দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৪

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৪
তাসফিয়া হাসান তুরফা

পরদিন তালুকদার ম্যানশন এ যখন তিনজনে পৌঁছালো তখন আয়মান সাহেব বাসায় ছিলেন না। তিনি নাকি নিশানকে নিয়ে অফিসে গেছেন। পরশু রাতে ফ্লাইট নিশানের। ও চলে যাওয়ার আগে বাবার সাথে অফিসে গেছে কিছু কাজে। আয়মান সাহেবকে না দেখে আসমা যদিও বেশ হতাশ হলেন তবু শ্বশুরকে অনেকদিন পর দেখে তার ভালোও লাগলো। এদিকে কোনো কিছু না জানা ইউনুস সাহেব একসাথে বৌমা, নাতি ও নাতবউ কে দেখে ভীষণ খুশি হলেন! সারাদিন বাসায় একা থাকায় বৃদ্ধার ভালো লাগেনা। অনেকদিন এ বাসায় ওদেরকে পেয়ে যেন তিনি সব ভুলে গেলেন। গদগদ স্বরে বললেন,

—তোরা সবাই একসাথে? থাকতে এসেছিস এখানে?
দাদুর চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখে নিশীথের মন চাইলোনা তাকে সত্যিটা বলতে। কিন্তু আসমা বেগম যেন আজ অন্যরকম এক মুডে আছেন। তিনি চোখমুখ গম্ভীর করে বললেন,
—থাকতে আসিনি, আব্বা। অনেক জরুরি একটা আলাপ করতে এসেছিলাম আপনার ছেলের সাথে।
বৌমার গম্ভীর মুখখানা দেখে বুড়ো মনে মনে ভড়কে গেলেন। চিন্তিত হয়ে বললেন,
—কি হয়েছে, বৌমা? এভাবে বলছো কেন?
—অনেক বড় অকাজ হয়েছে, আব্বা। সেটা আর কেউ না বরং আপনার বড় নাতি করেছে।
—নিশান? ও কি করলো আবার?
—ও বিয়ে করেছে আমাদের কাউকে না বলে।
ইউনুস সাহেব বেশ অবাক হলেন। চোখ বড় করে বললেন,
—কবে? দেশে আমরা জানলাম না কেন?
বৃদ্ধর সরলতায় আসমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—দেশে করলে তো আমরা জানতামই। এজন্য বিদেশে কাজ সেড়ে এসেছে। তাও খ্রিস্টান মেয়েকে!
স্তব্ধ ইউনুস সাহেব ক্রোধে ফেটে পড়লেন যেন। রেগেমেগে উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে বললেন,
—আমি জানতাম এমন কিছু হতে পারে। সে সময় কতজন আমাকে বলেছিলো নাতিকে এত কম বয়সে বিদেশ পাঠিয়োনা, অন্তত দেশে কাবিন করে রেখে বিদেশ পাঠাও। কিন্তু নিশান কেবল ইন্টার পাস করেছিল আর আয়মান এর অহংকারে ওকে আমি বিদেশ যাওয়া থেকে আটকাতে পারিনি! সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিলে আজ এমন হতোনা কখনো!
দাদু রাগে কাপছেন রীতিমতো। নিশীথ তাড়াতাড়ি যেয়ে দাদুকে ধরে। এ বয়সে এত স্ট্রেস নেওয়া শরীরের জন্য ভীষণ খারাপ। দাদুকে ধরে জোর করে খাটে বসিয়ে দিয়ে বলে,
—এখন এসব বলে কোন লাভ আছে, দাদু? যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। এটাই হয়তো কপালে লেখা ছিলো। এখন বলে কি লাভ!

তবু ইউনুস সাহেব থামলেন না। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,
—এগুলো সব আয়মানের দোষ। আসুক আজকে হতচ্ছাড়া! ওকে দেখাবো আমি আজকে ওর অহংকারের ফল।
—দাদু, তুমি শান্ত হও এখন। এত স্ট্রেস নিওনা। তোমার শরীরের জন্য ভালোনা। বাবা আসুক এরপর আস্তেধীরে কথা বলো। এখন রিল্যাক্স হও একটু!
—কিসের রিল্যাক্স হবো? আর নিশীথ তুই এগুলো বলছিস? আয়মান সারাজীবন নিশানের জন্য তোকে উপেক্ষা করেছে, তোর গুরুত্ব বুঝেনাই। আর তুই কিনা ওর হয়ে আমাকে শান্ত হতে বলছিস? তুই আদৌ আমার নিশীথ তো?
দাদুর কথায় নিশীথ চুপ হয়ে যায়। আসলেই তো! ওর তো খুশি হওয়া উচিত ছিলো বাবার সাথে এমন হওয়ায়। ও তো লোকটাকে কথা শুনানোর মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেছে এবার। ওর তো মজা পাওয়ার কথা এসবে! কিন্তু নিশীথ কোন মজা পাচ্ছেনা, ও মুখে অস্বীকার করলেও ওর মনের একটা কোণে কষ্ট লাগছে বাবার কথা ভেবে। নিশানই বোধহয় একমাত্র ছিলো যাকে আয়মান সাহেব কোন স্বার্থ ছাড়াই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। আর সেই ছেলেই কিনা এভাবে বাবার থেকে একেরপর এক সব লুকিয়ে গেছে? বিষয়টা সত্যিই কষ্টকর। তাই নিশীথের ভেতরকার পুত্রসত্ত্বা ওকে খুশি হতে দিলোনা। নিশীথ নিচু গলায় বলল,

