দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৯

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৯
অবন্তিকা তৃপ্তি

ভোরের আকাশটা আজ বড্ড অন্যরকম। আকাশে ছটা মেঘের ঘনঘনানি, বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ! অরূপ অনেকক্ষণ ড্রাইভ করার পর, তার মন চাইল, বাতাসটা একটু উপভোগ করা যাক। অরূপ নিজের মনের মালিক, সেও আর দেরি করলো না। গাড়িটা একটা নিরিবিলি জায়গায় থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। রাস্তার দুপাশে হাওর, হাওরে স্বচ্ছ পানির ঢেউ খেলছে। অরূপ গাড়ির বোনেটে লাফ দিয়ে উঠে বসলো। মাথাটা তুলে আকাশ দেখল, মুগ্ধ হয়ে ফোনটা বের করে ফটাফট কতগুলো ছবিও তুলে ফেললো। নিজেও একটা সেলফি তুলে ফেলল, ইনস্টাগ্রামে ছবিটা ছেড়ে ক্যাপশন দিল-

‘In every ending, there is a new beginning!’
হয়তো ক্যাপশনটা তেমন ভেবে অরূপ লিখে নিই, কিন্তু তার বাস্তব জীবনে যে এই ক্যাপশনটাই এভাবে ফলে যাবে, কে জানত!
ছবিটা পোস্ট করার পর মুহূর্তেও লাভ রিয়েক্ট, কমেন্টস এ ভরে গেলো, অরূপ হালকা হেসে ফোনটা আবার পকেটে পুড়ল। তারপর বোনেট থেকে নেমে গাড়িতে উঠে বসল, এখনও অনেকটা দূর যেতে হবে ওর!
অরূপ যখন আশাদের বাড়ি পৌঁছে তখন সকাল আটটা। অরূপ যেতেও আব্দুর রহমান নিজে এগিয়ে আনেন উঠোন থেকে। অরূপের হাতে মিষ্টি, ফল-ফাক্কর। অরূপ সেটা আব্দুর রহমানের হাতে দিয়ে বলল-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘আঙ্কেল,মা পাঠিয়েছেন আপনাদের জন্যে।’
আব্দুর রহমান কিছুটা লজ্জায় পরে বললেন-‘এসবের আবার কী দরকার ছিল বাবা। মেয়েটাকে নিবে, এমনিতেও তোমাদের অনেক ভোগান্তি যাবে।’
অরূপ হালকা হেসে সোফায় বসে বললো-‘এভাবে বলবেন না আঙ্কেল। আপনাদের পরিবার আমাদেরই একটা অংশ।’

আব্দুর রহমান হালকা হাসার চেষ্টা করলেন। মেয়েটা যাবে এভাবে, বোনের শ্বশুরবাড়ি। তারও মনটা কেমন খচখচ করেছে। কিন্তু গতরাত অনিরূপ বাবা যেভাবে অনুরোধ করল, ফেলতে পারলেন না তিনি। আব্দুর রহমান নিধিকে ডেকে নাস্তা রেডি করতে বললেন। অরূপ পর্দার আড়ালে দেখতে চাইছে কিছু কাকে কে জানে? বারবার তাকাচ্ছিল ওইদিকে, হঠাৎ নিজের কাছে নিজেই ভীষণ অবাক হয়ে চোখ সরিয়ে ফেলল। আব্দুর রহমান রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলেন অরূপের সঙ্গে। অরূপও তাতে তাল মেলাতে লাগল।
খাওয়া দাওয়া শেষে অরূপ বললো-‘আঙ্কেল, এবার উঠি।উনাকে রেডি হতে বলুন প্লিজ।’

আব্দুর রহমান এবার ভেতরে গেলেন। নিধি বাসনপত্র গোছাচ্ছে। আব্দুর রহমান বললেন-‘তোকে রেডি হতে বলল।’
নিধি ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাসন গুছিয়ে বাবার রুমে এসে ঔষুধের বক্স বের করে বলল-‘এই যে এখানে সব ঔষধ রাখা, আমি কিনে এনে রেখেছি। আমি আসা অব্দি কিছুই কেন লাগবে না। প্রেসক্রিপশন রাখা আছে, দেখে খেয়ে নিও। আর ফুলির মাকে বলা আছে, ঘোরদোর পরিষ্কার করে রেধে রেখে যাবে। তোমার চিন্তা করতে হবে না। তোমার একটাই কাজ, সময়মতো বাড়ি ফিরে খাওয়া, ওষুধ নেওয়া টাইমলি, আর টাইমলি ঘুমানো। বুঝেছো তুমি আব্বা?’

