দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৩

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৩
তাসফিয়া হাসান তুরফা

আসমা বেগমের চিৎকারে কাজের মেয়ে ভয় পেয়ে যায়। রুমের ভেতর থেকে কুরআন পাঠরত ইউনুস সাহেবও থমকে যান। পবিত্র গ্রন্থ বন্ধ করে বেরিয়ে আসেন রুমের বাহিরে! আসতে আসতে চিন্তিত স্বরে শুধান,
—কি হলো, বৌমা? পড়ে-টরে গেলে নাকি?
ইউনুস সাহেব কথা শেষ করতে পারেন না তার আগেই চোখের সামনে ঘটা দৃশ্য দেখে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান! আসমা বেগম অঝোর নয়নে কাদতে ব্যস্ত এদিকে তার বড় নাতি মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সমানে। নিশান একটু পরপর বলছে,

—হয়েছে, মা। এবার তো থামো। আমি এসে গেছি তোমার সামনে। একদিনেই চোখের সব পানি শেষ করবে নাকি?
তবু আসমা বেগম থামতে পারছেন না। চোখের সামনে প্রথম সন্তানকে দীর্ঘ পাঁচটা বছর দেখার অনুভূতি ঠিক কেমন, তা যে মা বুঝেছে একমাত্র তিনিই তার পরিস্থিতি বুঝবেন। আর কেউ নয়! নিশান মাকে থামার সময় দিলো। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দাদুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। ইউনুস সাহেবেরও চোখ ইষত ঘোলা হয়ে এসেছে ওকে দেখে! তা দেখে হেসে নিশান বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—আরে দাদু, তুমিও কাদছো নাকি?
ইউনুস সাহেব চশমার আড়ালে চোখের পানি আড়াল করে বললেন,
—আরে নাহ! ওসব তো মায়েরা কাদে। বাপ-দাদারা কাদেনা বুঝলি?
—তাই বুঝি? তবে চোখ ঘোলা হয়ে এলো কেন?
নিশান ইয়ার্কি করে শুধালো। বৃদ্ধ হেসে বললেন,
—ও কিছুনা। চোখে কি জানি পড়েছিলো এই আর কি!

নিশান মনে মনে হাসলো। ওর বাপ-দাদা সবাই একরকম। ভাঙবে তবু মচকাবেনা। বাবা তো বাবার মতোই আর দাদু, উনি বুড়ো হলেও এখনো শক্ত পারসোনালিটি। নিশান মাকে ছেড়ে এগিয়ে গেলো দাদুর নিকট। তাকে জড়িয়ে ধরতেই ইউনুস সাহেবও নাতিকে বুকে জড়িয়ে পিঠ চাপড়ে দিলেন। সহাস্যে বল্লেন,
—স্বাস্থ্য তো আগের চেয়ে বেশ ভালো হয়েছে, দাদুভাই। এখন বেশি মানাচ্ছে মাশাল্লাহ!
—তাও তো তোমার থেকে কমই লাগে, দাদু। এ বয়সেও তুমি যে ফিটফাট আমরা হতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে!
—কেন পারবিনা? তোরাও হবি। কার নাতি দেখতে হবে না!

দাদু-নাতির হাসির মাঝে নিজেকে সামলে নেন আসমা বেগম। আঁচলে চোখ মুছে নিশানের উদ্দেশ্যে বলেন,
—এভাবে কোনোকিছু না জানিয়ে কেউ বিদেশ থেকে হুট করে চলে আসে?
—বলে এলে কি তোমায় এরকম সারপ্রাইজ দিতে পারতাম, মা?
—কিন্তু একটা প্রস্তুতিরও তো ব্যাপার থাকে। তেমন কিছুই তো রান্না করিনি আজ। তোকে খাওয়াবো কি? এতদিন পর এলি আগে থেকে বলে রাখলে কই তোর জন্য কত কি করে রাখতা…
—মা, থামো প্লিজ! ঘড়ি দেখো। সকাল সাড়ে সাতটা বাজে কেবল। এ সময় কে কি খাবে? রিল্যাক্স!
—তো কি হয়েছে? তোর রুমে যা। আরাম করে গোসল করে আয়। ততক্ষণে ৮টা পার হয়ে যাবে। কি খাবি বল? আমি রান্না বসিয়ে দিচ্ছি।

