দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩২
অবন্তিকা তৃপ্তি
ধীরে-ধীরে কটা মাস পেরিয়েছে। নিধি-অরূপের সংসার এখন অনেকটাই পরিপূর্ণ। নিধির ক্যানসার প্রায় সুস্থের দিকে। ক্যানসার সুস্থ হয়ে গেলেই, ওরা বেবির জন্যে প্ল্যান করবে। অরূপ রীতিমত মরিয়া হয়ে যাচ্ছে একটা বাচ্চার জন্যে।নিধির থেকে অনমুতি নেওয়াও তার শেষ, বাকি শুধু এখন নিধির সুস্থতা।
বাকি কথা, আশা-অনিরূপ! বরাবরের মতোই আশার রাগ ভাঙ্গে না এত সহজে। রাগ কিছুটা ধীমে হয়ে এলেও, ও পরীক্ষা নিচ্ছে অনিরূপের। আগুনে যেমন লোহা পুড়িয়ে খাটি করা হয়, তেমনি খাটি করে নিচ্ছে আশা অনিরূপকে। যেন ভবিষ্যিতে এমন দু নম্বরি কাজ করতে অনিরূপ বারবার ভাবে।
রাগ ভাঙার পেছনে কারণ আছে অবশ্য। অনিরূপ প্রেগন্যান্সি জার্নিতে আশার পাশে শুরু থেকে আঠার মতো লেগে ছিলো। কখন কি দরকার, কখন কিভাবে চলতে হবে, আশার ডিপ্রেশন-হরমোনাল ইমব্যালেন্স সবকিছুই অনিরূপ মুখটা বুজে সহ্য করছে। একটা মেয়ে তো এমনটাই চায়, স্বামীর কাছে এমন আচরণই আশা করে। আশাদের গ্রামে এমন অনেক স্বামীকে চিনে ও, যারা প্রেগন্যান্সি জার্নিতে বউদের অবহেলা করে, ওদের ভালোবাসা সেই সময়টায় জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। আশা সে হিসেবে এতকিছু পাচ্ছে। এসব আদর-যত্ন ওর টিপিক্যাল গ্রাম্য মনটার ভীষন ভালো লাগছে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আশার মাঝেমধ্য মনে হয়, এসব কিছু, সব কিছুই কখনই অভিনয় হতে পারে না। হয়তো অভিনয় ছিলো, শুরুর দিকে। যেমনটা অনিরুপ বলে। আশা অনিরূপকে সুযোগ দিবে, দিবে আশা! তবে আরও কদিন লোহা পোড়ানোর পর!
ইদানিং মার্চ মাসের গরমটা বড্ড অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে। আশা ঘরে ফ্যান ফুল স্পিডে দিয়ে বিছানায় বসে ফল খাচ্ছে। ওর সামনে টিভিতে সূরা পড়ছে একটা বাচ্চা ছেলে। সেটাই শুনছে এখন। অনিরূপ সবে হাসপাতাল থেকে এসে রুমে ঢুকলো। আশা অনিরূপকে দেখল, পরপর রাগ দেখানোর চেষ্টা করে আবারও মুখ ফিরিয়ে নিল। অনিরূপ আশার দিকে চেয়ে হালকা হাসল, গা থেকে ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে খুলতে বলল-
‘স্বামীকে মুখ ঝামটি দিয়ো না আশা, পাপ হবে।’
আশা ফলের টুকরো চিবুতে চিবুতে আগের ন্যায় খোটা দেওয়া স্বরে বললো-‘ আর স্বামী যে পাপগুলো করে, ওগুলো? ওগুলো অন্যায় না?ওগুলোতে আল্লাহ পাপ দেননা?’
