দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬১

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬১
তাসফিয়া হাসান তুরফা

আয়মান সাহেবের প্রশ্নে নিশীথ একটুও চমকালোনা। বরং যেন খুব স্বাভাবিক কিছু শুনেছে সেভাবেই পুনরায় কফির মগে শেষ চুমুকটা দিলো। আয়মান সাহেব ধৈর্য ধরে ছেলের জবাব শুনার আশায় অপেক্ষা করলেন। এতদিন পর একটু একটু করে সম্পর্কের বরফ যখন গলছেই তখন তার প্রশ্ন করতে সমস্যা কোথায়! নিশীথ কোনো ভনিতা করলোনা। সরাসরি বললো,

—এইতো আছি বেশ! কষ্ট কেন হবে?
ছেলের গা ঝাড়া কথায় আয়মান সাহেব বিরক্তিতে মাথা নাড়লেন, মুহুর্তে যেন ধৈর্য হারালেন। চটে যেয়ে বললেন,
—কষ্ট কেন হবে মানে আবার কি? কেন হবেনা সেটাই তো বুঝছিনা। তুমি যেভাবে থাকতে তার ১% ও যদি এখানে থাকতো তবে না হয় বুঝতাম! এভাবে কি থাকা যায়?
—কেন যাবেনা? আমি তো দিব্যি থাকছি! কোনোদিন শুনেছেন আমায় কমপ্লেইন করতে?
—তুমি কমপ্লেইন করবেই বা কেন? তুমি তো জোর করে নিজেকে খুশি দেখানোর চেষ্টা করছো! আমার সামনে তো আরও বেশি করছো!
এবার বাবার কথায় নিশীথের শিথিল ভ্রুযুগল কুচকে গেলো, সরাসরি তার দিকে তাকালো। অবাক হবার ভান করে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—আপনার সামনে আমি নিজেকে খুশি দেখানোর চেষ্টা করবো কেন? আশ্চর্য!
আয়মান সাহেব তাচ্ছিল্যের সাথে হাসলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,
—অবশ্যই চেষ্টা করবে। ওই বাসা ছেড়ে তুমি চলে এসেছিলে আমাকে দেখানোর জন্য, তুমি আমায় প্রমাণ করতে চেয়েছিলে যে তুমি সব স্বচ্ছলতা ছেড়ে এখানে খুশি আছো! কিন্তু আমি তো আজ নিজ চোখে দেখছি তুমি কেমন অবস্থায় আছো!
—কেমন অবস্থায় আছি? আপনিই বলেন দেখি!
নিশীথ আগ্রহভরে শুধালো।

—একদম ভালো নেই তুমি। আসার পর থেকেই তোমার এ বাসার প্রতিটা কোণা ঘুরে ঘুরে দেখেছি আমি। ছোট্ট একটা বাসা, নেই কোনো ফার্নিচার, এসি, ফ্যানও কেবল একটা। শুনলাম টেবিলটাও নাকি কাল এনেছো তবে এতদিন খাটেই বোধহয় খাওয়াদাওয়া করতে তোমরা? তার মধ্যে কারেন্ট গেলে তো দমবন্ধ অবস্থা হয়! সারাদিন অফিস থেকে কাজ করে বাসায় এসে যদি এমনভাবেই থাকতে হয় তবে কি সে লাইফের কোনো মানে হয়? এভাবে কেউই সুখে থাকতে পারেনা, এটা তো জানা কথা। সেখানে কোনো তর্কে যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা!

নিশীথ খুব মনোযোগ দিয়ে বাপের কথা শুনলো। আয়মান সাহেব এর কাছে সুখে থাকার দাড়িপাল্লা দেখে সে কোনোরুপ বিচলিতও হলোনা। বরং সে যে মনে মনে তার বাপের কাছে থেকে এটাই আশা করেছিলো, ওকে দেখে এটাই মনে হলো! তাই নিশীথের তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো। আয়মান সাহেব ভেবেছিলেন তার কথা শুনে ছেলে কষ্ট পাবে, নয়তো রাগ করবে অথবা বড়জোর চুপ থাকবে। কিন্তু নিশীথকে উল্টো হাসতে দেখে তিনি যেন অবাকই হলেন! সে কি হেসে তাকে ইনসাল্ট করছে? গমগমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

