দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৮
অবন্তিকা তৃপ্তি
গ্রীষ্মকালের গরমটা ভীষণ তেজ ছড়াচ্ছে ইদানিং। অরূপ-নিধির বিয়ের আজ প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। ততদিনে নিধি বেশ সহজ হয়ে উঠেছে স্বামীর সঙ্গে। নিধি আজকাল খুব করে চাইছে, সম্পর্কটাকে গুছিয়ে নিতে, সময় দিতে সম্পর্কে। সেই অনুযায়ী একটু একটু করে এতবড় সংসারের দায়িত্ব হাতে তুলেছে। রান্নার দেখাশোনার পাশাপাশি অরূপের সুবিধা-অসুবিধার দিকটাও একইসঙ্গে দেখে।
প্রতিদিন অরূপের জামা কাপড় গুছিয়ে দেওয়া, প্রতিদিনের হ্যান্ডওয়াচ পছন্দ করে রাখা, শার্ট ইস্ত্রি করা- আপাতত সবটাই নিধি দেখে। ওয়াহিদা ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে এতটা চিন্তিত আর থাকেন না। কিন্তু মনে একটা খচখচানি থেকেই গেল। নিধি ক্যান্সারে ভুগছে-যদি বেশিদিন না বাঁচে! ছোট ছেলেটার সংসার জীবন শুরু হতে না হতেউ শেষ হয়ে যাবে। আফসোসে বুকটা জ/খম হয়ে যায় একথা ভাবলে ওয়াহিদার। আজকাল জায়নামজে বসে, মোনাজাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে ছোট ছেলের সংসারের দীর্ঘায়ু কামনা করেন তিনি। তার মোনাজাতে অপছন্দের নিধির ভালো থাকাটাও সামিল হয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিধি আজ হাসপাতালে এসেছে। অরূপ চেম্বারে ছিল। নিধির আসার খবর পেয়ে ও এটেন্ডেন্সকে ডেকে নিধিকে ভেতরে যেতে বলে। নিধি ধীর পায়ে কেবিনে ঢুকল। রোগী দেখা শেষ; অরূপ তখন কম্পিউটার শাট ডাউন করছিল। নিধিকে ঢুকতে দেখে কম্পিউটারে চোখ রেখেই বললো-‘বসুন, নিধি।’
বলা বাহুল্য, নিধির অত্যন্ত জোরাজরিতে অরূপের ‘আপনি’ সম্বোধনটা ‘তুমি’ তে পরিণত হয়নি এখনো। অরূপ শুরু থেকে ত্যারা স্বভাবের,ওর মতে যে সম্বোধনটা ও সম্মান করে, সেটা নিয়ে লোকে কী বললো ওর আসে যায়না। কিন্তু ওয়াহিদার কড়া নিষেধ। বউকে আপনি করে বলা যাবে না, এটা এ বাড়ির পুরুষদের স্বকীয়তার বাইরে। কিন্ত অরূপের জেদ এক কাঠি উপরে হওয়ায় সে এসব মেনেই নিলো না।
নিধি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে আছে। চোখ ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখছে। বেশ বড়সড় কেবিন। বড় হবে সেটাই স্বাভাবিক। মালিকের রুম বলে কথা!
অরূপ কম্পিউটার শাট ডাউন করে পূর্ণ দৃষ্টিতে নিধির দিকে তাকাল। বউয়ের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগটাই তাক করে বললো- ‘ডাক্তার দেখিয়ে আমরা বাইরে খেয়ে নিব আজ। মা কে বলা দিয়েছি।সমস্যা নেই তো?’
নিধি শোনে,সংসারের খুঁটিনাটি আনন্দটুকু সবটাই অরূপ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে নিধিকে দিতে। সময় থেকে শুরু করে সম্মান, সবটাই নিধি পায়! এখন আর নিধির নিজের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ নেই। ও ভালো আছে, এটাই সবথেকে বড় কথা।
নিধি মৃদু হেসে উত্তর দিল-‘ ঠিকাছে। কোথায় যাবেন?’
