দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৫

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৫
আফরোজা আশা

পড়াশোনা শব্দটা যতটা সহজ, ঠিক তার থেকেও বহুগুণ বিরক্তির বিষয় দিশার নিকট। সারাদিন উঠবে-বসবে,ঘুরবে- ফিরবে, মোবাইল চালাবে তাতে ঘুম বাবাজির পাত্তা পাবে না। যেই না দুচোখের সামনে বইখানা মেলে ধরবে, অমনি রাজ্যের ঘুম হানা দিবে তার চোখে। সেকি আর যে সে ঘুম! মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমোনোর থেকে বেশি কিছু হয়তো।
ক্লাসে বসে বহু কষ্টে লেকচার শুনছে দিশা। চোখজোড়া জোরজবরদস্তি মেলে রেখেছে। দীর্ঘ লেকচারের পুরোটাই টুপনি মুরগীর ন্যায় ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কাটালো। ভেতরের আত্মাখানা যেন গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করছে তার,
‘ ওরে কেউ বিছানা বালিশ দে আমি এখানেই ঘুমাবো। ’

অমনোযোগীর কারণে ক্লাসের মাঝে বার কয়েক ওয়ার্নিংও পেতে হয়েছে তাকে। অবাক করা বিষয় হলো লেকচারার যে মুহূর্তে ক্লাসের বাইরে পা রাখল, দুচোখের পাপিষ্ট ঘুমগুলো আপনা থেকেই কোথায় যেন গায়েব হলো। একদম টকটকে চোখ এখন। চড়া মেজাজে ব্রেঞ্চ ছেড়ে বাইরে এলো দিশা। পেছন থেকে নতুন পাতানো কয়েকজন সঙ্গী ডাকল তাকে, সে ডাক উপেক্ষা করে হনহনিয়ে গেটের দিকে হাঁটতে লাগল সে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাইশাকে বেজায় মিস করছে। একজন বাঁচাল মানুষের জন্য একজন নীরব সঙ্গী নিঃসন্দেহে উত্তম। তদ্রূপ মাইশা আর দিশাও। দিশা মন খুলে কথা বলে আর নিরবে-নিভৃতে, মনযোগের সহিত তার সব কথা মাইশা শোনে। দিশার বিশদ প্যাচালের মাঝে মাইশা যে দু-এক পরামর্শ দেয় তাও ওর জন্য বেশ উপকারি। সে যাওয়ার পর থেকে মন খুলে কথা বলার মতো মানুষ পায়নি দিশা। ভেতরে ভেতরে কেমন যেন গুমড়াচ্ছে মেয়েটা!

গেট পেরিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল সে। হুট করে একটা গাড়ি এসে থামল ওর কাছ ঘেঁষে। ভয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল দিশা। রুক্ষ মেজাজের পারদ তড়তড় বাড়ল। আগুন চোখে সামনে তাকাতেই গাড়ির দরজা খুলে গেল। ভেতরে বসা ব্যক্তিকে দেখে চোখ কপালে উঠল দিশার। যে আপদের জন্য ওর দিন-দুনিয়া ঘুরে গিয়েছে, সে আপদ আবার যেচে পড়ে পায়ে পাড়া দিচ্ছে। কিছু বলার জন্য উদ্যত হতে ফোন আসল ওর। রায়হানের নাম দেখে আরেকদফা চমকালো। কানে ধরতেই অপরপাশের ব্যক্তি কিছু কথা বলে রেখে দিল। চরম বিস্ময় নিয়ে কিয়ৎকাল সম্মুখ পানে হা করে চেয়ে থাকল দিশা। একপ্রকার ঘোরের মধ্যে থেকে গাড়ি বসল।
দ্বিধান্বিত অবস্থা তার। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছে। ফাহাদের আড়ালে পেছনে দুহাত এনে চিমটি কাটল। নাহ! স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই আছে সে।
কিছুদূর গিয়ে চোখের সানগ্লাস হাতে নিয়ে দিশার উদ্দেশ্যে জবান খুলল ফাহাদ,

‘ তুমি দিগন্তের বোন? ’
নেহাৎ মন ভেঙ্গেছে দিশার। ভালোভাবে রয়ে সয়ে জবাব দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হলো না। স্বভাবের বাইরে গিয়ে থমথমে গলায় আওড়াল, ‘ থোবড়াতে মিল পাচ্ছেন? ’
-‘ খুব কাছ থেকে দেখলে হালকা সাইড মারছে। ’
-‘ তাহলে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন দেখছি না। ’
-‘ বিয়ের দিন চাঁদের পাশে দেখে ভেবেছিলাম তুমি কোনো আত্মীয় হও। দিগন্তের বোন হবে সেটা বুঝিনি। ’
ললাটে ভাজ পড়ল দিশার। ঘাড় বাঁকিয়ে শুধাল,‘ চাঁদ? ’
থতমত খেলো ফাহাদ। কথার প্রেক্ষিতে ভুল করে বলে ফেলেছে। গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলল, ‘ নাথিং। ’
ফাহাদ কথা এড়িয়ে গেলেও দিশার যা বোঝার ঠিকি বুঝেছে।মক্ষম সুযোগ পেয়েছে মনের বিষ কিছুটা উগলে দেওয়ার। একদম হাত ছাড়া করবে না। কাটক্ষপূর্ণ বুলি আওড়াল,

