দোলনচাঁপার সুবাস শেষ পর্ব 

দোলনচাঁপার সুবাস শেষ পর্ব 
তাসফিয়া হাসান তুরফা

এক মাস পরের কথা। রোজকার ন্যায় সেদিন অফিস করছিলো নিশীথ। মিটিং এ ছিলো বাপ-চাচাদের সাথে। মিটিং এর মাঝে সবার ফোন সিলেন্ট থাকে। নিশীথ প্রেজেন্ট করছিলো ওদের প্রজেক্ট। এরই মাঝে ওর এসিস্ট্যান্ট এসে কথা বলায় বেশ রেগে যায় ও। এসিস্ট্যান্ট নিরুপায় মুখে বলে,
—এক্সট্রিমলি সরি এ সময়ে আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য, স্যার। কিন্তু আপনার মা বারবার কল দিচ্ছেন, ৫ বার ফোন দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। এজন্যই আপনাকে দিতে এসেছি হয়তো ইমার্জেন্সি কিছু হবে মনে করে।
এতক্ষণ অতিশয় বিরক্ত হলেও এবার নিশীথ মায়ের ফোন এসেছে শুনে বিরক্ত হতে পারেনা। বরং মনে ভর করে অজানা ভয়। দোলা ঠিক আছে তো? ওর ব্যথা উঠেনি তো? নিশীথ সবাইকে এক্সকিউজ মি বলে রুম ত্যাগ করে। মাকে ফোন দিতেই দাদু ফোন রিসিভ করেন। বললেন,

—তাড়াতাড়ি হাসপাতালে আয়, দাদুভাই। দোলার ব্যথা উঠেছে, আমি বৌমা গাড়িতে এখন ওকে নিয়ে যাচ্ছি হাসপাতালে। তোরাও ওদিক থেকে রওনা দে। যতদ্রুত সম্ভব ডেলিভারি করাতে হবে।
দাদুর কথা শুনে ওখানেই নিশীথের হার্টবিট বেড়ে যায়। ও দৌড়ে কনফারেন্স রুমে যেয়ে সবাইকে সরি বলে দ্রুত বের হয়ে যায় সেখান থেকে। আয়মান সাহেব এসিস্ট্যান্ট এর কাছে থেকে সব শুনে নিজেও আর বসে থাকতে পারেন না। আজকের মিটিং এখানেই শেষ বলে তিনিও হাটা দেন ছেলের পিছে। বাপ-ছেলে মিলে দুজনে এক গাড়িতে বসে রওনা হয় হসপিটালের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে জ্যামে থাকায় নিশীথ রে’গে হাটা দিতে চায়, আয়মান সাহেব ছেলেকে থামান। নিশীথের হাত ধরে বলেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—জোশের বশে হুশ হারিয়ে ফেলিস না। এতদূরের রাস্তা তুই হেটে কিভাবে যাবি? বেশি হলেও দশ মিনিট লাগবে জ্যাম ছাড়তে এরপর জোরে টান দিলেই আমরা পৌঁছে যাবো অনেকদূর।
—আপনি তো বুঝবেন না আমার ভেতরে এখন কি হচ্ছে তাই এসব বলছেন। না জানি ওখানে আমার দোলনচাঁপা একা কতটা কষ্ট পাচ্ছে! আমাকে মনে মনে কতই না স্মরণ করছে। আর আমি কিনা এখানে জ্যামে বসে সময় নষ্ট করছি!
নিশীথ ফোসফাস করে বললো। আয়মান সাহেব বেশ মনোযোগ দিয়ে নিশীথ কে দেখলেন। বেচারার মুখটা রাগে টেনশনে লাল হয়ে গেছে। তিনি আওয়াজ নরম করলেন। ছেলেকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