‘আশেপাশে নিরিবিলি কোন রেস্টুরেন্টে।’- অরূপ উত্তর করল। তারপর বাম হাতের হ্যান্ডওয়াচ একবার দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো-‘চলুন, ডাক্তার দেখিয়ে ফেলি।’
অরূপ ওয়ালেট, মোবাইল একে একে পকেটে ঢুকাচ্ছে। নিধি উঠে দাঁড়াল। শাড়ির আঁচল বাম কাঁধে টেনে নিলো পটু হাতে। অরূপ এসে নিধির পাশে দাঁড়াল। নিধির হাতটা মুঠোয় পুড়ে বেড়িয়ে এলো কেবিন থেকে। নিধি অরূপের পাশেপাশে হাঁটছে, ওর চোখদুটো দুজনের মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে তাক করা।
‘অরূপ, ভাবির আপাতত নতুন ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন নেই। সবই ঠিক আছে। নিয়মিত কেমো নিলে, মেডিসিন নিলে আশা রাখছি ঠিক হয়ে যাবে।’
অরুপের বুক থেকে পাথর নামলো। নিধিকেও ভীষণ উচ্ছ্বসিত দেখা গেলো। অরূপ এবার কিছুটা দোনামোনা করে নিধির দিকে তাকিয়ে আবারো ডাক্তারের দিকে তাকাল, বললো-‘কেমোর সাইড এফেক্ট কী দেখা যাবে?’
ডাক্তার উত্তম এবার একটু চিন্তিত হলেন। নিধির দিকে একবার চেয়ে আবার অরূপের দিকে তাকালেন। ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে বললেন-‘সচরাচর প্যাশেন্টের সঙ্গে যাই হয়, তাই হওয়ার চান্স আছে ভাবির সঙ্গে।’
নিধি আঁতকে উঠলো যেমন। অবচেতন মনে চেয়ারের হাতলে রাখা অরূপের বাম হাত খামছে ধরে তাকাল। অরূপ নিধির খামছে ধরা হাতটায় আলতো করে হাত রাখলো, ভরসা দেওয়াই চেষ্টা করলো।
তারপর ডাক্তারের দিকে চেয়ে বললো-‘সমস্যা নেই আমাদের। ও সুস্থ হলে এক্সটার্নাল বিউটি আবার ব্যাক আসবে। তুই প্রেসক্রিপশন লিখে দে।’
উত্তম প্রেসক্রিপশন লিখে দিলো। তারপর অরূপের দিকে চেয়ে বললো-‘বন্ধু হিসেবে একটা এডভাইস দিব, যদিও তুই জানিস সব। কিন্তু বলার কথা তাই বলছি- যদি বেবী প্ল্যান করিস, আমি বলবো এখন করিস না। ক্যান্সার ভালো হোক, তারপর এগুলে বেবী-মাদার দুজনের জন্যেই ভালো হবে।’
এতক্ষণে আতঙ্কে জর্জরিত থাকা নিধির দু-গাল এবার রক্তিম হয়ে গেলো। ও লজ্জায় আর মুখ তুলে চাইলো না। অরূপ সেটা দেখল। ওর বড্ড হাসি পেল। যে সম্পর্কটা শুধু হাত ধরার মধ্যে সীমাবদ্ধ, সেখানে আর বাচ্চা! অরূপ একটু হেসে উত্তমের দিকে চেয়ে বললো-‘চিন্তা করিস না, খেয়াল রাখব আমি।’
অরূপ নিধি রেস্টুরেন্টে বসে আছে। এই রেস্টুরেন্টের আশপাশটা বড্ড নিরিবিলি, অরূপ ঠিক বলেছিল। মনের মধ্যে একটা প্রশান্তি কাজ করছে। অরূপ ফোনে কথা বলছিল এতক্ষণ, মাত্রই ফোনটা কেটে সাইলেন্ট করে টেবিলের উপর উল্টো করে রাখলো। আপাতত আর কোনো কল সে রিসিভ করবে না। সময়টা এখন শুধু নিজেদের দিবে।
নিধি স্যুপে চামচ ঘুরাতে ঘুরাতে আড়চোখে অরূপের দিকে তাকাচ্ছিল বারবার। অরূপ সেটা দেখতে পেল। ও স্যুপ মুখে তুলে ভ্রু নাড়ালো, জিজ্ঞেস করল- ‘কী ব্যাপার? না খেয়ে ভাবছেনটা কী?’