অনিরূপ শার্ট খুলে বিনে রাখলো, জবাব দিল-‘ না, ওগুলো স্বামীর ভালোবাসা, প্যায়ার-মহব্বত; আল্লাহ জানেন সেটা।’
আশা মুখ বাকালো, লোকটা এখন ভোর-দুপুরে আবারও মশকরা করছে। অনিরূপ আর কথা বাড়ালো না, সোজা চলে গেল গোসলে। আজকাল বাইরে থেকে এলেই অনিরূপ গোসল করে তারপর বউর কাছে ঘেষে। নাহলে জীবাণু দ্বারা ইনফেকশন হতে পারে, যা আশার থেকে পরবর্তীতে বাচ্চার মধ্যে সংক্রমিত হবে।
অনিরূপ গোসল থেকে বেরিয়ে এসে দেখে আশা টিভি অফ করে বসে আছে। অনিরূপ টাওয়ালে ভেজা চুল ঝাঁকিয়ে মুছতে মুছতে বললো-‘সূরা বন্ধ করলে কেন? এসব শোনা ভালো তো।’
আশা মাথাটা চেপে ধরে ফলের থালা টেবিলের উপর রাখলো। ক্লান্ত মাথা বালিশে ঠেকিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো-‘মাথাটা ধরেছে ভীষণ। ভালো লাগছে না।’
অনিরূপ শুনে সঙ্গেসঙ্গে টাওয়াল ফেলে এগিয়ে এসে আশার মাথার কাছে বসল। টেবিলের উপর আজকাল মুভ রাখাই থাকে। অনিরূপ মুভ আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে আশার মাথাটা ম্যালিশ করে দিতে দিতে বললো-‘মাথার ব্যথা ইদানিং বেশি হচ্ছে না?’
‘হু। কিন্তু কেন হচ্ছে?’ আশার অশান্ত-ক্লান্ত স্বর।
অনিরূপ মাথা মালিশের পাশাপাশি বন্ধ চোখের উপরটায় মালিশ করে দিচ্ছে। বলল-‘এসব হয় এই টাইমে। আর কোনো কমপ্লিকেশন ফিল করছো? বলে ফেলো, আমি একবারে তৃষাকে জানিয়ে দিব।’
আশা চট করে চোখ খুলে তাকালো, গলায় জেলাসি নিয়ে কিছুটা কঠোর স্বরে বলল-‘সেটা আছে, আপনি বারবার এসবের জন্যে তৃষা আপুর কাছে যাবেন না। নিজে ডক্টর হয়ে কি লাভ, যদি বউয়ের রোগ ধরতে না পারেন?’
অনিরূপ অবাক হয়ে আশার দিকে তাকালো। আশা চোখ ছোটছোট করে গালটা ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে অনিরূপের দিকে। অনিরূপ সেটা দেখল, পরপর হো হো করে হেসে বলল-‘আরে বাবা, আমি তো তোমার সম্পর্কেই জানতেই যাই। আমার আশাবরি কি জেলাস?’
অনিরূপের ভ্রু বাকিয়ে কৌতুক গলা। আশা চোখ-মুখ কুচকে জবাব দিলো- ‘উহু, জেলাস নই। তবে আপনার মতগতি আমার সুবিধার লাগছে না। কখন যে বউয়ের রোগ জানতে গিয়ে নিজে ফেসে যান তার কি গ্যারান্টি। এমন অহরহ হচ্ছে, আজ টিভিতেও দিয়েছে এমন খবর।’
অনিরূপ হাসে, আশার বোকামি ওর বড্ড ভালো লাগছে।কিন্তু আশা কি জানে, অনিরুপ ঠিক কি বাজে ভাবে ফেসে আছে এই নারীর জন্যে। এই নারী আজকাল দেমাগি, নাক উঁচু অনিরূপকে একদম নাস্তানাবুদ বানিয়ে রেখেছে। অনিরূপ আজকাল কিছু বুঝতে চায় না, বউ ছাড়া। বৌটা ওর বড্ড শখের কি না!
অনিরূপ হালকা হেসে একটু ঝুঁকে আশার গালে ছোট করে চুমু বসিয়ে দিল, আশা ওই স্পর্শে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলার ভান করল!
