দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৮

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৮
অবন্তিকা তৃপ্তি

আশা ‘শেখ মহল’ ফিরেছে কটা মাস পেরিয়েছে। এতটাদিন আশা বারবার চমকেছে, বিস্মিত হয়েছে অনিরূপের একের পর এক বদলানো রূপ দেখে। তারা এক বিছানায় ঘুমায়, অথচ অনিরূপ আশাকে ছলে-বলে ছোয়ার চেষ্টাও করেনি। নানাভাবে অনিরূপ ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছে আশাকে। যেদিন আশা এ বাড়ি এসেছে, অনিরূপ সেদিন একটা কথাই বলেছে-

‘আশা, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো একজন বেটার হাসবেন্ড হওয়ার। তুমি প্লিজ এই ব্যাপারে আমাকে হেল্প করো। কোথাও অপ্রস্তুত হলে আমাকে তাৎক্ষণিক জানাবে, ভেতরে ভেতরে গুমরে মরবে না। আমরা দুজন দুজনকে না বোঝা অব্দি আমাদের দুরুত্ব থাক।’
আশা অবাক হয়েছিল, অবাক চেহারায় সম্মতি দিয়েছে। মানুষটার মধ্যে চেষ্টা দেখে আশা যারপরনাই আনন্দিত। আশাও মনেপ্রানে চেষ্টা করছে দুজনের মধ্যকার বন্ডিং ভালো করার জন্য, একটা প্রপার সম্পর্কের দিকে এগুনোর জন্যে।
এইতো আজকের কথা-

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনিরূপ গোসলে। আশা অনিরুপের এপ্রোন, শার্ট, প্যান্ট বের করে বিছানায় রেখেছে। অনিরূপ বেরিয়ে এলো, আশা হালকা স্বরে বললো-
‘মা ডাকছেন, রেডি হয়ে নিচে আসুন।’
অনিরূপ শুধুমাত্র কোমরে তাওয়াল প্যাঁচানো। আশা এতে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো, লজ্জা পেয়ে বললো-
‘অন্তত প্যান্ট পরে বের হওয়া যেত।’
অনিরূপ আশাকে তীক্ষ নজরে দেখলো, বুঝল আশা রাগ করে কথাটা বলে নিই। ও এবার ঠোঁট টিপে হেসে বললো-
‘আমাদের বডির মধ্যে এমন কিছুই একে অন্যের কাছে লুকায়িত নেই, রাইট মিসেস অনিরূপ? এত লজ্জার কী আছে?’

আশা ভ্রু কুঁচকে অনিরূপের দিকে চায়, ঠোটকাটার সর্বোচ্চ সীমা পাড় করে ফেলেছে এই পুরুষ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশা বেরিয়ে যেতে নিলে অনিরুপ পেছন থেকে ডেকে উঠে-
‘তুমি নিচে যাচ্ছ?’
আশা বলে-‘হ্যাঁ, নাস্তার টেবিল সেট করবো।’
অনিরূপ তখন সবে প্যান্ট পরেছে। আশার দিকে চেয়ে হাতের শার্ট দেখিয়ে বললো-
‘পরিয়ে দিবে শার্টটা?’-. মুখে অবিস্তর হাসি লটকে অনিরূপ আদুরে কণ্ঠে আবদার করল।

আশা কী বলবে, মানা করতে ইচ্ছে করল না। হালকা করে মাথা দুলিয়ে শার্ট নিয়ে পেছনে থেকে পরিয়ে দিলো অনিরূপকে। শার্টের বোতামও লাগিয়ে দিল। অনিরূপ এবার এপ্রোন হাতে মিষ্টি করে বললো- ‘এপ্রোন?’
অনিরূপের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। আশা ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে দেখল, অনিরূপ সঙ্গেসঙ্গে মুখটা দুঃখী করে বললো-
‘আমার হাতে ব্যথা, সত্যি। এই দেখো, ম্যাসাল ফুলে গেছে।’
অনিরূপ হাতের ম্যাসল শার্টের হাতা গুটিয়ে দেখাল। আশা বলে-
‘রোজ জিম করা ম্যাসাল এটা।’
অনিরূপ চোখ গোলগোল করে বললো-

‘নো ওয়ে, বেশি বুঝো তুমি। নাও এপ্রোন পরিয়ে দাও কুইক, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আশা।’
করুণ কণ্ঠে শেষের কথাটা বললো অনিরূপ। আশা দেখল, সত্যি লেইট হচ্ছে অনিরূপের।তাই অগ্যতা এপ্রোন হাতে নিয়ে পরিয়ে দিল। পড়ানোর সময় বললো-
‘দিনদিন আপনার আবদারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ডাক্তার।’
‘ডাক্তার?’
এমন সম্ভোধনে অনিরূপ অবাক হলো। আশা বললো-

