দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৬
অবন্তিকা তৃপ্তি
কাজী অফিসের সামনে অনিরূপ দাঁড়িয়ে আছে, গলায় সাদা গোলাপের সুন্দর এক মালা। বন্ধুদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। আজ অনিরূপ খুশি, জয়ী। তার বহু আকাঙ্ক্ষিত একটা গেইম; একটা খেলা সে জিতে গেছে-অবশেষে। খানিক দূরেই আশা লাল জামদানি গায়ে, মালা গলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনিরুপের হাসি বরাবরই মারাত্মক-কিন্তু আজ আশার ওই হাসির দিকে তাকালে শ-বার মরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে।না চাইতেও আশা নিজেই নিজের জীবনের কাল ডেকে এনেছে, স্বয়ং সর্বনা শের অপর নাম অনিরূপকে ডেকে এনেছে। অনিরূপের বন্ধুরা আশার দিকে চেয়ে অনিরূপকে খোঁচাচ্ছে, আজ অনিরূপ সব মজাতেও হালকা হেসে সায় দিচ্ছে। খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে সে আপাতত।
আশা ওদের দিকে চেয়ে হালকা হাসার ভান করে গলার মালা খুলে হাতে নিলো। মালাটা গলায় যেন ফাঁ সের মতো লাগছিল। অনিরূপ বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আশার দিকে এগিয়ে এলো। আশা ফাঁকা ঢোক গিলে অনিরূপের দিকে তাকাল। অনিরূপ আশার সামনে এসে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আশাকে কিছুক্ষণ দেখে তারপর হালকা হেসে আশার দিকে চেয়ে বললো-‘এরপর?’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আশা নীরব থাকলো কিছুসময়-তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে চেয়ে বললো-‘আমার আব্বাকে ফিরিয়ে আনা।’
অনিরূপ আবারও মজা করে বসলো। পুরনো কথা ভুলে যাওয়ার ভান করে বললো-‘আব্বা? কার আব্বা? আমি কাউকে ফিরিয়ে আনার কথা দেইনি।
আশার বুক ছ্যাত করে উঠলো। অনিরূপ কী ডাবল গেইম খেলতে চাইছে আশার সঙ্গে। আশা ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বললো-‘মানে? আপনি কথা দিয়েছিলেন আমাকে।’
আশা ক্ষীপ্ত হয়ে যাচ্ছে। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলছে ও। উপরে উপরে রাগ দেখালেও, ভেতরে ভেতরে আশা ভয় পেয়ে যাচ্ছে। আশা অনিরুপের ওয়াদার উপর ভরসা করে বিয়ে করেছে, এখন এতদূর এসে ফিরে যাওয়ার আর কোন পথ নেই। অনিরূপ আশাকে এখন ঠকালে?
অনিরূপ আশার এহেন দুর্দশা দেখে হেসে ফেলল শব্দ করে। হাসতে হাসতে আশার চুলে হাত রেখে বললো-‘কুল, আসো। আমরা থানায় যাব এখন।’
আবারও আশার পরিস্থিতি নিয়ে, আশার দুর্ভাগ্য নিয়ে কী জঘন্য মজা করলো অনিরূপ। আশা কিছুক্ষম অনিরূপের দিকে চেয়ে থাকলো। তারপর অনিরূপের হাতটা জোর করে মাথার উপর থেকে সরিয়ে ফেলল। অনিরূপ ভ্রূ কুঁচকে একবার নিজের সরিয়ে দেওয়া হাতের দিকে আরেকবার আশার দিকে তাকাল। আশা চুপচাপ কোনো কথা না বলে অনিরূপের গাড়িতে উঠে বসলো। অনিরূপ ছোট্ট করে এক নিশ্বাস ফেলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো।
অনিরুপ গাড়ি চালাচ্ছে, আশা চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে। গাড়ির স্পিড বড্ড বেশি, এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আশার সেদিকে মন নেই। সে ভাবছে- অনেককিছু। আশার পানি পিপাসা পাচ্ছে। ও কিছুক্ষণ পর অনিরূপের দিকে চেয়েবললো-‘গাড়িতে পানি আছে?’