নিধি স্যুপের বাটিতে চামচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একপর্যায়ে নিজের মনের মধ্যে চেপে রাখা কথা তুলেই ফেলল-‘ক্যান্সারের সাইড এফেক্ট হিসেবে কী কী দেখা যায়?’
অরূপ খাচ্ছিল, নিধির কথা শুনে ওর খাবার খাওয়া থেমে গেলো। ও নিধির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নিধি উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। অরূপ গলার স্বর এবার একটু কঠিন করে বললো-‘সেটা আপনার স্বামীকে ভাবতে দিন। আপনি খান এখন। স্যুপ খেয়ে বিরিয়ানি অর্ডার দিয়েছি।’
নিধি হতাশ চোখে অরূপকে দেখল। বলবেই না সে! হতাশ ভঙ্গিতে নিধি মুখে কুলুপ এঁটে খেতে লাগলো। অরূপের খাওয়া শেষ। ও এখন চেয়ারে হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত ভাঁজ করে নিধির খাবার খাওয়া দেখছে। লোকটা এত কী দেখছে, নিধি ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে কুকড়ে উঠে। লোকটার চোখ-দুটোও নীলাভ, ভাইয়ের মতো। দু-ভাই তাদের দাদার চোখ পেয়েছে। ওদের দাদা নাকি আমেরিকান বংশদ্ভুদ ছিলেন।
নীল চোখের পুরুষদের নিধি আগে শুধু টিভিতেই দেখত, ভালো লাগত ওই চোখের রং। কিম্তু ভাগ্যক্রমে আজ এই রঙা চোখের পুরুষ ওর স্বামী! মনেমনে আপ্লুত হয় নিধির হৃদয়!
অরূপ এখনও চেয়ে আছে। নিধি একসময় অতিষ্ট হয়ে বলে বসলো-‘এত কী দেখছেন?’
‘আমার বাচ্চার মা-কে।’ —-অরূপের কৌতুক স্বর।
নিধি এমন কথায় কেশে উঠলো। অরূপ দ্রুত উঠে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলো। নিধি দু ঢোক পানি খেয়ে আহত চোখে অরূপের দিকে তাকাল। ওর প্রশ্নের উত্তরে এমন ঠাট্টা নিধি আশা করেনি। স্বামীরা কী সবসময়ই এমন অদ্ভুত ঠাট্টা করতে পছন্দ করে। এসব স্বামীদের কি করা উচিৎ?