—তুই যতটা ভাবছিস অত সময় লাগবেনা, বাবা। বিশ্বাস কর আমার কথা। দেখ ওইতো সামনে জ্যাম ছাড়ছে। আমরা এক্ষুনি পৌঁছে যাবো তোর দোলনচাঁপার কাছে। মনে মনে আল্লাহকে ডাক। কিচ্ছু হবেনা ইন শা আল্লাহ!
বাবার নরম সুরে কাজ দিলো। নিশীথ চোখ বুজে আল্লাহকে ডাকলো। কিছুক্ষণের মাঝে জ্যাম ছাড়তেই ওরা হসপিটালে পৌঁছে গেলো। নিশীথ পৌঁছানোর পর থেকেই হন্যে হয়ে দোলাকে খুজতে লাগলো। কিন্তু উপরে গিয়ে মার থেকে জানতে পারলো দোলাকে এতক্ষণে ওটির মাঝে ঢুকানো হয়ে গিয়েছে। প্রচন্ড ব্যথায় ওর অবস্থা খুব একটা ভালো ছিলোনা দেখেই ডাক্তার আর সময় নষ্ট না করে ওটিতে নিয়েছে। দোলার নর্মালে ডেলিভারি হবেনা। সিজারই করতে হবে। নিশীথ রেগে বললো,

—আমায় না বলেই তোমরা ওটিতে ঢুকিয়ে দিলে? একটাবার আমাকে ফোন দিয়ে জানানোরও প্রয়োজন মনে করলানা, মা?
—তোর ফোনে কল দিয়েছিলাম বাবা। বন্ধ দেখাচ্ছিলো। তোর বাবাও যে তোর সাথে আসবে জানতাম না এজন্যই উনাকেও ফোন দেইনি। আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে দোলাকে ঢুকিয়ে দিয়েছি।
নিশীথ পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে আসলেই বন্ধ হয়ে আছে ফোন। আজকের মিটিং এর প্রেসারে চার্জটাও দেওয়ার কথা খেয়াল ছিলোনা। ও রাগে ফোন মেঝেটে ছুড়ে মারায় মুহুর্তেই ফোনটা দুখন্ড হয়ে যায় ভেঙে। আসমা বেগম কিছুটা ভয়ই পান ছেলের এ অবস্থা দেখে। প্রায় সাথে সাথেই হাসপাতালের একটা স্টাফ এসে বলে,

—স্যার এটা হাসপাতাল। প্লিজ এখানে জোরে চিল্লাচিল্লি করবেন না এবং জিনিস ভাংবেন না। আপনাদের জন্য বাকি রোগীদের ডিস্টার্ব হতে পারে।
নিশীথ রাগতে যেয়েও নিজেকে কন্ট্রোল করলো। আসলেই ছেলেটা ঠিকি বলছে। ওর মতো আরও স্বামী নিজেদের বউ বাচ্চার অপেক্ষা করছে। নিজের স্বার্থের জন্য ওদের ডিস্টার্ব করাটা উচিত হবেনা। নিশীথ থামলো বহুকষ্টে। কিন্তু ভেতরের অস্থিরতা দমিয়ে রাখতে পারলোনা তাই এলোমেলো ভাবে চারদিকে পায়চারি করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মাঝেই দোলার মা, পারভীন বেগমও হাজির হলেন শিমুল কামিনিকে নিয়ে। প্রথম মেয়ের সন্তান তাও আবার জমজ বাচ্চা টেনশনে শেষ হচ্ছেন তিনিও। ডেলিভারি হতে অনেকটাই সময় লাগলো। যত সময় ঘনালো নিশীথের চিন্তার জগতে আরও ডালপালা গজাতে লাগলো। পারভীন বেগম আসমা বেগমকে জিজ্ঞেস করছেন,

—দোলা ওটিতে যাওয়ার আগে কেমন ছিলো? ওর কি অনেক বেশি খারাপ অবস্থা ছিলো?
আসমা বেগম বেয়াই এর কথা শুনে আড়চোখে পায়চারি রত ছেলেকে দেখে নেন। অনেক কষ্টে শান্ত হয়েছে ছেলেটা। এখন যদি ও শুনে ওটিতে নেওয়ার আগে দোলা বারবার নিশীথকে দেখতে চাইছিলো তবে নিশীথকে আর থামানো যাবেনা! দেখা যাচ্ছে পাগল হয়ে সোজা ওটির মধ্যে ঢুকে গেছে!
তাই তিনি পারভীন বেগমকে সান্ত্বনা দিতে বললেন,