অনিরূপ আশার দিকে একপল চেয়ে গাড়ির পেছনের সিটব্যাগ থেকে পানির বোতল এগিয়ে দিল। আশা অর্ধেক বোতল পানি একবারে শেষ করে ফেলল। পানির বোতলে শেষ চুমুক দিবে, সেইসময় গাড়ি হঠাৎ ব্রেইক কষলো। আশা পানির বোতল নিয়ে সামনে ছিটকে পড়লো। কিছুটা পানি আশার গলাসহ গায়ের শাড়িতে পরে গেলো। আশা একবার অনিরূপের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে গলা মুছতে গেলে অনিরূপ আশার হাত আটকে দিল। আশা অনিরুপের দিকে চায়, অনিরূপের ওই নীলাভ চোখ কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে।
ওই নির্লজ্জ চোখ আশার ঠোঁট থেকে গলায় ঘুরাঘুরি করছে। অনিরুপ গাড়ির ইঞ্জিন অফ করার সঙ্গেসঙ্গে আশার ধ্যান ফেরে। আশা অনিরূপের উদ্দেশ্য বুঝে- চমকে উঠে অনিরূপের হাত সরিয়ে নিতে চাইলে, অনিরূপ আশার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে নিজের ঠিক মুখোমুখি এনে আচমকা আশার গলার মাঝখানে লম্বা সময় নিয়ে চুমু বসায়। শুষে নেয় গলায় লেগে থাকা পানিটুকু। আশা ছটফট করে উঠে, বারবার অনিরুপের বুকে ধাক্কা দিতে থাকে। তবে অনিরূপের দানব শরীর নিজের থেক একফোঁটাও সরাতে পারে না, যতক্ষণ না অনিরূপ নিজে থেকে সরে আসলো। অনিরূপ সরে আসলে, আশা হাঁপাতে হাঁপাতে অনিরুপের দিকে চাইল। ধীরে ধীরে আশার অসহায় চোখে রাগের ফুলকি ধ্বসে পড়লো। ওই রাগি চোখে অনিরুপ আবারও নিজের ধ্বংস দেখতে পেয়ে হাসলো। অনিরূপ নিজের ঠোঁট লিক করে তির্যক হেসে বললো-‘ ওহ্ ম্যাই আশা, ইওর নেক টেস্ট ইস ড্যাম স্যুইট। আই থিঙ্ক আ’ম অ্যাডিক্টেড টু ইওর নেক।’
অনিরূপের চোখ আশার গলার দিকে এখনও ঘুরছে। ব্যস, অনিরূপের এই সামান্য কথা আশার রাগে ঘি ঢালতে যথেষ্ট। আশা ক্ষেপে গিয়ে তেরে আসে অনিরূপের দিকে-‘‘নির্লজ্জ লোক,আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন।’
ক্ষিপ্ত আশা অভদ্র অনিরুপকে হাত বাড়িয়ে চড় মারতে হাত উঠায়, অনিরুপ হাত ধরে ফেলে সঙ্গেসঙ্গে। আশা কাঁপতে থাকে, যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দিবে অনিরূপকে, অনিরূপের ওই নেশালো ঠোঁটকে। অনিরুপ আশার চড় মারতে উদ্যত হওয়া ডান হাতের উল্টোপিঠে চুমু খায়,আশা থমকে যায় সঙ্গেসঙ্গে। অনিরূপ ফিসফিস করে হাস্কি আওয়াজে বলে-‘তোমাকে ছুঁবো না, এমন কোনো ওয়াদা করেছি বলে আমার মনে পড়ছে না। স্ত্রী তুমি আমার, হক আছে আমার। হক এখনি পুরোপুরি বুঝে নেইনি, নিব। সময় হোক আগে, নিব অবশ্যই।’
আশা অনিরূপের থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে অনবরত-, অনিরুপ একপর্যায়ে নিজেই আশার হাত ছেড়ে দিল। আশা সিটে বসে আবার। অনিরুপ স্টার্ট করে গাড়ি। আশা রাগে নিজের আঙুল নিজেই কামড়ে ধরে, চিবোয় আঙুল। অনিরুপ হেসে হেসে গাড়ি চালাচ্ছে। আশার এই অবস্থা দেখে সবচেয়ে বেশ মজা পাচ্ছে অনিরুপ। ভালোই লাগছে মেয়েটাকে তড়পাতে দেখতে।