অরূপ নিধিকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আবারও চেয়ারে আরাম করে হেলান দিলো, বললো-‘তবে এখন আপনি শুধুমাত্রই আমার বৌ। কিন্তু সুস্থ হয়ে গেলে আমার বাচ্চার মা হয়ে যাবেন, ফর শিউর।’
অরূপ এমন ঠোঁটকাটা কথা বলতে পারে, সেটা নিধি ঘূর্ণাক্ষারেও টের পায়নি কোনোদিন। এই ছেলেটার বিয়ের আগে কতটা ভদ্র, সভ্য ছিল। আর এখন? অসভ্যর এক কাঠি উপরে। নিধি আশেপাশে চেয়ে দেখল একবার, তারপর নিভু নিভু গলায় বললো- ‘আপনার ঠোঁটে লাগাম টানুন প্লিজ। আমরা রেস্টুরেন্টে আছি, আশেপাশে মানুষ আছে।’
অরূপ আশপাশটা দেখলক। তারপর নিধির দিকে ঝুঁকে এসে ওর মতো করেই ফিসফিস করে বললো-‘লুক, এখানে যারা এসেছে সবাই কাপল। সবাই এমন দুষ্টু-মিষ্টি কথাই বলছে। তুমি-আমি শুধু নই।’
নিধি এবার আরও হতাশ! এই মানুষকে নিয়ে কোথায় যাবে নিধি? লোকে বললে বলুক। তারও এখন লোকের কথায় তাল মিলিয়ে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি করা কথা বলা লাগবে? নিধি অস্বস্তিতে পরে গেছে লক্ষ্য করে অরূপ এবার চুপটি করে ভদ্র হয়ে বসলো। নিধির দিকে চেয়ে চূড়ান্ত সুপুরুষের ন্যায় বললো-‘বেবিদের কথা বাদ দিচ্ছি আপাতত। আপনি খান, নিশ্চিন্তে খান।’
সকাল সকাল আজ অনিরূপের সংসারে রীতিমত আগুন লেগেছে। অনিরূপের বাল্যকালের ফ্রেন্ড এসেছে আজ বাসায়। দুর্ভাগ্যবশত সেই ফ্রেন্ড ডাক্তার, এবং মেয়ে। নাম- তৃষা রহমান।
ওয়াহিদার মুখে এই মেয়ের সুনাম শুনে শুনে ত্যক্ত-বিরক্ত আশা। মেয়েটা আসার পর থেকে; অনিরূপের সঙ্গে তৃষার এতটা ঘনিষ্ঠতা সহ্য হচ্ছে না আশার। এই তো, ওরা সোফায় পাশাপাশি বসে গল্পগুজব করছে। অনিরূপ মন দিয়ে শুনছে, তৃষা বলছে। পাশেই ওয়াহিদাও দুজনের গল্পে একটু-আকটু তাল দিচ্ছেন। পুরো ব্যাপারটায় আশা ফুলছে, যেমন করে ফুলছে চুলোয় সেঁকতে দেওয়া আটার রুটিটা।
আশা বারবার বসার ঘরের দিকে তাকাচ্ছে। নিধি সবজি চপিং বোর্ডে কাটতে কাটতে আশাকে দেখছিলো। আশার অস্থিরতা দেখে ও এবার সবজি কাটা বাদ দিয়ে পুরোপুরি আশার দিকে তাকালো,-‘অ্যাই আশা, তোর হয়েছেটা কী? ওদিকে কী দেখিস বারবার।’
আশা এবার চোখ ফেরাল। আর তাকাবে না ওদিকে। যা ইচ্ছে করুক। হাসতে হাসতে জ্ঞান হারাক। কী আসে যায় আশার? কিচ্ছু না।
আশা গম্ভীর মুখে রুটি সেঁকতে লাগল। নিধি বসার ঘরে একবার তাকালো, অনিরূপ-তৃষাকে দেখা যাচ্ছে। ও হয়তো বুঝতে পারছে ব্যাপারটা।তাই নিধি হালকা গলায় বললো-‘তুই শুধুশুধু হিংসে করছিস আশা। অনিরূপ ভাই তৃষা আপুকে ফ্রেন্ড হিসেবেই দেখে। আসছে অব্দি একজন পর্যন্ত দুজনকে গায়ে লাগতে দেখিনি। বন্ধু হিসেবে গল্প করতেই পারে। এটা নিয়ে অজথা মাথা প্যাঁচাস না।’
আশা নিধির দিকে তাকাল। এবার কিছুটা নরম হয়ে বললো-‘জানি আমি। সে আমাকে ধোঁকা দিবে না। কিন্তু তবুও; ওদের হাসির আওয়াজ কানে আসলে আমি ঠিক থাকতে পারছি না। এটা শুনলে, ও কী আমাকে ব্যাকডেটেড ভাববে?’