—হ্যাঁ, সব ঠিক ছিলো। প্রথম বার বাচ্চা হবে তাও জমজ, বুঝেন না? ঘাবড়ে যাচ্ছিলো অনেক। তবে আমাদের মেয়েটা বেশ সাহসী। ওর ডেলিভারি ঠিকি সফল হবে দেখে নিয়েন। আমরা জলদিই নাতি-নাতনিদের কোলে নিবো!
নিশীথ চুপচাপ শুনলো মায়ের বলা কথাগুলো। ওর কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম বেয়ে পড়ছে। এতগুলো মানুষ মিলেও ওকে শান্ত করতে ব্যর্থ! বারবার সেদিন রাতের দোলার বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দোলা ও ওদের বাচ্চারা ভালো থাকবে তো? কেন ওদের ডেলিভারির আগে দেখা হলোনা? এটাও কোন বাজে সংকেত নয় তো?

দোলাকে হারানোর কথা মাথায় আসতেই নিশীথের দু চোখ বেয়ে পানি পড়তে আরম্ভ করে। আয়মান সাহেব আড়াল হতে খেয়াল করলেন ছেলেকে। কখনো নিশীথ কে এমন পরিস্থিতি তে দেখবেন তিনি ভাবেননি। উনি চুপিসারে এগিয়ে এলেন ছেলের কাছে। পেছন থেকে নিশীথের কাধে হাত রাখতেই ও বাবাকে দেখে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলোনা। আয়মান সাহেবও নিজের সবশক্তি দিয়ে ছেলেকে আগলে রাখেন বুকের মাঝে।
“আমার দোলনচাঁপার কিছু হবেনা তো, বাবা? আমার বাচ্চারা ভালোমতো দুনিয়ায় আসবে তো, তাইনা?”
নিশীথ কতদিন পর আয়মান সাহেবকে “বাবা” বলে সম্বোধন করলো ও জানেনা। আয়মান সাহেব নিজেও অবাক। এবার ছেলের পাশাপাশি খোদ তিনিও আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন। নিশীথ কাদছে তার সন্তানের জন্য, আয়মান কাদছেন তার সন্তানের জন্য! তিনি আশ্বাস দিয়ে বললেন,

—অবশ্যই, বাবা। একদম চিন্তা করিস না। আল্লাহ আছেনা? সব ভালো হবে দেখিস! এইতো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তোর সন্তান তোর কোলে থাকবে!
আয়মান সাহেব এর বলাও শেষ হলো আর ওটি থেকে একটা নার্স বের হলো। তিনি বললেন,
—মিসেস দোলনচাঁপার ফ্যামিলি কোথায়? উনার হাসবেন্ড কই?
নিশীথ দ্রুত চোখ মুছে এগিয়ে যেয়ে বল্লো,
—আমি ওর হাসবেন্ড। দোলা, আমার বাচ্চারা ঠিক আছে? ডেলিভারি শেষ?
—জি, বাচ্চারা ঠিক আছে। এখনি দিয়ে যাচ্ছি।

