন্ধ্যার কিছু আগে বাণীকে নিয়ে পাটোয়ারী বাড়ির সবাই চলে গেল। রহমান বেলাকে যেতে বললে সে পরে যাবে বলে জানলো। জোর করেনি মেয়েকে তিনি। কেবল দিগন্তের দিকে শান্ত চাহনিতে চেয়ে কিছু অভিযোগ ছেড়ে গিয়েছেন। তা দেখে আলগোছে হেসেছে দিগন্ত। তার মাথায় কি চলছে সেটা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। আপাতত মনোবল ঠিক রাখার জন্য হলেও বেলাকে কাছ ছাড়া করবে না। দিনশেষে রাতে যে আরামটুকু পায়, সেটুকু ছাড়া যে বাঁচা মুশকিল।

রকেয়া তালুকদার শৌখিন মানুষ। দিনরাত মিলিয়ে গোটা কয়টা পান না খেলে চলে না তার। তবে দূর্ভাগ্যবশত দুপর থেকে পান মুখে তুলতে পারেননি তিনি। সাদা চুন শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাড়িভর্তি মেহমান থাকায় কেউ এনে দিতেও পারেনি। সন্ধ্যার পরে বাজার থেকে এক প্যাকেট চুন কিনে আনল দিলদার তালুকদার। মিতালী প্রত্যাশাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সেটা বেলার হাতে দিলেন তিনি।

দিগন্তের জন্য বাটিতে দই তুলছিল বেলা। মিষ্টি খায় না সে। তাই আলাদা টক দই ফ্রিজে ঠান্ডা হতে রেখেছিল। দইয়ের বাটিটা রেখে আরেকটা বাটিতে চুনটা ঢেলে নিল। যাওয়ার সময় এটা দাদী-শাশুড়ির ঘরে দিয়ে যাবে। দুটো বাটি দুপাশে আলাদাভাবে নিল। উল্টাপাল্টা হলে আবার সমস্যা! দইটা আগে দিগন্তকে দিয়ে পরে এসে চুনের কাজ সারলে ভালো হতো। কিন্তু দুবার উপরনিচ করতে বড্ড আলসামো লাগল বেলার। তাই একবারে দুটো নিয়েছে। রকেয়া তালুকদারের ঘরে যেতেই তিনি চেপে ধরলেন বেলাকে। নানান ধরণের কথাবার্তা মশগুল হলেন। তার বেশির ভাগ কথায় লাজে নেতিয়ে যাচ্ছে বেলা। কোনোমতে চুনের বাটি রকেয়া তালুকদারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেল সেখান থেকে।

ঘরে এসে দিগন্তের দেখা পেল বিছানায় এলোমেলো কিছু কাগজপত্রে সাথে ল্যাপটপে কাজ করছে। বেকার দিগন্ত তালুকদার হুট করে এতো কি কাজ করছে বুঝে না বেলা! জিজ্ঞেস করবে করবে করেও করা হয়ে উঠেনি এখনো। ট্রে টা সাইড টেবিলে রেখে দইয়ের বাটি ওর মুখ সম্মুখে ধরল। একহাতে ল্যাপটপে টাইপ করতে করতে অন্যহাতে সেটা নিল দিগন্ত। বেলাকে বলল তার পাশে বসতে। বড় স্ক্রিনে কৌতুহলি চোখ রেখে বসল বেলা। দিগন্ত এক চামচ দই গালে তুলল। ললাটে ভাজ ফেলে গিলল সেটা। নাক ছিটকে বলল,
‘ কেমন দই? কে এনেছে? ’
অন্যদিকে মনোযগী বেলা জবাব দিল, ‘ আব্বু। ’
‘ না টক, না মিষ্টি। এই তোর বাপের আনা জিনিস। আমার সাথে বাজারে বের হতে বলিস। শিখিয়ে দিবো বাজার করা। ’
আব্বুকে টেনে কথা বলায় খেঁকিয়ে উঠল বেলা,

‘ আপনাকে খেতে হবে না। দেন আমার আব্বুর আনা জিনিস আমিই খাবো। ’ দিগন্তের হাত থেকে বাটি কেড়ে নিয়ে এক চামচ মুখে পুড়ল বেলা। ব্যস, আর গলা দিয়ে নামলো না। বাটি রেখে ওয়াশরুমে ছুটল। কিছুক্ষন পর কাঁচুমাঁচু করে দিগন্তের সামনে এলো। ভুল করে যে ভুল করেছে এবার কি হবে?
এদিকে দিগন্ত মুখ থেকে গলা অব্দি কোনো স্বাদ পাচ্ছে না। ঘন ঘন ঢোক গিলছে অথচ টের পাচ্ছে না কিছু। জিভটাও কেমন ঝাঁঝালো হয়ে আছে। বেলার চোরাভাব মুখখানা দেখে গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করল,
‘ কি? ’
দুহাত কোচলিয়ে বেলা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল মেঝেতে। ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা তার। ভীতি গলায় বলল,
‘ দইয়ের বাটিটা দাদীর ঘরে রেখে এসেছি। ’
দিগন্তের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। বিছানায় রাখা বাটির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ এটা? ’
মিনিট খানেক পর অপরাধী গলায় জবাব দিল বেলা,

‘ চু..চুন। ’
মুখ থেকে আর কিছু বের হলো না দিগন্তের। বেলার দিকে একদম শান্ত চাউনীতে চেয়ে রইল। দিগন্তের সে অস্বাভাবিক দৃষ্টি দেখে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল বেলার। একটু অসতর্কতার জন্য দইয়ের জায়গায় চুন খেয়ে মুখ পুড়েছে তারা। এবার না লোকটা তাকেই আস্ত খেয়ে ফেলে!
-‘ কাছে আয়। ’
বেলার প্রাণপাখি ফুড়ুৎ করে উড়াল দিল এবার। ছলছল নেত্রে ভেজা গলায় আওড়ালো,
‘ আমি ইচ্ছে করে করিনি। ’
‘ কাছে আসতে বলেছি। ’
টলমলে পায়ে এগিয়ে গেল দিগন্তের কাছে। বেলাকে ঘুরিয়ে কোলে মাঝে নিল দিগন্ত। পেছন থেকে ওর গালের সাথে খসখসে গাল মিশিয়ে নরম স্বরে আওড়াল,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৩

‘ কিছু হয়নি। এরপর থেকে সাবধান থাকবেন। ’
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বেলা। ঝট করে দিগন্তের দিকে ফিরে ওর বুকে পড়ল। বেলার চুলের ভাজে হাত গলিয়ে কান্নাভেজা লাল মুখখানা উপরে তুলল দিগন্ত। অধরকোণে প্রগাঢ় স্পর্শ রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ ওষুধ। ঠিক হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। ’
ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নতশিরে মুচকি হাসল বেলা। অথচ চোখের কোণে তার পানি চিক চিক করছে। ক্ষণিকের আসা ভীতিটা দূর হয়েছে কবেই! একরাশ ভালোলাগায় ছেয়ে গিয়েছে মন আঙিনা।

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here