দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩
অবন্তিকা তৃপ্তি
অনিরূপ মিথ্যা বলেনি- সে সত্যিই আশার পিছু ছাড়েনি। বরং জড়িয়ে নিয়েছিল আশাকে নিজের সঙ্গে আস্টেপিস্টে। আশা বিয়েতে রাজি ছিলো না-পুরো ব্যাপারটা অনিরূপের কাছে মারাত্মক অ পমানের ছিল। তাই অনিরূপ একটা খেলা খেললো, একটা গেইম।
রহমান সাহেব গত বছর চড়া সুদে গ্রামের মোড়লের থেকে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন ধানের বীজ কেনার জন্যে। সেই ত্রিশ হাজার টাকার সুদ এক বছরে এসে জমেছে, প্রায় এক লাখ টাকার কাছাকাছি। টাকা পরিশোধ করার সময়ের পূর্বেই-আজ মোড়ল পুলিশ নিয়ে যখন আসল রহমান সাহেবের বাড়ি, মাথায় রীতিমত বাজ পড়লো রহমান সাহেবের।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মোড়লের হাতে হিসাবের কাগজ, পুলিশের হাতে হ্যান্ডকাফ। সব দেখে রহমান সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। প্রতিবাদ করে বললেন-‘টাকা ফেরত দেওয়ার তো আরও ২ মাস সময় বাকি আছে মোড়ল সাহেব। আমাকে সময় দিন দয়া করে।’
মোড়ল বিশ্রী হেসে পানের পিক মাটিতে ফেলে নখ দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে বলল-‘ মাইয়ার বিয়া তো দিতে গেসিলা, টাকা না থাকলে বিয়ার সাহস কেমনে করো, রহমান? মাইয়ার বিয়া তো ভাইঙ্গা দিলা, এখন ওই বিয়ার টাকা আমারে দাও। বাকি টাকার হিসাবও আজ করবা, নাইলে- দেখো তো কারে নিয়া আসছি।’
মোড়ল পুলিশের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকালো। নিধি বাড়ি নেই, পড়াতে গেছে বাচ্চাদের। আশা উঠোনে এত চিৎকার শুনে ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে আসলো। মোড়ল আর রহমানের মধ্যে তুমুল দ্বন্ধ দেখে আশা হতভম্ব। কিছুই বুঝতে পারলো না প্রথমে। এগিয়ে এসে পুলিশকে জিজ্ঞেস করল-‘এসব কী হচ্ছে স্যার?’
পুলিশ এমাদ গা ছাড়া ভাবে হেসে বললো-‘তোমার আব্বা সুদে টাকা ধার নিয়েছে।টাকা তো ফেরত দিচ্ছেই না, উল্টো মেয়ের বিয়ে দিতে টাকা খরচ করছে।মোড়ল সাহেব তার টাকা চাইছেন এখন।আমি আইনের লোক হিসেবে মোড়লকে সামান্য সাহায্য করছি শুধু।’
এমাদ বিশ্রী হেসে আশার দিকে তাকিয়ে বললো। আশা তাজ্জব হয়ে বললো—‘আইনের লোক হয়ে সুদের টাকা চাইতে এসেছেন আপনি? লজ্জা করে না আপনার?’
এমাদ কিছু বলার আগে মোড়ল তেড়ে আসলো আশার দিকে, রেগে হিসহিসিয়ে বললো-‘ওর লজ্জা কেনো করবে? টাকা দেওয়ার আগে তোমার আব্বারে বলা হয়নাই এটা সুদের ধার? বলা হয়নাই, জিকাও তোমার আব্বারে। সে তো জেনেই সুদের টাকা নিসে। এখন টাকা ফেরত দিবে, এখন আমগো লজ্জা খুঁজো বাপ-বেটি। মা স্তানি চলে এখানে?’
