দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৩

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৩
অবন্তিকা তৃপ্তি

কটা দিন পর…
অনিরূপ চেম্বারে বসে আছে। লাগাতার প্যাসেন্ট দেখে ও যারপরনাই বিরক্ত-ক্লান্ত! শেষ প্যাশেন্ট দেখা শেষ হলে এটেন্ডেন্স এসে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দিয়ে যায়।অনিরূপ চেয়ার থেকে উঠে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে ঘরই দেখে। বেশ রাত হয়েছে! অনিরূপ ফোন চেক করে। আশার কল এসেছিল আধা ঘণ্টা আগে, প্যাসেন্ট থাকায় রিসিভ করতে পারেনি। শেষ অব্দি মেসেজ এসেছে আশার-

‘Apnar ki late hobe?sobai wait korche, ekshonge khabe.’
আশা মেসেজটা দিয়েছে দশ মিনিট আগে। অনিরুপ ক্রূর হাসে মেসেজ পড়ে। তার বউটা ধীরে ধীরে সংসারকে বুঝতে শিখেছে, আগলাতে শিখে গেছে। বাহ, দারুণ! অনিরূপ পাল্টা রিপ্লে করে-
‘Ar bibi saheba?she wait korche na? ‘
কিছুসময় পর আশা রিপ্লে করে-‘hu, sheo korche. Druto ashun!’
অনিরুপ মৃদু হেসে উঠে, আঙুল চালিয়ে রিপ্লে করে-
‘I’m on the way!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অনিরূপ বেরোবে, তখন এটেন্ডেস দরজা খুলে ঢুকে-‘স্যার, অমিত স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’
‘অমিত’ নামটা শুনে অনিরূপের ভুরু কুচকে যায়! কলেজ লাইফের শত্রু, এখন প্রফেশনাল লাইফের শত্রুও হয়ে গেছে! মুখ দিয়ে বিশ্রী গালিও বের হল কয়েকটা। অনিরূপ ঘড়ি দেখে,শালা পারফেক্ট টাইমিং নিয়ে এসেছ। অনিরূপ আবারও চেয়ারে বসে হেলান দিল। পায়ের উপর পা তুলে বললো-‘ফাইন, পাঠাও ওকে।’

অমিত রুমে ঢুকে! বড্ড ফুরফুরে মেজাজে রুমে ঢুকলেও, চোখের সামনে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা অনিরূপের ঠোঁটে বক্র হাসি দেখে অমিতের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো। ও থমথমে মুখে অনিরূপের সামনের চেয়ারে বসে। অনিরূপ এবার সোজা হয়ে বসে, অমিতের মুখের দিকে চেয়ে সরাসরি প্রশ্ন করে-‘কী চাই?’
অমিত এবার হাসে! মুখটা ওর ক্ষুদে শয়তানি বুদ্ধিতে ঝলমলিয়ে উঠে বলে-‘এই তো, এইজন্যে তুই এতটা ফেভ্রেট আমার জয়! ওকে! লেটস ফেইস! এর আগেও আমি এসেছি, আজও এসেছি! আমার এই হসপিটালের ফোরটি পারসেন্ট শেয়ার চাই!’

অনিরূপ ভ্রূ উঁচু করো, তারপর ফিক করে হেসে বলে উঠে-‘মামা বাড়ির আবদার হচ্ছে নাকি এখানে?’
অমিত টেবিলে হাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে এসে বললো-‘ওহ জয়! এবার আমি একদম ছক কেটেই মাঠে নেমেছি। তুই দিবি, ৫১ কেন? আমি চাইলে তুই পুরোটাই দিবি। কেন জানিস?’
অনিরূপ চেয়ে দেখে অমিতকে। ওর ঠোঁটে এখনও উপহাসের হাসি! অমিত সেই হাসি দেখে এবার এক বিন্দুও ভরকে না। কারণ ও জানে! অনিরূপ শত্রুপক্ষকে এমন উপহাসের ব্যবহার দিয়ে, মনোবল ভাঙতে পছন্দ করে! অমিত হালকা হেসে, পকেট থেকে ফোন বের করল! এগিয়ে দিল ফোনটা অনিরূপের দিকে-‘দেখ তো এই পুলিশ অফসারকে চিনিস কী না?’