‘নাম ধরে ডাকতে পারব না, আপনার মায়ের নিষেধ। তাই এই নাম। ভালো না লাগলে বলুন, অন্য নামে ডাকব।’
আশার সরাসরি উত্তর। অনিরূপ হেসে আশার গাল টিপে দিয়ে বললো-
‘এই নামটা জোস, ডেকো, সমস্যা নেই।’
আশা গালে হাত দিয়ে চোখ গরম করে তাকালো, অনিরূপ ইশারায় সরি বলে ঘড়ি হাতে পড়তে পড়তে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। নিচে ওয়াহিদের ডাক শোনা যাচ্ছে। অনিরূপ ‘মা, আসছি’ বলতে বলতে সিঁড়ি থেকে নামছে।
অনিরূপ খাওয়া দাওয়া করে বের যাওয়ার আগমুহূর্তে আশার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো-
‘দুপুরে রেডি থেকো, ঘুরতে বেরোব।’

‘কোথায় যাব?’- আশা বাসনপত্র গোছাতে গোছাতে প্রশ্ন করল।
‘যেদিকে মন খুলে প্রেম করা যাবে। সেদিকে। আসি, বাই।’
অনিরূপ আশার দিকে চেয়ে দুষ্টু হেসে চলে গেলো। আশা চোখ ছোটছোট করে অনিরূপের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। রান্নাঘর থেকে ওয়াহিদা চেচালেন-
‘আশা, গরুর মাংসটা ভেজাও।’’
আশা আবারো দৌড়ে রান্নাঘরে ছুটলো, একটুও ফুরসত নেওয়ার সময় নেই এখন আশার।

সেদিন সত্যি সত্যি আশাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলো অনিরুপ। গিয়েছে শহর থেকে অনেকটা দূরে একটা নদীর পারে। আশা অনেকটাই খুশি আজকে। হাবভাব অনেকটাই চেঞ্জ ওর। আশা আগেআগে হাঁটছে, শাড়ির আঁচল দুলছে নদীর দখিনা বাতাসে। অনিরূপ পিছুপিছু জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে হাঁটছে। আশা কিছুটা এগিয়ে বললো-

‘ডাক্তার, ওই দেখুন নৌকা। নৌকায় উঠবেন?’
আশাকে অনেক উচ্ছসিত দেখা যাচ্ছে। অনিরূপ এগিয়ে আসলো, আশার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে অদূরে দাঁড়ানো নৌকা দেখে বললো-
‘যাওয়া যাবে, চলো।’
অনিরূপ নৌকা ভাড়া নিলো। আশা নৌকার কোনায় বসে পা ভিজিয়ে আছে, পানি নিয়ে খেলছে। অনিরূপ এক জায়গায় বসে আশাকে নেশালো চোখে দেখেই যাচ্ছে। ওর নদীতে চড়ার ইচ্ছে ছিল না, শুধুমাত্র বউকে খুশি করতেই দ্য গ্রেট অনিরূপের এই আত্মত্যাগ!

নৌকায় অনিরূপের বেশ কয়েকবার মনে হয়েছে, টাইটানির মুভিটার মতো আশাকে পেছন থেকে জরিয়ে কিস করতে। বাট আফসোস! বিয়ে করা বউয়ের বেলায়ও কত নিষেধাজ্ঞা, শালার কপালটাই খারাপ। অনিরূওয়ার মুডের দফারফা হলেও, সে আশার সামনে বেশ হাসিখুশি থাকল।
ওরা প্রায় এক ঘণ্টা নৌকা চড়ে এসে তীরে নামল। অনিরূপ ভীষণ টায়ার্ড, ও একটা বেঞ্চে বসল। আশাও ওর পাশে বসে নদী উপভোগ করছে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে আশা একপর্যায়ে ভীষণ গম্ভীর হলো, বললো-
‘আপনি এসব আমাকে খুশি করার জন্যে করছেন, তাইন ডাক্তার?’
অনিরূপ তাকালো, ভ্রু কুঁচকে বললো-

‘খুশি করার জন্য?যা করছি আমি মন থেকেই করছি।আমাদের একসঙ্গে টাইম স্পেন্ড করা খুব কম হয়েছে সেজন্যে করছি।’
মিথ্যে কথা, অনিরুপ এসব করছে শুধুমাত্র আশার মনটাকে জয় করার জন্য। একটা হার্ড ইয়েট কুলেস্ট গেইম জেতার জন্যে।
আশা অনিরূপের উত্তরে খুশি হল নাকি বোঝা গেলো না। শুধু মৃদু হাসল। অনিরূপ ঘড়ির দিকে তাকাল, চেম্বারের টাইম হয়েছে ওর। তাই বললো-
‘আশা, এবার উঠি? চেম্বার আছে সন্ধ্যায়।’
আশা সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়াল, বললো-
‘ওহ, হ্যাঁ। চলুন।’
অনিরূপ গাড়ি করে আশাকে নামিয়ে দিলো। নিজে এরপর চেম্বারে চলে গেলো।