‘ মনে একজন, মস্তিষ্কে আরেকজন, চোখ দেখে আরেকজনকে, হাতে হাত থাকে আরেকজনের সাথে, মুখ প্রশংসা করে আবার আরেকজনের। এইসব ছেলেরা খাঁটি রত্নের সন্ধানে শেষমেষ কয়লার খনিতে মুখ থুবরে পড়ে। ’
ফাহাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দিশাকে একপলক দেখল। মেকি হাসল দিশা। চটপটে গলায় বলল,
‘ ভাইয়া, ভাইয়ার কথা বলছি। আমার ভাই আবার লাখে একটা। ওইসব বেহুদা ছেলের মতো না। এক বেলাকে ভালোবেসেছে, ওকেই বিয়ে করেছে। ’

-‘ হোয়াট রাবিশ! ’
-‘ সেকি আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো? ভাববেন না যেন আপনাকে বলেছি। গাছেরও খায়, তলেরও কুড়ায় ওসব ছেলেদের মিন করেছি। ওসব ছাগলের উচিত আমার ভাইয়ের পা ধোয়া পানি খাওয়া। ’
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল দিশা। সে শব্দটা ফাহাদের মনে হলো কেউ ওর গালে ব্যগ্র এক থাবা দিয়েছে মাত্র। শক্ত চোয়ালে দিশার আড়ালে বিড়বড়িয়ে আওড়ালো সে,
‘ তালুকদার বাড়ির এক একটা নমুনা। ’

আর কথা হলো না ওদের মাঝে। গাড়ি থামল একটা বড় কফিশপের সামনে। ফাহাদ আর দিশা ভেতরে যেতেই কর্ণারের এক টেবিলে দেখা মিলল কাক্ষিত দুই ব্যক্তির। রায়হান হাতের ইশারায় দিশাকে ওদের দিকে ডাকল। অতঃপর একসঙ্গে হলো চারজন। কিন্তু দুইজোড়া চোখ একে অন্যকে ভৎস করতে ব্যস্ত।
ধোয়া ওঠা গরম কফি আসতেই চুমুক বসালো দিশা। আপাতত নার্ভাসনেসের কারণে মাথা-ঘাড় টানছে তার। কোনোভাবে কি দিগন্ত জেনে গিয়েছে ও ফেইক আইডি দিয়ে ফাহাদকে স্টক করত? সেকারণে এখানে ডেকেছে? তবে তো আজ দিশার জীবনের অন্তিম সময় চলছে। না, আর ভাবতে পারছে না দিশা। এর মাঝে পরপর কয়েক চুমুক দিয়ে জিভ পুড়ে গেল। বাড়িতে হলে এতোক্ষনে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতো। কিন্তু এখন যে মান-সম্মানের প্রশ্ন। পোড়া মুখ নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল মেয়েটা।
নিরবতা ছাড়িয়ে হঠাৎ রায়হান একটা ফাইল রাখল টেবিলের মধ্যিখানে। স্ফুলিঙ্গের ন্যায় দৃষ্টি সরিয়ে ফাইলের দিকে তাকাল ফাহাদ। কথাবার্তাহীন সেটা হাতে তুলে নিয়ে একের পর এক পৃষ্টা উল্টাতে লাগল। দিশা কৌতুহল নিয়ে ভীতি স্বরে শুধাল,

‘ ক..কিসের ফাইল? ’
দিগন্ত জবাব দিল না। রায়হান বলল, ‘ মনার কেসের। ‘
মুখের কফিটুকু গিলা দায় হলো দিশার জন্য। বন্ধ মুখে গোলাকার আঁখি মেলে গুঙিয়ে উঠল সহসা, ‘ উমমহ। ‘
পরক্ষণে আওড়ালো, ‘ তোমাদের মাঝে তাহলে আমাকে আনলে কেনো? থাকো আমি বাড়ি ফিরব। ওহহ, কফি যে খাওয়ালে তার নসিবে ডজন বাচ্চা লাগুক। থাকো টাটা। ’
বলে জান বাঁচিয়ে পালাতে চাইল দিশা। তাতক্ষনাৎ ধমকালো দিগন্ত, ‘ বস। কাজ আছে তোর। ’
মুখ লটকে আবারো বসল দিশা। মন বলছে ছুটে পালাতে। পাশে নির্বিকার ভঙ্গিতে পাতা উল্টাতে থাকা পুরুষটার জন্য কেমন অস্থির অস্থির লাগছে ওর। হাত-পায়ের ঘাম ছুটছে। কথায় আছে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। দিশার অবস্থা এখন সেরকম। ভয়ে-আতংকে মরি মরি অবস্থা তার। এই না কেউ ধরে ফেলে, ফাহাদকে ও এতোদিন ডিস্টার্ব করেছে। তাহলেই হলো!যদিও সবকিছু ডিলিট দিয়েছে তাও অজানা আতংকে মুড়ে আছে অন্তঃস্থল।
বেশ কিছুক্ষন পর ফাহাদ বলল,

‘ কোনো কিছু না জেনেই কেস ওপেন করা ঠিক হলো? ডায়েরি ছাড়া সেদিনের কোনোকিছু হাতে নেই। না আছে ছেলে দুটোর খোঁজ। ’
সহসা দিগন্তের কটাক্ষমিশ্রিত কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল,
‘ তোর কমিশনার বাপের দাপটে তো বাঁচিস না। কাজে লাগা এখন। ’
-‘ কমিশনার বলেই তোর বাপের মতো যেখানে সেখানে মুখ দিয়ে বেড়ায় না। ’
জায়গা মতো আঘাত পড়ায় রাগে ফেটে পড়ল দিগন্ত। হাত শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ করে ফাহাদের মুখ বরাবর পাঞ্চ মারল। সহসা ঘাড় বাঁকিয়ে নিল ফাহাদ। ঠোঁটের কোণ ফেটে আসা কিঞ্চিৎ রক্তটা বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে মুছতে মুছতে বিকৃত হাসল। সেকেন্ড কয়েকের মাঝে দিগন্তের দিকে তেড়ে গিয়ে ওর শার্টের কলার চেপে ধরল। শক্তপোক্ত হাতখানা যেই না দিগন্তের মুখে আঘাত হানতে যাবে অমনি চেঁচিয়ে উঠল দিশা। ওর বিকট চিৎকার শুনে সরে এলো ফাহাদ। ক্ষণিকের জন্য দুজনেই ভুলে বসেছিল দিশার কথা। দিগন্ত চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে চুউউ শব্দ তুলল।
দুপাশে না বোধক মাথা নাড়িয়ে রায়হান বলে উঠল,

‘ খোঁচাখোঁচি বাদ দিয়ে কাজের কথায় আসবি তোরা? মেইন কাজ সেরে আগে আমাকে আর দিশাকে ছাড়। তারপর যত ইচ্ছা মারামারি কাটাকাটি করিস। বউ দূরে, মন-মেজাজ খুব খারাপ।ভালো লাগছে না কিছু। ’
ফোঁস করে দম ছাড়ল দিগন্ত। চোখমুখে একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকা দিশার দিকে চেয়ে বলল,
‘ কাল থেকে আমাদের স্টুডিওতে যাবি। জুনায়েদ তালুকদারের এবারের মিউজিক অ্যালবামে তুই ফিমেইল ভয়েসার হবি বলে বায়না ধরবি। যতক্ষন না তোর বাপ-চাচা মানছে ততক্ষন নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকবি। তারপর অ্যালবাম বাহানায় অফিসে ঢুকতে হবে তোকে। ’
দিগন্তের কথা শুনে চক্ষু চড়কগাছ দিশার। গলায় সুরের ‘স’ ও নেই, সে নাকি গাইবে গান! মহা আশ্চর্যের কথা! অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল, ‘ এ্যাঁহহ! আমি? ’

-‘ হুম। জুনায়েদ তালুকদারের কাছে ভিডিও ক্লিপ আছে। সেটা এনে দিবি আমাদের। ’
-‘ সে কাজ এমনিও পারব। কিন্তু গান গাইবো মানে? আমাকে কবে গান গাইতে দেখেছো। গলার সুর তো কষ্মিনকালেও ছিল না। ’
দিগন্ত আর ফাহাদ অগ্নিদৃষ্টিতে রায়হানের দিকে তাকালো। শুকনো ঢোক চাপল রায়হান। দিগন্ত বারবার বলেছে দিশা গান-টান পারে না। রায়হান ওর ওপরে পরে বলেছে দিশার গান শুনেছে সে। সত্যিই তো শুনেছে। অবাক গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৪

‘ সেদিন তোমার ঘর থেকে গুনগুনিয়ে গান শুনলাম। মিথ্যা বলছো কেনো? বেশ ভালো গাও তুমি। ’
বিরক্তিতে চোখমুখ বেঁকিয়ে নিল দিশা। জিভের ডগায় অজস্র গালি ঘুরলেও আপাতত সেসব উচ্চারণ করার সাহস নেই। কোনোমতে বলল,
‘ দূর! আমি না ওটা মাইশা ছিল বোধহয়। ওর গানের গলা সুন্দর।কোনো একসময় হয়তো গুনগুনিয়েছে সেটাই শুনেছো তুমি। ’
শুকনো মাটিতে জোরে সোড়ে আছাড় খেলো রায়হান। সহসা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। হড়বড়িয়ে বলল,
‘ বাদ, বাদ। এ প্ল্যান বাদ। ও ভোলাভালা। এসব পারবে না। ’

দিগন্তবেলার প্রেমান্দোলন পর্ব ৫৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here