অনিরূপ বলল-‘আমার কাছে জেদি, তিরিঙ-বিরিঙ করা এই আশা আছে, পুরুষ জাতের দোষ আমায় কখনো ছুঁবে না, ডোন্ট ওরি।’
আশা মুখ ফুলিয়ে তাকাল, পরপর চোখ বুজে ফেলল। ও এখন আর চোখ মেলাতে পারবে না। চোখ মেলালেই ওর স্ত্রী সত্তার কাছে অনিরূপের সব দোষ মওকুফ হবে, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অনিরূপকে ও নিজে যেচে দুহাতে বুকের মধ্যে বন্দি করবে। আশা জানে, এমনটাই হবে। তাই ও লুকিয়ে ফেলল নিজের বেহায়া দু-চোখ!
বাড়ির পাশে পদ্ম দীঘিটা জানালার সামনে বড্ড আনমনে দেখছে আশা।শুরু থেকে এই দীঘি রেড এলার্ট দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। বলা হয়- দীঘিতে অতৃপ্ত আত্মা বলতে কিছু একটা ঘুরে।কিন্তু গত এক বছর আগে, দীঘিটা নিয়ে কোর্টে কেইস লড়া হয়। কেইসে দীঘিকে একটা স্বাভাবিক দিঘী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তারপর থেকে এই দীঘি পর্যটন এরিয়া হয়ে গেছে। দিনে প্রায় শ মানুষ এসে এই জায়গায় উপভোগ করে যায়। তবে কিছুদিন আগে, এই দীঘিতেই একটা লাশ পাওয়া গেছে। লাশটা দেখে আর সবাই ভয় পেলেও, ওয়াহিদা রীতিমত চিৎকার দিয়ে উঠেছেন। লাশটা আর কারো না, অনিরূপের বন্ধু অমিতের। ওয়াহিদা অমিতকে চিনেন, অমিত এত ভালো একটা ছেলে! ওর এমন অদ্ভুতুর মৃত্যু ওয়াহিদাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। তাই ওয়াহিদা সাফ মানা করে দিয়েছেন- এ বাড়ির কেউই দিঘী ঘুরতে যাবে না।
অমিত, সেই লোকটা। যাকে আশা ঘেন্না করে ভীষণ। আশা যা জানতে চায়নি কোনোদিন, সেসব কথাই অমিত আশাকে জানিয়ে ফেলেছে। আশা তারপর থেকেই অনিরূপের কোনো ভালোবাসা, আদর-যত্ন গ্রহণ করতে পারেনা। সবটাই নাটক, ছলনা মনে করে বসে। তবে অমিতের এভাবে মৃত্যু আশাকে ভাবিয়ে তুলেছে। অমিত পানিতে ডুবে মারা গেছে, আশপাশের সবাই এটাই বলে। অমিত মৃত্যুতে খুবই অদ্ভুত ভাবে অনিরূপ ভীষণ কষ্ট পায়। অনিরূপ নিজে অমিতের বাড়িতে গিয়ে ওর মা-বাবাকে দেখে আসে। তারপর নিজে গিয়ে অমিতের সব সম্পত্তির কাগজ পত্রের ঝামেলা নিজে উকিল দিয়ে মিটিয়ে অমিতের বৃদ্ধ মা-বাবার কাছে সপে দিয়ে এসেছে।
আশা এসবে কিছুটা অবাক হলে, অনিরুপ সেটার জবাবও দিয়েছে-‘অমিত আমার ভীষণ ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলো, আশা। ও একটা ভুল করেছে, এখন ওর দোষে ওর বৃদ্ধু বাবা-মাকে শাস্তি দিয়ে কি লাভ, বলো? ছেলে চারকূলে ওদের একমাত্র আপন! আমার উচিত মনে হয়েছে যা, আমি সেটাই করছি।’
আশা কথাটা শুনে, অনিরুপের প্রতি সম্মান ওর সেদিন যেন আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়। কথায় আছে- যে তোমাকে ধারালো কাঁটা দেয়, তাকে বদলে ফুল উপহার দাও; অনিরূপ সেটাই করেছে।
এভাবেই একটু একটু করে আশা অনিরূপকে ক্ষমা করতে শুরু করেছে।তবে অভিমানী আশা স্বামীকে এটা এখনও বুঝতে দেয়নি। ভুগুক লোকটা! নয় মাস ভুগে, নিজের সন্তানকে যেদিন কোলে নিবে; আশা সেদিন লোকটাকে ক্ষমা করবে। ততদিন পস্তাক!