নিধি বোনের অস্থিরতা দেখে এবার বললো-‘তাহলে তুইও যা, জয়েন কর ওদের সঙ্গে। দে, রুটিটা আমি সেঁকে দিচ্ছি।’
নিধি আশার হাত থেকে খুঁন্তি নিতে চাইলে আশা দিল না। গোমড়ো মুখে বললো-‘না, আমি যাব না আপা। সে ভাববে, তাকে আমি প্রাইভসি দিচ্ছি না। গল্প করুক।’
নিধি বললো-‘গাধা, উনি এসব কিছুই ভাববে না।’
আশা তবুও গেলো না। নিধি এবার আশার বোকামো দেখে হেসে ফেললো। হেসে আশার মাথায় চাপড় দিয়ে হাত ধুতে বেসিনের দিকে চলে গেলো।
তৃষা দুপুরে খাবার খেয়ে চলে গেছে। সকাল থেকে এখন অব্দি সকল কাজ, মেহমানদারি শেষ করে আশা সবেই ঘরে এসেছে গোসল করতে। অনিরূপ বাথরুমে, পানির আওয়াজ আসছে। গোসল নিচ্ছে বোধহয়।আশা বাথরুমে টোকা দিলো–‘আপনার কী লেইট হবে?’
অনিরূপ শাওয়ার অফ করে হালকা জোরে জবাব দিল-‘না, আসছি।’
আশা গুমড়ো মুখে আবার বিছানায় বসলো। ওর আজকে সারাটাদিনটাই মাটি গেলো। শুধুশুধু ওই মেয়েটা এসে ওর মাথা বিগড়ে দিয়েছে। রাগে-জেলাসিতে মাথার ভেতরটা ধপধপ করছে। নিজেকে এক ফোঁটাও স্বস্তি দিতে পারছে না।
অনিরূপ বের হয়েছে। ট্রাউজার পরে, হাতে টিশার্ট। আশা অনিরূপকে একবার ভ্রু কুঁচকে দেখল। ওকে দেখে ওর পুরনো রাগটা আবারও মাথাচারা দিয়ে উঠলো। আশা মুখ ঝামটি দিয়ে গটগট করে ত্রিপিস নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।
পেছনে অনিরুপ আহাম্মকের মতো ভ্রু কুঁচকে বৌয়ের এই নিরব রাগটুকু দেখলো। সে কী করছে-সেটাই তো বুঝতে পারছে না। বৌ এত রাগলো কেন? অনিরুপ টিশার্ট পরে বিছানায় বসলো। বসে আশার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।
আশা বের লো। প্রথমবারের মতো আশাকে ত্রিপিস পরতে দেখে অনিরপের রাগ হলো বেশ। ও শান্ত স্বরে বললো-‘ত্রিপিস পরলে কেন? শাড়ি পড়ো।’
‘কারো এত ইচ্ছা পূরণের এতো ঠেকা নিয়ে আমি বসে নেই।’- আশার কাঠকাঠ গলা!
অনিরূপ ভরকে গেলো। ও কাচুমাচু মুখে আশার দিকে চেয়ে রইলো। আশা ফেইসক্রিম মেখে মোবাইল নিয়ে বিছানার এক কোণে বসে গেলো। অনিরূপ পাশে থাকা সত্ত্বেও পুরোদমে ওকে ইগনোর করা হলো।
অনিরুপের মুখটা এসব দেখে একবারে থমথমে হয়ে গেলো। ও গলার স্বর অনেকটাই থমথমে করে বললো-‘ ‘ত্রিপিসে তোমাকে একদমই মানাচ্ছে না, আশা। বেইবি বেইবি লাগছে।’
আশা এবার তিরিক্ষি মেজাজে বললো-‘না মানালে নাই।’
অনিরূপ এতক্ষনে এবার বুঝল পরিবেশ আসলেই গরম। ও আলতো করে আশার হাতটা ধরে বললো-‘আশা, এত রাগ কেন? কী হয়েছে? ডিড অ্যাই ডু স্যামথিং ব্যাড?’
