দীঘির জলে কার ছায়া শেষ পর্ব
অবন্তিকা তৃপ্তি
তারপর, তারপর পেরিয়ে গেছে অনেকটা দিন, অনেকটা মাস, অনেকটা রাত-দিন! আশা অনিরূপের বাচ্চাও ততদিনে বেশ বড় হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে শেখ অনিশা জানা। ভীষণ মিষ্টি দেখতে হয়েছে বাচ্চাটা।
আশা-অনিরূপ তো রীতিমত জান ফেলে মেয়ের উপর। অনিরূপ আজকাল বাসায় এলে মেয়েকে নিয়েই পড়ে থাকে সারাক্ষণ। মেয়ে বড় হচ্ছে, অনিরূপ চায় ওর মেয়ে ভীষণ, ভীষণ বড় হোক, সেলফ ডিফেন্স শিখুকো, পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলামে বেশি সচল থাকুক। অনিরূপ মেয়ে বড় হলে নিজের স্বপ্নগুলো তুলে ধরবে মেয়ের কাছে। আপাতত মেয়ে তার এখনও ছোট, সবে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে।
এই তো আজকের কথা- অনিরূপ ঘরে আসলো! মেয়ে তখন মায়ের বুকের সঙ্গে মিশে খাচ্ছে। অনিরূপ ঘরে ঢুকে আশার দিকে একপল চেয়ে হাসল, আশাও হাসল একটু। অনিরূপ মেয়ের দিকে ইশারা করে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো- ‘ঘুমে নাকি?’
বলার সাথেসাথে অনিশা খাওয়া ছেড়ে ঘাড় কাত করে পাপার দিকে তাকাল। আশা শাড়ি ঠিক করলো। অনিশা অনিরূপকে দেখেই মিষ্টি হাসল, ডাকল খিলখিল করে হেসে হেসে -‘পা-পাপ্পা।’
ব্যাস, অনিরূপ ওখানেই গলে গেল। ও মেয়ের কাছে এগিয়ে এসে মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিল, মেয়ে কোলে যাওয়ার জন্যে রীতিমত হাত বাড়িয়ে লুটিতে পড়বে এই ভাব। আশা মেয়েকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে বলল-‘আম্মু, পাপা ফ্রেশ হয়ে আসুক। পাপার গায়ে ময়লা তো।’
মেয়ে কি এসব শোনে! হয়েছেও বাবার মতো নাছোড়বান্দা। অনিরূপ মেয়েকে আর ছুলো না,কণ্ঠে আদর ঢেলে বলল-‘পাপা আসব আর যাব। ততক্ষণ প্রিন্সেস কুইনের কাছে থাকবে, ওকে পাপা?’
কি বুঝলো ওই ছয় মাসের মেয়ে। বাবার কথার সায় দিতে সঙ্গেসঙ্গে মায়ের বুকের সঙ্গে লেপটে গেল। আশা অবাক হয়ে মেয়েকে দেখে আবারও অনিরূপের দিকে তাকাল, হতবাক কণ্ঠে বললো-‘ মেয়েকে একেবারে বশ করে ফেলেছেন দেখছি।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনিরূপ হাসল, মেয়েকে একনজর ভালো করে দেখে চট করে আশার ঠোঁটের কোণে চুমু খেয়ে আবারও ভদ্রভাবে সরে গিয়ে বলল-‘শুধু মেয়ে? মেয়ের মা আমার বশে নেই?’
আশা লাজুক হাসল। মেয়েকে ভালো করে নিজের সঙ্গে চেপে নিয়ে আস্তে করে বললো- ‘সব নিজের ক্রেডিট নাকি? আমি দয়ালু বউ দেখে আপনা-আপনি বশে এসেছি। অন্যকেউ হলে আসতো না।’
অনিরূপ হাসল! আশা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে হাসি দেখে গেল। অনিরুপ আর কথা বাড়াল না। ঝটপট বাথরুমে গেল ফ্রেশ হতে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই আশা মেয়েকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, কোলে থাকা অনিশাকে অনিরূপের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো-‘ ওকে রাখুন, আমি খাবার বাড়ব।’
অনিরূপ মেয়েকে আলগোছে কোলে নিল। বাবার কোলে গিয়েই মেয়ের হাসি কে দেখে! অনিরূপের টিশার্ট ছোট হাতে চেপে ধরে বাবার বুকে মুখ ঘষল। অনিরূপ মেয়েকে নিয়ে পুরো রুমময় হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে বলতে লাগল-
‘টুইংকেল টুইংকেল লিটল ষ্টার,
হাউ আই উন্ডার হোয়াট ইউ আর।’
আশা বাপ-মেয়েকে রেখে হেসে বেরিয়ে গেল নিচে।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল! মেয়ে বোধহয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে! আশা দ্রুত সব গুছিয়ে রুমে এলো।
অনিরূপ সবে তখন মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দোলনায় রাখছে। আশা দরজায় সিটকিনি তুলে দিয়ে ঘুরে বলল-‘আজ মেয়ে দোলনায় কেন?’
অনিরূপ আলগোছে মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে আশার দিকে ফিরল। ওর চোখে মুখে নেশা কাজ করছে ভীষণ।আশা হয়তো বুঝতে পারল সেটা। এতদিনেও মানুষটার নীলাভ চোখের ওই নেশালো দৃষ্টি সহ্য হয় না আশার। লজ্জায় বারবার নুইয়ে পড়ে ও।
আশা তাকিয়ে আছে অনিরূপের দিকে, একটাসময় অস্ফুট স্বরে বললো-‘আজ-মেয়- আমি–‘
আশার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। অনিরূপ হাসে, ওর হাতে একটি টকটকে লাল গোলাপ। আশার দিকে দুষ্টু চোখে চেয়ে গোলাপটা মুখে দিয়ে নিচের অংশ কামড়ে ধরে আশার দিকে এগুতে লাগলো। আশা কি বলবে? ওর সারা গা শিরশির করছে ভীষণ। আশার পাশে এসে অনিরূপ আশার কোমর চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। আশা অবলীলায় ঘেঁষলো স্বামীর গাঁয়ের সঙ্গে। অনিরূপের বুকে হাত রেখে তাকালো স্বামীর দিকে। অনিরূপ গোলাপ মুখ থেকে নিয়ে আশার পুরো মুখে গোলাপের পাপড়ি বুলালো, আশা চোখ বুজে মৃদু হেসে মুখ সরিয়ে নিতে নিতে বললো- ‘আহ, সুড়সুড়ি লাগছে তো।’
অনিরূপ হাসল, ও আর জ্বালালো না, গোলাপটা আশার কানের পিছে গুঁজে দিয়ে কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলল-‘মন থেকে ক্ষমা করা হয়েছে এই অধমকে, ম্যাডাম?’