বলেই নার্স চলে গেলো। বাচ্চাদের কথা শুনে সবাই খুশি হলেও নিশীথের খটকা লাগলো। দোলার ব্যাপারে কিছু বললোনা কেন? নিশীথ বেশিক্ষণ ভাবনার সময় পেলোনা এর মাঝেই বাচ্চাদের নিয়ে নার্সরা চলে এসেছে। ফুটফুটে দুটো নিষ্পাপ প্রাণ। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে চুপ করে আরেকজন টুকুরটুকুর করে চাইছে আশেপাশে। নিশীথ হাসলো! এই বাচ্চাটা নির্ঘাত ওর মতোই হবে। দূরন্ত চঞ্চল। আরেকটা ওর দোলার মতো শান্তশিষ্ট! নিশীথ কাপা কাপা হাতে মেয়েকে কোলে নিলো। বাচ্চাটা এখনো টুকটুক করেই চেয়ে আছে! ওর চাহনি নিশীথের মন কেড়ে নিলো। বুকের মাঝে এমন এক অনুভূতি সৃষ্টি হলো যা আগে কোনদিনও হয়নি। এটাকেই বুঝি বাবা হওয়ার অনুভূতি বলে? নিশীথের চোখজোড়া পুনরায় ভিজে উঠে। সামনেই আয়মান সাহেব মুগ্ধ নয়নে ছেলের কোলে তার মেয়েকে দেখছেন। উনি কিছুক্ষণ পর খানিকটা ইতস্তত করে হাত বাড়িয়ে বললেন,

—তোর মেয়েকে আমার কোলে একটু দিবি, বাবা?
তাকে অবাক করে দিয়ে নিশীথ হাসিমুখে বাচ্চাকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—তোমার নাতনি ও। অবশ্যই নিবে! নেও সাবধানে ধরো!
আয়মান সাহেব নাতনিকে কোলে নিয়ে মন ভরে দেখলেন। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলেন দুই বাচ্চাকে ঠিকভাবে দুনিয়ায় এনে দেওয়ার জন্য। ওদিকে পারভীন বেগম ছেলেবাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে গেছেন বেশ। তার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়লো। তিনি নিশীথকে ডেকে বললেন,
—আমার দোলার কি অবস্থা, বাবা? নার্স কিছু বললো?
নিশীথ শাশুড়িকে কিছু বললোনা। নিজেই রুমের মধ্যে ঢুকতে ধরলো এমন সময় একজন নার্স বললো,
—কি করছেন, স্যার? পেশেন্ট এর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। তার জ্ঞান না ফেরা অব্দি প্লিজ কেউ আসবেন না। জ্ঞান ফিরলে আমরাই জানাবো!

—এ কথাটা আগে বলেছিলেন? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার ওয়াইফ কেমন আছে তখন কেন বলতে পারেননি কথাটা?
নিশীথ নার্সকে ধমকে উঠে বলে। নার্স ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
—দুই বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ততায় শুনতে পারিনি আপনার কথাটা। আসলে এ সময় তো সবাই বাচ্চা নিয়ে বেশি এক্সাইটেড থাকে তো তাই আমরাও বাচ্চার দিকেই মনোযোগ দিয়েছিলাম।
—আমার বউয়ের জ্ঞান ফিরলে বলবেন। এন্ড ডোন্ট বি লেইট দিস টাইম!
নিশীথ আরেকবার শান্ত গলায় হুমকি দিয়ে আসে নার্সকে। নার্স ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কেটে বলে,
—ওরে ভালোবাসা! ভাব দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ায় এক উনার বউই যেন বাচ্চা পয়দা করেছে!

দোলার জ্ঞান ফিরতেই ও দেখলো ওকে ঘিরে আশেপাশে সবাই কান্নাকাটি করছে। কিন্তু কেন সেটা ও বুঝতে পারলোনা! সাথে সাথেই ওর মাথায় এলো ওর বাচ্চারা ঠিক আছে তো? নিশীথ কোথায়? ওকে কেন দেখছেনা! দোলা দূর্বল হাতে ইশারা করে ডাকতেই ওর মা এগিয়ে আসেন দৌড়ে। ওকে দেখে জড়িয়ে ধরে কতগুলো চুমু খান মুখজুড়ে! দোলা ধীর গলায় চিন্তিত স্বরে বলে,
—আমার বাচ্চারা কোথায়, মা? ওরা ঠিক আছে?
—সবাই ঠিক আছে। শুধু তুই ঠিক ছিলিনা। আল্লাহর অশেষ রহমতে তোর জ্ঞান ফিরেছে, মা। আরেকটু হলে আমিই হার্ট অ্যাটাক করতাম তোর জন্য!
—কি বলছো,মা?