—তুমি যা খাওয়াবে আমি তাই খাবো। তবে একটাই শর্ত তোমায় তুলে খাওয়াতে হবে, মা।
ছেলের কথায় আসমা বেগমের চোখমুখ খুশিতে জ্বলজ্বল করলো। গদগদ কণ্ঠে বললেন,
—সেটা তুই না বল্লেও খাওয়াতাম! এখন যা তো বাবা ফ্রেশ হয়ে আয়, আরাম করে বোস। রেস্ট নে। লম্বা জার্নি করে এসেছিস।

নিশান ওর রুমে যেতে নিবে এমন সময় আয়মান সাহেব চলে আসেন। মূলত তিনি অফিস যাওয়ার জন্য উঠেছিলেন ঘুম থেকে। আসমা বেগমের চিৎকার কানে এলেও তেমন ভাবনায় নেন নি। বরং মাত্রই ফ্রেশ হয়ে নাস্তার কথা বলতে এদিকে আসছিলেন। কিন্তু হলরুমে এসে চোখের সামনে যা দেখলেন তাতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না! নিশান এগিয়ে এসে দাড়ালো তার সামনে। এদিকে আয়মান সাহেব বিস্মিত লোচনে চেয়ে আছেন। এটা কি সত্যিই নিশান দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে? তার প্রিয় সন্তান? এক মুহুর্তের জন্য আয়মান সাহেব নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। তার অবিশ্বাস্য দৃষ্টি দেখে নিশান হেসে ডাকে,

—কেমন আছো, বাবা?
এবার ছেলের কণ্ঠ শুনে আয়মান সাহেব সম্ভ্রম ফিরে পান। এ তো সত্যিই তার ছেলে এসেছে! আয়মান সাহেব কোনো কথা না বলেই সরাসরি বুকে জড়িয়ে নেন ছেলেকে। নিশানও বাবাকে আগলে ধরে। আয়মান সাহেব আপ্লুত কণ্ঠে বললেন,
—পাঁচটা বছর পর বাপের কথা মনে পড়লো, বাপ? একটাবারও আমাদের কাছে আসার সময় হয়নি?
নিশান শ্বাস ছেড়ে বলে,

—বিদেশে জীবন গুছিয়ে নিতে সময় লাগে, বাবা। তুমি তো বুঝোই এসব। আমি না এলেও তোমাদের তো যেতে বলেছিলামই কতবার। তোমরা কেউই তো গেলেনা। সেই যে একবার তুমি গিয়েছিলে ওটাই লাস্ট!
—ব্যবসা ছেড়ে কীভাবে যেতাম? তোর দাদার পর তো সব আমাকেই দেখতে হয় এখন। সময়ই তো পাইনা। তুইও নেই যে আমার কাজ হালকা হবে!
—আমি নেই তো কি হয়েছে? আমার ছোটু তো আছে! নিশীথ যায় তো অফিসে। ওর উপর দায়িত্ব দিয়ে এখন তুমি রেস্ট নাও।
নিশান সুযোগ বুঝে বললো। নিশীথের প্রসঙ্গ আসায় আয়মান সাহেব ওর থেকে সরে এলেন। নিশানের কথার তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দিয়ে বললেন,

—সে যদি দায়িত্ব নিতে জানতো তবে তো হতোই। আমাকে এত চিন্তা করতেই হতোনা!
আয়মান সাহেবের খোচা মারা কথা বুঝেও নিশান অবুঝের ভান করে বললো,
—ওমা। দায়িত্ব নিতে জানেনা মানে? নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী হয়ে বউয়ের দায়িত্ব নিয়েছে। ওর উপর ভরসা করবেনা তো কার উপর করবে?

আয়মান সাহেবের এ মুহুর্তে নিশানের মুখে এসব কথা পছন্দ হলোনা। মাত্র ছেলেটা দেশে এসেছে আর এসেই কিনা ছোটভাইয়ের ওকালতি করতে লেগে গেছে! এই পরিবারের সবাই যেন একেকটা উকিল। নিশীথের পারসোনাল উকিল! আয়মান সাহেব বিরক্ত মনে ভাবলেন। নিশানকে তাড়া দিয়ে বললেন,
—হয়েছে এখন। বাকি কথা সব পড়ে হবে। তুই শাওয়ার নিয়ে নে। এরপর খেয়েদেয়ে রেস্ট কর। জেটল্যাগেরও একটা ব্যাপার আছে! তোর ওখানে তো এখন রাত হতো!
বাবার কথায় মাথা নেড়ে রুমের দিকে যেতে যেতে নিশান বলে,
—তা ঠিক বলেছো। শাওয়ার নিয়েই লম্বা একটা ঘুম দেবো। বড্ড মাথা ধরেছে। আম ভেরি টায়ার্ড!