—হাসছো কেন? এখানে কি আমি ফাইজলামি করছি নাকি হাসির মতো কিছ্য বলেছি?
নিশীথ ঠোঁটের কোণে হাসি বজায় রেখেই মাথা নেড়ে বিদ্রুপের স্বরে বললো,
—হাসির মতো কথা বললে হাসবো না তো কি করবো? আপনি যা বললেন তা শুনার পর হাসা ছাড়া আর উপায় পেলাম না!
—কি এমন বলেছি শুনি?
আয়মান সাহেব চটে গেলেন। নিশীথ তা লক্ষ্য করলো ঠান্ডা মাথায় বললো,
—আপনার কাছে সুখের মাপকাঠি একরকম, আমার কাছে অন্যরকম। ইভেন দুনিয়ার প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই সুখ-দুঃখের মাপকাঠি আলাদা। তাই সবাইকে এক দাড়িপাল্লায় মাপলে তো হবেনা, তাই না?
—এত কথা যে বলছো, তা তোমার কাছে সুখের মাপকাঠি কি এমন? বলো শুনি!
নিশীথ মুচকি হেসে বললো,

—আপনি এ বাসাটাকে নেহাতই একটা ছোট্ট অগোছালো সাদামাটা বাসা হিসেবে দেখছেন। কিন্তু আমার কাছে এ বাসাটা দোলনচাঁপার সাথে আমার প্রথম সংসার। আপনার কাছে এটা তেমন কিছু না হলেও এটা আমার কাছে আমাদের নিজেদের দুনিয়া! যেখানে আমরা দুজন বিয়ের পর থেকে প্রতিটা সুখ-দুঃখের গল্প একসাথে ভাগাভাগি করেছি। এ বারান্দা, এ রুমে গরমের মাঝে যেমন আমি কষ্ট করি একই কষ্ট আমার দোলনচাঁপাও করে। কিন্তু কখনো ওকে একটাবার মুখ ফুটে কোনো কমপ্লেইন করতে শুনিনা…

—তা শুনবে কিভাবে? ওর তো অভ্যাস আছেই এভাবে থাকার, ওর কেন কোনো কষ্ট হবে…
আয়মান সাহেব কথাটুকু শেষ কর‍তে পারলেন না, এর মাঝেই নিশীথ কথা কেটে বলে,
—কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন ও আমাকে আমার টাকার জন্য বিয়ে করেছে, আমার বিলাসবহুল জীবন দেখে বিয়ে করেছে। তবে ও আমার সাথে এখানে থেকে কষ্ট করছে কেন? ওর তো এখানে থেকে কষ্ট করে কোনো লাভ নেই! তবে ও এখনো কেন আমার সাথে থেকে এডজাস্ট করছে বলতে পারবেন?
এবার নিশীথের প্রশ্নে আয়মান সাহেব থমকে দাড়ান। কিছু বলার চেষ্টা করেও যেন বলতে পারেন না! বাবাকে নিরুত্তর হতে দেখে নিশীথ মনে মনে সন্তুষ্ট হয়। খানিকবাদে নিজেই বলে,

—জবাব ভেবে পাচ্ছেন না তাইতো? আচ্ছা আমিই বলে দিচ্ছি! এর একটাই স্পষ্ট কারণ। দোলনচাঁপা আমাকে ভালোবাসে। ঠিক ততটাই, যতটা আমি ওকে ভালোবাসি। এটা আপনি বাদে আর সবাই দেখতে পারে। আপনি কেন দেখতে পারেন না জানেন? কারণ আপনি নিজের অহংকারে অন্যকে ছোট করে দেখেন। আপনার কাছে সুখ-শান্তি বলতে টাকা, সচ্ছলতা, ঐশ্বর্য বাদে আর কিছুই নেই। আপনি একা নন, জীবনের একটা বড় সময় অব্দি আমি নিজেও এটাই ভাবতাম! আপনার ছেলে বলে কথা?