আশা থেমে গেল, এবার কানেও সুড়িসুড়ি লাগছে। ও কান সংকুচিত করে ফেলে শিরশিরানি অনুভূতিতে, অনিরূপের কাঁধের টিশার্ট খাঁমচে ধরে অশান্ত ভাবে বললো-‘হু, করেছি।’
অনিরূপ আশার কোমরটা আরও শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টানল, আশা শিউরে উঠল। অনিরূপ নিভু গলায় বলল-‘শাস্তিটা এবার বেশি হয়ে গেল না?’
আশা চোখ খুললো। অনিরুপের চোখে ভেজা চোখে চেয়ে বলল-‘সরি। ক্ষমা অনেক আগেই করেছিলাম। কিন্তু বলিনি। ভেবেছি বেবি হওয়ার পর একবারে বেবি-বউকে নিজের করে পাবেন।’
অনিরূপ হাসল! বউয়ের মুখের দিকে ঝুঁকে আবারও নিভু গলায় অনুমতি চাইল-‘ও, তাই? তাহলে বৌটাকে নিজের করে নিয়ে নেই আজ? অনুমতি আছে?’
আশা লাজুক হাসল। সম্মতিস্বরূপ দুহাতে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরলো।
রাতের শেষ প্রহরে; আশা অনিরূপের বুকে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। অনিরূপ আশার নগ্ন দেহটা কম্বল দিয়ে ভালো করে ঢেকে নিয়ে ওকে নিজের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরল। আশাও আদুরে বিড়াল ছানার মতো অনিরূপের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বললো-
‘ও ডাক্তার?শুনুন না।’
অনিরূপ মাথা নিচু করে তাকাল বুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বৌটার দিকে, কৌতুক করে বললো-‘হু, বলো না।’
আশা স্বামীর বুকে নাকমুখ ঘষতে ঘষতে বলল- ‘আমার না এত সুখগুলো হজম হচ্ছে না। এত ভালোবাসা, আপনি, আমাদের মেয়ে। সবকিছু মনে হচ্ছে আমি একদিন হারিয়ে ফেলবো। এমনটা কেন মনে হচ্ছে? এটা কি সাইকোলজি ঘটিত কোনো অসুখ।’
অনিরূপ আশার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। বুঝতে পারল, নারী মনের অস্থিরতা। ও বড় আদর করে আশার ঠোঁটে চুমু খেয়ে হেসে বলল–‘ ঘুমাও, তুমি অযথা চিন্তা করছ।’
আশা শোনে না, আলগোছে অনিরূপের বুকে চুমু খেয়ে বললো-‘একটা কথা রাখবেন আমার?’
‘কি কথা?’- অনিরূপ বললো।
আশা অনিরূপের চোখের দিকে তাকাল, দুজনের চোখে চোখে অনেক কথা হলো। আশা ভেজা চোখে বড্ড আবেগী গলায় বললো—-‘কোনোদিন প্লিজ আমাকে আর আমার মেয়েকে ছেড়ে কথায় যাবেন না, কখনো আমাদেরকে ভালোবাসতে কার্পণ্য করবেন না, আর সবসময়ই আমাদের নিজের দুহাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আগলে রাখবেন।কথা দিন!’
অনিরূপ আশার দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইল, পরপর আশার ভেজা চোখ দুটো মুছে দিল ভীষণ যত্নে। তারপর ওর গোলগাল মুখটা দুহাতের আজলায় নিয়ে নিজের মুখী করল,ভীষণ নরম গলায় বলল-
‘আমার নিশ্বাস থাকতে, আমার কলিজা দুটোকে কলিজায় তুলে রাখব। এখন ঘুমাও আশা, বড্ড রাত হয়েছে।’
‘আরেকটু কথা বলি না? আমার ভালো লাগছে ভীষণ।’ –আশা বড্ড আকুতি নিয়ে বললো।
অনিরূপ আশার চোখটা হাত দিয়ে বন্ধ করে দিয়ে বলল-‘উহু, এখন শুধু ঘুম। তোমার শরীর অসুস্থ হয়ে যাবে এভাবে সজাগ থাকলে। তাই এক্ষুনি চোখ বন্ধ।’
আশা বকা খেয়ে বাধ্য মেয়ের মতো চোখ বন্ধ করে ফেলল। অনিরূপ আশার কপালে চুমু খেয়ে ওকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল।
তারপরদিন…
আশা মেয়েকে নিয়ে দুপুরে ঘুমিয়েছিল। ঘুমের ঘোরে হঠাৎ এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে-
অনিশা হুট করেই একদিন বেশ বড় হয়ে গেছে। আশা-অনিরূপ মেয়ের সঙ্গে খেলা করছে পদ্ম দীঘির পাড়ে। অনিশা খেলতে খেলতে দীঘির একদম কোণায় এসে দাঁড়িয়েছে। আশা ডাকছে মেয়েকে বারবার- ‘ জানা, মা ওদিকে যেও না। মায়ের কাছে আসো, জানা!’
অনিশা শুনছেই না। ওই ছোট ছোট হাড়ি পাতিল হাতে নিয়ে পদ্ম দীঘির পাড়ে ঘেঁষতে ঘেঁষতে হঠাৎ মুখ থুবরে পড়ে গেল জলে। আশা চমকে উঠল। দৌড়ে গেল দীঘির পাড়ে। ডুবছে ওর বাচ্চাটা, অনিশা বাঁচার অনেক চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। বারবার মাথা তুলে হাত দিয়ে ডাকছে আশাকে -‘মাম্মা , মা-মাম্মা।’
আশা মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই পদ্ম দীঘির পাড় ছুতে পারছে না। আশার পায়ে কে যেন দড়ি বেঁধে রেখে দিয়েছে। আশা আশেপাশে কাউকেই পাচ্ছে না। ওর মেয়েটা ডুবছে দিঘীতে। আশা বাঁচাতে পারলো না মেয়েকে। অনিশার ছোট শরীরটা একপর্যায়ে পানিতে তলিয়ে গেল। আশা জোরে চিৎকার করে উঠল-‘জানাআআ!’