দোলা কিছু বুঝতে পারেনা। এমনিতে দূর্বল শরীর, মাথা ভো ভো করছে এখনো। চোখ মেলে যে সবাইকে দেখবে তারও জো নেই। ওর জ্ঞান ফিরেছে দেখে নার্স বাচ্চা দুটোকে এনে ওর পাশে শুয়ে দেয়। দোলা ক্লান্ত শরীরে বাচ্চাদের দেখে মন ভরে। হাত নড়ানোর বল নেই তবু কষ্ট করে দুই বাচ্চাকে ছুয়ে দেয়। এত কষ্টের পর এই বাচ্চাদুটো এসেছে ওর জীবনে। আবেগে ওর মন ভরে যায়। তবে নিশীথকে এখনো না দেখাটা বিস্ময়কর। দোলা শুধায়,

—নিশীথ কোথায়?
আসমা বেগম কিছু বলার আগেই রুমে নিশীথ প্রবেশ করে। ওকে দেখেই দোলার মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে। নিশীথকে দেখে বলে,
—আপনি এসেছেন?
—হুম। এখন কেমন লাগছে?
—টায়ার্ড। আপনাকেই খুজছিলাম। বাবুদের দেখেছেন? ছেলেটা একদম আপনার মতো হয়েছে!
—আর মেয়েটা তোমার মতো মিষ্টি!
দোলা লাজুক হাসে। ওদের বাচ্চা ভাবতেই কত্ত শিহরণ বয়ে চলে মনে! অথচ ডেলিভারির আগে ও ভেবেছিলো আর কখনোই দেখা হবেনা বাচ্চাদের। দেখা হবেনা নিশীথের সাথেও! দোলাকে ভাবতে দেখে নিশীথ বলে,

—কি ভাবছো, দোলনচাঁপা?
—জানেন, আমি ভেবেছিলাম আর কখনোই আপনাকে দেখতে পারবোনা। বাচ্চাদের ধরতে পারবোনা। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা এসব সত্যি!
নিশীথ কিছু বললোনা। ঝুকে এসে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তমাকে। ফিসফিসিয়ে বললো,
—আমি থাকতে তোমার কিছুই হবেনা, দোলনচাঁপা!

ছয় বছর পরের কথা। ফুটফুটে দুটো বাচ্চা দুরন্তপনায় এদিক ওদিক ছুটছে। তাদের পেছনে দোলা ব্যস্ত পায়ে ছুটছে আর বলছে,
—নয়নতারা, এবার তো থাম তোরা। আর পারছিনা ছুটতে!
—থামবোনা, মাম্মি।
দুটো বাচ্চাই সমস্বরে জবাব দিলো। দোলা এতক্ষণে রীতিমতো হাপিয়ে উঠেছে ওদের পিছে ছুটে! ও থেমে গেলো। রেগে বললো,
—বেশি আহ্লাদ হয়ে গেছে না? আর খাওয়াবোই না আজ তোদের। না খেয়েই থাক তোরা।
—আমরা না খেলে পাপা তোমায় বকবে, মাম্মি।
তারা দুষ্টু গলায় বললো। মেয়ের সেয়ানা কথায় দোলা অবাক না হয়ে পারেনা। ও সুযোগবুঝে মেয়ের কান টেনে বললো,