অনিরূপ একবার অমিতের দিকে চেয়ে, পরপর ফোনের দিকে চায়! ইমাদ! ওই গ্রামের পুলিশ ইমাদ! যাকে অনিরূপ আশাকে বাজে মন্তব্য করায় চড় মরেছিল। ইমাদ জবানবন্দি দিচ্ছে- অনিরূপ কিভাবে আশার বাবাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে ওকে বিয়ে করেছে, সেটুকুর বর্ণনা প্রমাণ সহ একের পর এক বলে যাচ্ছে ইমাদ! অনিরূপ এবার রক্তলাল চোখে অমিতের দিকে চেয়ে অসম্ভব শান্ত স্বরে বলে-‘শত্রুতাকে পারসোনাল নেওয়ার ভুল করবি না অমিত! আমার বউ, আমার ফ্যামিলি! ওগুলো আমার নিজস্ব! তোর নিংরা হাত ওতে দিবি না।’

‘নিজস্ব?’ -কথাটা বলে হো হো করে হেসে উঠে অমিত। অনিরূপ এখনও ভয়াবহ রাগ নিয়ে দেখছে অমিতকে। অমিত হাসি থামিয়ে বললো-‘‘তোর বউ জানে? জানে যে তুই কত বড় পাক্কা খেলোয়াড়! বউকে পেতে শালা তোর এত খেলা লাগল, কীসের এত বড়াই রে তোর?’

অনিরূপ বুঝে, অমিত ইচ্ছে করে অনিরূপের দুর্বল জায়গায় হাত দিতে চাচ্ছে। কিন্তু অনিরূপও পাক্কা খেলোয়াড়! ও এসব হতে দিবে কেন? অনিরূপ রাগ কমাল, তারপর আচমকা শব্দ করে হেসে উটলো। অমিত ভ্রু কুচকে ফেলল! ভিডিওটার পর অনিরুপের কাছে এমন হাসি ওকে মানাল না!
অনিরুপ হাসতে হাসতে বললো-‘বারবার বারবার বলেছি আমাকে ক্ষেপাস না, তুই ক্ষেপিয়েই যাচ্ছিস! যা করার কর, তবে বাইচা থাক আগে!’
অনিরুপ এবার চেয়ার থেকে উঠে অমিতের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়!অমিত চোখ তুলে অনিরুপের দিকে তাকাল! অনিরূপ হিসহিসিয়ে জিহ্বা নাড়িয়ে বলে উঠে- ‘গু-ড লা-ক!’

অমিতকে এভাবে শাসিয়ে আসার পরও অনিরুপ শান্তি পাচ্ছে না। ওর বারবার, বারবার ওই বাস্টার্ডকে খুন করে ফেলার ভূত চেপে গেছে। অনিরূপ আর আটকাতে পারল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কল করে বসল-‘মিশন ৫, ডু ইট! এন এন্ড অ্যা হ্যাভ সাপ্লাইড!’

‘এসব কী অদ্ভুত কথা বলছেন?’- আশা বারান্দায় ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করল! অনিরূপ আশাকে দেখে সঙ্গেসঙ্গে ফোন কেটে দিল। আশা অনিরূপের অদ্ভুত ব্যবহার দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল! সন্দেহের চোখে একবার অনিরূপের হাতের ফোন, তো আরেকবার অনিরুপের দিকে চেয়ে বললো-‘আপনি কিছু লুকাচ্ছেন?সত্যি করে বলুন তো।’
অনিরূপ কিছু বললো না, শুধু থমথমে মুখে আশার দিকে চেয়ে রইল। আশা বুঝতে পারলো, অনিরূপের মন খারাপ। তাই ও চিন্তিত হয়ে এগিয়ে আসলো, অনিরূপের খোঁচা খোঁচা গালে হাত বুলিয়ে আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল-‘মন খারাপ? হাসপাতালে কিছু হয়েছে?’