সঙ্গেসঙ্গে আশা ঘুম থেকে উঠে বসলো। ও এই শীতেও গরমে ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছে। আশা দ্রুত পাশে তাকাল, অনিশা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। ওর এক হাতে মায়ের শাড়ির আঁচল চেপে ধরা। আশা মাথার ঘাম মুছে, মেয়ের পাশে আধশোয়া হলো। মেয়ের কপালে, গালে, ঠোঁটে অসংখ্য চুমু খেলো। মেয়ের বুকে ছোট ছোট করে চাপড় দিয়ে মেয়ের চুল গুছিয়ে দিল। আশা চুমু খেতে খেতে প্রায় কেঁদেই ফেলল একপ্রকার। ও নিজেকে সামলাতে না পেরে মেয়েকে ঘুমের মধ্যেই তুলে নিজের বুকের উপর শুইয়ে ফেলল। মেয়ের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে দোয়া পড়তে লাগলো-
‘আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম..’
মেয়েকে অনেকক্ষণ নিজের মধ্যে শুয়ে রাখার পর ধীরেধীরে আশা শান্ত হলো। আশার বুকটা এখনও কাঁপছে। ওর মন কু ডাকছে বারবার। কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। আশার টেবিল থেকে ফোন নিয়ে কল করলো অনিরূপকে। বন্ধ দেখাচ্ছে ফোন।এতে অশান্ত আশা আরো অশান্ত হয়ে গেল। হঠাৎ একটা কল এলো অজানা নাম্বার থেকে, আশা মেয়েকে বুকে নিয়েই কল ধরল। ওপাশ থেকে কেউ বলল-‘হ্যালো, আমি কেয়ার হসপিটাল থেকে সজীব বলছি। অনিরূপ শেখ জয় কি আপনার হাসব্যান্ড?’
আশা ভ্রূ কুঁচকালো, ও উত্তর দিল-‘ জি।’
ওপাশের লোকটা বললো-‘উনাকে কেউ গুলি করে মারার চেষ্টা করেছে।কিছু লোক রাস্তায় তাকে পরে থাকতে দেখে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।। উনার ওয়ালেট থেকে আপনার ছবি এন্ড নাম্বার পেয়েছি আমরা। আপনি দ্রুত আসুন হাসপাতালে।
আশা সঙ্গেসঙ্গে মেয়েকে বুকে নিয়ে উঠে বসল। বিস্মিত, অশান্ত মন নিয়ে কাপা গলায় জিজ্ঞেস করল- ‘উনি ঠিকাছেন তো? ব-বেচে-‘
‘বেঁচে আছে এখনও সে। তবে আশঙ্কা করছি আমরা। আপনি দ্রুত আসুন, আমরা আপনার স্বামীকে ওটিতে নিচ্ছি।’
ওপাশের লোকটা কল কেটে দিল। আশা কিছুক্ষণ ওভাবেই পাথরের মতো বসে থাকল বিছানায়। তারপর সম্বিত পেতেই পাগলের মতো শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে মেয়েকে নিয়ে ছুটলো নিধির ঘরে। ওয়াহিদা বাড়ি নেই আজ, উমায়েদকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি গেছেন। বাড়িতে শুধু নিধি, তার উপর প্রেগন্যান্ট। আশা মেয়েকে নিয়ে নিধির কাছে গেল, নিধি বই পড়ছে।
আশাকে এভাবে হন্তদন্ত দেখে ও উঠে বসল, অবাক হয়ে বললো-‘তোর কি হয়েছে আশা? এভাবে ছুটছিস কেন?’
আশা অনিশাকে নিধির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল-‘ওকে দেখে রাখো আপা। আমি আসছি বাইরে থেকে।’
নিধি অনিশাকে কোলে নিয়ে অবাক হয়ে বলল-‘কিন্তু যাচ্ছিসটা কোথায়?’
আশা এবার কাঁদোকাঁদো মুখে বলল-‘হাসপাতাল থেকে কল এসেছে- উনার গুলি লেগেছে আপা, আমার এই সুখ শান্তি আবার কেউ কেড়ে নিতে চাইছে। আমি হাসপাতাল যাচ্ছি।’
নিধি চমকে উঠলো, সঙ্গেসঙ্গে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল, দ্রুত বলল -‘আমিও আসি তোর সঙ্গে। এভাবে একা যাবি?’
আশা একবার নিধির ভারি শরীরটার দিকে তাকাল, পরপর বাঁধ সেধে বললো-‘‘না, তুমি থাকো। আমি সামলে নিব সব। উনাকে একবার দেখে আসি আমি, রাতে মা ফিরলে আমি মা-কে ডেকে নিব হাসপাতালে। এখন এতজন যাওয়ার দরকার নেই।’
নিধি কিছুক্ষণ জোর করলো। কিন্তু আশা নিধিকে রেখে যাওয়ার জন্যে তৎপর। পরে আশা নিধির এত জেদ দেখে বলল-‘ আমার মেয়েকে দেখে রাখা লাগবে তোমার। ওকে এই অবস্থায় নিয়ে যাবো না হাসপাতাল। ওর কাছে থাকো তুমি আপা।’
আশা মেয়েকে দিয়ে দিল নিধির কোলে। নিধি শুনল, আসলে ওর শরির একদমই ভালো থাকে না আজকাল। সারাক্ষণ এটা-ওটা লেগেই থাকে। এইজন্যে ডাক্তার ওকে কমপ্লিট বেড রেস্টে থাকতে বলেছেন। তাছাড়া অনিশা কে দেখে রাখা লাগবে, বাসায় আর কেউই নেই। তাই নিধি থেকে গেল। আশা বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকালো। তারপর আবার ফিরে এসে মেয়েকে কোলে নিয়ে মেয়ের সারা মুখে চুমু ভরিয়ে ফেলল। মেয়ের কানের কাছে চুমু খেয়ে প্রায় কেঁদে উঠে বলল-
‘আল্লাহ আমাদের মা মেয়ের সুখ একটুও সহ্য করতে পারেন না কেন আম্মু? আম্মু ফিরে আসবে তাড়াতাড়ি, তুমি প্লিজ লক্ষ্মী বাচ্চা হয়ে থেকো মা। কাউকে জ্বালিও না। অনিরূপ শেখ জয়ের মেয়ে উনার মতোই বুঝদার, রাইট মা? মা আসছি, তুমি ঘুমাও। মা এসে তোমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে আর অনেক অনেক আদর দিবে, আমার লক্ষ্মী বাচ্চা।’