আশা রহমানের দিকে তাকাল। রহমান লজ্জায় মাথা নিচু করে আছেন।
মেয়ের বারবার-বারবার বারণ করা সত্ত্বেও সুদের আশ্রয় নিয়েছেন রহমান। মেয়েকে কী বলে এখন থামাবেন? আশা মনেমনে যে তার উপর ব্যথিত হয়েছে, সেটা রহমান বুঝেন। আশা সত্যি হতাশ হলো ভীষণ। মুসলিম হয়ে সুদের টাকা ধার নেওয়া হারাম, অথচ সেটা তার আব্বা কত সহজে করে বসে আছে। আশা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। রহমানের দিকে দৃষ্টি তাক করে বললো-‘আব্বা? তুমি আবার সুদের টাকা কেন নিয়েছো? গ্রামে কী আর কেউই ছিলো না? সুদ নেওয়া হারাম, আব্বা-কতবার বলবো এটা।’
রহমান লজ্জিত ভঙ্গিতে মেয়ের দিকে চেয়ে বললো-‘আর কেউ টাকা দিতে চায়নাই। তাই বাধ্য হয়ে-‘
আশা চোখ বুজে ফেলল অপমানে-রাগে। রহমানকে আর কিছুই বলার নেই আশার। মোড়ল সাহেব বললেন-‘বাপ বেটির আলাপ শেষ হইলে আমার টাকা ফেরত দাও এহন। আমি টাকা নিয়ে যাইগা।’
আশা এগিয়ে এলো দু কদম। স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-‘কতো টাকা বাকি আপনার?’
মোড়ল হাতের হিসাবের খাতা দেখে বললো-‘ত্রিশ হাজার দেওয়া হয়েছে- আর সত্তর হাজার বাকি।’
আশা মাথা ঝুকালো। এতগুলো টাকা? যতটুকু ধার নিয়েছিল, সেগুলো তো দেওয়া শেষ। এখন বাকি শুধু শোষণের সুদের টাকা। আশা পুলিশের দিকে এগুলো। বললো-‘আমাদের হাতে এখন আমার বিয়ের ৫০ হাজার আছে। এগুলো নিন, আমরা বাকি ২০ পরে দিব। আমাদের সময় দিন প্লিজ।’
রহমান সাহেব মেয়ের কথা শুনে অবাক হলেন। সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠলেন-‘আশা ওগুলো তোর আম্মার গয়না বেচার টাকা। এগুলো দিলে তোর বিয়ে কিভাবে দিবো আমি? আমাকে সময় দিন মোড়ল সাব। আমি সব টাকা দিয়া দিব, আমাকে মাত্র-মাত্র ৭ মাস সময় দিন। দয়া করুন।’
মোড়ল এসব শুনলো না। রহমান সাবের এত কাকুতি-মিনতি সব একটুও কানে নিলো না। বলা চলে-কানে নিতে চায়নি বা সাহস হয়নি। উপরে যে মানুষটা আছে, সে মানুষটারই হাতের পুতুল সেজে নাচছে ওরা শুধু। যা বলা হয়েছে, যা দেখানো হয়েছে-সেসব একে একে ঘটছে এই ক্ষেত্রে। এখানে মোড়ল, পুলিশ সবাই একেকজন অভিনেতা, রহমান আর আশা রিয়েল্যাটি শো এর একেকটা ক্যারেক্টার শুধুমাত্র।
মোড়ল এবার সরাসরি পুলিশকে বললো-‘আপনি ওরে হ্যান্ডকাফ পরাইবেন? নাকি আমি আমার কাজ হাসিল করবো?’
এমাদ রহমানের সাহবের হাতে হ্যান্ডকাফ পরাতে গেলে আশা চিৎকার করে বলে-‘সুদের টাকার উপর আইনের কোন সাজা নেই। আপনি আমার আব্বাকে হ্যান্ডকাফ কোন আইনের ভিত্তিতে পড়াবেন?’’