এত আদর করে কথা বললে, আশা মুহূর্তেই গলে গেলো। ও আর রাগ দেখালো না। মনের ভেতর ক্ষোভটা জমিয়ে রেখে, হার মেনে ছোট্ট করে এটুকু বললো- ‘শাড়ি পরে আসছি, ছাড়ুন।’
অনিরূপ হয়তো বুঝতে পারলো, আশা রাগটা মূলত কী নিয়ে। ও আর ঘাটাল না। উঠে গিয়ে আলমারি খুললো। আশার দিকে সিল্কের শাড়ি বাড়িয়ে রেখে বললো-‘শাড়িটা রাতেই এনেছিলাম। ঘুমিয়ে গিয়েছিলে দেখে দিতে পারিনি। এটা পরে আসো এখন।’
আশা শাড়িটা দেখল। হালকা আকাশি রঙের ভীষন সুন্দর সিল্কের শাড়ি।
কী মনে করে হঠাৎ, অনিরুপ শাড়িটা আলগোছে বিছানার উপর রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেলে, আশা ভাবে অনিরূপ বেরিয়ে যাবে। ওর মুখটা থমথমে হয়ে আছে। অনিরুপ কী ওর রাগ এটুকুও বুঝল না? ও কী ঠিকঠাকভাবে রাগটা দেখাতে পারল না? কেন অনিরূপ হালকা নরম গলায় কথা বলাতেই আশা রাগ ভুলে আইসক্রিমের ন্যায় গলে গেলো? নিজের উপরই রাগ বোধ হচ্ছে এবার আশার।
আশার ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়ে অনিরূপ দরজা লক করে আশার দিকেই এগুলো। আশা থমকে যাওয়া দৃষ্টিতে দরজায় লকের দিকে চায়। এই দিন-দুপুরে লোকটার কী মাথা খারাপ হলো? যেকোনো সময় কেউ ডাকতে আসতে পারে। আশা নিচু গলায় অস্ফুট স্বরে বলল-‘প্লিজ বিকাল এখন।’
অনিরুপ অভদ্র হেসে শাড়িটা আবার হাতে নিলো, আশার দিকে চেয়ে গা জ্বালানো হাসি ছুঁড়ে বলে-‘চলো, তোমাকে শাড়ি আমি পরিয়ে দেই। আমি কিন্তু ভীষণ সুন্দর শাড়ি পরাতে পারি।’
কী? শাড়ি পরাবে? আশা বিস্ময় সামলে, আতঙ্কে লাফিয়ে দু কদম সরে গিয়ে বললো-‘না, আমি আপনার হাতে শাড়ি পড়বো না। আর আপনি পুরুষ হয়ে শাড়ি পড়াতে পারেন? কটা মেয়েকে শাড়ি পরিয়েছেন।’
অনিরূপ জবাব না দিয়ে আলগোছে আশার দিকে এগিয়ে আশার কাঁধের ছড়িয়ে রাখা ওড়নায় হাত রাখতে গেলে আশা অনিরুপের হাত আটকে দিল। এবার হয়তো লজ্জা পেয়েছে ও। অনিরূপ এবার বিরক্ত হয়ে মিহি গলায় শোধাল-
‘দূরে সরে যাচ্ছো কেন বারবার? খালি আমার বুক পোড়ানোর ধান্দা, কাছে আসো এক্ষুনি।’
আশা লজ্জায় মরিমরি হয়ে যাচ্ছে। রাগটুকু ততক্ষণে ধোয়াশায় মিলিয়ে গেছে। এখন যা বাকি আছে, সেটুকু শুধুই ভালোবাসা। আর কিচ্ছু নয়।
তারপর- অনিরূপ আশাকে বেশ সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিল। আশা লজ্জায় মরে গিয়েও বুকে জমা করে রাখলো অফুরন্ত সুখের স্মৃতি।
অনিরূপ শাড়ির আঁচল আশার বাম কাঁধে তুলে দিয়ে আশাকে দূর থেকে একবার আপাদমস্তক দেখলো। আশা লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে রেখেছে। অনিরূপ আঙুল দিয়ে ‘নাইস’ ইঙ্গিত দিয়ে বলল-‘অনিরূপের বউটা ট্রুলি বড্ড মারাত্মক! সিল্কের শাড়িতে ফিগারটাও জোস দেখাচ্ছে।’
আশা লজ্জায় হেসে ফেললো। স্বামীর বাহুতে হালকা কিল বসিয়ে বললো-’সবসময় বেশিবেশি, না?