আশা কথাগুলো বলে দ্রুত অনিশাকে নিধির হাতে তুলে দিল। কিন্তু মেয়েটা ঘুমের ঘরেই আশার শাড়ি খামচে ধরল। আশা তাকাল মেয়ের ওই হাতের দিকে। নিধি বললো-
‘তোর মেয়েও এক পিস, বাপের মতো তোকে হাত ছাড়া করতে চায়না এক মুহূর্তের জন্যেও।’
আশা অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকাল, পরপর মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে আলতো হাতে শাড়ি থেকে মেয়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিধির দিকে তাকালো। নিধি চেয়ে আছে আশার দিকে। আশা বললো-
‘ওর খেয়াল রেখো আপা। মেয়েটা ঘুমের মধ্যে মায়ের বুক খুঁজে, ওকে প্লিজ সেসময় নিজের বুকে চেপে ধরো। আর দুধ চাইলে আমি ফিডার বানিয়ে রেখেছি, খাইয়ে দিয়ো। আর তুমি, আমার মেয়ের খেয়াল রাখতে গিয়ে নিজে অসুস্থ হয়ে যেও না, তোমার পেটেরটার কথাও ভাবিও।’
নিধি অবাক হয়ে আশার দিকে তাকাল। আশা চোখ মুছে মোবাইল হাতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। ওর বুক কাঁপছে। চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে। ও উদ্ভ্রান্তের মতোই বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
আজ অবরোধ, বিরোধী পক্ষ থেকে হরতাল ডাকা হয়েছে। পুরো ঢাকা শহর আজ ফাঁকা একদম। হাঁটতে হাঁটতে আজ একটাও সিনজি পাওয়া যাচ্ছে না। আশা হেঁটে হেঁটে গেল অনেকটা পথ। হঠাৎ দীঘির ওখানে একটা খালি সিএনজি পাওয়া গেল। আশা দৌড়ে গেল ওদিকে। সিএনজি ওয়ালাকে ডেকে বলল-
‘ভাই, কেয়ার হাসপাতালে যাবেন?’
সিএনজিওয়ালা মাথা ঘুরিয়ে আশার দিকে তাকাল। চমকে উঠল আশা। এটা তো তানিম, অনিরূপের বেস্ট ফ্রেন্ড। ও এখানে সিএনজি নিয়ে?তানিম সিএনজি থেকে নেমে দাঁড়াল। তারপর আশার দিকে চেয়ে বিশ্রী হাসল। আশা ওই হাসি দেখে বিড়বিড় করলো-‘ তাবিম ভাই আপনি?’
তানিম আশার হাত চেপে ধরল, আশা সঙ্গেসঙ্গে শিউরে উঠে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। তানিম বিশ্রী হেসে আশার হাত ছুঁতে লাগল-
‘কাকে খুঁজতে চলেছেন ভাবি?’
আশা এবার রেগে উঠল, এমন একটা অবস্থায় তানিমের এই অসভ্য দু রূপ দেখে ও রেগে অপর হাত দিয়ে তানিমের গালে ঘাপ্পড় বসাল, রাগে কাপতে কাপতে বলল-
‘ছাড়ো আমাকে, অনিরূপ জানতে পারলে-‘
‘জানতে পারলে কি ভাবি? কিছুই হবে না। কারণ অনিরূপ জানবেই না এগুলো। তার আগেই আপনি ফিনিশ!’
‘মানে?’ -আশা ভ্রু কুচকালো।
‘মানে হচ্ছে, একটা ভাই তার ভাই হারানোর বদলা নিবে আজ।’
‘কি বলছ তুমি, তানিম?’ -আশার হতবম্ভ স্বর।
‘অমিত কে চিনেন ভাবি! চিনবেন না কেন, আলবাত চিনেন। আমি অমিতের ভাই, ফাহাদ, আপনাদের তানিম নই আমি।’
হাসতে হাসতে বলল তানিম। আশা তাকিয়ে আছে তানিমের ওই বিশ্রী হাসির দিকে। এই তানিমকেই অনিরূপ কতটা ভরসা করে, আশা নিজে কতবার দাওয়াত দিয়ে খাইয়েছে ওকে। অথচ কেউ জানতেই পারলো না, তানিম আসলে ছিলো ছদ্মবেশী?
ওর মনে কু ডাকছে বারবার। বারবার মনে হচ্ছে- ঘরে ওর ছোট মেয়েটা আছে, আর হাসপাতালে ওর অসুস্থ বর। আশা এবার রেগে বলল-‘আমাকে ছাড়ো তানিম, তুমি বারবার ভুলে যাচ্ছো আমি কার স্ত্রী।’
‘ছেড়ে দিব নাকি? সত্যি ছেড়ে দিব?’ —তানিম ভ্রু বাকিয়ে বলল।
আশা কড়া চোখে তাকাল, তানিম এবার হাসল। বলল-
‘ঠিকাছে, আপনার কথাই সই! আমি ছেড়ে দিচ্ছি।’ কথাটা বলে তানিম আচমকা আশাকে পেছন ফিরিয়ে ধাক্কা দিয়ে দীঘির জলে রীতিমিত ছুঁড়ে ফেলে দিল।
আশা জোরে চিৎকার করে উঠে পানিতে পরে গেল। সঙ্গেসঙ্গে দীঘির পানি হয়ে উঠল অশান্ত, ঢেউয়ের উপর ঢেউ খেলে গেল পানিতে। আশা সাঁতার জানে না, ও বারবার বারবার মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা করছে, ডাকছে-‘অনিরূপ, আপা, বা-বাঁচাও। আমাকে-বা-বাঁচাও।’
তানিম হাসছে। আশা উঠে আবারও তানিমের দিকে ফিরে বাঁচার জন্যে গিরগিড়াতে লাগল-‘তা-তানিম.. তা, আমার বাচ্চ-বাচ্চাটা ঘরে এক-একা…’
অনিরূপ সবে বাড়ি ফিরেছে, আজ ও ঢাকার বাইরে ছিলো। ফোনও চার্জ নেই।অনিরূপ বাড়ি এসে ফোন চার্জে লাগাল। আশা কোথায ? নিধির ঘর থেকে বাবুর কান্নার আওয়াজ পেলে ও ঘরে গেল অনিরূপ। নিধি বাবুকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা কিরছে। অনিরূপ নিধির কল থেকে বাবুকে কোলে নিলো। নিধি চোখের সামনে সম্পূর্ণ সুস্থ অনিরূপকে দেখে ভীষণ অবাক হলো, জিজ্ঞেস করলো-‘ভাইয়া, আপনার না গুলি লেগেছে?’