নিধির শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। নিধির গত একমাস ধরে টানা জ্বর, ক্ষুধামন্দা। শরীরটাও আজকাল আগের মত কাজ করতে পারে না, সারাক্ষন ক্লান্ত বোধ করে। যে নিধি একা হাতে পুরো একটা সংসার সামলাতো, সেই নিধি আজকাল সারাক্ষণ কেমন নুইয়ে নুইয়ে থাকে। কাজে হাত দিলেও সেই কাজ সম্পূর্ণ শেষ করতে পারেনা। ব্যাপারটা আশাকে বলার পর আশা খুবই চিন্তিত হয়ে বললো-
‘ডাক্তার দেখান উচিত আপা তোমার। তোমার রিপোর্টগুলো আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করো তো। আমি উনাকে দেখাই আজ।কিছু বলতে পারবেন হয়তো।’

নিধিও রিপোর্ট সেন্ড করে।নিধি নিজেই জানতে চায়, ওর মূলত হয়েছেটা কী? কীসের জন্যে এত শরীর খারাপ? মেডিসিনে কাজ হচ্ছে না কেন? জ্বরটাও আজকাল মেডিসিন নিলেও সারছে না। সবকিছুতে বিরক্ত হচ্ছে ভীষণ নিধি।
অনিরূপ রাতে বাড়ি এলে, আশা ঘুমানোর সময় অনিরূপকে রিপোর্ট দেখায়। অনিরূপ ভ্রু কুঁচকে রিপোর্ট সব দেখে। সবগুলো রিপোর্ট পরে অনিরূপের মুখের আদল বদলে যায়। ও চিন্তিত হয়ে বলে-
‘কতদিন ধরে মেডিসিন নিচ্ছে তোমার আপু?’
‘একমাস ধরে।’

‘রিপোর্ট আমার কাছে ভালো ঠেকছে না। এই থিঙ্ক তার শহরে আসা উচিত, আমি নিজে কিছু রিপোর্ট করবো। তুমি তাকে এখানে আসতে বলো।আমাদের বাসায়। সুবিধা হবে আমার এতে।’
নিধি ‘শেখ মহল’ আসবে ভেবে আশার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। নিধি কখনো এভাবে শেখ বাড়ি আসবে না, বোনের শ্বশুরবাড়ি যাবে ও? এতদিন থাকব? নিধি কতগুলো কথা শুনিয়ে ছাড়বে আশাকে। আশা কাচুমাচু হয়ে বললো-
‘আপা আসবে না এখানে এভাবে।’
অনিরুপ অবাক হয়ে বললো-‘কেন? তোমার বাড়ি এটা? আসতে পারে না কেন?’
‘তোমার বাড়ি’ কথাটা আশার কানে খুব লাগল। অনিরূপ এটা মনে করে এখন? আশা নিজের ভালো লাগাটুকু আড়াল করে বললো-

‘আপা এ ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে।’
অনিরূপ এবার অধৈর্য্য হলো বললো-
‘দেখি তুমি কল দাও ওকে। আমি কথা বলছি।’
আশা দোনামনা করল, কিন্তু অনিরূপের বারবার বলার পর কল দিল নিধিকে। দেখা গেলো, অনিরূপ এভাবে কনভেন্স করল নিধিকে যে নিধি নিজেও বেকায়দায় পড়ে গেলো। অনিরূপ হাল ছাড়ছে না দেখে শেষমেশ নিধি রাজি হলো। কথা হয়েছে অরূপ গিয়ে নিয়ে আসবে নিধিকে ওদের বাড়ি থেকে। অরূপকেও বলে ফেলল অনিরূপ কাল ভোরে যাওয়ার জন্য।

আশা সবকিছু দেখল। ওর আপন মানুষদের জন্যে অনিরূপের এত চিন্তাটা আসার ভালো লাগল ভীষণ। তবে মুখে তেমন একটা খুশি প্রকাশ করল না ও। ইদানীং রাতে চা খেয়ে ল্যাপটপে কিছু বিষয় আজকাল রিসার্চ কিরছে অনিরূপ। আজও করবে বোধহয়। তাই আশা আজ প্রথমবারের মতো উৎসুক হয়ে নিজেই বললো-
‘চা আনি?’
অনিরূপ ল্যাপটপের স্যাটার খুলতে খুলতে অবাক হয়ে তাকাল আশার দিকে। আশা নুইয়ে পড়া গলায় আবারো বললো-
‘সবসময় খান তাই বললাম।’
অনিরূপ অবাক হলো, অতঃপর বউয়ের সুমতি হয়েছে ভেবে হালকা হাসল। ল্যাপটপ অন করতে করতে ঠোঁট টিপে হেসে বললো-

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৭

‘ইয়াহ, যদি তোমার দয়া হয় এই অধমের উপর।’
আশা আর দাঁড়াল না। চা বানাতে চলে গেলো। অনিরূপ নিজের মাথার ঝাকড়া চুল ব্যাকব্রাশ করতে করতে বিড়বিড় করল-
‘যে ভাতে মরে, তাকে আঘাত করে মারতে নেই। আহারে আমার ভাতে মরা বউটা।’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ১৯