আব্দুর রহমান সাহেবের চোখ কেন যেন ছলছল করে উঠল। মনে পড়ে গেলো, নিধির মায়ের কথা। এমন করেই বাপের বাড়ি গেলে চিন্তায় ভেঙে পড়তো উনার স্ত্রী। মনেমনে হাসলেন উনি, বড় মেয়েটা হয়েছে একদম ওর মায়ের মতো। ছোট মেয়েটা অবশ্য উরণচণ্ডী, কিন্তু কাজ করে ভালো। আব্দুর রহমান বললেন-‘আমি দেখে নিব ওসব। ছেলেটা এতক্ষণ ধরে বসে আছে, ওরও তো কাজ আছে মা।’

নিধিও আর দেরি করলো না। দৌড়ে গেল রেডি হতে।নিধি যেতেই, আব্দুর রহমানের মুখটা ছোট হয়ে গেলো। বয়স কতইবা ওর? এই এ বছর ২১ বছর হলো। ১৯ বছরের মাথায় বিয়ে, ২০ এর মাথায় ডিভোর্স। মেয়েটার কপালে আল্লাহ সুখ রাখলেন না একদম। ভুলটা উনারই। কিছু স্বার্থপর মানুষের মুখে জামাইর মিথ্যা সুনাম শুনে, মেয়েটার কথা না শুনেই বিয়ে দিয়েছেন উনি। কী হলো শেষ অব্দি? অল্প বয়সেই ডিভোর্স ট্যাগ লেগে গেলো। আফসোসের নিশ্বাস বেরিয়ে আসে আব্দুর রহমানের।

অরূপ ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে নিধি জানালার দিকে উদাস চেহারায় তাকিয়ে আছে। অরূপ আড়চোখে একবার তাকাল, মেয়েটার মন কী আজ ভালো নেই? একদমই ভালো নেই? অরূপ ভাবে! মেডিকেলে পোড়ার সময় অরূপের একটা চমৎকার গুণ ছিল। কারো খারাপ, উদাস মন ভালো করার গুণ। অরূপ সেটাই করল। ও গাড়ীতে গান চালাল,
‘ইনকি পিংকী পঙ্কি, ড্যাডি বট ডনকী। ডনকী ডাই, ড্যাডি ক্রাই!’

এমন অদ্ভুত গান শুনে নিধি হতভম্ব চোখে অরূপের দিকে তাকাল। অরূপ ভাবলার মতো হেসে বলল-
‘গানটা ভালো না? আপনার উদাস মন ভালো করতে একদম উপযোগী।’
গানটা এখনো চলছে। নিধি নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে বলল-‘আমি উদাস কে বলল?আমি উদাস নই।’
নিধি আবারও বাইরে তাকাল। অরূপ মথা দুলিয়ে হেসে গান অফ করে বলল-‘জানি।’
নিধী অরূপের দিকে তাকাল-‘কী জানেন?’