অনিরূপ ভ্রু বাকিয়ে তাকাল, বলল-‘কি বলছো এসব? আমার গুলি কখন লাগল?’
নিধি সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়াল ভারি পেট নিয়ে। অশান্ত হয়ে বলল -‘ভাইয়া আশাকে কে যেন কল করে বলেছে আপনার গুলি লেগেছে। আপনি হাসপাতালে ভর্তি, তাই ও আমার হাতে অনিশাকে দিয়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেছে। আশার কি কোনো বিপ—‘
অনিরূপ থমকে গেল নিধির কথাগুলো শুনে। তাহলে আজ সকাল থেকে অনিরূপকে বিভিন্ন নম্বর থেকে যেসব সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল, ওগুলো তাহলে—-
অনিরূপ কিছুক্ষণ নিধির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে পরপর মেয়েকে নিধির কোলে দিয়ে ছুটে গেল বাইরে।
অনিরূপ আশাকে ডাকতে ডাকতে এগুচ্ছে। ও পাগলের মতো হাসপাতালের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ দীঘি ওপাশ থেকে আশার মতো কারো গলা যেন শুনতে পেল। সঙ্গেসঙ্গে ও দাড়িয়ে গেল, তারপর আবারও ছুটে গেল দীঘির ওদিকে। তানিম দাড়িয়ে ছিলো পাড়ে, অনিরূপকে আসতে দেখে ও সঙ্গেসঙ্গে লুকিয়ে গেল।
অনিরূপের ডাক শুনে, আশা বারবার মাথা তুলে উঠার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। পানি খেতে খেতে ওর সারা গা ফুলে গেছে। চোখের সামনে অস্পষ্ট ভাবে ভাসে অনিরূপ ওর এদিকে এগিয়ে আসছে, আশা ডাকার চেষ্টা করে অনিরূপকে। কিন্তু ওর গলা থেকে কোনো আওয়াজ আসছে না। ও জোরে জোরে ডাকে, কেউ শুনে না ওর ডাক। অনিরূপ দীঘির পাড়ে আসার আগেই আশা নেতিয়ে যায়, পানি খেতে খেতে ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল ওই পদ্ম দীঘির জলে।
অনিরূপ পাড়ে এসে থামে, স্থির চোখে জায়গাটা দেখে। জায়গাটা আজ বড্ড নিরব, অবরোধের জন্যে আজ এখানে কেউ নেই। অনিরূপ আর ভাবে না কিছুই- সে সঙ্গেসঙ্গে নেমে পড়ে দীঘির জলে। দীঘির পানি এন ভিসজন ঠান্ডা। সাতরে কিছুটা দূর যেতেই পায়ে ধাক্কা খেলো কিছুর। কয়েকটা আঙ্গুলের মতো কিছু একটা যেন কামড়ে ধরল অনিরূপের পা। অনিরূপ ওটা কি দেখার জন্যে দ্রুত ডুব দিল। একটা সাপ ঘুরছে অনিরূপের পায়ের কাছে।
অনিরূপ আরও ডুবে নিচে যাবে, তার আগেই তানিম পেছন থেকে ডেকে উঠল-
‘এই অনি, পানিতে কি করিস তুই?’
অনিরূপ ডুব থেকে মাথা তুলল। তানিমকে একবার দেখেই ও অস্থির ভঙ্গিতে বলল-‘এখ-এখানে আশার কন্ঠ শুনেছি আমি। আমার আ-আশা—‘
‘আরে ভাবির মতো কাউকে তো দেখলাম মেইন রোড দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে দৌড়াতে যাচ্ছে। তোদের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে আবার?’
অনিরূপ কথাটা শুনে আবার একবার জলের দিকে তাকাল। ওর চোখ যেন সরছেই না জল থেকে। আরও কিছুক্ষণ থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে এখানে। তবুও আশার সেইফটির কথা ভেবে ও পানি থেকে উঠে গেল।
কিন্তু বোকা অনিরূপ বুঝতে পারল না, ওটা সাপ ছিলো না। আশার শেষ একবার বাঁচার জন্যে আঙ্গুল দিয়ে খামচে ধরেছিল স্বামীর পা-দুটো। পোউর আশা শেষ অব্দি ভেবেছিল ও বেচে যাবে।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। আশার মৃত্যু ওভাবেই লেখা ছিলো!অনিরূপ বুঝতেই পারল না যে যাকে ও পাগলের মতো খুঁজছে, অনিরূপ চাইলেই এখনো বাঁচাতে পারে ওকে।
কিন্তু অনিরূপ তখন আশার নিরাপত্তার ব্যাপারটা অস্থির হয়ে গেছে। আশেপাশে অনিরূপের শত্রুর অভাব নেই, কখন কি ঘটে যায়। তাই ও ভেবেছে কেউ অনিরূপের সঙ্গে শত্রুতার রেশ ধরে আসর ক্ষতি করে না বসে। অনিরূপ তাই দেরি না করে পানি থেকে উঠে ভেজা কাপড়েই মেইন রোডের দিকে ছুটে। মেয়েটাকে পেলে অনিরূপ এবার কষে একটা থাপ্পড় বসাবে, এবার আর বউ-ভালোবাসার ধার ধরবে না ও। কতবড় সাহস! অচেনা নাম্বার থেকে যে কেউ কল দিয়ে বললেই, দৌড় লাগাতে হবে?
অনিরূপ চলে যেতেই তানিম দীঘির পানির দিকে চেয়ে হো হো করে হেসে উঠে! পোউর বউয়ের পোউর স্বামী!
