দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৫ (২)
তাসফিয়া হাসান তুরফা
আয়মান সাহেব বজ্রাহতের ন্যায় শুধালেন,
—কি বললে?
—নিশান ভাইয়া বিয়ে করেছে।
—সেটা তুমি কিভাবে জানলে? নিশান বলেছে?
—হ্যা, নিশীথকে বলেছে। উনিই আমাকে বলেছেন।
দোলা আবারও ভয়ে ভয়ে বললো। এতক্ষণ আবেগের বশে সত্যিটা বলে দিয়ে এবার ওর একটু ভয় লাগছে। বাবা ওকে ভুল বুঝবেন না তো? আবার সত্যিটা জেনে উনার কিছু হবেনা তো? এদিকে আয়মান সাহেবের চেহারায় স্পষ্ট অস্থিরতা বিরাজমান! অশান্ত কণ্ঠে দোলাকে বলছেন,
—আর কি কি বলেছে ও নিশীথকে? আমায় সবকিছু খুলে বলো, দোলনচাঁপা! নিশান আমাকে কিছুই বলেনি। আমি কিচ্ছুই জানিনা।
দোলা বলবেনা বলবেনা করেও ইতস্তত করে সবকিছু খুলে বললো। বলে যখন দিয়েছেই তখন পুরোপুরি বলে দেওয়াই ভালো। অযথা লুকিয়ে তো লাভ নেই আর! আয়মান সাহেবের অস্থিরতা ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলেছে। তিনি হাতের মুঠো একবার খুলছেন আবার বন্ধ করছেন। বিভ্রান্তের ন্যায় বললেন,
—বিয়ে করতে চায় আমাকে বললেই তো পারতো। আমি কি ওকে কোনকিছুর জন্য মানা করেছি যে এটার জন্য করবো? নিশীথকেই মানা করতে পারিনি। ওর পছন্দের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছি সেখানে নিশানকে কেন বাধা দিতাম? তাও ওরা বিদেশ থাকবে নিজের মতো করে খাবে। ও আমার সাথে এমন কেন করলো, দোলনচাঁপা? তুমি কি বলতে পারো? একবারো কি আমায় বলতে পারতোনা?
উনার কণ্ঠে একিসাথে রাগ একিসাথে অভিমান। দোলার কষ্ট লাগলো। কিন্তু ও শক্ত হয়ে বললো,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
—কারণ ছিলো বলেই হয়তো বলেনি!
—মানে?
আয়মান সাহেব সন্দিহান! দোলা চোখমুখ শক্ত করে বলে,
—ভাইয়ার বউয়ের নাম ক্যাথরিন। উনি খ্রিস্টান, কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা। জন্ম থেকেই সেদেশে আছেন।
এবার আয়মান সাহেবের মাথায় যেন আরেকবার বজ্রপাত হলো! এবারের মাত্রাটা আগের চেয়ে বেশি। উনি বুকে কিছুক্ষণ হাত চেপে ঢললেন। দোলা ঘাবড়ে গেলো, এই বুঝি হার্ট অ্যাটাক করে বসে শ্বশুর। দোলা ভীত কণ্ঠে আয়মান সাহেবের কাধে হাত কাপা কাপা হাত রেখে বললো,
—বাবা! আপনি ঠিক আছেন তো?
আয়মান সাহেব হাত তুলে ওকে ইশারায় থামিয়ে দিলেন। জোরে জোরে কতক্ষণ নিশ্বাস নিলেন পাগলের মতো। তার মাথায় আর কোনোকিছু কাজ করছেনা এখন। চোখেমুখে আধার দেখছেন। আয়মান সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে বন্যায় সবকিছু ভেসে যাওয়া মানুষ শেষ স্মৃতি যেভাবে আকড়ে ধরার চেষ্টা করে, উনিও নিশানের প্রতি সেভাবেই নিজের আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। জীবনে প্রথম প্রেম হারিয়ে বাবার চাপে আরেকজনকে বিয়ে করে যখন আয়মান সাহেব দিনদুনিয়ার প্রতি উদাসীন ছিলেন তখন তার পৃথিবী আলো করে দুনিয়ায় নিশানের আবির্ভাব ঘটে আসমার কোলে। ওই ছোট্ট প্রাণ যখন আশেপাশের কারও কোলেই কান্না থামাচ্ছিলোনা তখন আয়মানের বুকে যেতেই ও কান্না থামিয়ে ছোট্ট হাতে তার আংগুল চেপে ধরে বড় বড় চোখে তার দিকে তাকায়। আয়মান সাহেব লক্ষ্য করেন, তার বুকের মাঝে পাথর হয়ে থাকা ভালোবাসাটা ওই মাসুম বাচ্চার পরশে চুইয়ে পড়তে শুরু করেছে। সেই থেকে নিশানের প্রতি তার দূর্বলতা শুরু। প্রথম সন্তানের প্রতি সব মা-বাবার কিছু দূর্বলতা থাকে, আয়মান সাহেবও ব্যতিক্রম ছিলেন না। বিশেষত নিশান তার জীবনে এমন সময় এসেছিলো যখন তার জীবনে অন্য কাউকে ভালোবাসার জন্য তার ইচ্ছে ছিলোনা। তাই নিশানের প্রতি তার টান সবসময় বেশি। কিন্তু সেই প্রিয় সন্তান যখন বড় হয় তখন আবেগের বশে এমন সিদ্ধান্ত নেয় যা বাবা-মায়ের সম্মান বাকি রাখেনা আর। তখন অতিরিক্ত শোকে বাপ-মায়ের বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকেনা!
