দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫১

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫১
তাসফিয়া হাসান তুরফা

—আব্বা, আপনি কিছু বলছেননা কেন নিশীথকে? দেখুন না কিভাবে কথা বলছে বাবা-ছেলে! ঘরের মাঝে এমন কথা-কাটাকাটি কি ভালো দেখায়? আপনি কেন থামাচ্ছেন না এ ঝগড়া?
আসমা বেগম শশুড়ের কাছে মিনতি করেন। না তিনি পারছেন নিশীথকে থামাতে, আর না-ই তিনি পারছেন আয়মান সাহেবকে কিছু বলতে। অবশ্য তিনি বললেই যে আয়মান সাহেব তার কথা শুনবেন- এমনটা না! তাই ইচ্ছে করেই তাকে কিছু বলছেন না। উনাকে বলা আর না বলা একি কথা! আসমা বেগমের প্রশ্নে ইউনুস সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

—আমি নিশীথকে কিভাবে আটকাতে পারি, বৌমা? যেখানে প্রসঙ্গ ওর বউয়ের, সেখানেই আর দশটা স্বামীর মতো নিশীথ কথা বলবেই। এটা স্বাভাবিক।
—আই কান্ট বিলিভ দিস! তুমি ওর বেয়াদবিকে আস্কারা দিচ্ছো, আব্বা?
—নিজের বউয়ের সম্মান রক্ষায় কথা বলা যদি বেয়াদবি হয়, তবে আমি স্বেচ্ছায় বেয়াদব হতে রাজি। তবু আমার দোলনচাঁপাকে নিয়ে একটা উল্টাপাল্টা কথা বলার অধিকার আমি কাউকে দেইনি, দেবোওনা। এটা সবাই ভালোমতো শুনে রাখো। আর খালামনি তুমি, ফার্দার আমার বউকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা। কথাটা মনে রেখো!

বাপের কথার বিপরীতে একপ্রকার হুংকার দিয়ে বলে উঠলো নিশীথ। একিসাথে সরাসরি সালমা বেগমকে হুমকি দিয়ে বসলো। নিশীথের কথায় অপমানবোধে লালচে হয়ে এলো সালমা বেগমের মুখ। বোনের কাছে এগিয়ে গিয়ে চড়া গলায় বললেন,
—বাহ আসমা। ভালো শিক্ষা দিয়েছিস তোর ছেলেকে। মায়ের বড় বোনের সাথে কিরকম ব্যবহার করতে হয় খুব ভালোভাবেই শিখিয়েছিস! যাকে ছোটবেলা থেকে এত আদর-যত্নে বড় করলাম তার মুখে এমন কথা শুনতে হবে কল্পনাও করিনি।
খানিকটা থেমে বললেন,

—আমি কি এমন খারাপ কিছু বলেছি শুনি? শুধু বলেছিলাম দোলাকে সামলে রাখতে। কিন্তু তোর ছেলের সেটাও সহ্য হলোনা। না জানে কি জাদুটোনা করেছে এ মেয়ে নিশীথের উপর!
আসমা বেগমের অভিনয়ে আর কেউ না গললেও বিচলিত হতে দেখা গেলো আয়মান সাহেবকে। ফোস ফোস করতে করতে বললেন,

—সালমা ঠিকি বলেছে। সব এই মেয়ের দোষ। ওর জন্যই এত অশান্তি। যেদিন থেকে এসেছে ওদিন থেকেই কিছু না কিছু লেগেই আছে এ বাসায়। এর চেয়ে লিরাকে বিয়ে করে আনলে ভালো হতো!
—হ্যাঁ, মেয়েটা আমাদের স্ট্যাটাসের ছিলো! একটা সামঞ্জস্য হতো!
সালমা বেগম ফোড়ন কাটেন। নিশীথ অতীষ্ঠ ভংগিতে বলে,

—কি স্ট্যাটাস স্ট্যাটাস শুরু করেছো তোমরা হ্যাঁ? মানুষের চেয়ে কি বংশ মর্যাদা বড় হয়? আল্লাহ তোমাকে আমাকে যেভাবে বানিয়েছেন আর সবাইকেও সেভাবেই বানিয়েছেন। বাবা, তোমার মনে আছে একবার ছোটবেলায় আমি এক দারোয়ানের সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলাম? তখন তুমিই আমায় শিখিয়েছিলে যে আর্থিক অবস্থা দিয়ে কখনো মানুষকে বিচার করতে হয়না, তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে হয়না। তুমি বলেছিলে, দাদু এক সময় কতই না কষ্ট করে আমাদের এ ব্যবসা দাড় করিয়েছিলো! সে সময় আমার দাদি তার পাশে থেকে সাপোর্ট না করলে কি এসব সম্ভব হতো? এসব গল্প তো আমি, ভাইয়া তোমাদের মুখেই শুনে আসছি ছোটবেলা থেকে। আর আজকে আল্লাহর রহমতে আমাদের অবস্থা এতটা উপরে হওয়ায়, তুমি নিজেই নিজের দেওয়া শিক্ষা ভুলে গেলে?