‘পদ্ম দীঘিতে ভেসে উঠেছে আরো একটি মেয়ের লাশ! লাশটির বয়স আনুমানিক ২৪/২৫ এর ঘরে। নারীর ব্যক্তিগত সম্পর্কে যা জানা গেছে- তিনি বিবাহিত, হাসব্যান্ডের নাম অনিরূপ শেখ জয়। তাদের একটি মেয়ে আছে, ছয় মাসের। তিনি ঢাকা শহরের ওয়েসিস হাসাপতাল এর সিইও উমায়েদ শেখ এর ঘরের বড় পুত্রবধূ।’
অবহেলায় টেবিলের উপর পত্রিকাটা পরে আছে।অনিরূপ পাথরের মতো বসে আছে খাটিয়ার পাশে।খাটিয়াটা মৃত আশার শরীরটাকে যে গিলে ফেলতে চাইছে।
এই খাটিয়ায় শুয়ে থাকা আশাকে আজ চেনাই যাচ্ছে না। অনিরূপ লাশ শনাক্ত করেছে নাকফুল দেখে। নাকফুলটা অনিরূপ প্যারিস থেকে ফেরার সময় এনেছিল, এমন ডিজাইন বাংলাদেশে এখন অব্দি পাওয়া যায়নি কোথাও।
আশার পুরো গা পানি খেয়ে ফুলে গেছে,অনেকক্ষণ পানিতে থাকায় কুচকে গেছে আশার যৌবনের শক্ত চামড়া, পুরো গা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। অনিরূপের পাশে নিধি কোলে নিয়ে বসে আছে অনিশাকে। অনিশা কাঁদছে, ঘরে এত মানুষের ভিড়ে ওর গরম লাগছে। ঘেমে যাওয়ায় নিধি জামা খুলে দিয়েছে অনিশার। এই ছোট মেয়ে গরমে কাঁদছে , অথচ ও যে জীবনে কি হারিয়ে বসলো সেটা তো জানতেই পারলো না এই ছোট মেয়েটি। বড় হবে যেদিন, সেদিন বুঝবে মা হারানোর কি রক্তচোষা শূন্যতা। অনিরুপ আশার ওই কুচকে-ফুলে যাওয়া হাতটা ধরে বসে আছে। ওর চোখ দুটো লাল, চোখে পানি নেই একদম। ও নির্জীব মানুষের মতো অপলক দেখছে তার সাধের-বড় শখের মৃত বৌটাকে।
অনিরূপ কাঁদছে না দেখে ওয়াহিদা ছেলের বাহুর কাছে থাপ্পড় বসিয়ে ঝাকাতে লাগলেন ছেলেকে—
‘অনি, কাদো আব্বা, কেঁদে হালকা করো নিজেকে। অনি, এই অনি!’
অনিরূপ কথা বলে না। ও একটি পর পাথরের মতো শুধু এটুকু বলল-‘
‘মা, ওটা সাপ ছিলো না, মা। ওটা আমার আশা ছিলো, আমার আশা।’
বলতে বলতে মৃত আশার খাটিয়ায় মাথা ঠেকিয়ে অনিরূপ আচমকা হু হা করে কেঁদে উঠে। আশেপাশের সবাই দেখে, একজন শক্ত, দেমাগী পুরুষের কি নির্মম ভাবে ভেঙ্গে পড়া, ভেঙ্গে গুড়িয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়া অনিরূপ আশার ফুলে যাওয়া ওই শরীরটা এবার চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে।বাবার কান্না দেখে অনিশা নিজে কান্না বন্ধ করে বড়বড় চোখে বাবাকে দেখছে। মেয়ের খাটিয়া চেপে ধরে চিৎকার করে কাশছেন আব্দুর রহমান! তার ছোট মেয়ে, তার ছোট আম্মু! নিধি কোলে থাকা আশার শেষ চিহ্ন, ওর মেয়েকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে কেঁদে উঠেছে। অরূপ পাশে বসে চোখের জল ফেলছে। ওয়াহিদা ছেলের হাতের টিশার্ট খামচে ধরে শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠেছেন। পাশে উমায়েদ। সবার চোখে আজ জল! শেখ বাড়ির এই সুন্দর সম্পর্কগুলো আজ একেবারে শেষ, নিঃস্ব। এখন থেকে শেখ মহলে কেউ উৎসব উদযাপন করবে না। শেখ মহল অবশেষে পরিনত হলো ‘ডেড হাউজ’ এ !
অনিরূপের কান্না থামছে না, ও আশাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে পাগলের মতো ব্যবহার করছে। আশার নষ্ট হয়ে যাওয়া ওই মুখে পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে। আর বলছে-
‘আমি তোমাকে এভাবে কেন হারিয়ে ফেললাম আশা! সোনা, উঠো। আমাদের মেয়েটার কি হবে?আমাদের মেয়েকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন! আশা, শুনো তুমি? আমি তোমকে হারিয়ে ফেললাম আশা।আমাকে এভাবে অপরাধবোধে ডুবিয়ে তুমি এভাবে কেন চলে গেলে? আশা, আমাদের কি হবে?আমাদের মেয়ের এবার কি হবে? সোনা, প্লিজ উঠো! আমি তোমাকে এভাবে দেখতে পারছি না। আশা, আমার আশা, আশাআআ।’
অনিরূপ চিৎকার করে উঠেছে আবার। অনিশা বাবার এমন চিৎকারে নিজে এবার গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠে। অন্যবারের মতো এবার অনিরূপের কানে গেল না মেয়ের কান্না। ও নিজের মধ্যেই নেই। ও নেই নিজের মধ্যে আর। কি থেকে কি হয়ে গেল! অনিরূপের সোনার সংসারটা, সোনার বউ! সবটাই জলে ডুবে গেল। ওই দীঘির জল অনিরূপকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল।
তারপর কেটে গেছে, অনেকটা বছর! আজ অনিশাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। অনিরূপ আজ সকাল থেকে ঘরবন্দি হয়ে নিজের ঘরে বসে আছে। অনিশাকে তৈরি করে দিচ্ছে নিধি-অরূপের মেয়ে ধারা। অনিশা আয়নার সামনে বসে আছে। ধারা অনিশার কপালে শেষ সাজস্বরূপ টিপটা লাগিয়ে দিয়ে বললো-‘উফ, অপু! তোকে এত্ত জোস লাগছে। আজ পাত্র এর মাথা ঘুরাবে নির্ঘাত।’
অনিশা মলিন হাসল। ও এসব সাজ ভালো লাগছে না আজ একদম। কোথাও যেন কিছু একটা নেই! কি নেই? অনিশার মাম্মাই তো নেই, কখনো ছিলই না অনিশার সাথে।
ওদের সাজুগুজুর মধ্যে নিধি খাবার নিয়ে রুমে এলো। অনিশাকে তৈরি দেখে নিধি হেসে অনিশার কানের পেছনে কাজল লাগিয়ে দিয়ে বলল-
‘আমাদের সোনাটাকে তো আজ খুব সুন্দর লাগছে: গড ব্লেস ইউ মা।’
অনিশা শুনল, তারপর আচমকা জিজ্ঞেস করে বসে-
‘ছোটমা? আমার মাম্মাকে বিয়ের দিন কেমন লেগেছিল? আমার মতোই নাকি এর চেয়েও বেশি সুন্দর এন্ড প্রিটি লেগেছে?’