অরূপ ঠোঁটে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বলল-‘আপনি এই যে মাত্রই একটা মিথ্যা বললেন সেটা জানি। অসুস্থতা নিয়ে মন খারাপ করে লাভ আছে বলুন? ইটস নরমাল। আর যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে চৌদ্দ বংশের সকল পুরুষ ডাক্তার। সো, ডন্ট অরি।’
নিধি বলল-‘ডাক্তাররা কী কেউ অসুস্থ হয়না? অসুখে মরে না?’
অরুপ ড্রাইভ করতে করতে উত্তর দিল-‘মরে, বাট আল্লাহ আমাদের হাতে অনেককিছুই দিয়েছেন। আমরা চাইলে আল্লাহর থেকে সাহায্য নিয়ে অনেক রোগ সুস্থ করতে পারি।’
নিধি শুনে, অরূপ ড্রাইভ করতে করতে সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। নিধি আর কিছু বলে না।

অনিরূপ সকালের নাস্ত খাচ্ছে। পাশেই আশা বসে। আজ বাড়িই সবাই ঘুমে। সকাল ততটাও হয়নি, সবে ৯টা বাজে। অনিরূপের কাজ থাকায় সে আজ দ্রুত বের হচ্ছে। অনিরুপ খেতে খেতে বলল- ‘বোনের সঙ্গে কথা হয়েছে? বেরিয়েছে ওরা?’
আশা উত্তর দিল-‘হু, রাস্তায়।’
‘ওরা এলে, একবার ওকে নিয়ে আমার কাছে এসো। আজকেই রিপোর্টটা করিয়ে ফেলব।’-অনিরূপ খেতে খেতে বলল!

আশা চিন্তিত স্বরে বলল-‘আপার কী খুব বড় রোগ হয়েছে ডাক্তার?’
আশার সুডৌল মুখটা কালকে রাত থেকেই ভীষণ শুকনো, ম্যারাম্যরে হয়ে আছে। অনিরূপ ওকে দেখে, গভীর নজরে। কেন যেন, আশার শুকনো মুখটাই অনিরূপের ভালো লাগে। আশার শাড়ির আঁচল মাথায় ছিল এতোক্ষণ, এখন বাতাসে পরে গেছে। ঘন চুলগুলো হাতখোপা করা, কপালের উপর লেপ্টে আছে কতগুলো বেবী হেয়ার। ভালোই তো লাগছে দেখতে ওকে। শাড়ি না পড়লে এই মেয়েকেই নির্ঘাত ছোটখাট একটা বাচ্চা লাগত দেখতে। অবশ্য ২৯ বয়সী অনিরুপ এক কথায় বলা যায়,বাল্য বিবাহ করেছে। আশাকে দেখে সেটাই মনে হয় আশেপাশের সবার।

অনিরুপ অল্প কিছুক্ষণ চেয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে ওর। হসপিটাল থেকে বারবার কল আসছে। অনিরূপ খেয়ে মুখ ধুয়ে তারপর সেই ভিজে মুখ আশার আঁচলেই মুছে। আশা আঁচল সরাতে গেলে, অনিরূপ হাস্কি স্বরে বলে-‘বউদের শাড়ির আঁচল কিন্তু স্বামীদের ব্যক্তিগত সম্পদ, আশা।’
আশা শাড়ির আঁচল চেপে ধরে, বুকটা অদ্ভুত রকমের কাঁপছে। ইদানীং লোকটা কাছে এলেই আশা কাপে, অকারণেই কাপে। বুঝছে না, এই কাপুনি কী নারভাসনেস থেকে, নাকি লোকটার আবেগী কথার কারণে।

আশা আঁচল চেপে ধিমে স্বরে বলে বসে-‘বউদের সবকিছু স্বামীদের সম্পদ হলে, ব-বউদের সম্পদ কী?’
অনিরূপ আশার থেকে এমন কথা আশা করেনি। আশার মুখটা লাল, লাজে নাকি রাগে? বুঝল না ও। বুঝতে চাইলোও না অবশ্য। একটু এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল বউয়ের। আশা কিছুটা পিছিয়ে যেতে চাইল সঙ্কোচে, আটকে দিল হাত ধরে অনিরূপ। আশার মাথায় আলতো হাতে আঁচল তুলে দিয়ে, আশার হাতটা ধরে নিজের বুকে চেপে ফিসফিসিয়ে বলল-‘স্বামীদের আগাগোড়াই বউদের। একচ্ছত্র সম্পদ বলতে গেলে এই বুকটা, যেটা তুমি স্পর্শ করে আছো।’