অনিরূপ চোখ বন্ধ করে ফেলল! আবার তাকাল, তারপর আশার কোমরে আচমকাই হাত দিয়ে ওকে নিজের দিকে টেনে আনল! অনিরূপর বুকের সঙ্গে মিশে চমকে উঠল আশা! দুহাত অনিরূপের বুকের উপর রেখে অবাক চোখে দেখতে লাগল ওর অস্থির স্বামীকে!
অনিরূপ আশার মুখের দিকে চেয়ে বড্ড অস্থির-অধৈর্য্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল-‘আশা! আশা! তুমি কী এখনো আমাকে ভালোবাসোনি? আমাকে মেনে নিতে পারো নি? অন্য কেউ তোমাকে আমার নামে ফুসলালে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? সে, সে সামথিং।’

আশা বড়বড় চোখে অনিরূপকে দেখল! অনিরুপ উত্তরের জন্যে মুখিয়ে আছে! আশা থামল, ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে ডান হাতটা তুলে অনিরূপের গালে রাখল। গাল ছুয়ে দিতে দিতে বললো—‘মানি, আমি মানি আপনকে স্বামী হিসেবে! অন্য কেউ আমাকে ফুসলাতে পারবে না, আমি এমন নই-আপনি জানেন।’
অনিরূপ যেন হাফ ছাড়ল! মনেমনে অমিতকে কতগুলো বিশ্রী গালি দিয়ে আশার কোমরে হাতটা চেপে আরও টেনে আনল ওকে নিজের দিকে! আশার মুখের দিকে মুখটা এগিয়ে এনে বললো-‘প্রুভ দাও তবে।’
আশা বড়বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে অনিরূপের ঠোঁটের দিকে চায়! অনিরুপের ঠোঁটে হালকা হাসি লেগে আছে! ওটা বোধহয় তৃপ্তির হাসি! আশা অনিরূপের ঠোঁটের দিকে চোখ ফেরায়, বাসর রাতে এই ঠোঁটটা আশার সর্বাঙ্গে ছুয়েছিল। তখন আশার বিষাক্ত লাগছিল সব. কিন্তু আজ! আজকের চিত্র ভিন্ন! স্বামীর স্পর্শ পাওয়ার জন্যে মরিয়া আশা জানে, ওষ্ঠের আসক্তি! আশার বুক কাঁপছে! ও মুখ ফিরিয়ে নিলো লজ্জায়!

অনিরূপের গালে আশার চুল স্পর্শ করল। অনিরূপ আশার লজ্জা পাওয়া দেখে নিঃশব্দে হাসল! আশার বুক বারবার শ্বাসে উঠানামা করছে ভীষণ। অনিরুপ বুঝল সবকিছুই।সে এ ঘাটালো না, ধৈর্য্য ধরলো এবারেও! আশার চুলে চুমু খেয়ে উস্কি গলায় শোধালও-‘অপেক্ষা করবো আশা, একটা দীর্ঘ চুমুর, যেটা তুমি নিজে থেকে দিবে আমাকে! নিরস করো না আমাকে প্লিজ।-‘
আশা লজ্জায় আর তাকাতেই পারল না অনিরূপের দিকে! অনিরূপের কল এসেছে! অনিরুপ কল করা মানুষের নাম দেখে ভ্রূ কুঁচকে ফেলল! ও আশাকে ছেড়ে দিয়ে কল রিসিভ করে রুমে গেলো-

‘কাজ শেষ?’
‘স্যার, গাড়ি এখন ম্যানহোলে পরে আছে। খুব বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট করেছে। কোমায় যাইতে পড়ে, চান্স আছে।’
‘সেন্ড দ্য পিকচার।’
‘ওকে স্যার।’

অনিরূপের ফোনে ছবি এলো একটা। অমিতের রক্ত লাল ছবি, বিশ্রীভাবে আঘাতে মুখটা থেঁতলে গেছে একদম! অনিরূপ ছবিটা খুঁটিতে খুঁটিতে দেখতে থাকে, ‘শালা, আমারে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিল। কলিজা দেখো শু*** বাচ্চার।’
‘আল্লাহ, এটা কার ছবি?’- আশা হাতে ভাঁজ করা শাড়ি, ও চোখ মুখ কুঁচকে ছবিটার দিকে চেয়ে আছে।!
অনিরূপ ফোনটা বন্ধ করে ফেলল সঙ্গেসঙ্গে।আশার দিকে চেয়ে বলল-‘ভয় পেও না! পেশেন্ট, অ্যাকসিডেন্ট করেছে। সেটার ছবি।’