—তাই বুঝি? আসুক তোর পাপা। আমিও দেখবো কাকে বকে তোদের না আমাকে!
—ব্যথা পাচ্ছি। কান ছাড়ো। পাপা আসতে দেরি আছে তখন ধরো। আজকে ফ্রাইডে!
তারার কথায় হেসে দোলা ওর কান ছেড়ে দেয়। মেয়েটা ভুল বলেনি, আজ শুক্রবার। নিশীথের আসতে দেরি হবে। এ ছয় বছরে অনেককিছুই পরিবর্তন হয়েছে ওদের জীবনে। ইউনুস সাহেব তিন বছর আগে ইইন্তেকাল করেছেন। আয়মান সাহেব আসমা বেগম এর মধ্যে এখন আগেকার চেয়ে সহজ সম্পর্ক বিদ্যমান। পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলেও আগের চেয়ে বেশ ভালো দুজনে। আয়মান সাহেব এখন নাতি-নাতনিদের জন্য পাগল। অফিসে আর যান না বললেই চলে। নিশীথ পুরোপুরি অফিসে মনোযোগ দিয়েছে।

আর নিশান, সেই যে ইগো নিয়ে দেশ ছেড়েছিলো, এখনো দেশে ফিরেনি। আর কখনো ফিরবে কিনা কে জানে! নিশীথের কানাডিয়ান এক ফ্রেন্ডের কাছে ওরা শুনেছে নিশানের একটা মেয়ে হয়েছে বিদেশে। আয়মান সাহেব শুনে বেশ মন খারাপ করেছেন। বিয়ের খবর না দিলেও অন্তত নাতনি হওয়ার খবরটা তো দিতে পারতো, সেটাও নিশান দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি! তবু নয়ন ও তারাকে নিয়ে তিনি বেশ ভালোই আছেন। ওদের দেখলেই জীবনের বাকি কষ্ট ভুলে যান। দোলনচাঁপা এখন এ বাড়ির সবকিছু সামলায় নিজ হাতে। ফলে আসমাও এ বয়সে এসে এমন বউমা পেয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন। এতকিছু পরিবর্তন এর মাঝেও এ ছয় বছরে একটা জিনিস পরিবর্তন হলোনা। প্রতিমাসের প্রথম জুম্মার পর নিশীথ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। বেশ অনেকক্ষণ পর বাসায় আসে। প্রথম প্রথম দোলা ভীষণ জিদ করতো শোনার জন্য কিন্তু নিশীথ বলেনি। তাই আর জিজ্ঞেস করেনা। তবে এখনো দোলার জানতে ইচ্ছে করে নিশীথ কোথায় যায়?

নিশীথ সেদিন বিকেলে বাড়ি ফেরে ঘর্মাক্ত শরীরে। পাঞ্জাবি খুলে গোসল করে বাচ্চাদের কাছে আসে। দুই বাচ্চা বাবাকে দেখেই দৌড়ে এসে নিশীথের কোলে উঠে গেলো। ছোট্ট নয়ন বাবার গলা জড়িয়ে বললো,
—পাপা, তুমি আমাদের জন্য কি নিয়ে আসছো?
—চকলেট আনসো,পাপা?
তারা উৎসুক চোখে শুধায়। নিশীথ ছেলেমেয়েকে চোখে হারায়। দুজনকে নামিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করতে বলে। বাচ্চারাও সাথে সাথেই ওর কথা শুনে। নিশীথ পকেটে রাখা চকলেট বের বলে,
—আমার নয়ন-তারা, এবার চোখ দুটো খুলো দেখি! দেখো পাপা কি এনেছে তোমাদের জন্য!
বাচ্চারা দেখলো ওদের প্রিয় দুটো ক্যাডবেরি চকলেট বাবার হাতের মুঠোয়। ওদের আর পায় কে! দুজনেই নিশীথের থেকে প্যাকেট খুলে নিয়ে চকলেট খেতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর দুজনেই চকলেটে মাখা মুখে হাসি টেনে বললো,
—থ্যাংক ইউ, পাপা!

