দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭২
তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশীথ রুমে ঢুকতেই ইউনুস সাহেব বললো,
—আমার যতদূর মনে হয় নিশানের কোনো মেয়ে পছন্দ আছে। কি বলিস, নিশীথ?
আয়মান সাহেব বাবার কথায় ভ্রু কুচকে ফেললেন। তার মুখ দেখেই বুঝা গেলো ছোটছেলের মতো বড়ছেলেরও পছন্দ আছে শুনে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট। বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিশীথ তা স্পষ্ট বুঝতে পারলো। ও মাথা নেড়ে বললো,
—আমারও এটাই মনে হয়, দাদু।
—কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়না।
আয়মান সাহেব মাঝে দিয়ে বললেন। নিশীথ আড়চোখে বাবার দিক চেয়ে বললো,
—আজকালকার যুগে বিশেষ করে আমাদের এ বয়সে যেকোনো মানুষের পছন্দের কেউ থাকতেই পারে। না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক। কিন্তু তবু কিছু মানুষ যে কেন এটা মেনে নিতে পারেনা আমি বুঝিনা!
আয়মান সাহেব বুঝলেন নিশীথ তাকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বলেছে। তাই দম্ভভরে বললেন,
—বাবা-মার কাছে প্রত্যেকটা সন্তান নিয়ে আলাদা আলাদা এক্সপেক্টেশন থাকে। তোমার থেকে যেটুকু আশা ছিলো তা তো তুমি আগেই শেষ করে দিয়েছো। তাই এ ব্যাপারে আর কিছু বলোনা। কারণ, আমার কোন সন্তান কেমন তা আমাদের চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। নিশান সারাজীবন আমার এক্সপেক্টেশন পূরন করে এসেছে। ও তোমার মতো না যে, যা মন চায় ফট করেই তা করে ফেলবে। সবকিছু বুঝেশুনে ক্যালকুলেট করে চলে আমার বড়ছেলে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাবার এমন কথা শুনে অন্যসময় হলে হয়তো নিশীথের একটু হলেও কষ্ট লাগতো তবে আজকে ওর হাসি পাচ্ছে। হাসি পাচ্ছে এই ভেবে যে, যার জন্য আয়মান সাহেব এত দাম্ভিকতা দেখাচ্ছেন তার সেই গুনধর ছেলে যে কি করে ফেলেছে সেটার ছিটেফোঁটা ধারণাও তার নেই। যদি থাকতো তবে এভাবে বড়মুখে কিছু বলতে পারতেন না। বরং উনি নিজেই এখন কষ্ট পেতেন। নিশীথ চুপ থাকার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠলো। সবাই বুঝলো নিশান বাসায় এসে গেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই নিশান দাদুর রুমে ঢুকতেই বাপ-দাদা ও ভাইকে একসাথে দেখে বেশ চমকে গেলো। কথায় আছে, চোরের মন পুলিশ পুলিশ। নিশানের ক্ষেত্রেও হলো ঠিক তাই। নিশীথকে এখানে দেখে সন্দেহের সুরে প্রশ্ন করলো,
—তুই এখানে? কখন এলি?
—সন্ধ্যায় এসেছি। কেন? আমি আসতে পারিনা এ বাসায়?
—আমি একবারও বলেছি আসতে পারবিনা? নরমালি তো আসিসনা। আজ হঠাৎ এলি এজন্যই বললাম।
—আজকেও আসার প্ল্যান ছিলোনা। তোমার জন্যই আসতে বাধ্য হয়েছি, ভাইয়া।
নিশান ঢোক গিলে বলে,
—ম,মানে?
আয়মান সাহেব বিরক্তিকর সুরে বললেন,
—কি তখন থেকে কথা প্যাচানো শুরু করেছিস তোরা? তুই নিজের ঘড়ি ছেড়ে এসেছিলি ওর ওখানে। সেটা দিতে এসেছে।
বাবার কথায় নিশান যেন স্বস্তি ফিরে পেলো। জোরপূর্বক হেসে বললো,
—ওহ আচ্ছা। সেটা বলো।
ভাইয়ের অবস্থা দেখে নিশীথ মনে মনে হাসলো। ভাবলো, আমাকে তো সত্যি বলা থেকে আটকাতে পারবে ভাইয়া, কিন্তু এবার বাবা তোমাকে যা বলবে সেটা শুনার পর কিভাবে তুমি মিথ্যা বলো আমিও দেখবো!