নিশীথ এটুক বলে থামে। আয়মান সাহেব চোখ তুলে তাকান ছেলের দিকে। আজ এতদিন পর নিশীথ তার সাথে এতগুলো কথা বলছে! শেষ এরকম বড় কথোপকথন বাড়ি ছাড়ার আগের দিন হয়েছিলো তাদের মাঝে! আয়মান সাহেবের ভাবনার মাঝেই নিশীথ নিশ্বাস নিয়ে আবারো বলে,
—কিন্তু জানেন, দোলনচাঁপার সাথে দেখা হওয়ার পর আমি রিয়েলাইজ করেছি যে জীবনে অফুরন্ত টাকা-পয়সা, বাইরের চাকচিক্য এসবের বাইরেও ভালো থাকা যায়! বরং পাশে যদি ভালোবাসার মানুষটা থাকে তবে এসবের বাইরেও মানুষ দিব্যি বাঁচতে পারে, বরং বেশ সুখে-শান্তিতেই বাঁচতে পারে।

—এসব কথা নাটক সিনেমাতে ভালো লাগে, নিশীথ। বাস্তব জীবনে সুখে থাকা এত সোজা না!
নিশীথ অধৈর্য হয় এবার। এত সুন্দর করে ধৈর্য ধরে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু বুঝানোর পরেও কেন বাবা বুঝতে চাইছেনা? কি হতে পারে তার এমন নারাজির কারণ? সে আর ধরে রাখতে পারেনা। সরাসরি প্রশ্ন করে বসে,
—কেন আপনি ভালোবাসা জিনিসটাকে এত অপছন্দ করেন? কেন আমার দোলনচাঁপাকে মেনে নিতে পারেন না?
—কারণ আমি বাস্তবতা দেখেছি। তোমার বয়স অল্প, তার মধ্যে নতুন বিয়ে। এখন সবকিছুই মধুর লাগবে। যখন বয়স বাড়বে সময় বাড়বে আরও হাজারো দায়িত্ব কাধে আসবে তখন দেখবে ভালোবাসা জানলা দিয়ে পালাবে। সারাজীবন সাথে থাকার ওয়াদা সবাই করতে পারে, পালন কেউ করতে পারেনা!

নিশীথ কথা বলার জন্য মুখ খুললো এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। বাপ ছেলে দুজনেই বারান্দার দরজার দিকে তাকালো। দরজা ঠেলে আসমা বেগম প্রবেশ করলেন বারান্দায়। তাকে দেখে নিশীথ ও আয়মান সাহেব দুজনেই স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। আসমা বেগম এগিয়ে এসে বললেন,
—কি শুরু করেছো তোমরা? একটা বাসায় দাওয়াত খেতে এসেও শুরু করতে হলো? সবাই কি ভাববে সে খেয়াল আছে?

—সবাই কি ভাববে সে খেয়াল আমার ঠিকই আছে, কিন্তু তোমার ছেলের নেই!
আয়মান সাহেব হনহন করে বেরিয়ে গেলেন বারান্দা থেকে। পেছনে পরে রইলো নিশীথ ও তার মা! নিশীথ আসমা বেগমের নিকট এগিয়ে এসে ক্লান্ত স্বরে বললো,
—আর কতদিন এভাবে চলবে, মা? যে সবকিছু দেখেশুনেও কিছু বুঝতে চায়না তাকে কিভাবে বুঝানো যায় বলো?
—কোনো মানুষ ইচ্ছে করে খারাপ হতে চায়না নিশীথ। অনেক সময় জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, পরিস্থিতি তাকে এমন বানিয়ে দেয়।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬০ (২)

—মানে? বাবার সাথে কি হয়েছে?
নিশীথ কৌতুহল নিয়ে শুধায়! আসমা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাছাড়া ভাব নিয়ে বলেন,
—আমি কীভাবে বলবো? তোর বাবা আমাকে কিছু বলে নাকি? আমার যা মনে হলো তাই বললাম!
এমন সময় ইউনুস সাহেব ডেকে উঠায় আসমা বেগম নিশীথকে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। কিন্তু তারা কেউই জানলোনা, দরজার বাইরে থেকে দোলনচাঁপা তাদের সমস্ত কথা শুনছিলো!

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬১ (২)