দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫৩

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫৩
তাসফিয়া হাসান তুরফা

আকাশদের বাসা নিশীথদের পাশের এলাকায়। ওদের বিল্ডিংয়ের তিনতলা খালি হওয়ায় আপাতত সেখানেই উঠেছে নিশীথ-দোলা। কাল সবাইকে বাড়ি ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে আজকেই এ বাসায় উঠা শুনতে অনেকটা নাটকীয় মনে হলেও নিশীথ দোলার জীবনে আজ এটাই নির্মম বাস্তবতা। দোলার এখনো মনে পড়ছে বাসা থেকে বেরোনোর আগে নিশীথ কিভাবে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিলো, নিজের রুম থেকে বেরোনোর আগে প্রত্যেকটা জিনিস ছুয়ে দেখছিলো! কে বলেছে ছেলেদের মাঝে ইমোশন কম? তাদের মাঝেও আবেগ আছে, শুধু ক্ষেত্রবিশেষে ওরা প্রকাশটা কম করতে পারে!

দুই কামরা বিশিষ্ট ছোটখাটো বাসা। একটা কিচেন, এটাচড বাথরুম আর ছোটখাটো ডাইনিং স্পেস। এই যা! নিশীথদের বাসার সাথে তুলনা করলে এটা কিছু না হলেও এ মুহুর্তে এত শর্ট নোটিসে যা পেয়েছে তাতেই দুজনে সন্তুষ্ট। দোলা বাসায় ঢুকেই স্বভাবগত কারণে কোমড়ে ওড়না পেচিয়ে ঝাড়ু হাতে লেগে রুম পরিষ্কার করতে লেগে গেছে। নিশীথের কথায় ওর বন্ধুরা আপাতত সংসারে টুকিটাকি যা যা দরকার তা এনে দিয়েছে। এমনকি আজকের খাবারটাও আকাশের মা পাঠিয়ে দেবেন ওদের জন্য! দোলার পরিষ্কার কর্মসূচির শেষ হওয়ার মাঝেই নিশীথ গোসল করে বের হলো। ভ্যাপসা গরমে মাথা ব্যাথা করছিলো খুব, গোসল করে একটু আরাম পাওয়া গেলো। এরই মাঝে বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। নিশীথ রুম থেকে বেরোতেই দেখলো দোলা গেট খুলতে যাচ্ছে। ওকে থামিয়ে সে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—তুমি দাড়াও, আমি দেখছি কে!
নিশীথের কথায় পেছন ফিরে দোলা থেমে গেলো। মাথায় কাপড় দিয়ে সরে গেলো দরজার সামনে থেকে। নিশীথ এগিয়ে এসে দরজা খুলতেই আকাশকে দেখতে পেলো।
—ভেতরে আসবো, ভাই?
—আরে আয়!
নিশীথ সরে দাঁড়াতেই আকাশ প্রবেশ করলো ভেতরে। দোলাকে সালাম দিতেই ও হেসে সালামের জবাব দিলো। ওর পাশে ঝাড়ু দেখে আকাশ বললো,

—তোমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে এখানে এসে, তাইনা ভাই? আসলে অনেক শর্ট নোটিসে জানিয়েছো তো তাই ঘর পরিষ্কারও করে দিতে পারিনি। সরি, ভাবি!
দোলা লজ্জিত হয়ে বললো,
—আপনি সরি বলছেন কেন, ভাইয়া? আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছেনা। নিজের বাসা তো পরিষ্কার করতামই। আমার অভ্যাস আছে!
—হ্যাঁ, দোলা ঠিক বলেছে। অযথাই ভাবছিস তুই। আমার তো তোকে থ্যাংকস দেওয়া উচিত আমার এক কথায় তোর বাসায় উঠার সব ব্যবস্থা করে দেওয়ার…

—ধুর নিশীথ ভাই, পাগল হয়ে গেলে নাকি? তুমি কি আমার জন্য কম করেছো? এটা তো কিছুই না। ভাবির কষ্ট না হলেও তোমার জন্য থাকাটা কষ্ট হবে আমি জানি। আমি উল্টো তোমার চিন্তা করছি!
আকাশের কথায় ইষত হেসে নিশীথ ওর কাধে হাত রাখে। আড়চোখে দোলার দিক তাকিয়ে বলে,
—আমার জন্য বেশি চিন্তা করিস না। তোর ভাবি আছে না আমার সাথে? আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নেবো দুজনে!
নিশীথের কথায় এবং ওর মুখে “তোর ভাবি” শুনে দোলা ভীষণ লজ্জা পেলো। মুহুর্তে গাল দুটো সামান্য লালচে হয়ে এলো। ও রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো,