নিশীথ অফিস থেকে এসেছে একটু আগে। ফ্রেশ হয়ে বসতেই দোলা খেয়াল করলো, নিশীথকে আজ সকাল থেকে বেশ খুশি খুশি লাগছিলো। কিন্তু অফিস থেকে আসার পর থেকে যেন ওর চোখেমুখে কেমন জানি উদাসীনতা, যা দোলার বোধগম্য হলোনা। ও পানি নিয়ে এসে নিশীথের পাশে বসে বললো,
—কি হয়েছে? বেশি টায়ার্ড লাগছে?
নিশীথ চুপচাপ পানি খেয়ে “না” বোধক মাথা নাড়লো। কিন্তু দোলার বিশ্বাস হলোনা। ও আবারো জিজ্ঞেস করলো,

—লেবুর শরবত বানিয়ে দিই? আরাম পাবেন।
—লাগবেনা।
—ব্ল্যাক কফি খাবেন? মাথা ধরেছে খুব? টিপে দেবো?
দোলার উদ্বিগ্নতায় এবার না চাইতেও নিশীথের ঠোঁটের কোণে হাসি উকি দিলো। দোলার হাত চেপে ধরে বললো,
—কিছুই লাগবেনা, দোলনচাঁপা। রিল্যাক্স!
দোলা ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
—তবে এমন দেখাচ্ছে কেন আপনাকে? মন খারাপ লাগছে?
—না।

—সেটা তো আমিও ভাবছি। আজকে ভাইয়া এলো, আজ অন্তত আপনার মন খারাপ হওয়ার কথাই না!
দোলার কথায় নিশীথ স্মিত হাসলো। আনমনেই বললো,
—ভাইয়া আসায় সবাই ভীষণ খুশি হয়েছে এটা সত্যি বলেছো! আমাদের পরিবারের জন্য আজ ঈদের দিন হাহা।
দোলা হেসে বললো,
—সন্তান এত বছর পর বাইরে থেকে এলে তো খুশি হবেই। ইশ আমরাও যদি ওখানে থেকে সবার খুশিতে শামিল হতে পারতাম..

দোলা কথা বলেই জিব কাটে। মনে মনে নিজেকে গালি দেয়। এমনেই বাসার জন্য নিশীথের মন খারাপ থাকতে পারে, তার মাঝে ওর কি দরকার ছিলো এ কথাটা বলার? ওর মুখটাও দরকারের বাইরে চলা শুরু করেছে আজকাল। অসহ্যকর ব্যাপার!
নিশীথ উঠে দাঁড়ায়। জানলার কাছে এগিয়ে যায়। রাতের বেলা এ সময় ঠান্ডা বাতাস বয় ভালোই। আকাশে আজ চাঁদ নেই, আছে শুধু গুমোট পাকানো মেঘের জটলা। সেদিকে চেয়ে নিশীথ বলে,
—আজ অফিসে তোমার শশুড়কে যত খুশি দেখলাম, লাস্ট কবে তাকে এমন হাসিখুশি দেখেছি, আমি মনে করতে পারছিনা!
নিশীথের কথায় দোলাও উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়। বাম হাতে ওর ডান বাহু জড়িয়ে ধরে কাধে মাথা রেখে সরল গলায় বলে,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬২

—তাই নাকি? এ তো দারুণ ব্যাপার!
দোলার কথা বলা শেষে বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে যায়। নিশীথ কোনো কথা বলেনা। মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎ বলে ওঠে,
—আচ্ছা, দোলনচাঁপা
—হুম?
—আমার জন্য কখনো তাকে এত খুশি হতে দেখেছো কি? নাকি আমি কখনো ম্যাটারই করিনা তার কাছে?
দোলনচাঁপা চমকায়। কাধ থেকে মাথা তুলে মুখ ফিরিয়ে নিশীথের মুখ পানে চায়। আকাশে জটলা পাকা মেঘের মতোই আধার জমেছে নিশীথের সুশ্রী মুখখানায়। মনে মনে ও ভাবে, তবে কি এজন্যই নিশীথের মন খারাপ?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৪