নিধি অনিশার মুখে এ কথা শুনে অবাক হলো। ধারা মায়ের দিকে একবার চেয়ে আবার বোনের দিকে তাকাল। নিধি এবার হাসল। প্লেটের খাবার নিয়ে অনিশার পাশে এসে বসে বললো—‘আমার ছোট বোন অনেক সুন্দর ছিলো দেখতে। ঠিক আমার ছোট মায়ের মতো। দেখি হা করো। খেতে খেতে বলছি।’
অনিশা হা করে। নিধি খাইয়ে দিতে দিতে বললো –
‘আশা- একদম জেদী, প্রতিবাদী, একরোখা মেয়ে ছিলো। তোমার ছোটমা এর পুরো বিপরিত। ও কখনো কঠিন পরিস্থিতিও ভেঙ্গে পড়তো না।তোমার পাপাকেও নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতো রীতিমত। তোমার পাপাকে তো বিয়ে করতে একদম রাজি ছিলো না তোমার মাম্মা। তারপর কি যেন হল একদিন, আশা রাজি হয়ে গেল তোমার পাপাকে বিয়ে করতে। বিয়ের দিন তোমার মাম্মাকে পরীর মতো দেখাচ্ছিলো; একটা মলিন, অনুজ্জ্বল পরী। তবে তোমার পাপা ছিলেন সুপার ম্যান! সে ঠিকই ওই মলিন, অনুজ্জ্বল পরীকে জয় করে নিয়েছিল। তোমার পাপা-মাম্মার সুখের একটা সংসার হয়েছিল। সেই সুখের সংসারে ভালোবাসা হয়ে এলে তুমি। দুজনের পুরো দুনিয়া সেদিন তোমাকে ঘিরে বদলে গেল। দুজনের জান হয়ে গেলে তুমি।
‘তারপর—‘ -অনিশার আগ্রহী প্রশ্ন।
নিধি এবার কিছুটা থামল।ঢোক গিলে কান্না আটকে ধীরে ধীরে বলতে লাগলো-
‘তারপর তাদের এই সুখের সংসারে এক ইবলিসের নজর পড়ল! ইবলিস ওর বিশ্রী থাবায় তছনছ করে দিল তাদের সুখের সংসার। পরি হারিয়ে গেল আকাশে, পরির বেবি-স্বামী সবাইকে ছেড়ে চলে গেল নিজের মতো করে।’
‘ওই ইবলিস কে ছিলো ছোটমা? ওর কি শাস্তি হয়েছে?’-অনিশা এবার কাঁদোকাঁদো মুখে বলে উঠল। প্রতিবার একই গল্প শুনে অনিশা, প্রতিবারই ও একই প্রশ্ন করে। নিধিও একই উত্তর দেয় । এবারেও তাই-
নিধি মলিন হাসলো, বলল-‘ ওই ইবলিসের শাস্তি হয়েছে মা। কঠোর শাস্তি! মৃত্যুর সময় ওর মুখটাই দেখার অবস্থাতে ছিলো না। ভীষণ বর্বর ভাবে মৃত্যু হয়েছিল ওই ইবলিসের।’
‘কে মেরেছিল ওই ইবলিসকে? -অনিশার অবাক গলা।
‘তানিমকে মেরেও তোমার কেন শান্তি হচ্ছে না ভাই?’
অরূপ অনিরূপের কাঁধে হাত রেখে অধৈর্য্য ভঙ্গিতে বলে উঠলো। অনিরূপ বড়বড় শ্বাস ফেলে দুহাতে নিজের মুখটা চেপে ধরে বলল-
‘আমি ওপারে আশাকে নিজের মুখটা দেখাতে পারব না অরূপ। কোনোদিনও না। আমি ওকে শুরু থেকে ধোঁকা দিয়েছি। ওকে জাস্ট নিজের একটা গেইম হিসেবে দেখেছি। ওর সঙ্গে বেইমানি করেছি। একটা বিশ্রী গেইম খেলে, ম্যানুপুলেট করে বিয়েটা করেছিলাম ওকে। সবকিছুর শাস্তি আমি পাচ্ছি এখন।’
অনিরূপ এবার থামি। ও মুখ তুলে অরূপের দিকে চায়, ওর অ্যাডামস অ্যাপেল কেপে উঠে কান্না আটকানোর কারণে। অনিরূপ শ্বাস আটকে, বলল——‘কিন্তু অরূপ, সবকিছুর পরে আমার ভালোবাসাটা খাঁটি ছিলো। আমি আশাকে শেষ অব্দি আর গেইম হিসেবে দেখিনি। আমি ওকে ভালবেসেছিলাম, সত্যি সত্যি। কিন্তু আল্লাহ আমার সঙ্গে এটা কি করে ফেললেন অরূপ?’
অনিরূপের হাহাকার গলা। অরূপের চোখে জল! ও নিজেকে সামলাতে পারে না আশার কথা উঠলে। অনিরূপ কি করে সামলায় নিজেকে?
অনিরূপ আবার বলে-
‘আমি কি এত শাস্তি আদৌ ডিজার্ভ করি, অরূপ? হয়তো করি! কিন্তু শাস্তিটা আমাকে আমার কলিজাকে খুন করে কেন দেওয়া হলো? আমি নিশ্চয়ই এত বিশাল শাস্তি ডিজার্ভ করিনা। আমাকে মেরে ফেলতেন উনি, আমার আশাকে কেন? আমার মেয়েটা আমার জন্যে আজ মা হারা হয়ে গেল। ও বুঝলই না ওর মা ওকে কতটা ভালোবাসতো! ও মায়ের মুখটা মনে রাখতে পারলো না। আজ আমার দোষে আমার নিষ্পাপ মেয়ে ভুগছে! কেন বল তো?’
অনিরূপ কথাটা বলতে বলতে কান্না আটকে রেখেছে। যার দরুন শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল ওর। অরূপ দ্রুত ইনহেলার এগিয়ে দিল ভাইয়ের দিকে। অনিরূপ ইনহেলার টানল!
অরূপ বললো-
‘ভাই, আজ এসব ভেবে আজ মন খারাপ করিস না। আজ অনিশার জন্যে কত বড় দিন। একটু স্বাভাবিক হ ভাই। মেয়েটার কথা একটু ভাব, ও তোকে এবাবে দেখলে ভালো থাকবে আজ?’