—বসেন, ভাইয়া। আপনাকে খাওয়ানোর মতো তো কিছু নেই এখন, আমি পানি নিয়ে আসছি!
খাওয়ার কথা শুনে আকাশের টনক নড়লো যেন। তড়িঘড়ি দোলাকে থামিয়ে বললো,
—ভালো কথা মনে করে দিয়েছেন, ভাবি। কি জন্য এসেছি আর কিসব বলছিলাম এতক্ষণ। মা আপনাদের জন্য বিরিয়ানি রান্না করে পাঠিয়েছে। আমি ওটাই দিতে এসেছি। এতক্ষণ গল্পের মাঝে তো দিতেই ভুলেই গিয়েছি!
আকাশ কথা বলতে বলতে নিশীথের হাতে খাবারের বক্সভরা ব্যাগটা তুলে দেয়। নিশীথ হেসে হাতে নিয়ে দোলার হাতে ধরিয়ে দেয়। আকাশকে বসতে বললে ও মানা করে। ওর কাজ আছে বলে চলে যায়। নিশীথও আর আটকায়না। আকাশ চলে যেতেই নিশীথ দরজা লাগিয়ে দোলার উদ্দেশ্যে বলে,

—গরম গরম খাবার এনেছে, দ্রুত খেতে হবে নয়তো ঠান্ডা হয়ে যাবে! অনেক দেরি হয়ে গেছে দেখো! চারটা বাজছে প্রায়।
—আমি ঝটপট গোসল করে আসি? দশ মিনিট দেন আমায়।
নিশীথ মাথা নাড়তেই দোলা ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে দ্রুত বাথরুমে চলে যায়। ও গোসল করে বের হতেই দুজনে একসাথে খাবার বসে খেয়ে নেয়। এখনো বিছানা টেবিল কিছুই কেনা হয়নি, খালি ফ্ল্যাটের মেঝেতে বন্ধুদের এনে দেওয়া তিনস্তরের মোটা গদি পাড়া আছে! তাতে বসেই একত্রে খাবার পর্ব সেড়ে নিলো ওরা। নিশীথ কার সাথে যেন কথা বলতে বারান্দায় চলে গেলো, ওদিকে দোলা ততক্ষণে প্লেট তুলে পরিষ্কার করতে লেগে গেলো।

নিশীথ এখনো রুমে আসেনি। ফোনে কথা শেষ করে একধ্যানে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেকার রৌদ্রজ্বল আকাশটা এখন আর নেই। বরং সেখানে ভর করেছে ধূসর রাঙা মেঘ। নিশীথ পকেটে হাত দিয়ে লাইটার বের করে সি’গারেট ধরাবে এমন সময় ওখানে দোলা চলে এলো। নিশীথের হাতে লাইটার ও সিগারেট দেখে ড্যাবড্যাব চোখে তাকাতেই নিশীথ অপ্রস্তুত ভংগিতে বলে,

—এখন এসোনা এখানে। তোমার সামনে খেতে চাইনা। মানা করোনা প্লিজ, আমার এটার প্রয়োজন।
দোলা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে চুপ থেকে মন খারাপ করে চলে যায়। নিশীথ দেখেও কিছু বলেনা। স্ট্রে’স কমাতে অভ্যাসগত টেনে নেয় নিকো’টিন। কিছুক্ষণের মাঝে রুমে ঢুকে দোলার কাছে আসতেই ও মুখ কুচকে বলে,
—কাছে আসবেন না! এ গন্ধ আমার সহ্য হয়না!
নিশীথ থতমত খেয়ে থেমে যায়। বাথরুমে যেয়ে ব্রাশ করে এসে দোলার পাশে বসে। দোলা তখনো চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে। নিশীথ শুধায়,