নিশীথের মনে মনে বলা কথাটা শেষ না হতেই আয়মান সাহেব গলা খ্যাকারি দিয়ে উঠলেন। নিশানের দিক চেয়ে হাসি মুখে বললেন,
—বাবা নিশান, তোমার কাছে একটা প্রশ্ন ছিলো
—কি প্রশ্ন?
নিশান ভ্রু কুচকে শুধায়। আয়মান সাহেব গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
—তোমার জীবনে কি বিশেষ কেউ আছে?
—হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
নিশান জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে। আয়মান সাহেব আর রাখঢাক না করে সরাসরি বললেন,
—প্রশ্ন করলাম কারণ আছে। তোমার মাসুদ আংকেল কে তো চিনোই? আমাদের কোম্পানিতে ছিলো এক কালে, আমার খুব কাছের বন্ধু। ওরা তো পরে নিজেদের ব্যবসা শুরু করে দিয়েছিল। মাশাল্লাহ ভালোই বড় ব্যবসা ওদের। এত সচ্ছল অবস্থা হয়েছে…
—বাবা, এখন তুমি এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলছো কেন? যা বলার সরাসরি বলো তো!
নিশান সরু চোখে প্রশ্ন করে। আয়মান সাহেব ভনিতা ছাড়াই সরাসরি বললেন,
—ওর ছোট ভাইয়ের মেয়ে, সাইমা। অনার্স পাস করলো এবার ব্র্যাক থেকে। ছেলে খুজছে ওর জন্য। তাই তোমার জন্য সাইমার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। মেয়েটা খুব সুন্দর, আমার ধারণা তোমার পছন্দ হবে আর…
—এক মিনিট, বাবা। একটু থামো
নিশান হাত সামনে দিয়ে ইশারা করে বাবাকে থামিয়ে দেয়। নিশীথ এবার এক্সাইটমেন্টে নিশ্বাস আটকে রাখে ভাই কখন নিজের বিয়ের বো’মা ফাটায় সেটা শুনার অপেক্ষায়। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে নিশান বললো,
—বাবা আমি এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত নই।
—ওমা। এটা কেমন কথা? তোর ছোটভাই বিয়ে করে বসে রয়েছে আর তুই বলছিস এখনো বিয়ের জন্য প্রস্তুত না?
আয়মান সাহেব অবিশ্বাস্য স্বরে বললেন। নিশান মাথা নিচু করে বললো,
—বাংলাদেশের লাইফস্টাইল আর কানাডার লাইফস্টাইল সেইম না। বিদেশে অনেককিছুরই ব্যাপার আছে। এমন একটা ডিসিশন হুট করেই তো আর নিতে পারিনা তাইনা!
আয়মান সাহেব কিছু বলতে যেয়ে ভেবে দেখলেন ছেলের কথাই ঠিক। ও যখন বলছে মানে ভেবেচিন্তেই হয়তো বলছে। তাই আর মাথা গলালেন না। শুধু বললেন,
—ঠিক আছে। তুই যখন রেডি হবি আমাকে জানাস শুধু। আমি মেয়ে দেখা শুরু করবো।
নিশান মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। আয়মান সাহেব খুশিমনে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। পাশেই নিশীথ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে নিশানের দিকে চেয়ে আছে। ওর সেই দৃষ্টিতে চোখ মেলাতে পারছেনা নিশান। জীবনে এ প্রথম ভাইয়ের প্রতি এতটা বিতৃষ্ণায় গা গুলিয়ে উঠছে ওর!
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭১
কিভাবে একটা মানুষ এতটা পরিবর্তন হতে পারে নিশীথ কোনোভাবেই বুঝতে পারেনা। যেখানে আজ পুরো সুযোগ ছিলো বাবাকে সত্যিটা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলার সেখানে নিশান সুযোগ পেয়েও সেটাকে পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিলো। উপরন্তু বাবাকে ওর বিয়ে নিয়ে মিথ্যা আশ্বাস দিলো? এমনটা করার আগে একবারো কি ওর বুক কাপলোনা? নাকি আবেগগুলো নিশান বিবেকের সাথে কানাডাতেই ফেলে এসেছে?
নিশীথের মনে সহস্র প্রশ্ন আসে!