এমাদ কিছু বলার আগে মোড়ল বললো-‘মোড়লের আইনের ভিত্তিতে পড়াইবো। আইন নাই তো কী হইলো, বানানো যাইবো না? যাইবো তো, আমরা বানাই নিমু। তুমি চিন্তা করিও না, আশা মা।’
আশা ফ্যালফ্যাল চোখে নিজের বাবার হাতে হ্যান্ডকাফ পড়াতে দেখে। মোড়লের পাঞ্জাবির পকেটে একটা ছোট মাইক্রোফোন। মাইক্রোফোনে অনিরূপ সবার কথোপকথন শুনে, বুঝে আর হাসে। আশা, তার পোউর আশা।
অতঃপর আশার শত চেষ্টা পরও রহমান সাহেবকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। রহমান সাহেব সদরের থানাতে যাবেন। আশা তাই তড়িগড়ি করে ঘরে ঢুকে বোরকা পরে চাবি দিয়ে ঘর তালা দিয়ে বাইরে আসে। আশা শহরে যাবে, আইনের অপরাধের একটা বিহিত করা লাগবে। এভাবে অন্যায়ভাবে রহমান সাহবেকে জেলে পাঠাতে পারেনা কোনো আইন। আশা চাবি পাশের বাড়িতে দিয়ে আসে নিধির জন্যে। নিধি এলে বলে দিতে বলে-আজকের ঘটনার কথা।
সবকিছু সামলে আশা তারপর একটা সিএনজি ভাড়া করে সদরের দিকে এগোয়।
আশা থানার বেঞ্চে থতমত খেয়ে বসে আছে। মাথাটা ভনভন করছে ভীষণ। নিধি বারবার বাড়ি থেকে কল দিচ্ছে। অস্থির হয়ে গেছে নিধি। দু বোন একা কিভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে বুঝতে পারছে না। টাকা না দিলে এরা ছাড়বে না রহমান সাহেবকে। সুদের টাকার হিসাব লুকিয়ে ফেলা হয়েছে, এখন হিসাবের খাতায় যোগ হয়েছে- রহমান ধার হিসেবে এক লক্ষ টাকাই নিয়েছেন। কী বিশ্রী হিসাব, কী নোং রা খেলা। কত সুন্দর নিরপরাধ মানুষকে অপরাধের কাটগড়ায় ঝুলিয়ে ফেলা হলো।
আশার হাতে ফোন। শেষবার নিধির সঙ্গে কথা হয়েছে। নিধি সাফসাফ বলে দিয়েছে-কেইস করার কথা, উকিল ভাড়া করার কথা। কিন্তু আশা জানে, এসব কিছুই বৃথা। উকিল,সে রহমানের মতো গরিব একটা পরিবারের কেইস কেন লড়বে? কেইস আদালতে উঠাতেও প্রচুর টাকা চাই। ওতো টাকা দিয়ে কেইস লড়ে আদৌ সফলতার হার খুব কম। তাছাড়া, আশা কোথা থেকে পাবে এত টাকা? আশা আর কোন উপায় দেখছে না।
বাড়ি থেকে আসার সময় নিজের বিয়ের জন্যে জমানো টাকা ব্যাগে করে এনেছিল, আরও ২০ হাজার টাকা জোগাড়ের জন্যে এনেছিল নিজের গলার চেইন। এটা এখন বিক্রি করতে হবে। আশা তখন থানা থেকে বের হচ্ছিল, মাঝপথে ইমাদ চা খেতে খেতে আসার সামনে এসে দাঁড়ালো। আশা ইমাদ কে দেখে ভ্রূ বাঁকিয়ে চাইলো। ইমাদ বিশ্রী ভঙ্গিতে আশাকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে তাকায়। আশা আচমকা পথ আটকানোতে বিরক্ত হয়। তবুও পুলিশের লোক দেখে ভদ্রতা বজায় রেখে বলে-‘কিছু বলবেন?’
ইমাদ একহাতে আশার হাত ধরার জন্যে হাত বাড়ায়, আশা বুঝতে পেরে সঙ্গেসঙ্গে হাত সরিয়ে নিলো। ইমাদ হালকা হেসে বললো-‘টাকা দরকার? ম্যানেজ হয়ে যাবে। শুধু-‘
‘শুধু?’ -আশার সরাসরি প্রশ্ন।
ইমাদ আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁট ছুইয়ে নোংরা হেসে বললো-‘আমার কটেজ সামনেই, একরাত কটেজে দেখা করো। টাকার হিসাব মিলে যাবে।’
আশার রাগে-অপমানে গা রি-রি করে উঠলো। শক্ত এক থাপ্পড় বসাতে ইচ্ছা হল পুলিশরুপি জা নো য়ার ইমাদের গালে। কিন্তু আশা হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে আটকালো। পুলিশকে চ ড় মারা মানে, রহমান সাহেবের কেইস আরও জটিল করে ফেলা। আশা বুদ্ধিমান, সেটা কখনও করবে না। আশা নিজের রাগ সংবরণ করে। মুখ অপমানে আবারও লাল হয়ে গেছে। আশা শান্ত থাকার চেষ্টা করে হাফ ছাড়ে।
কঠোর কণ্ঠে বলে দেয়–‘আপনার প্রস্তাব আমার লাগবে না। টাকা আমি জোগাড় করে নিতে পারব।’
আশা কথাটা বলে দ্রুত টাকার ব্যাগ হাতে বেরিয়ে যায় থানা থেকে।
আশা থানা থেকে বেরিয়ে যেতেই একজন কনস্টেবল সবার থেকে লুকিয়ে অনিরূপকে কল লাগায়-
‘স্যার, ম্যাম বোধহয় আজ টাকা জোগাড় করে ফেলবেন।’
‘কিভাবে?এতগুলো টাকা?’