—কিছু বলার জন্য এসেছিলে?
—হুম
—এখন বলো। সরি, তখন আসতে বাধা দিয়েছিলাম।
—ইটস ওকে! একটা প্রশ্ন করি?
—করো।
—আপনি সিগারেট কেন খান?
দোলার বোকা প্রশ্নে নিশীথ না চাইতেও হেসে ফেলে। ভাবুক হয়ে বলে,

—পুরোপুরি জানিনা। তবে অভ্যাস হয়ে গেছে। শুরুটা বন্ধুদের সাথে মজার ছলে করলেও এখন স্ট্রেস কমাতে খে’য়েছি!
—আমি আপনার কাছে কেন আছি?
—মানে?
ওর প্রশ্নে নিশীথ বিস্মিত হয়ে যায়। দোলা নিশীথের হাত ধরে বলে,
—আপনার স্ট্র্বস, দুঃখ ভাগাভাগি করতে তো আমিই আছি। আপনার খারাপ লাগলে আমার সাথে কথা বলবেন। আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করবো আপনার মন ভালো করার! যদি আমি থাকতেও অন্যকিছু দিয়ে আপনার স্ট্রেস কমাতে হয় তবে আমি থেকে লাভ কি?

দোলার কথায় নিশীথ আরেক দফা বিস্মিত হয়ে যায়। মেয়েটা যে ওর কথাকে এত সিরিয়াসলি নিবে, ও ভাবেনি। নিশীথ কিছু বলবে এমন সময় আকাশ ডেকে উঠে। দেখতে দেখতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়া শুরু হয়। খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির পানি ঘরে ঢুকবে ভেবে নিশীথ জানালা লাগাতে গেলে দোলা বাধা দেয়। ওকে থামিয়ে বলে,
—খোলাই থাক না! বৃষ্টির আসল আনন্দ তো বৃষ্টির পানি ছুয়ে দেখতেই।

দোলা ছুটে এসে জানালায় হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ছুয়ে দেখে। নিশীথের নজর নিজের উপর উপলব্ধি করে হঠাৎ ওর গায়ে পানি ছিটিয়ে দেয়। কোনোরুপ আগামপ্রস্তুতি না থাকায় নিশীথ আচমকা ভিজে গেলে মেয়েটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। নিশীথের হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে ততক্ষণে। বৃষ্টির গতিবেগ বারান্দার মুখোমুখি হওয়ায় মুহুর্তেই দুজনে কাকভেজা হয়ে যায়। নিশীথ ভেতরে যেতে চায়,

—কিছুক্ষণ আগেই গোসল করে এসেছি। আবার পুরো ভিজে যাচ্ছি। ভেতরে চলো!
—থাকুন না কিছুক্ষণ? দেখবেন সব স্ট্রেস, দুঃখ, মন-খারাপ, গ্লানি বৃষ্টির পানিতে ভিজে মিলেমিশে দূর হয়ে যাবে।
—ছেলেমানুষী কথা বাদ দিয়ে ভেতরে চলো, দোলনচাঁপা। তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে…

নিশীথ ধরতে আসলে দোলা সরে যায়। উল্টো, ও এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে! নিশীথের পেছনে গিয়ে পিছে থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরে ওকে। এবার নিশীথ নড়তে পারেনা! অগত্যা দোলার জিদ মেনে ওকে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়। ওর বুকে জড়িয়ে রাখা দোলার হাতের উপর নিজের হাত রেখে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির পানিকে স্বাগত জানায় নিশীথ। মিনিট দশেক সেভাবেই অতিক্রম হয়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টির বেগ দৃশ্যমান ভাবে কমে আসে। দোলা ধীরে ধীরে সরে যায়। নিশীথ চোখ খুলতেই ওর সামনে দোলাকে দেখতে পায়। নিশীথ তাকাতেই দোলা মিষ্টি করে হাসে। ভ্রু নাচিয়ে বলে,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫২(২)

—এখন কেমন লাগছে?
নিশীথ মাথা নাড়িয়ে হাসে। কিছুক্ষণ আগে বলা দোলার কথা মনে করে ও মানতে বাধ্য হয়, বৃষ্টির সংস্পর্শে হোক কিংবা প্রিয়তমার সান্নিধ্যে – ওর মন খারাপ অনেকাংশেই ভালো হয়ে গেছে!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৫৪