আশার চোখে পানি জমে গেছে। অনিরুপের নোংরা স্পর্শ ও মানতে পারছে না। ইচ্ছে করছে-কুটিকুটি করে ফেলতে ওই ঠোঁটগুলো।আশা আঙুল চিবুতে চিবুতে আশা বিড়বিড় করে বললো-‘তার স্পর্শ করা জায়গা পোকায় খাক, জ্ব লেপু ড়ে যাক।’
আশার চোখ টলটলে, কিন্তু চোখ বেয়ে ওগুলো গড়িয়ে পড়বে না। আশা পড়তে দিবে না কখনো। শুধু রহমান সাহেব একবার ছাড়া পান, আশা এই সবকিছু শেষ করবে। রাগ সামলানোর জন্যে এখনও আঙুল চিবিয়ে যাচ্ছে ও। অনিরুপ কিছুক্ষণ পর সামনে তাকিয়েই আশার আঙুল মুখ থেকে টেনে আনে। আশা ক্ষীপ্ত হয়ে অনিরুপের দিকে তাকায়। বললো ও-‘চুপচাপ গাড়ি চালাতে পারেন না? আমার উপর এত নজর কেন? আপনি প্লিজ সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালান, আমি অস্বস্তি বোধ করছি।’
অনিরূপ ওসব কথা গায়েই মাখলো না। বরং নিজের মতো করে বললো-‘কামড়ানোর সময় এলে আমিই কামড়ে দিব, নিজে থেকে এই কাজ করা লাগবে না। ওটা আমার সেক্টর।’
আশা থামে, জোরেজোরে শ্বাস ফেলে নিজের রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করে অনিরূপের দিকে ফিরে সরাসরি স্পষ্ট গলায় বলে ফেললো-‘আমি সময় চাই, এই বিয়ে আমার জন্যে একটা সওদা জাস্ট। একটা সওদা করে আমার থেকে শারীরিক কিছু কিছু আশা করলে বোকামি করবেন। মনে রাখবেন, আমি মন থেকে আপনার স্ত্রী হইনি।’
অনিরূপ ভ্রু বাঁকাল, হাসলো-যেন উপহাস করলো আশাকে। এমন মজার কথা যেন সে কখনোই শুনেই নি। অনিরূপ হেসে হেসেই বললো-‘মন? ওটা আবার পাওয়া লাগে নাকি? অনিরূপ কারো মন পাওয়ার আশা করেনা।’
আশা স্তব্ধ হয়ে অনিরূপের দিকে চেয়ে থাকে। অনিরুপের নীলাভ চোখগুলো হাসছে, ওর ওই নেশালো ঠোঁটও হাসছে। অনিরূপের প্রতি আরেকবারের ন্যায় ঘৃণা জন্মাল আশার। মানুষটা সাক্ষাৎ শ য়তান-একটা জ ঘন্য নোং রা মানুষ।
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৫
আশা নীরবে অন্যপাশে মুখ সরিয়ে ফেলে তাকিয়ে থাকে।যার মন নেই, তার কাছে অন্যের মনের মূল্যও কী করে থাকবে? পোউর আশা সেটা বুঝতে পারলো না কেন? আশা নিজের উপরই হেসে উঠে। বারবার, বারবার এই অনিরূপ আশাকে বোকা বানাচ্ছে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মানুষ চেনায় আশা ঠিক কতটা বোকা, অদক্ষ।
অনিরূপ কিছুসময় পর সন্দেহজনকভাবে হেসে জিজ্ঞেস করলো-‘থানায় একজনকে আমি তোমার সামনে পেটাব। দ্য গ্রেট অনিরুপের স্ত্রী হিসেবে, আমি চাই তুমি আমাকে চেয়ার্স অ্যাপ করবে। করবে তো?’