দেখতে দেখতে কেটে গেছে নটা মাস! অনিরূপ ইদানিং ঘরেই থাকে বেশিরভাগ সময়। আশার ডেলিভারি ডেট সামনে, আর কদিন পরেই। অনিরূপ বাসায় এখন সর্বক্ষণ একজন নার্সকে রেখেছে। যেন অনিরূপ না থাকলে, নার্স আশার দেখাশোনা করতে পারে।
আজ কথা- আশা কোলের উপর বাচ্চাদের নাম রাখার বইটা নেড়েচেরে দেখছিল। নিধি সেই মুহূর্তে বিরিয়ানি প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকলো। বিরিয়ানির ঘ্রাণ পেতেই আশার চোখ-মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। ইদানিং খাবারের বড্ড ক্রেভিংস্ আশার মাথায় ঘুরে। অনিরূপ বাসায় থাকলে, এটা সেটা বানিয়ে খাওয়ায়। শুরুতে আশা অপটু অনিরূপের রান্না খেতে পারতো না। তবে এখন পারে এল; রাঁধতে রাঁধতে অনিরূপ শিখে গেছে সবটা।
ভাবা যায়; ওই নাক উঁচু লোকটা আশার জন্যে রাধতেও শিখেছে। এই সেই অনিরুপ যে আশাকে সবসময়ই একটা গেইম হিসেবে দেখে এসেছে, এই অনিরূপ এখন আশা বলতে উন্মাদ!
এই মুহূর্তে আশা বিরিয়ানি দেখে আর কিছু মাথায় নেই! ও বই রেখে সোজা হয়ে বসে নিধির কাছ থেকে বিরিয়ানির প্লেট নিল। নিধি হালকা হেসে বললো-‘মা আজ সবার জন্যে বিরিয়ানি রেঁধেছেন, তোর জন্যে আলাদা করে আমাকে দিয়ে উপরে পাঠালেন।’
আজকাল ওয়াহিদা আশার প্রতি বেশ নমনীয়! আশা হাসল, হবেন না কেন? উনাকে বংশের প্রদীপ দিচ্ছে যে আশা!
আশা বিরিয়ানির প্লেট নিয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসলো। নিধি পাশ থেকে বলল-‘বেবির নাম ঠিক করছিস নাকি?’
আশা খেতে খেতে বলল-‘না, নাম ওর পাপা রাখবে বলেছে।’
নিধি বলল-‘তাহলে নামের বই তুই দেখছিস কেন?’
আশা জবাব দেয়—‘তার দেওয়া নাম পছন্দ না হলে, যেন চেঞ্জ করতে পারি সেজন্যে। বলা যায়না, যদি অদ্ভুত নাম রেখে বসেন।’
নিধি হাসল, বলল-‘অনিরূপ ভাইয়ের চয়েজ অবশ্যই ভালো, আমার মনে হয় তোর নাম পছন্দ হবে। শুধুশুধু বই পড়ে মাথায় চাপ নিচ্ছিস।’
আশা কোণা চোখে তাকায়,ভ্রু বাকিয়ে বলল-‘হয়েছে সাফাই গাওয়া?’
নিধি হেসে ফেলল, বলল-‘ঠিকাছে, চুপ হলাম। তোর নাকি ইদানিং মাথা ব্যথা বেশি হচ্ছে? অনিরূপ ভাই আজ মা কে বলছে শুনলাম।’
আশার খাওয়া প্রায় শেষ! ও শেষ লোকমা মুখে তুলে বললো- ‘হু, ডাক্তার বলেছে, হরমোনাল ইমব্যালেন্সের জন্যে হচ্ছে এসব।’
নিধিকে এবার চিন্তিত হতে দেখা গেল। ও ভাবুক স্বরে বলল-‘তোর এত ফিট শরীরেই এত কমপ্লিকেশন। আমার যে ভবিষ্যতে কি হবে, খোদা জানেন।’
আশা হঠাৎ এই কথা শুনে অত্যন্ত উৎসাহ দেখাল, খুশি হয়ে বলল-‘আপা, তোমরা কি বেবি প্ল্যান করছ?’
নিধি উদাস গলায় উত্তর দিল-‘ না, ওসব আমার সুস্থ হওয়ার পর। আপাতত তোর দেবরের একটা বাচ্চার অভাবে কচুর মতো মুখটা দেখেই দিন রাত পাড় করা হচ্ছে।’
আশা-নিধি দুজনেই হেসে উঠল শব্দ করে।হাসতে হাসতে হঠাৎ আশা ‘আহ’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠে। নিধি থতমত খেয়ে যায়। সঙ্গেসঙ্গে আশাকে আগলে ধরে,— ‘কি হয়েছে আশা? পেইন উঠেছে?’
আশার তলপেটের ব্যথা ধীরেধীরে চুড়ান্ত রূপ নিলো। আশা ব্যথায় পেট চেপে জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে উঠল, হাপাতে হাপাতে বলল-‘আ-আপা, আ-আমার মনে হয় লেবার পেইন করছে। আপা, উন-উনাকে একটা কল করো, আমার খুব ভ-ভয় করছে।’
নিধি আশার ঘামে ভেজা মুখ মুছিয়ে দিল, সঙ্গেসঙ্গে নার্সকে ডাকল। নার্স এসে সবকিছু পরীক্ষা করে বলল-‘আমাদের হাসপাতাল যেতে হবে, লেবার পেইন এটা।’
আশা বারবার বলছে, অনিরূপকে কল লাগানোর জন্যে। নিধি তাই দ্রুত হাতে অনিরুপকে কল করলো। অনিরূপ বাইরে গেছিল জরুরি কাজে। ও কল পেয়ে দ্রুত বাড়ি এলো। আশা ব্যথায় চোখ-মুখ খিঁচে শুয়ে হাপাচ্ছে পেট চেপে। অনিরূপ অসহায় ভঙ্গিতে আশার ব্যথাতুর মুখটা আরকেবার দেখেই সঙ্গেসঙ্গে ওকে পাজকোলে তুলে নিল। অনিরূপ অনুভব করে, ওর হাত ভেজা! রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর হাত। অনিরূপ শিউরে উঠল, দু চোখ বুজে জোরেজোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে দৌড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। পেছনে ওয়াহিদা, নিধি। অরূপ, উমায়েদ দুজনেই হাসপাতালেই সবকিছুর ব্যবস্থা করে রাখছেন।
গাড়িতে আশা অনিরূপের শার্টের কলার শক্ত করে চেপে ধরে আছে।বারবার অনিরূপকে বলছে -‘ আমার বা-বাচ্চা ব-ব-বাঁচবে তো, ডাক্তার? আ-আমি কি ম-মরে যাব? আহ! আমার ব-ব্যথা করছে ভীষণ!’
অনিরূপ আশার চুলটা গুছিয়ে দিচ্ছে বারবার, বারবার বলছে-‘কিছু হবে না আশা, শান্ত হও লক্ষিটি। এগুলো হয়ই, এসব ন্যাচারাল। শান্ত হও, সোনা।’
আশা চিৎকার করছে ভীষণ, ব্যথায় ওর অনিরূপের হাত খামচে ধরে বসে আছে। অনিরূপের মনে হচ্ছে, হাত থেকে মাংস উঠিয়ে নিবে আশা। অনিরূপ সেসব পরোয়া করছে না। ও আশাকে শক্ত করে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে আছে। আশা হাপাচ্ছে, অনিরূপ বলল-‘পানি খাবে, সোনা?’
আশা কথাই বলতে পারছে না ব্যথায়।অনিরূপ তবুও আশাকে পানি খাওয়ালো। তারপর হঠাৎ মেয়েটা ব্যথায় মাঝরাস্তাতেই জ্ঞান হারিয়ে বসল। অনিরূপ থমকে গেল, আশার অজ্ঞান দেহটা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে ড্রাইভারকে জোরে ধমক দিয়ে বসল -‘ ওই, গাড়ি জোরে চালা।’
‘অনিরূপ, সিজার লাগবে আশার। প্যাশেন্ট এর বিপি অনেক বেশি, প্লাস বেবির ওয়েট বেশি। কি কর-‘
‘ওভেসলি সিজার করবে।’’ – অনিরূপ দ্রুততার সঙ্গে অধৈর্য্য ভঙ্গিতে বলে উঠে। তৃষা শান্ত চোখে অশান্ত অনিরূপকে দেখে, তারপর নিজে কিছুটা শান্ত গলায় বলে-‘ তুই থাকতে চাইছিস তোর বৌর কাছে?’
অনিরূপ চোখ তুলে তৃষার দিকে তাকাল, ওর পুরো মুখটা ঘেমে আছে। আপাতত হ্যান্ডসাম অনিরূপকে দেখতে একজন দায়িত্বশীল স্বামী এবং বাবা দেখাচ্ছে। যে তার বউ-বাচ্চার চিন্তায় অস্থির!
তৃষা অনিরূপের কাঁধে হাত রাখল, অনিরূপ সম্বিত ফিরে পেয়ে কিছু না বলে হাঁটা ধরলো ওটি রুমের দিকে। স্যারকে দেখে নার্স এগিয়ে দিল অনিরুপের দিকে সেইফটি ক্লথ। অনিরূপ অজ্ঞান আশার দিকে একবার চেয়ে ঝটপট পরে নিল ক্লথটা।
বাইরে সবাই চেয়ারে বসে, কেউ দাড়িয়ে দোয়া করছে।আব্দুর রহমান খবর পেয়েই দ্রুত গাড়ি রিজার্ভ করে শহরে হাসপাতালে এসেছেন। মেয়ের এহেন অবস্থা শুনে, তিনি যেন সেখানেই মূর্ছা যাবেন! নিধি আপাতত উনাকে শক্ত করে ধরে চেয়ারে বসিয়ে পানি খাওয়াচ্ছে।
অপারেশনের আগেই আশার জ্ঞান ফিরেছে। ওকে অ্যানাস্থেসিয়া দিয়ে রাখা হয়েছে। আশার সিজার করা হচ্ছে! পুরোটা সময় অনিরূপ আশার পাশে চুপ করে বসে ছিলো। । আশা বেডে অসহায়ের মতো পরে আছে। আশার ছলছল চোখ দুটো অনিরূপের থমথমে, কাদোকাঁদো মুখতা অপলক দেখে যাচ্ছে। আশা শুধু দেখে গেল, ওর জন্যে, ওর মতো রাগী, অযোগ্য বউয়ের জন্যে অনিরূপের ছটফটানি, হারানোর তীব্র ভয়!
ঠিক সেই মুহূর্তেই, মন থেকেই আশা একেবারে গলে গেল তখন স্বামীর প্রেমে,স্বামীর ওই ভয়ার্ত দু চোখে। কি করবে আশা? ক্ষমা কি দেখে করবে না? যে মানুষ ওকে হারানোর জন্যে এত ভয়, যে মানুষ ওকে ভালোবাসা দিচ্ছে অগণিতবার- সেই মানুষের সবকিছু কখনোই আগাগোড়া মিথ্যা হবে না। আশার প্রেম পাগল ওই মানুষকে আশা ক্ষমা না করে কোথায় যাবি? আচ্ছা, আশা যদি এখন মারা যায়? অনিরূপ কি করবে? অনিরূপ টিকতে পারবে তো পৃথিবীতে?
অনিরূপ আশার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দেখে গেল শুধু, আশার নরম শরীরে কাটাকাটি! যে মসৃণ পেট অনিরূপকে প্রতিবার কামুক করে তুলত, সেই পেটটা এখন কাটা হচ্ছে, ওই কুচকে যাওয়া পেটে ওদের দুজনের অস্তিত্ব একটু-একটু করে বেড়ে উঠেছিল।
পেট কেটে বাচ্চাটা যখন বের করা হলো, অনিরূপ অবাক-অদ্ভুত চোখে ওই বাচ্চার দিকে চেয়ে ছিলো। তার এত শখের বাচ্চা, তার জাদুর বাচ্চা-শেষ অব্দি এই সুন্দর পৃথিবীর মুখ দেখল!
এটা সে, যে বাচ্চা নিজের আদুরে হাতে মা-বাবার সম্পর্কটা দড়ির মতো ধরে রাখবে! তৃষা রক্তে ভেজা বাচ্চাকে গোসল করিয়ে গায়ে সাদা টাওয়াল জড়িয়ে অনিরূপের হাতে দিল। অনিরূপ আলতো হাতে আলগোছে বাচ্চাটা কোলে নিল। তারপর ঠাঁই চেয়ে রইল বেবির দিকে।এত্ত সুন্দর এই বাচ্চা! অনিরূপ বাচ্চাকে সরাসরি দেখে কথা বলাই ভুলে গেল যেন, ও আবেগে বাচ্চাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে! বিড়বিড় করে শুধায়- ‘বাবা,আমার জান আব্বু!’
বাচ্চাটা ভীষণ কাঁদছে। অনিরূপের বুড়ো আঙুল নিজের ছোটছোট হাতে চেপে ধরে কাঁদছিল। তৃষা হেসে বলল-
‘তোদের দুজনের বাচ্চাটা আসার আগেই পৃথিবী কাঁপিয়ে দিল, লাইক হার ফাদার।’
অনিরূপ তখনও ঠাঁই চোখে বাচ্চার দিকে চেয়ে রয়েছে। পরপর কৃতজ্ঞতার চোখে আশার দিকে তাকাল। আশা ক্লান্ত, ও বেডে পড়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাপ-বেটির দিকে চেয়ে ছিলো। অনিরূপ বাচ্চাটাকে চুমু খেয়ে, আশার বুকের উপর রাখল। আশা হাত উঠিয়ে ছুতে পারছে না নিজের বাচ্চাকে, শরীরটা কেন যেন অবশ লাগছে। অনিরূপ সেটা বুঝে নিজে বাচ্চার পিঠে হাত দিয়ে ধরে রাখল। আশা কান্নাভেজা চোখে নিজের বাচ্চাকে দেখছে। বাচ্চাটা কাঁদছে ভীষণ, আশা বাচ্চার চোখে মুখে চুমু খেয়ে হুট করে উদ্ভ্রান্তের মতো কেঁদে উঠল, পাগলের মতো বাচ্চার সারা মুখে চুমু খেতে খেতে বলল-‘আম্মু, আম্মু, ও আমার আম্মু।’
অনিরূপ মা-মেয়েকে দেখেই যাচ্ছে অপলক। তৃষা বলল- অনি,আশার রেস্টের প্রয়োজন । বাচ্চা নিয়ে বাইরে যা।’
আশা বাচ্চাকে দিবে না, অসহায়ের মতো তাকাল অনিরুপের দিকে ও! অনিরূপ বুঝলো আশাকে! ও আশার চুলে এক হাত বুলিয়ে বলল-‘কয়েক ঘন্টার ব্যাপার তো, আশা! তারপরই বাচ্চাকে কোলে রাখতে পারবে, যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণ! এখন একটু রেস্ট নাও, সোনা!’
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩১
অনিরূপ বড্ড আদুরে গলায় বলল কথাগুলো! আশা আর কি করবে? অগ্যতা বাচ্চাকে ছেড়ে দিল। অনিরূপ আশার ক্লান্ত, ঘামে ভেজা গাল-দুটোতে চুমু খেয়ে বাচ্চা নিয়ে বেরিয়ে এলো ওটি রুম থেকে।
অনিরূপ বেরিয়ে আসতেই, বাইরে একপ্রকার হইচই লেগে গেল বেবিকে নিয়ে। অনিরূপ আর নিজের বেবিকে কোলে রাখতে পারল না। অনিরূপ-আশার বাচ্চা বারবার এ-ওর কোল বদলাতে থাকল!