অনিরুপের বিস্মিত কণ্ঠ।
‘উনার বিয়ের জন্যে জমানো টাকা আর চেইন বিক্রি করবেন।’
অনিরূপ কিছুক্ষন চুপ থাকে, তারপর হালকা হাসলো। মেয়েটার মধ্যে দম আছে বলতে হবে। ভাঙবে তবু মচকাবে না? বিয়ের টাকা দিয়ে অনিরুপের হক মারতে চাইছে? অনিরূপের ঝাঁক-ঝমক করে বউ ঘরে তোলার ইচ্ছাকে দমন করতে চাইছে? রুড আশা!
কিন্তু অনিরূপকে বিয়ের টাকা আশা কেন খরচ করবে? আশা সেটা করলে দ্য গ্রেট অনিরূপের গায়ে লাগবে না ব্যাপারটা? অবশ্যই লাগবে। অনরূপ তাই হালকা হেসে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল-‘টাকা ছিনতাই করাও।’
‘ছিনতাই?’ কনস্টেবলের অবাক প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ।’-অনিরূপের শান্ত উত্তর।
কনস্টেবল বললো-‘এতগুলো টাকা হারিয়ে গেলে ম্যাম মুর্ছা যাবেন স্যার।’
‘হারবে না টাকা। ম্যামের হাসবেন্ডের কাছেই টাকা জমা থাকবে, সময় হলে পেয়েও যাবে। এখন যা বলে দিয়েছি করো।’
‘ঠিক আছে স্যার। আমি লোক লাগাচ্ছি।’
অনিরূপ কল কাটতে গেলে- কনস্টেবল হঠাৎ কিছু একটা বলার জন্যে উশখুশ করে উঠে-‘স্যার, একটা কথা বলব?’
‘কী?’
‘স্যার, ইমাদ স্যার-‘
কনস্টেবল থামে। সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশ একবার দেখে তারপর মোবাইল আবার কানে রেখে ফিসফিস করে বলে-‘ইমাদ স্যার ম্যামকে কু-ইঙ্গিত দিয়েছেন আজ।’
সঙ্গেসঙ্গে অনিরূপের হাসিহাসি মুখ বদলে যায়, ভ্রু কুঁচকে যায়। হাতের ফাইল টেবিলে রেখে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেয় ফোনে,তীর্যক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে-‘কী ইঙ্গিত দিয়েছে?’
কনস্টেবল লাল দিয়ে গলা ভেজানোর চেষ্টা করে। অনিরূপকে বলা উচিত হবে? এরপর যদি কোনই ধ্বংসলীলা চালায়? অনিরূপের রাগ সম্বন্ধে কে না জানে।
‘বলো কী বলেছে?’
অনিরূপ আবারো ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করে।
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ২
কনস্টেবল থামে, শুকনো গলায় বলে-‘ম্যামের টাকা তিনি দিবেন যদি ম্যাম একরাত-‘
কনস্টেবলের আর কিছু বলা লাগলো না। অনিরূপ টেবিলে জোরে এক থাবা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাগে কপালের নীল রগ ফুলে উঠেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, তারই পোষা কুকুর কিভাবে নিজের মালকিনের দিকে হাত বাড়াচ্ছে!
অনিরূপ নিজের রাগ দমিয়ে রাখে। জোরেজরে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করে, তারপর মুখচোখ লাল করে অনিরুপ শুধু এটুকুই বললো-
‘ইমাদ যেন কখন থানা থেকে বেরোয়?’