—সে যতই আমাকে উপেক্ষা করুক, আমি তো চাইলেও তাকে উপেক্ষা করতে পারবোনা। তাইনা দাদু? বাবা-ছেলের সম্পর্কটাই তো এমন। তোমার ও বাবার মাঝে অতীতে যা বোঝাপড়া হয়েছে তার পর কি বাবা তোমায় একবারও উপেক্ষা করতে পেরেছে?
এবার ইউনুস সাহেব আর উত্তর দিতে পারলেননা। হঠাৎ অতীত মনে পরে যাওয়ায় চুপ করে গেলেন। তা দেখে নিশীথ বলে,
—তুমি চিন্তা করোনা, দাদু। কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তো আছেই ভাইয়া দেশে। দেখা যাক ও নিজে থেকে বলে নাকি? না বললে আমরাই ওকে প্রশ্ন করবো। বাবাকেও আজকেই বলার দরকার নেই। তারও বয়স হয়েছে, হুট করে শুনলে কি হয় না হয়! এরচেয়ে কাল আমরা আসবোই তো এখানে ভাইয়াকে বিদায় দিতে। সব হিসেব-নিকেশ কাল হয়ে তবেই ও কানাডা যাবে।
নিশীথের কথায় এবার সবাই একমত হলো। এমন একটা বিষয়ে একা একা কথা না বলে পুরো ফ্যামিলি মিলেই নিশানের সাথে কথা বলা উচিত। অর্থাৎ কালকেই সব হিসাব হবে!

আসমা বেগম ও নিশীথ বাসায় চলে গেলেও, দোলা ওখান থেকে সরাসরি চলে গেলো ওর মায়ের বাসায়। অনেকদিন মা ও ভাইবোনের সাথে দেখা হয়নি! ওদের সাথে সময় কাটিয়ে বিকেল হয়ে এলো। দোলা যেতে যেতে পার্ক দেখে ভাবলো, অনেকদিন এ পথে হাটা হয়না! ও হাটতে হাটতে পার্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলো আর নিশীথের সাথে এখানে বিয়ের আগের পুরনো স্মৃতি মনে করছিল। পুরনো কথা ভেবে দোলা হাসতে হাসতেই সামনে তাকিয়ে দেখে আয়মান সাহেব একটা লোকের সাথে বেশ উৎসাহ নিয়ে কথা বলছেন। তা দেখে দোলার ভ্রু কুচকে যায়। ভাবে, বাবার তো এ সময় অফিসে থাকার কথা। তিনি অফিস বাদ দিয়ে এখানে কি করছেন?
দোলা খুব কনফিউশানে পড়লো। ও কি চলে যাবে নাকি একটু অপেক্ষা করে দেখবে। পরে ভাবলো অপেক্ষা করেও বা কি করবে? আয়মান সাহেব ওকে দেখে কথা বলবেন না তো এমনিতেও। তাই নিজের চর্কায় তেল দিয়ে ও আপনমনে হেটে যাচ্ছিলো। এমন সময় নিজের নাম শুনে ও থেমে যায়। পরিচিত কণ্ঠ ওকে ডেকে উঠলো, “দোলনচাঁপা”

শ্বশুর এর মুখে দোলা নিজের নাম শুনে চমকে উঠে দাড়ালো নিজ স্থানে। আয়মান সাহেব ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেব দেখে দোলা ভদ্রতার খাতিরে এগিয়ে গেলো তার দিকে। সালাম দিতেই মাথা নেড়ে তিনি জবাব নিলেন। পাশের লোকটা জিজ্ঞেস করলো,
—মেয়েটাকে তুই চিনিস, আয়মান?
—আমার ছোটছেলের বউ, দোলনচাঁপা।
আয়মান সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন। লোকটা হেসে বললো,
—বাহ! তোর ছেলের বউ তো ভীষণ মিষ্টি দেখতে। খুব সুন্দর মানিয়েছে নিশীথের সাথে।
দোলা পরিচয় পর্বের মাধ্যমে জানতে পারলো লোকটা আয়মান সাহেবের বন্ধু এবং এখানে নাকি তারা নিশানের জন্য মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন। এটা আয়মান সাহেব ওকে বলেনি, বন্ধু লোকটা নিজেই আগ বাড়িয়ে ওকে জানিয়ে দিলো। তা দেখে আয়মান সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন,
—হয়েছে তুই চুপ কর এখন। আর তুমি এদিকে একা একা কি করছো? নিশীথ কোথায়? আজকে অফিসেও এলোনা আমি ভেবেছি বাসায় আছে।

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৩

—জি, উনি বাসায়ই আছেন। আমরা আপনার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম ও বাসায়। আপনি ছিলেন না দেখে সবাই বাসায় চলে গিয়েছে।
—সবাই আমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে? কেন? কিছু হয়েছে?
আয়মান সাহেবের কণ্ঠে সন্দেহের রেশ। দোলা পড়লো বিপাকে। নিশীথ তো কালকে জানাতে চেয়েছে বাবাকে। তবে এখন দোলা কি বলবে?

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৫