নিশীথ হাসলো। দুই বাচ্চার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
—তোমাদের মাম্মি কোথায়, সোনামনিরা? দেখছিনা যে!
—মাম্মি বাগানে। ফুলগাছে পানি দিচ্ছে।
নিশীথ বাচ্চাদের কথা শুনে বাগানে গেলো দোলার কাছে। ইদানিং দোলা বেশ গাছপ্রেমি হয়েছে। বিভিন্ন ফুলগাছের প্রতি ওর ভীষণ অনুরাগ। এখন যে গাছে পানি দিচ্ছে তা ওর নামেরই ফুল! গতকাল রাতে ফুটেছে। এ ফুলটা ওকে নিশীথই এনে দিয়েছে। ওদের একটা নয়নতারা ফুলের গাছও আছে! দোলা বেশ যত্ন করে সে গাছে পানি দেয়। বাচ্চাদের নামে হওয়ায় গাছটাকেও নিজের বাচ্চার মতোই পরিচর্যা করে। নিশীথ পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরায় দোলা ভয় পায়। তবে পরক্ষণেই বিঝে এটা কার কাজ! ও তবু কিছু না বলে চুপ করে থাকে। নিশীথ অবাক হয়ে শুধায়,

—কিছু হয়েছে?
—আমার আবার কি হবে?আপনার কি হয়েছে সেটা বলুন!
—আমার কি হবে, দোলা? আমি তো মাত্রই বাসায় ফিরলাম।
—ওহ! জুম্মা পড়ে আসতে বিকেল হয়ে যায় বুঝি? নাকি আসরের নামাজটাও মসজিদে পড়ে এলেন?
দোলা খোচা মেরে শুধায়। নিশীথ গম্ভীর হয়ে যায়। শান্ত মুখে বলে,
—তোমায় না আগেও বলেছি এ ব্যাপারে কিছু না জিজ্ঞেস করতে! তবু কেন বারবার জিজ্ঞেস করো, জান?
—আপনি কেন আমার থেকে লুকাচ্ছেন বলুন না?

নিশীথ ইতস্তত বোধ করে। এই একটা বিষয়ে ও কখনো কারও সাথে কথা বলতে চায়না। বিষয়টার সাথে জুড়ে আছে এক বিষাদময় দিনের স্মৃতি। দোলনচাঁপার ডেলিভারির দিন সব ভালোভাবে হওয়ার পরও যখন দোলার জ্ঞান ফিরছিলোনা, ডক্টররাও ওকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। প্রেগ্ন্যাসির পুরোটা সময় অনেক অসুবিধা হয়েছে দোলার। এমনকি ডেলিভারির সময়ও ওর প্রচুর ব্লাড লস হওয়ায় বডি রিকোভার করতে পারছিলোনাম দোলার এবি নেগেটিভ রক্ত। যদিও নিশীথ আগে থেকেই ব্লাডের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো ইমার্জেন্সির জন্য। তবু শেষ মুহুর্তে যখন দোলার জ্ঞান ফিরছিলোনা ডক্টর রা ভেবেছিলেন ওর শরীর এত দূর্বলতা নিতে পারবেনা। সবকিছু তখন দোলার জ্ঞান ফেরার উপর নির্ভর করছে। নিশীথের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়ে। দিকঠিকানা হারিয়ে মানুষ যেখানে যায় ও সেখানেই গিয়েছিলো।

হাসপাতালের মসজিদে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ সিজদায় থেকে যখন নিশীথ দোলার জন্য দোয়া করছিলো তখন ওর পাশেই একটি এতিম ছেলেও কেদে আল্লাহর কাছে সাহায্যের দোয়া করছিলো। নিশীথ ওর কান্না শুনে জানতে পারে, ওর আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো নেই। অর্থের অভাব কতটা থাকলে মানুষ এভাবে আল্লাহর কাছে সাহায্য চায় নিশীথের জানা নেই। তার মধ্যে ছেলেটা যখন ওর প্রয়াত বাবা-জন্য দোয়া চাইছিলো তখন নিশীথের হৃদয়ে ধাক্কা লাগে! ওর বাবার সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়েই ও বুঝেছে কতটা খারাপ এ অনুভূতি। আর সেখানে ছেলেটার দুনিয়ায় কেউ নেই, এতটা অসহায় হয়ে সৃষ্টিকর্তার সামনে হাত পেতেছে বিষয়টা নিশীথের অন্তরে দাগ কাটে।

