দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬(৩)
তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশীথ ধীরেসুস্থে রুমে প্রবেশ করে। ওকে দেখে অবাক হলেও কিছুক্ষণের মাঝেই নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন ইউনুস সাহেব। নিশীথের মুখখানা থমথমে। তা দেখে মনে মনে ইউনুস সাহেব ঘাবড়ালেও নিশান বেশ খুশি। ওকে দেখে মনে হলো, যেন এ মুহুর্তে সে এখানে নিশীথেরই অপেক্ষা করছিলো! নিশীথ এসে সরাসরি দাদুর সামনে দাঁড়ালো। কঠোর নয়নে চেয়ে শুধালো,
—কি হলো, দাদু? থামলে কেন? গল্প যখন শুরু করেছো তখন শেষ না করে থামলে তো হবেনা!
নিশান তাল মিলিয়ে বললো,
—নিশীথ ঠিক বলেছে, দাদু! আমরা শেষ পর্যন্ত জানতে চাই। কে বাবার প্রেমিকা ছিলেন এবং কেন তার সাথে বাবার বিয়ে হয়নি? কেন আমরা…
ওকে থামিয়ে দিয়ে বুড়ো বললেন,
—তোরা দুটো এবার চুপ করবি? কি তখন থেকে নির্লজ্জের মতো বাবার প্রেমিকার খবর নিতে চাইছিস। এমন একটা বিষয়ে কথা বলতে কি তোদের একটুও মুখে বাধছেনা?
নিশীথ ফুসে উঠে বললো,
—যার কারণে আমাদের জীবনে এত প্রভাব পড়লো তাকে নিয়ে জানার আগ্রহ আমাদের কেন হবেনা, দাদু?
—নিশীথ, তুই..
—আমি কি, দাদু? আর কতদিন আমাদের এভাবে ধোয়াশার মধ্যে রাখবে? আর কত বছর আমাদের থেকে সত্যটা লুকিয়ে রাখবে?
ইউনুস সাহেব জবাব দিলেন না। নিচের দিকে একধ্যানে চেয়ে রইলেন শুধু। এবার নিশীথ আর পারলোনা থেমে থাকতে। ও আচমকা হাটু গেড়ে মাটিতে বসলো। ঠিক দাদুর সামনে! ইউনুস সাহেব মুখ তুলে তাকালেন প্রিয় নাতির দিকে। নিশীথ অনুরোধের স্বরে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—প্লিজ দাদু, আমরা দুই ভাই রিকোয়েস্ট করছি এবার আমাদের সত্যিটা বলে দাও। জীবনের এত বছর পর অন্তত আমাদের থেকে আর কিছু লুকিয়ে রেখোনা। সারাজীবন আমরা দেখেছি মা-র প্রতি বাবার উদাসীনতা। কিন্তু কখনো জানতে পারিনি কেন! তোমার কি মনে হয়না একটাবার সন্তান হিসেবে আমরা সত্যটা জানার অধিকার রাখি?
ইউনুস সাহেব ছলছল চোখে তাকালে নিশান এবার বসে পড়ে নিশীথের পাশে। সে-ও দাদুর হাটুতে হাত রেখে বলে,
—এত বছর সবকিছু চোখের সামনে দেখেও আমরা কখনোই জানার ইচ্ছা প্রকাশ করিনি। এটা তো তুমিও স্বীকার করবে, দাদু? তবে আজ যখন আমরা দুই ভাই এত করে চাইছি তখন কেন তুমি আমাদের আবারও সত্য থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছো? এমনটা করোনা, দাদু। তোমার বয়স হয়েছে, নিশীথও বিয়ে করে দূরে থাকে। আমার কথা আর কি বলবো, আমি থাকি বিদেশ। এখনি বছরে একবার আসার সুযোগ পাইনা বিয়ের পর কি হবে কে জানে! তুমি কি চাও আমরা সারাজীবন এভাবে কষ্ট পেয়ে যাই? নাকি তোমার গোপন করে রাখা সত্য তোমার কাছে আমাদের চেয়েও বড়?
এবার দুই নাতির পীড়াপীড়িতে বৃদ্ধ পড়ে যান চাপে। শেষমেশ দুই ভাইয়ের জোরাজুরিতে একপ্রকার বাধ্য হয়ে তিনি সবটা খুলে বলেন। বলা যায়, সত্য বলতে সক্ষম হন। দুই নাতির দিকে তাকিয়ে চোখের চশমা পাশে খুলে রেখে বলেন,
—দেখ দাদুভাইয়েরা, তোরা এখন আর ছোটো নেই। দুজনেই বড় হয়ে গেছিস। দুজনেরই সত্যটা জানার ও বুঝার ক্ষমতা হয়ে গেছে। হয়তো তোরা প্রথমে ভীষণ অবাক হবি, এরপর কষ্ট পাবি। কিন্তু আমার বিশ্বাস তোরা সবটা জেনে-বুঝেই মনে ধারণা করবি।
নিশীথ অধৈর্য হয়ে বললো,
–উফফ দাদু, কি তখন থেকে একি কথা বারবার বলছো? আমরা বললাম তো আমরা আগেই কোনোকিছু জাজ করবনা। তুমি এখন তাড়াতাড়ি সবকিছু বলো। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা!