অনিরূপ হাসলো, আশার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো- ‘‘তৃষা সেই মেয়ে, যার জন্যে অনিরুপ বউকে ফিরে পেয়েছে। তৃষা নিডস অ্যা বিগ থ্যাঙ্ক ইউ ফ্রম ইউ।’
আশা অবাক হয়ে তাকালো! অনিরূপ ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে বললো-‘এত কষ্ট করে পাওয়া বউকে ছেড়ে অন্য মেয়ে নিয়ে কোন পাগলে ঘুরে?শি ইজ জাস্ট অ্যা ফ্রেন্ড, নাথিং মোর।ডোন্ট ওরি।’
আশা এবার লজ্জা পেল। ও অনিরূপকে নিয়ে এতটা নীচ চিন্তা কি করে করে ফেলল? অনিরূপ তো এমন নয়, আশা জানে সেটা। তবুও এতটা গভীর ভাবনা, ইশ! বড্ড বোকামো করে ফেলেছে ও।
আশা নিচু গলায় লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো-‘ সরি,বুঝতে পারিনি। আমার রাগ করাটা উচিত হয়নি।’
অনিরূপ হেসে আশার কোমরে দুহাতে জরিয়ে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললো-‘ইটস ওকে ম্যাডাম! আপনার সম্পূর্ণ রাইট আছে জেলাস হওয়ার।’
আশা হেসে ফেললো শব্দ করে। অনিরুপের ওই হাসিতে নেশা ধরলো। ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ার চেষ্টা করা মাত্রই, আশা অনিরূপকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পালাতে চাইলো। তবে সেগুরে বালু! অনিরূপ আশার আঁচলটুকু নিজের হাতে পেঁচিয়ে ধরলো। আশা চমকে উঠে আঁচল চেপে থেমে গেলো।অনিররূপ আঁচল ধরে টানছে, আশাও শাড়িতে পিন না থাকায় একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে স্বামীর দিকে। একটাসময় অনিরূপের বুকে আশার পিঠ ঠেকলো।
অনিরূপ আশার ঘাড়ের নরম অংশে মুখ ডুবালো। শিউরে উঠল আশা, খামছে ধরলো শাড়ি। অনিরূপ আশার ঘাড়ে নাক ঘষে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো- ‘পালাচ্ছো নাকি?’
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৭
আশা চোখ বুজে শিরশির কণ্ঠে জবাব দিল — ‘‘উহু।’
অনিরূপ আশার দিকে চায়, আশার চোখ বন্ধ! ঠোঁট কাপছে ভয়াবহ আবেগে! অনিরূপ তা দেখে হালকা স্বরে বলে-
‘আজ থেকে আমার জেদি বউকে আমি পালাতে দিলাম। তার বদলে ঘরে আনলাম-আমার ভালোবাসার বউখান।’