মেয়ের কথা ভেবেই অনিরূপ এতকাল জীবিত আছে। নাহলে আজকাল কে না মনের অসুখে সুইসাইড করে। কিন্তু অনিরূপ তো আর স্বার্থপর হতে পারে না। মা নেই ওর মেয়ের, এখন জদি বাবাও ছেড়ে চলে যায় ওর মেয়েটা কই যাবে?
অনিরূপ স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো-‘আমি তৈরি হয়ে আসছি, তুই যা।’
অরূপ বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখে অনিশা দাঁড়িয়ে আছে। অরূপ অনিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেল। অনিশা শাড়ি গায়ে ঘরে ঢুকে দেখে অনিরূপ চোখের জল মুছছে লুকিয়ে। অনিশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল-
‘এগেইন পাপা? উফ..তুমিও না. এখনো বাচ্চাদের মতো কাঁদো।’
অনিরূপ হাসার চেষ্টা করে বললো-
‘শাড়িতে তোমাকে বড় বড় দেখাচ্ছে আম্মু।’
অনিশা শাড়ির দিকে একবার চেয়ে খুশিখুশিভাবে বললো-‘এটা নাকি মাম্মার শাড়ি, ছোটমা আমাকে পরিয়ে দিয়েছে। আমাকে সত্যি ভালো লাগছে পাপা?’
অনিরূপ হাসে! অনিশা বলতে গেলে আশার কার্বন কপি. মেয়েকে দেখে এইজন্যে অনিরুপ আশার দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারে। অনিরূপ হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল-
‘আম্মু, তোমাকে আজ একদম তোমার মায়ের মতো দেখাচ্ছে, সো এডরেবল এন্ড টু মাচ বিউটিফুল!’
অনিশা হাসল! তারপর আলমারি থেকে অনিরূপের জন্যে স্যুট, কোর্ট বের করে দিয়ে বিছানায় রেখে বললো-
‘ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসো, রেডি হবে। গো কুইক!’
অনিরূপ হাসল; একদম আশার মতো করে কথাও বলে মেয়েটা।অনিরূপ মেয়ের কথামত ফ্রেশ হয়ে এলো। তারপর অনিশা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে অনিরূপকে রেডি করিয়ে দিল!
পাত্রপক্ষ চলে যেতেই অনিশা রেগেমেগে নিজের রুমে চলে এলো। বাড়ির বাকিরা অবাক হয়ে গেল শান্ত-শিষ্ঠ অনিশার এমন ব্যবহারে। অরূপ অনিরূপের দিকে তাকাতেই, অনিরূপ ঢোক গিললো। তারপর হেঁটে চললো মেয়ের ঘরের দিকে!
অনিশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে! অনিরূপ গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াল। অনিশার চোখে-মুখে রাগ ভেসে উঠেছে! অনিরূপ সেটা দেখে জিজ্ঞেস করলো-
‘পাত্র পছন্দ হয়নি, আম্মু?’
অনিশা রেগে তাকাল অনিরূপের দিকে, মারাত্মক লাল মুখ নিয়ে বলল- ‘ হি ইজ সাচ অ্যা পাভার্ড, পাপা। আমাকে কি বলেছে জানো? আমি আমার বডি কাউন্ট কত? এন্ড সে আমাকে একা পেয়ে আমার সঙ্গে অসভ্যতা করার চেষ্টা করেছে। তুমি এক্ষুনি এই বিয়েতে মানা করবে। রাইট নাও!’
অনিরূপ থমকে গেল! ও নির্জীব চোখে মেয়েকে দেখতে থাকল! মনে পরে গেল, নিজের অতীতের কিছু খারাপ স্মৃতি! অনিরূপ সঙ্গেসঙ্গে মেয়েকে বুকে টেনে নিল, মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অস্থির ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বললো-
‘না, না! তোমার কপালে যেন আল্লাহ কোনো অনিরূপ না রাখে আম্মু, কোনো অনিরূপ না রাখে। আমি তোমার মায়ের কাছে কোনো জবাব দিতে পারব না। অনিরূপরা কখনো ভালো হয়না। অনিরূপরা ভিলেন, একটা মেয়ের লাইফে ওরা ঝড় হয়ে আসে, অনিরূপরা ওই মেয়ের জীবন লণ্ডভণ্ড করে ফেলে আম্মু. তোমার জীবনে আমি অনিরুপ চাইনা, কখনো কোনো অনিরূপ আসুক!নো, নেভার।’
অনিশা শোনে না বাবার বিড়বিড় করে বলা কথা। ও বাবার বুকের সঙ্গে আদুরে ভঙ্গিতে মিশে থাকে!
~ ‘KARMA IS A BITCH’, কথাটা একদম সত্য! তুমি যার জীবনে ঝড় হবে, কার্মা তোমাকে সেই একই ঝড় ফিরিয়ে দিবে. কর্মা প্রতিশোধ নিতে পছন্দ করে। কর্মা রুষ্ট হয়, ওর উপর বিচরণ করা কারো সঙ্গে অবিচার হলে, কাউকে আশার মতোই গোড়া থেকে ভেঙ্গেচুরে দিলে।
নিজের সঙ্গে করা অন্যায় নরম স্বভাবের আশারা হয়তো ক্ষমা করে দিতে পারে, কিন্তু কার্মার মন পাথর, সে ক্ষমা করে না কখনোই! বরং ফিরিয়ে দেয় তার থেকেও দ্বিগুণ রূপে! কেউ কেউ কার্মার প্রতিশোধ দাত কামড়ে সহ্য করে ফেলে, তো কেউবা অনিরুপের মতো বেঁচে থেকেও মরে যায়।
দীঘির জলে কার ছায়া পর্ব ৩২
ভিলেনদের হারাতে সবসময়ই হিরো কিন্তু আসে না, মাঝেমধ্যে কার্মার মতো কিছু নিজের এক থাবায় ভিলেনদের সম্পূর্ণ সাজানো গোছানো জীবন তছনছ করে ফেলে! কিন্তু এই শোধ-প্রতিশোধের খেলায় মাঝেমধ্যে ঝড়ে যায় আশার মতো নিষ্পাপ কিছু জীবন, কিংবা জীবনে একা করে ফেলে অনিশার মতো নিষ্পাপ কিছু সন্তানদের!
কর্মা বড়ই নিষ্ঠুর, বর্বর! অনিরূপদের উচিত- সময় থাকতে নিজেকে শুধরে ফেলা, নাহলে আবারো—‘KARMA IS A BITCH’