পাশ থেকে নিশানও তাড়া দিলো,
—আমিও, দাদু। প্লিজ এবার অপেক্ষার অবসান ঘটাও জলদি!
ইউনুস সাহেব একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অতঃপর বললেন,
—আয়মান তখন সবেমাত্র অনার্স পাস করেছে। এমন সময় ওর বিয়ের জন্য একটা পাত্রীর সম্বন্ধ আসে। আমি মেয়েটার খোঁজ নিলাম। অল্পবয়সী মেয়ে, দেখতেও মিষ্টি। পরে আরেকটু খোজ নিয়ে জানতে পারলাম মেয়েটা আমার পুরনো এক বন্ধুর পালিত মেয়ে হয়! এত বছর পর বন্ধুর সাথে দেখা, মেয়েটার সম্বন্ধে জানা, সবমিলিয়ে ওকে আমার পুত্রবধূ হিসেবে বেশ মনে ধরলো। এরপর একদিন আমি আয়মানকে জিজ্ঞেস করলাম, ও বিয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা? আয়মান বললো, আমার একটু সময় লাগবে। আমি ওকে বললাম, তোমার বয়সে আমার বিয়ে হয়ে তুমিও দুনিয়ায় এসেছিলে। আর কত সময় লাগবে তোমার?
আয়মান বললো, আব্বা আমি তো সবে ব্যবসায় ঢুকেছি। একটু গুছিয়ে নিতে দিন। এরপর দেখছি!
ইউনুস সাহেব থামলেন। নিশীথ ব্যাকুল কণ্ঠে শুধালো,
—তারপর?
—তারপর আর কি? আমি বন্ধুকে অপেক্ষা করতে বলে নিজেও অপেক্ষা করলাম। এরপর একদিন আয়মান এসে বললো, আব্বা আমি বিয়ে করতে রাজি! আমি ওকে বললাম ওর জন্য আমি মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি। এতে ওর কোনো আপত্তি আছে কিনা? ও বললো, আ…
—তারপর বাবা তোমায় বললো উনার পছন্দের নারী আছে, তাইতো?
নিশান মাঝখানে ফোড়ন কেটে বললো। এবার ইউনুস সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
—তোরা যদি বারবার আমায় এভাবেই আটকাস তবে আমি বলবো কিভাবে?
—আচ্ছা সরি, দাদু। তুমি এগোও। আমরা আর কিছুই বলবোনা মাঝখানে!
নিশান জিভ কেটে বললো। নিশীথও মাথা নেড়ে সায় জানালো ভাইয়ের কথায়। ইউনুস সাহেব দম নিয়ে পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন,
—তোদের মতো আমিও ভেবেছিলাম হয়তো আয়মান মানা করবে। কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে তোদের বাপ সুন্দর করে বললো, আমার কোনো পছন্দ নেই আব্বা। আপনার যাকে পছন্দ আমি তাকেই বিয়ে করবো! আমার কোনো আপত্তি নেই।
দাদুর কথায় নিশীথ ও নিশান দুইজন একে-অপরের দিকে অবাক চোখে তাকায়। কাহিনি কোনদিকে মোড় নিতে যাচ্ছে ওরা কেউ বুঝতে পারেনা।
—তারপর আয়মান মেয়েকে দেখলো, ওর মেয়েকে পছন্দ হলো। আমি আমার বন্ধুর সাথে কথা বলে বিয়ের ডেট ফিক্স করলাম। যথারীতি বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। বিয়ের দিন সকালে আমরা বরযাত্রী রওনা হচ্ছিলাম এমন সময় তোদের বাপ আমার রুমে এসে হাজির হলো! আমি ওকে দেখে অবাক হয়ে বললাম, “আরে তুই এখনো রেডি হোসনি যে? অথচ আমরা একটু পরেই বাসা থেকে বের হবো! এখানে কেন এলি? তাড়াতাড়ি রেডি হ গিয়ে”
আমি যতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বললাম, আয়মানকে ততটা স্বাভাবিক দেখালোনা। ওকে দেখে মনে হচ্ছিলো ওর উপর দিয়ে কোনো ঝড় বয়ে গেছে। ওর অবস্থা দেখে আমি রুম থেকে সবাইকে বের করে দিলাম। দরজা লাগিয়ে ওকে বিছানায় বসিয়ে নরম সুরে শুধালাম, “কি হয়েছে বাপ? অস্থির লাগছে?” আমি লক্ষ্য করলাম, আমার নরম কথায় কাজ হলো।
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৬৬ (২)
আয়মান মুহুর্তে গলে গেলো। ও হঠাৎ আমার পায়ে লুটিয়ে বললো, “আব্বা, আমায় মাফ করুন। আমি এ বিয়ে করতে পারবোনা”। ওর কথায় আমার মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম। বিয়েবাড়ি প্রস্তুত, দুই পক্ষের সব মেহমান এসে গেছে এমন সময় এসে কিনা বর বলছে বিয়ে করবেনা? আমি রেগে বললাম, “এসব কি বলছো, আয়মান? বিয়ে করবেনা মানে? ঘরভর্তি মেহমান, সব প্রস্তুতি শেষ। সেই মুহুর্তে এসে এমন ফাইজলামির মানে কি?” আমার ধমকে আয়মান কেপে উঠলো। এরপর নিজেকে সামলে, আমার সামনে ওর জীবনের একটা লুকোনো কাহিনি প্রকাশ করলো!