নিশীথ আহত গলায় প্রশ্ন করে। বাবার প্রতি আগে থেকেই অনেক অভিমান ওর মনে। সেসব কি কম ছিলো যে এখন ওর ভালোবাসাকেও অপমানিত হতে হবে বাবার কাছে? এতদিন পর নিশীথের মুখে “তুমি” সম্বোধন শুনে ওর কথায় আয়মান সাহেব অতীতে ফিরে গেলেন, বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মাটির দিকে। একিসাথে ইউনুস সাহেবও নাতির কথায় পুরনো স্মৃতি মনে করেন। এদিকে সালমা বেগম দোলনচাঁপার কাছে গিয়ে বলেন,
—খুশি হয়েছো তুমি? বাবা-ছেলের মাঝে এমন ভেজাল লাগিয়ে? এসব করার জন্যই তো এখানে এসেছিলে তাইনা? আলাদা করতে চাও নিশীথকে ওর পরিবার থেকে!

—আমি কেন উনাকে তার নিজের পরিবার থেকে আলাদা করতে চাইবো, খালামনি? কি লাভ হবে আমার এসব করে? আপনি কতটুকুই বা চেনেন আমাকে? আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেশুনে আর কত ভিত্তিহীন অপবাদ দেবেন আমায়? বরং, এখানে দোষ তো আপনার। আপনি যদি আমাকে অপমান না করতেন তবে এতকিছু হতোইনা।
এবার দোলা জবাব দেয়। এতক্ষণ নিজের নামে উল্টাপাল্টা কথা শুনে বহু ধৈর্য ধরেছে। নিশীথ একাই ওর হয়ে সবাইকে জবাব দিয়েছে। এবারো যদি দোলা চুপ থাকে তবে নিশীথের প্রতিবাদকে অপমান করা হবে। তাই দোলা কড়া গলায় নিজের পক্ষে জবাব দেয়! ওর কথায় সালমা বেগমের প্রচণ্ড রাগ হয়। রে’গে যেই না দোলার গায়ে হাত তুলতে যাবেন ওমনি নিশীথ এসে ওনার হাত ধরে বাধা দেয়! দু’চোখে ক্রোধের আগু’ন ঢেলে বলে,

—এতক্ষণ ধরে এতকিছু বলার পরেও তুমি আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলছো? কে দিয়েছে এই অধিকার তোমাকে? হু গেভ ইউ দ্যা রাইট টু টাচ হার?
—নিশীথ, আমি…
—কিচ্ছু শুনতে চাইনা আমি। নিজের ভালো চাইলে তুমি এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যাও, খালামনি। নয়তো আমি এমন কোনো বেয়াদবি করবো যা তুমি বা আমি কেউ পছন্দ করবোনা।
—আমার কথাটা শোন…
—প্লিজ লিভ ফ্রম হেয়ার! রাইট নাও!

নিশীথের হুংকারে মনে হলো যেন তালুকদার বাড়িও কেপে উঠবে! সালমা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। চুপচাপ দ্রুতপায়ে রুমে গিয়ে নিজের লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তার পিছু পিছু একপ্রকার দৌড়ে আসমা বেগমও নিচে নামলেন। আয়মান সাহেব একধ্যানে সেদিকে চেয়ে রইলেন। কিছু বলবেন বলবেন করেও মুখ খুললেন না! নিশীথ কারও সাথে কোনো কথা না বলে সরাসরি দোলার কাছে গেলো। পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

—রুমে যাও।
—আর আপনি?
দোলা জিজ্ঞেস করলো।
—আমার চিন্তা করতে হবেনা। আমার কাজ আছে। আমি আসছি একটুপর। তোমায় যা করতে বলেছি সেটা করো!
—কি কাজ আছে আপনার? প্লিজ রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু করবেন না! মাথা ঠান্ডা করুন!
দোলা নিশীথকে বুঝানোর চেষ্টা করলো। ইউনুস সাহেব ও আরেফিন সাহেব দূর থেকে দুজনের এসব কথাবার্তা দেখে মুচকি হেসে ড্রয়িংরুম থেকে প্রস্থান নিলেন। তাদের সাথে নিশীথের চাচিও বেরিয়ে গেলেন। সবাই যেতে নিশীথ দোলাকে তাড়া দিয়ে বললো,

—আমি বাবার সাথে একাকী কিছু কথা বলতে চাই, দোলনচাঁপা! প্লিজ আর কথা বাড়িয়োনা। রুমে যাও!
নিশীথের চাপা ধমকে দোলা সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেলো রুমের উদ্দেশ্যে। মূলত ও ভয়ে আছে, নিশীথের এমন রুদ্ররুপ দেখে। কখন যে ওর উপরও ক্রো’ধাগ্নি বর্ষণ হয় কে জানে? তাই দোলা রিস্ক নিলোনা। কোনোরুপ কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ প্রস্থান করলো বসারঘর থেকে।
দোলা যেতেই বাপের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকালো নিশীথ। আয়মান সাহেব ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। ওকে দেখে এগিয়ে এলেন। নিশীথ গম্ভীর স্বরে বললো,

—আপনার সামনে বাইরের একজন এসে আপনার বউকে অপমান করলে আপনি কি করতেন?
—তোমার মা-কে কেউ অপমান করবে কেন? ওর মধ্যে অপমান করার মতো কিছু আছে?
আয়মান সাহেব পাল্টা প্রশ্ন করলেন। জানেন ছেলে মা-কে নিয়ে কিছু বলতে পারবেনা তাই ইচ্ছা করেই তার এ চালাকি। নিশীথ তবু দমলোনা। শুধু শান্তস্বরে বললো,

—আমার মা-কে নিয়ে আমি কিছু বলিনি। আপনি ভুল বুঝলেন। আমি শুধু বলেছি, আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে দেখুন। আপনার ভালোবাসার মানুষকে আপনার চোখের সামনে কেউ অপমান করলে আপনি কি করতেন?
নিশীথের প্রশ্নে আয়মান সাহেবের চোখমুখ দৃশ্যমান ভাবে শক্ত হয়ে এলো। নিশীথ তা স্পষ্ট খেয়াল করলো, করে অবাকও হলো। কিন্তু এমনটা হওয়ার কারণ ধরতে পারলোনা। কেননা, ওর মায়ের প্রতি আয়মান সাহেবের এমন অনুভূতি আছে ও বিশ্বাস করেনা! তবে নিশীথ ধরতে না পারলেও আয়মান সাহেবের কিছু একটা হলো! উনি মুহুর্তের মাঝেই কেমন যেন উ’গ্র হয়ে উঠলেন। নিশীথ কিছু বুঝার আগেই গর্জে উঠে বললেন,

—এইযে ভালোবাসা ভালোবাসা বলে ডায়লোগ দিচ্ছো, ভালোবাসা নিয়ে কতটুকু ধারণা আছে তোমার? এই বয়সে সবাই এমন আবেগে চলে। এসব আবেগ-ভালোবাসা দিয়ে দুনিয়া চলেনা। কিন্তু তুমি তো তোমার মায়েরই ছেলে, আমার মতো হতে পারলেনা। তোমায় আমি প্র‍্যাক্টিকাল বানাতে চেয়েছিলাম, তুমি সেই ইমোশনাল ফুল-ই হয়েছো।
—আপনি প্র‍্যাক্টিকাল হয়েও বা কি করলেন? আমি তো ছোট থেকেই দেখে আসছি আপনার সাথে থেকে আমার মা তো সারাজীবন কষ্টই পেলো। তবে কি লাভ এমন সাকসেসফুল জীবনের যেখানে নিজের লাইফ পার্টনারকে খুশিই রাখা যায়না?

—নিশীথ! বড্ড বেশি কথা বলছো। দুদিনের ভালোবাসা পেয়ে খুব বাড় বেড়েছে তাইনা? ভুলে যেয়োনা তুমি যাকে বিয়ে করেছো সে একটা ছোটলোক। আজ তোমার টাকা আছে দেখেই ও তোমার সাথে খুশিতে আছে। দুদিন অভাবে পড়লেই দেখবে এসব আবেগ-ভালোবাসা জানলা দিয়ে পালাবে। তোমার খালা কোনো ভুল কথা বলেনি! আমরা দুনিয়া দেখেছি বলেই এসব বলছি!

এবার বাবার কথা শুনে নিশীথের সমস্ত ধৈর্যশক্তি এক লাফে জানলা দিয়ে পালালো। এতক্ষণ বাইরের মানুষ অপমান করায় ওর অতটা গায়ে না লাগলেও এবার নিজের বাপ অপমান করায় নিশীথের ভীষণভাবে ইগোতে লাগলো। ও কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ থেকে কিসব যেন ভাবলো! আয়মান সাহেব মনোযোগ দিয়ে ছেলের হাবভাব দেখলেন। কিছুক্ষণ বাদে বড়সড় এক শ্বাস নিয়ে নিশীথ বাপের দিকে এগিয়ে এলো। চোখে চোখ রেখে বললো,
—বেশ তবে! আপনার ধারণা আমি ভুল প্রমাণ করেই দম নেবো।
—মানে? কি বলতে চাইছো? ক্লিয়ার করে বলো।

আয়মান সাহেব দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে শুধালেন। নিশীথ যেন নিজের মাঝে নেই। আপাতত ওর চোখেমুখে অন্য রকমের শীতলতা বিরাজমান করছে। ও শীতল দৃষ্টি বাপের দিক চেয়ে বললো,
—যে বাসায় আমার বউকে সবার সামনে যখন তখন অপমানিত হতে হবে, সে বাসায় আমি আর থাকতে পারবোনা।
—মাথা ঠিক আছে তোমার? কোথায় যাবে তুমি?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫০

আয়মান সাহেব ভড়কে উঠে বললেন। নিশীথকে এখনো বেশ শান্ত দেখা গেলো। যেন বেশ ভেবেচিন্তে বলছে সেভাবেই উত্তর দিলো,
—যেখানেই যাই না কেন, আমি এজ সুন এজ পসিবল দোলাকে নিয়ে আলাদা বাসায় শিফট হবো!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here