আয়মান সাহেবও অতি শোকে পাথরের মতো জমে আছেন। তিনি না নড়ছেন, না কথা বলছেন, এমনকি মাথাটাও নিচের দিক নোয়ানো! দোলার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। অন্তর ছটফট করেছে। তবে ও তাড়াহুড়ো করলোনা। শ্বশুরকে শান্ত হওয়ার, নিজেকে সামলে নেওয়ার জন্য সময় দিলো। বেশ অনেকক্ষণ অতিক্রম হওয়ার পর দোলা এবার মাথা কাত করে আয়মান সাহেবের চেহারার দিকে তাকালো। মনোযোগ দিয়ে তার গতিবিধি মনোভাব বুঝার চেষ্টা করলো। অথচ দেখলো এখন তিনি রাগ হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে তাকালেন।
তাকে দেখে মনে হলো যেন আল্লাহর কাছে জবাব চেয়ে তাকিয়ে আছেন!
সবসময় একরকম তেজী ভাবে থাকা লোকটাকে দোলা এমন অদ্ভুত শান্ত ভাবে থাকতে কখনো দেখেনি। তার মধ্যে ঘটনা যখন তার প্রিয় ছেলের বিয়ের তখন তো কস্মিনকালেও তার থেকে এমন রিয়েকশন আসবে সেটা ভাবেনি! আয়মান সাহেব কিছু বলছেন না দেখে দোলা আস্তে করে ভয়ে ভয়ে তাকে ডাকলো,
—বাবা?
আয়মান সাহেব নিরবে দোলার দিকে তাকালেন। এবার দোলার বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। মেঘে ঢাকা বিকেলের পড়ন্ত আলোতে ও স্পষ্ট টের পেলো ওর সামনে বসা আয়মান সাহেবের চোখে পানি। লোকটা চুপচাপ মাথা নিচু করে রেখেছেন, যেন মাথা তুললেই তিনি কেদে ফেলবেন! দোলা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলোনা। ওর শ্বশুর কাদছেন? তাও ওর সামনে? কষ্টে দোলার বুক ভেসে আসছে। একিসাথে ওর মনে হলো যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। হঠাৎ অপরাধবোধে কান্না গলায় দলাপেকে যাচ্ছে। মুহুর্তের মাঝে দোলার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অনর্গল অশ্রুজল। আয়মান সাহেব বললেন,
—তুমি কাদছো কেন?
আয়মান সাহেব কম্পিত কণ্ঠে শুধালেন। দোলা কান্নার মাঝেই জবাব দিলো,
—আপনি কাঁদছেন তাই!
—আমি তো কাদছি নিজের ভাগের পরিহাসে। নিজের কষ্টে। তোমার তো কান্নার কারণ নেই!
দোলা কান্নার মাঝেই হিচকি তুলে বললো,
—বাবার কষ্ট দেখে মেয়ে কি স্বাভাবিক থাকতে পারে? আমার তো বাবা নেই। আপনি আমার বাবার মতোই। আপনাকে কষ্টে দেখে আমারও কষ্ট লাগছে!
দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৭৫
আয়মান সাহেবের বুক চিড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। তার নিজের সন্তান যে কিনা বাবার কষ্টের কথা পরোয়া না করে, নিজের জীবনের এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারলো আর কয়েক মাস আগে বিয়ে হয়ে তার ছেলের ঘরে আসা এক মেয়ে তার চোখে পানি দেখে নিজেও কেদে বুক ভাসাচ্ছে! তবে কি উনি সারাজীবন মানুষ চিনতে ভুলই করে গেলেন?