ওর মনে হলো আল্লাহ যেন ওকে ওসিলা হিসেবে ছেলেটার সাহায্য করতে চাইছেন কেননা ছেলেটাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার ক্ষমতা নিশীথের আছে। নিশীথ এই সুযোগ কে কাজে লাগালো। ও খাস দিলে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো, ও ছেলেটার আর্থিকভাবে দায়িত্ব নিবে। এ নেক কাজের বিনিময়ে হলেও যেন ওর দোলনচাঁপা সুস্থ হয়ে যায়! নিশীথের মনের দোয়া আল্লাহ সেদিন কবুল করেছিলেন। এরপর থেকেই নিশীথ প্রতিমাসে প্রথম জুম্মার পর যেয়ে ছেলেটাকে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে ওর খোজখবর নিয়ে আসে। এখন ছেলেটা স্কুলে পড়ছে। ও কলেজ পাশ করলে ওকে চাকরি দেওয়ারই নিয়ত আছে নিশীথের। মূলত সেদিনের পর থেকে নিশীথ প্রতিরাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারে। যে ছেলে সারাজীবন অর্থ ভোগ করে গেছে, সে বুঝে অর্থ ভোগের চেয়ে অর্থ দানে কতটা শান্তি বিরাজ করে! কিন্তু নিশীথ এ ব্যাপারে কাউকে বলেনা। ও মনেপ্রাণে মানে, এ ব্যাপারটা শুধু আল্লাহ আর ও জানে। অন্যকাউকে জানানোর কোন মানে হয়না, এমনকি স্বয়ং দোলনচাঁপাকেও নয়!
নিশীথ হঠাৎ দোলার গালে চুমু খেয়ে বলে,

—আমি তোমাকে ভালোবাসি, দোলনচাঁপা। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম এলাকার গলিতে সেদিনই আমার মন বলেছিলো এই মেয়েকে ছাড়া আমার চলবেইনা! আর দেখো এখন তোমাকে ছাড়া আমার সত্যিই চলেনা! কিভাবে এত বশ করলে আমাকে হুম? কি জাদো করেছো যে তোমার সুবাস ছাড়া আমি ভালোই থাকতে পারিনা?
নিশীথের আবেগময় কথায় বোকা দোলনচাঁপা আবারও গলে যায়। ভুলে যায় একটু আগে কি নিয়ে নিশীথের উপর রাগ করেছিলো! লাজুক হেসে ফুলগাছে দেওয়ার পানি নিশীথের উপর একটু ছিটিয়ে দৌড়ে বাসার মধ্যে ঢুকে যায়। নিশীথ চমকে উঠে ছুটন্ত দোলার ওড়নার এক প্রান্ত ধরে ওর পিছু পিছু যেতে যেতে নিচু গলায় বলে,

দোলনচাঁপার সুবাস পর্ব ৮৪

—খুব দুষ্টুমি শিখেছো তাইনা? একবার বাচ্চাদের ঘুমিয়ে যেতে দাও, তোমায় বুঝাচ্ছি দুষ্টুমি কাকে বলে!
পেছনে রয়ে যায় বাগানে অবস্থিত দোলনচাঁপা গাছ যেটায় কাল রাতে ফুল ফুটেছে। দোলনচাঁপা ফুলের আবার একটা অভ্যাস আছে। এ ফুল রাত ছাড়া ফুটেনা। রাত যত গভীর হয় দোলনচাঁপাও ততটা প্রস্ফুটিত হতে থাকে।
নিশীথ অর্থ গভীর রাত। আর দোলনচাঁপা, সে তো রাতেরই ফুল। নিশীথের সান্নিধ্যে যেমন দোলনচাঁপা ফোটে, তেমনি নিশীথের জীবন ভরে যায় দোলনচাঁপার সুবাসে!

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here