আশা অনিরূপের বুকে হাত রাখে, তারপর আচমকাই হাত সরিয়ে ফেলে তটস্থ গলায় বলল-‘আ-আপনার দ-দেরি হচ্ছে না। ফ-ফোন বাজছে আপনার।’
অনিরূপ ভ্রূ বাঁকিয়ে আশাকে দেখে, আশা অনিরূপের এমন চাওনি ডেকজে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। ছুটে রান্নাঘরে চলে যায়। অনিরূপ হেসে ফেলে আশার ছোটাছোটি দেখে। কল রিসিভ করতে করতে বলে যায়-‘একবার ধরতে পেলে, দেখব কতো ছোটাছোটি করতে পারেন।আপাতত দরজাটা লাগান।’

আশা রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাপাচ্ছে। অনিরুপ ইদানীং কেমন অদ্ভুত কথা বলে, কেমন অদ্ভুত চোখে চায়, আশাকে দেখে! আশার চোখের সামনে সবকিছু অনিরুপের ওই নীলাভ চোখটা ভেসে উঠে, যে চোখে অনিরূপ আশাকে দেখে নির্লজ্জের মতো। আশা বুকটা আবারও ধক করে উঠে, দুহাতে মুখ ঢেকে মৃদু সুরে আর্তনাদ করে উঠে আশা।

অরূপ গাড়ি পার্ক করে পার্কিং এরিয়ায়। নিধি অপেক্ষা করছে গাড়ি থেকে লাগেজ বের করার। অরূপ গাড়ি থেকে নেমে লাগেজ বের করে নিধির পাশে এসে দাঁড়ায়, নিধিকে এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললো- ‘কী ব্যাপার? আপনি এখনও ভেতরে যান নি?’
নিধি নিচু গলায় লাগেজ দেখিয়ে বললো-‘লাগেজ আমার হাতে দিন, আমি নিয়ে যেতে পারব।’

অরূপ হাতের কালো লাগেজটা একবার দেখে, তারপর হালকা হেসে নিধির দিকে চেয়ে বলে-‘পুরুষদের জন্মই হয়েছে এসব ভারী জিনিস টানার জন্য, আপনি আগে যান, আমি নিয়ে আসছি।’
নিধি মনেমনে একটু লজ্জা পায়, এত কষ্ট করে সারা রাস্তা ড্রাইভ করে এলেন, এখন আবার নিধির লাগেজ নিচ্ছে। লজ্জা-সঙ্কোচে নিধি যারপরনাই অস্বস্তিতে ভুগলো। অরূপ হাত দিয়ে ইশারা করল নিধিকে সামনে যাওয়ার জন্যে। বাধ্য হয়ে লাগেজটা অরূপের হাতে দিয়ে নিধি এগিয়ে গেলো।

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৯

অরূপ তখন সবে কলিং বেল বাজিয়ে লাগেজ রেখে দাঁড়িয়ে আছে সদর দরজার সামনে।গা-টা বারবার মুচড়ে মুচড়ে উঠছে অরূপ। নিধি অরূপকে একবার দেখে, সদর দরজার সামনে পা রাখতেই সিঁড়িতে পা ভেজে আচমকাই নিধি পড়ে যেতে নিল। অরূপের গায়ের উপর পড়তেই অরূপ টাল সামলাতে, নিধিকে বাঁচাতে নিধির কোমর ছুয়ে আটকালো পড়ে যাওয়া থেকে। নিধি থরথর করে কেঁপে উঠে অরূপের বুকের কাছের শার্ট খাঁমচে ধরলো। অরূপ নিধির দিকে কেমন অন্যরকম দৃষ্টিতে এই প্রথম তাকাল, নিধির মুখের আদল আচমকাই অরূপের ভীষন ভালো লেগে গেলো। অরূপ তাকিয়ে ছিলো, নিধি ভয়-লজ্জা-সঙ্কোচ নিয়ে উঠে দাড়াবে সোজা হয়ে- তার পূর্বেই সদর দরজাটা খুলে বড়বড় চোখে ওদের দুজনকে দেখে ফেলল আশা!

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২০