আশা আফসোস করে বললো-‘খুব বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট করেছে। বাঁচবে তো?’
‘চেষ্টা করবে ডাক্তাররা। তুমি কোথায় যাচ্ছো?’
‘গোসল করবো। গরম লাগছে ভীষণ।’
অনিরূপ এবার দুষ্ট হেসে বলে-‘আমিও আসি?’
আশা ভ্রূ বাকিয়ে বললো-‘তার প্রয়োজন নেই। আমি একাই পারি।’
আশা কথাটা বলে মুখ ঝাঁমটি দিয়ে চলে গেলো বাথরুমে।

রাতের দিকে…নিধি বোতলে পানি ভরতে, অরূপের রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। অরুপের রুমের দরজা হালকা খোলা!নিধি স্পষ্ট শুনতে পেল, ঘর থেকে ওর নাম শোনা যাচ্ছ। নিধি আটকে যায়, নিজের অনিচ্ছায়!
নিধি শুনতে পেল- অরূপ কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে-
‘রিয়াদ, আমি দোটানায় ভুগছি! উনাকে আমার ফিলিংস কনফেস করা পসিবল না, ইনফ্যাক্ট এমন একটা সিচুয়েশনে!’

ডিভোর্সি, ক্যান্সার! আই নো! আমার এতে বিন্দুমাত্র প্রবলেম নেই। ক্যান্সার ভালো হয়ে যাবে, আশা রাখছি। ডাক্তারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ট্রিটমেট আরও কয়েকমাস নিতে হবে! ফার্স্ট স্টেজ ক্যানসার!!
আর ডিভোর্স্, ভাই আমি সবকিছু ভেবেছি! আটকাতে পারিনি। ফিলিংস আসার, এসে গেছে। এখন ভাবী জানলে হয়তো উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে পারে।ও আমি ম্যানেজ করে ফেলব। বাট ভাইয়া সাপোর্ট করবে আশা করি।’
‘———-‘
‘সেটাই তো প্রবলেম। নিধি বোধহয় আমাকে মানবেন না।উনি একদম ঘাড়ত্যারা! আর এত্ত ইন্ট্রোভার্ট! মুখ ফুটে কিছু বলতেও চাননা। তুই ভাই আমাকে আইডিয়া দে আমাকে, প্লিজ।’
‘————‘
‘মেয়ে পটানো অনেক কষ্টের ভাই! আজকে আমি তোদের কষ্টটা বুঝতে পারছি।’
অরূপ অসহায় ভঙ্গিতে কথাটা বলে উঠে! ওপাশ থেকে হাসির আওয়াজ শোনা যায়! অরূপ একপর্যায়ে ভীষণ সিরিয়াস হয়ে বললো-

‘উনি আমকের ফিরিয়ে দিলে আমি কী করবো আমি নিজেও জানি না।আচ্ছা ডাইরেক্ট প্রপোজ না করে, ওদের বাড়িতে ভাবীকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাল কেমন হয়? সে!’
নিধি আর এক মুহূর্ত থাকল না। দৌড়ে রুমে চলে আসে! এসব কী হয়ে গেল! ওর ক্যান্সার? ওর এসব চিকিৎসা নেওয়া হচ্ছে ক্যানসারের জন্যে? কিন্তু আশা যে বলল, ওর শরীরে ইমিউনিটি কম, এইজন্যে এসব হচ্ছে? নিধি দুহাতে মাথার চুল খামছে বিছানায় বসল। লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে নিধি। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়াল। অরূপ! অরূপ এসব ভাবতে পারল কিভাবে? ও কী কোনভাবে অরূপকে কোনো পজিটিভ ইঙ্গিত দিয়েছিল কখনও? না, না! নিধি এসব কিছুই করেনি।
তবুও? নিধি ভেবে নিলো নিজের সিদ্ধান্ত! বোনের সংসারে অশান্তি আনবে না ও! ওর নিজের সংসার নেই তো কী হয়েছে? বোনটা সুখী আছে, থাকুক! ও কালকেই চলে যাবে ওর বাড়িতে! মরে গেলে যাবে, বাড়ি থেকেই চিকিৎসা চালাবে! কিন্তু এ জীবনেও আর শেখ মহলে পা দিবে না! ও কারও জীববে দয়া হবে না, কারও জীবনের করুণা হবে না।

অনিরূপ লাইব্রেরিতে! আজকের রাতটা একটু পড়াশোনা করবে ও! মূলত পড়াশোনা তো একটা বাহানা! আজ রাতে একটা প্ল্যান কষবে ও! আশাকে ও নিজের করে পেয়ে গেছে ও! কিন্তু এখন ওদের এই সুখী সংসারের পেছনে লোক লেগে গেছে। ওদের আলাদা করার জন্যে প্রমাণ নিয়ে হাজির হচ্ছে একেকটা বাস্টার্ড! তাই ও আজ সবকিছু প্ল্যান করবে। কিভাবে শত্রুপক্ষের মোকাবেলা করা যায়! একজনকে তো পগার পা করে দিয়েছে। বাকি আর কজন আছে কে জানে!

আশা গোসল করে বাথরুমে শাড়ি খুঁজছে! ভুলক্রমে সে শাড়ি বাইরেই রেখে চলে এসেছে। আশা কী করবে ভাবতে, ভাবতে হ্যাঙ্গারে অনিরূপের সাদা শার্ট ঝুলানো দেখতে পেল! আশা শার্টটা দেখে! একটু এগিয়ে শার্টটা হাতে নিলো, নেড়ে দেখল! কল্পনায় ভাসল সেদিনের দৃশ্য! অনিরুপ চায়, আশা ওর সামনে ওর শার্ট পরে আসুক! আশা লাজুক হাসলো! তারপর প্রথমবারের মতো নিজের ইচ্ছেতেই ভেজা গায়ে শুধু অনিরূপের সাদা শার্ট পরে নিলো! বাথরুমের দরজা খুলে উকি দিয়ে রুমটা দেখল। অনিরূপ রুমে নেই! আশা হাফ ছেড়ে বের হলো বাথরুম থেকে।

কোমরে হাত দিয়ে পুরো রুমটা ভ্রু কুঁচকে একবার দেখল।কিছু একটা করা উচিত! ওদের মধ্যে তো এখন সব ঠিক! অনিরূপ একা একা সম্পর্কটা কত টানবে? আশার এখন এগিয়ে আসা উচিত! দুজন দুজনকে পূর্ণ করা উচিত এবার! আশা হাসল একটু! তারপর রুমটা সাজাতে লেগে গেল! মোমবাতি দিয়ে রুমটা সাজালো! বারান্দা থেকে কয়েকটা গোলাপ ছিঁড়ে এনে পাপড়িগুলো মেলে দিল বিছানার উপর! রুমে রোজ এয়ারফ্রেশনার স্প্রে করল। নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, চুল থেকে টাওয়াল খুলে ভিজে চুল এলোমেলো করে মেলে দিল পিঠে-সামনে। ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপটিন্ট লাগালো। পারফিউম স্প্রে করল গায়ের উপর। ব্যাস, ও ফিটফাট! বিছানায় বসে অপেক্ষা করতে লাগল স্বামীর আসার।

আধা ঘণ্টা পর অনিরূপ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। রুমটা কৃতিম বাতি নেই, পুরো রুমটা মোমবাতির আলোয় ঝলমল করছে! অনিরূপ মুগ্ধ হয়ে পুরো রুমটা একবার চোখ বুলাল! বুকটা ধকধক করছে ওর! বিছানায় চোখ গেলো,গোলাপ দিয়ে সাজানো বিছানা।! উফ, এসব করেছেটা কী আশা? ঝড় তুলে দিয়েছে অনিরূপের বুকের মধ্যে! অনিরূপ ডাকে-‘আশা?’
বারান্দা থেকে অনিরূপের সাদা শার্ট গায়ে শা মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে! অনিরূপের চোখ একদম ছানাবড়া হয়ে যায়। ও আশাকে পা থেকে মাথা অব্দি আপাদমস্তক দেখে, আশা হেঁটে অনিরুপের সামনে আসে! ওর হাতে একটা গোলাপ!

অনিরূপ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আশার দিকে! আশা নত মুখে, লজ্জিত ভঙ্গিতে গোলাপটা অনিরূপের দিকে এগিয়ে দিলো, কিন্ত মুখে কিছুই বললো না। অনিরূপ হতবম্ব হয়ে গোলাপটা নিল! আশা লজ্জায় মাথাই তুলতে পারছে না। ভেজা চুলে, সজ্জিত বধূকে দেখে অনিরুপের মনটাই ভালো হয়ে গেলো। ও আশার দেওয়া গোলাপ আশার কানের গুঁজে দিয়ে ধিমে স্বরে বললো-‘গোলাপের গায়ে গোলাপই মানায়।’
আশা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হেসে উঠে। অনিরূপ রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে দেখে বললো-‘এসব কী আমাদের জন্যে?’

আশা নিচু স্বরে উত্তর দিল-‘হু।’
অনিরূপ তৃপ্তির হাসি হাসে!তারপর আশাকে পাঁজকোলে তুলে নিলো, আশা একহাতে অনিরুপের গলা জড়িয়ে ধরে অপর হাতে গায়ের শার্ট হাঁটুর কাছে চেপে ধরে।অনিরূপ আশাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর আশার উপর আধশোয়া হয়ে আশার মুখের দিকে চেয়ে রইলো! আশার ঠোঁট কাঁপছে ভীষণ! অনিরুপ আশার ভিজে চুল বিছানায় মেলে দিয়ে আবার ওর স্নিগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে রইল!
একপর্যায়ে নিজের এতদিনের, অভিনয় ভেঙে! সত্যি সত্যি নিজের অনুভূতি মেলে ধরল আশার সামনে-‘ভালোবাসি, আমার জেদি বউটা!’

আশা অনিরূপের দিকে তাকাল! চোখে জল জমেছে ওর! অনিরূপ ওর চোখের জল খুব যত্ন নিয়ে মুছে দিল! জিজ্ঞেস করল-‘তুমিও বলো কিছু!’
‘কী বলব-‘ – আশার লাজুক স্বর!
‘অনুভূতি আছে আমার জন্যে?’
আশা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়! অনিরূপ বলে-
‘উহু, মুখে বলো।’
আশা অনিরূপের দিকে চায়! অনিরূপের নেশালো নীলাভ চোখের দিকে চেয়ে বেশ সময় নিয়ে লাজুক গলায় বলে-‘ভালোবাসি!’

অনিরূপ হেসে ফেলল! হালকা হেসে আশার কপালে চুমু খেল। আশা আবেশে অনিরূপের টিশার্ট খামছে ধরল। অনিরূপ আশার শার্টের দিকে চেয়ে বললো-‘শার্টের বোতাম খুলবো? পরে আবার রাগ করবে না তো?’’
আশা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। অনিরূপ বললো-‘এত ফরফর করে কথা বলো সবসময়, আর এখন কথাই বলা ভুলে গেছো। এতো লজ্জা কেন পাচ্ছো?’

আশা লাজুক হাসলো! অনিরূপ শার্টের বোতামে হাত রাখলো! একটা বোতাম খুলতেই, আশা লজ্জায় মরিমরি অবস্থা। দুহাতে অনিরূপকে জরিয়ে ধরলো! এ মুখ আর অনিরূপকে দেখাতে পারবে না ও! অনিরূপও হালকা হেসে জড়িয়ে ধরে ফিসফিয় করে বললো-‘যদিও কিছুই দেখা যাচ্ছে না মোমবাতির আলোয়! তবুও তুমি বললে মোমবাতিটাও নিভিয়ে দিয়ে আসি?’

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২২

আশা উত্তর দিল না। অনিরূপ মজা নিচ্ছে সুযোগ পেয়ে। খুব অসভ্য! অনিরূপ হালকা হেসে আশার হাতটা গলা থেকে ছাড়িয়ে আবার বিছানায় শোয়ালো! আশা চেয়ে থাকল অনিরূপের নীলাভ চোখের দিকে! অনিরূপ হালকা হাসলো! মুখটা এগিয়ে এনে আশার ঠোঁটে ঠোঁট বসালো! আশা ভেসে গেলো!
একপর্যায়ে মোমবাতির আলো ক্ষয়ে গেলো! কিন্তু ভিলেন অনিরুপ যে অভিনয় করতে করতে একটু একটু করে তার বউয়ের প্রেমে পড়ে গেছে, সেটুকু সুখে ভাসা আশা একটুও বুঝল না। তার আবেগী, কিশোরী মনের প্রেম পুরোটাই ঢেলে দিল স্বামীর তরে!

দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২৪